শুক্রবার, ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ দুপুর ১:২৬
Home / কবিতা-গল্প / গোলামির জিঞ্জির থেকে ইমামের মুসল্লায়

গোলামির জিঞ্জির থেকে ইমামের মুসল্লায়

Shikol_Bhangaইবরাহিম খলিল : সালাম ইবনে জুবাইর নামে বনু কুরায়জায় ছিলো এক ইহুদি ব্যবসায়ি। সে একবার শামে গেলো ব্যবসার উদ্দেশ্যে। অনেক মালামাল কিনলো। ফিরতিপথে দেখলো একটা গোলাম বিক্রি হচ্ছে। কুৎসিত কদাকার। স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য যেমন নেই, আবার জ্ঞান-গুণও নেই। মালিক নিতান্তই দায়মুক্তির জন্য বেচতে চাচ্ছে পানির দারে। সস্তা যেহেতু তিনি কিনে নিলেন। আর কিছু না হোক ঘরের কাজে তো লাগানো যাবে।

গোলামের নাম ছিলো সালেম। সালাম ইবনে জুবাইর তাকে মদিনায় নিয়ে এলেন। ব্যবসায়ি মালামাল মুহূর্তেই সব বিক্রি হয়ে গেলো। কিন্তু গোলামটা কেউ কিনলো না। যে-ই দেখে বলে— ওকে কে কিনবে? ওর না আছে বুদ্ধিশুদ্ধি, না আছে শক্তি-সামর্থ্য।
দীর্ঘ এক সপ্তাহ চলে গেলো গোলামটা কেউ কিনলো না। এদিকে ব্যবসা গুটিয়ে বাড়ি যাওয়া দরকার। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যতো কমই হোক এবার বেচে দেবেন।

মদিনায় সুবাইতা নাম্নী এক সম্ভ্রান্ত কুমারী মেয়ে ছিলো। প্রতিদিন প্রচ- রোদে গোলামটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মায়া হলো। শেষমেশ সে কিনে নিলো গোলামটা। নিতান্ত অল্প দামে। কেনার সময় জিজ্ঞাসা করলো— আপনি কোত্থেকে কিনেছেন গেলামটা? সালাম বললো— সে ছিলো তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। শামের বাজারে বিক্রি হচ্ছিলো দেখে কিনে নিয়ে এলাম। মেয়েটির মন দরদে উছলে উঠলো। সে ভাবলো, কোন মা-বাবার সন্তান কে জানে! ছেলেকে হারিয়ে নিশ্চয়ই মায়ের এখন পাগলিনী দশা। হয়তো দিনরাত কাঁদছেন। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। হতভাগা মায়ের করুণ অবস্থা কল্পনা করে সে-ও দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সুবাইতা গোলামকে বাড়ি নিয়ে গেলো। ছোটো ভাইয়ের মতো আদর করে লালন-পালন করতে লাগলো। ভালো খাবার-পানি পেয়ে ক’দিনেই গোলামের স্বাস্থ্য ফিরে এলো। আদর-যতেœ চেহারায় দেখা দিলো লাবণ্য। অল্প দিনেই বুদ্ধিশুদ্ধি ও বিচক্ষণতা প্রকাশ পেতে লাগলো।

আবু হুজাইফা নামে মক্কার আরেক ব্যবসায়ি শামে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে মদিনায় এলেন। সুবাইতার মহানুভবতার কথা শুনে তার ভালো লাগলো। ভাবলেন, নিষ্ঠুর জগৎসংসারে এমন হৃদয়বান মেয়েও আছে তাহলে। মেয়েটিকে না দেখেই তিনি তাঁর মা-বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। মা-বাবা ভাবলেন, কুরাইশি ব্যবসায়ি নিজ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে, এ তো বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার! প্রস্তাবটি তারা লুফে নিলেন। বিয়ে হলে কিছুদিন আবু হুজাইফা মদিনায় কাটালেন। পরে স্ত্রী ও গোলামসহ মক্কায় চলে গেলেন।

আবু হুজাইফা ছিলেন হযরত উসমান রা.-এর বন্ধু ও ব্যবসায়ি অংশীদার। হঠাৎ তার মনে হলো উসমান কেমন যেনো তাকে এড়িয়ে চলছেন। কতোদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই, কথাবার্তা নেই। তাই তিনি একদিন উসমানের বাড়িতে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন— কী ব্যাপার উসমান, আজকাল কেমন এড়িয়ে চলছো, রাগ নাকি আমার ওপর?
: এড়িয়েই তো চলতে হবে; তোমার আমার রাস্তা যে ভিন্ন। আগের সেই বন্ধুত্ব কি এখন আর টিকবে?
: মানে তুমি কী বলতে চাচ্ছো?
: তুমি লাত-মানাতের পূজারী আর আমি এক আল্লাহর ইবাদতকারী। দু’জনের পথই যে ভিন্ন।
শুনে আবু হুজাইফা আঁতকে উঠলেন— তুমি দেখছি মূর্তিবিরোধী কথাবার্তা বলছো। আচ্ছা, ব্যাপার কী খুলে বলো তো!
: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সা.-কে পাঠিয়েছেন আমাদের মধ্যে। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে আমি মুসলমান হয়ে গেছি। বললেন হযরত উসমান রা.।
বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ আবু হুজাইফার কাছে অসহনীয় ঠেকলো। তিনি বলে উঠলেন— যদি ভালো মনে করো আমাকেও মুসলমান বানিয়ে নাও। খুশিতে হযরত উসমান উদ্বেলিত হলেন। বন্ধু আবু হুজাইফাকে মুসলমান বানিয়ে নিলেন। মুসলমান হয়ে প্রফুল্লচিত্তে ঘরে ফিরলে স্ত্রী সুবাইতা জিজ্ঞাসা করলেন— কী ব্যাপার, আজ যে বড়ো উৎফুল্ল লাগছে? এমন তো দেখিনি কখনো!
: আরে, আমি তো মুসলমান হয়ে গেছি! আবু হুজাইফার জবাব।
স্ত্রী নেক মহিলা ছিলেন। বললেন— আমিও তাহলে মুসলমান হয়ে যাবো। সুবাইতা তখনি মুসলমান হয়ে গেলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁরা রাসূল সা.-এর মজলিসে বসতে শুরু করলেন।

একবার রাসুল সা.-কে তাঁরা বলতে শুনলেন— যে ব্যক্তি কোনো গোলাম আযাদ করে সে অনেক সওয়াব পায়। ফযিলত শুনে সুবাইতা সালেমকে আযাদ করে দিলেন। আযাদ হয়ে সালেম তো মহাখুশি। কিন্তু পরক্ষণেই অজানা আশঙ্কায় তার চেহারাটা মলিন হয়ে গেলো। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কোথায় থাকবেন? কোথায় খাবেন? কে দেবে তাকে আশ্রয়? মহা ফাঁপড়ে পড়ে গেলেন সালেম। এবার ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হলেন স্বয়ং আবু হুজাইফা। বললেন— তোমার কোনো চিন্তা নেই, আজ থেকে তুমি আমার পালকপুত্র। সেদিন থেকে তাঁর নাম হয়ে গেলো সালেম বিন হুজাইফা। তিনিও কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন। তারপর থেকে অধিকাংশ সময় রাসূল সা.-এর দরবারে পড়ে থাকতেন। কুরআন শিখতেন এবং মাসআলা-মাসায়েল মুখস্থ করতেন।

রাসুলের দরবারে থেকে থেকে অনেক সূরা তিনি শিখে ফেলেন। অনেক মাসআলা-মাসায়েলও জেনে নিলেন। তারপর মুসলমানদের সঙ্গে একদিন মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় গিয়ে দেখা গেলো তাঁর চেয়ে বড়ো আলেম আর কেউ নেই। অথচ মুহাজিরদের মধ্যে হযরত ওমর রা.-ও ছিলেন। সকলের সম্মতিতে ইমাম হলেন হযরত সালেম বিন হুজাইফা।

মদিনার সেই ইহুদি মনিব সালেমকে ইমামের কাতারে দেখে অবাক হয়ে গেলো। বিস্ময়ের সঙ্গে বললো— এ তো সেই গোলাম যাকে কেউ কিনতে চাইতো না। শাম থেকে অল্প মূল্য কিনে এনেছি। মদিনায় এসে পড়েছি মহা বিড়ম্বনায়। কেউ কিনছে না। সেই পতিত লোকটা কিনা আজ মুসলমানদের ইমাম! সে মুসলমানদের জিজ্ঞাসা করলো— তোমরা এমন একজন গোলামকে কীভাবে ইমাম বানালে? তাদের নির্দ্বিধ জবাব— তিনি আমাদের মধ্যে সবচে’ বড়ো আলেম, তেলাওয়াত করেন চমৎকার। তাই তিনি আমাদের ইমাম। দেখুন, ইলমের বরকতে দলিত পতিত এক গোলামকে আল্লাহ পাক কতো সম্মান দিয়েছেন! (ইলমে নাফে : ৭৫)

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

৪৩ টি পতিতালয়ের মালিকের লেখা কবিতা কেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত?

ফেসবুকীয় মতামত-:: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়বিরোধী রবী ঠাকুরের কবিতা কেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত? জাতি তা জানতে চায়…… ...