লম্বা দাড়িওয়ালা এক সৌদি পুরুষ। নাম জাবের। নাজরান শহরে তার ধ্বংসপ্রায় বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে দেখাচ্ছিলেন প্রতিবেশী ইয়েমেন থেকে আসা ক্ষেপণাস্ত্র কিভাবে তার বাড়িটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, “গতকাল বিকেলে ইয়েমেনের দিক থেকে বিস্ফোরণ ঘটে। আমার পরিবারের লোকজন বাড়িতেই ছিলো। আল্লাহর রহমতে তারা বেঁচে গেছেন।”
“এই বাড়িতে বাস করে পাঁচটি পরিবার। সেখানে নারী আছে, শিশু আছে, আছে বৃদ্ধ মানুষও। তারা কি অপরাধ করেছে যে তাদের ওপর এমন হামলা হলো?” প্রশ্ন করেন জাবের।
এর কিছুক্ষণ পরেই ওই এলাকায় আরো সাতটি ক্ষেপণাস্ত্র এসে আঘাত হানে। এতে দু’জন নিহত হয়। আহত হয় আরো অনেকে।
সৌদি আরবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সীমান্তের ওপারে ইয়েমেন থেকে শিয়া হুতিরা নির্বিচারে এসব গুলি চালাচ্ছে।
যুদ্ধে সৌদি আরব
রাজধানী রিয়াদের শান্তিপূর্ণ রাস্তায় এই যুদ্ধের কোন আঁচ পাওয়া যায় না। কিন্তু তার কয়েকশো মাইল দক্ষিণে, যেখানে গৃহযুদ্ধের কারণে প্রতিবেশী ইয়েমেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে, সীমান্ত ছাপিয়ে সেই যুদ্ধের ঢেউ এসে পড়ছে সৌদি আরবের কয়েকটি শহর এবং গ্রামাঞ্চলেও।
সৌদি কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়েমেনের যুদ্ধে তাদের পাঁচশোর মতো নাগরিক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন আরো বহু মানুষ।
কিন্তু ইসলামের পবিত্র বহু স্থাপনার ভূমি হিসেবে পরিচিত এবং তেল সম্পদে সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ এই দেশটিতে যখন যুদ্ধের ছায়া এসে পড়ছে তখন দেশটির জনগণ চিন্তিত হয়ে পড়ছেন।
ধ্বংস হয়েছে স্কুল, মসজিদ
ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সৌদি আরবের খাওবার গ্রামে মেয়েদের একটি স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে।
ওই স্কুলটিতে গিয়ে দেখা গেছে শ্রেণি কক্ষগুলো ভেঙে চুরমার, ঘড়ি পড়ে আছে মাটিতে, ক্ষেপণাস্ত্রটি যখন আঘাত হানে ঠিক সেই সময়ে এসে ঘড়ির কাটা দুটো থেমে গেছে।
বিবিসির সাংবাদিক ফ্রাঙ্ক গার্ডনার সৌদি আরবে ইয়েমেন থেকে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে আহত কয়েকজন গ্রামবাসীর সাথেও কথা বলেছেন।
হুতিদের ছোঁড়া রকেট তাদের মসজিদেও আঘাত হেনেছে।
ফ্রাঙ্ক গার্ডনারকে সৌদি সেনাবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী প্যাট্রিয়ট ব্যাটারিতেও যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, যেখানে ইয়েমেনের দিকে তাক করে সৌদি মরুভূমিতে ক্ষেপণাস্ত্র-বিরোধী ব্যবস্থা পেতে রাখা হয়েছে।
সৌদি কর্মকর্তারা মনে করেন, ইয়েমেন থেকে ছোঁড়া এসব ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেট সৌদি আরবের শহর- নাজরান, আবা, গিজান, খামিস মুশিয়াত, এমনকি পবিত্র শহর মক্কাও।
যেসব ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানছে
রুশ আমলে নির্মিত পুরনো এসব ক্ষেপণাস্ত্র একসময় ছিলো ইয়েমেনের সেনাবাহিনীর হাতে। কিন্তু এখন সেগুলো হুতিরা দখল করে নিয়েছে।
এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে স্কাড বি ক্ষেপণাস্ত্র যা এক টনের মতো বিস্ফোরক বহন করতে পারে। আরো আছে টচকা যা বহন করতে পারে প্রায় পাঁচশো কেজি বিস্ফোরক।
সৌদি প্রতিরক্ষা বাহিনীর গুলিতে মাটিতে নামিয়ে আনা এরকম একটি টচকা ক্ষেপণাস্ত্র বিবিসির সাংবাদিককে দেখানো হয়।
সৌদি কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৫ সালের ৬ জুন থেকে ২০১৬ সালের ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরবকে লক্ষ্য করে ইয়েমেন থেকে ৩৭টি ব্যালিস্টিক মিসাইল ছোঁড়া হয়েছে।
ইয়েমেনে যুদ্ধের শুরু
ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন সংখ্যালঘু হুতি গ্রুপের যোদ্ধারা ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহর অনুসারী সৈন্যদের সাথে নিয়ে একটি জোট গঠন করে।
হুতিরা সরকারের ভেতরে দুর্নীতি বন্ধ করা এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির দাবি জানায়।
একসময় তারা রাজধানী সানাতেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। পার্লামেন্ট ভেঙে দেয় এবং প্রেসিডেন্টকে গৃহবন্দী করে রাখে।
ইয়েমেন তখন সবেমাত্র আরব বসন্তের বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসছিলো। জাতীয় পর্যায়ে সংলাপও অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে, বেঁছে নেওয়া হয়েছে নতুন একজন প্রেসিডেন্টকেও। দেশটিতে সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান আর গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের আশা করে ছিলো মোটামুটি সকলেই।
কিন্তু সেই স্বপ্ন আর আশা সব ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
সৌদি আরবের অনুগত প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদি জীবন বাঁচাতে দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর শহর এডেনে পালিয়ে যান।
হুতিরা আকাশ থেকে তার প্রাসাদের ওপরও বোমা বর্ষণ করে।
ইয়েমেনের বৈধ সরকার, যা জাতিসংঘের স্বীকৃত, সেটি এখন নির্বাসিত। এই সরকার আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে।
সৌদি আরবের অভিযান
আর তাতে এগিয়ে এসেছে সৌদি আরব। এই দেশটির নেতৃত্বে, বিশেষ করে আরব দেশগুলোকে সাথে নিয়ে, আন্তর্জাতিক এক জোট বাহিনী হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
আর যুদ্ধের সেই ঢেউ এসে লেগেছে সৌদি আরবেও। তাদের অভিযানে এখনও খুব বেশি কাজ হয়নি। ইয়েমেনের বেশিরভাগ এলাকা এখনও হুতিদের নিয়ন্ত্রণে। আর নিহতের সংখ্যাও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।
উভয়পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্য করে হামলার চালানোর অভিযোগ করছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা