ডক্টর তুহিন মালিক:
(১) মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে যুবককে রাতভর নির্যাতন করে টাকা না দেয়ায় পিটিয়ে হত্যা করেছে পুলিশ। পুলিশি নির্যাতনে নিহত যুবক রায়হান আহমদ সাবেক বিডিআর কর্মকর্তার সন্তান। রবিবার ভোর ৪টা ২৩ মিনিটের দিকে মায়ের মোবাইল ফোনে ০১৭৮৩ ৫৬১১১১ নম্বর মোবাইল থেকে কল দিয়ে রায়হান জানায় পুলিশ তাকে ধরে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে এসেছে। এখন তার কাছে ১০ হাজার টাকা ঘুষ চাচ্ছে। টাকা দিলে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেবে। এ সময় কেঁদে কেঁদে রায়হান তাকে বাঁচানোর আকুতি জানায়। ওই মোবাইল নম্বরটি বন্দর ফাঁড়ির কনস্টেবল তৌহিদের। এদিকে ছেলেকে পুলিশে ধরেছে শুনে রায়হানের মা তার চাচাকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পাঠায়। রায়হানের চাচা টাকা নিয়ে রায়হানকে ছাড়িয়ে আনতে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে যান। কিন্তু ১০ হাজার টাকার বদলে ৫ হাজার টাকা নিয়ে আসার অপরাধে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় রায়হানকে।
(২) দেশে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন প্রতিরোধে একটি আইন আছে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধানও আছে। তবে সাত বছর আগে ২০১৩ সালে আইনটি প্রণয়ন করা হলেও, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত মাত্র ১টি মামলার বিচার হয়েছে। তাও আবার এতবছর পর গত মাসে। অথচ শুধুমাত্র চলতি বছরের প্রথম আট মাসেই দেশে পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে ৫৩ জন। এ আইন ছাড়াও আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তার গ্যারান্টি দিয়ে ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না’।
(৩) ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর ফৌজদারি কার্যবিধির বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার (৫৪ ধারা) এবং পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ১৬৭ ধারা প্রয়োগ নিয়ে ৩৯৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। রায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য ১০ দফা নির্দেশনা এবং হাকিম, বিচারক ও ট্রাইব্যুনালের জন্য ৯ দফা নির্দেশনা রয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এলে বিচারিক আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন বলে আদালত রায় দিয়েছেন।
(৪) অথচ আশ্চর্যজনকভাবে, প্রধানমন্ত্রীর সামনেই আমাদের পুলিশ বাহিনী পুলিশি নির্যাতন ও পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু সংক্রান্ত এই আইনটি বাতিলের দাবী করেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই এই আইনটি বাতিলে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপও দাবী করেছে পুলিশ। পুলিশের এই আবদারের জবাবে প্রধানমন্ত্রী গত ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি বলেন, ‘এ ধরনের রায় আদালত কেন দিল, তা জানি না। যেহেতু আদালতের রায়, আমাদের হাত-পা-মুখ বন্ধ, কিছু বলতে পারি না। কিন্তু আমরা কি আইনশৃঙ্খলা, মানুষের জানমাল রক্ষা করব না? পুলিশ কাজ করবে না? পুলিশের হাত-পা যদি বেঁধে দেওয়া হয়, তাহলে পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করবে কীভাবে? দশটা ভালো কাজ করতে গেলে একটা-দুটো ভুল হতেই পারে।’
(৫) পুলিশি নির্যাতনে মানুষ হত্যা যখন খোদ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় ’একটা-দুটো ভুল হতেই পারে।’ তখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের এইরুপ আশকারা ও দায়মুক্তির মূল্য দিতে হচ্ছে সামান্য ১০ হাজার টাকা পুলিশকে ঘুষ দিতে না পারায় পুলিশি নির্যাতনে নির্মমভাবে প্রাণ হারানো যুবক রায়হানকে। এখন এ রাষ্ট্রে বিচার চাইবেন কার কাছে?
ডক্টর তুহিন মালিক
আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ