বিশিষ্ট লেখক, কবি, শিল্পী ও ডিজাইনার আমিনা জাহিরাহ বা সাবেক ব্রান্ডি চেজ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন আমেরিকার অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের তুসা’ন শহরে। কিন্তু তিনি এশিয়ার সুসান বা লিলি ফুল খুব পছন্দ করেন।
সুক্ষ্মদর্শী ও কবিসুলভ মনের অধিকারী এই নারী বলেছেন, “আমি একজন সৃষ্টিশীল ও আদর্শবাদী নারী যে বেহেশতের পথ পেতে চায়। আমার মনে হয় আমি জন্ম নিয়েছি দ্বিতীয় বার, আর এখন অপ্রস্ফুটিত ফুলের কুড়ির মতই ফুটে ওঠার শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের অপেক্ষায় আছি যে, কখন পল্লবিত হব এবং আমার সুন্দর রঙ্গগুলো মেলে ধরব দুনিয়ায়।”
পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের নানা অপপ্রচারের কারণে পাশ্চাত্যের অনেকেই মনে করেন মুসলিম নারী, স্ত্রী ও কন্যারা বড়ই অসহায় এবং দাসীর মতই তাদের জীবন; তাদের অধিকারগুলো পদদলিত হয় মুসলিম পুরুষদের হাতে, ইত্যাদি। মুসলিম বিশ্বের নারী সমাজ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের এ ধরনের অপপ্রচার সত্ত্বেও ইসলামের প্রতি পশ্চিমা নারী সমাজের আকর্ষণ দিনকে দিন বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হিজাবধারী মুসলিম মহিলারা পরিবার ও সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই সক্রিয় ভূমিকা রেখে এ ভুল ধারণা বা প্রচারণার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন যে তারা বন্দী বা অসহায় হয়ে আছেন।
নওমুসলিম মহিলারা বলছেন, ইসলাম তাদেরকে বন্দী বা ঘরকুনো করে রাখেনি, বরং হিজাব পরার ফলে তারা নৈতিক অবক্ষয় কবলিত পাশ্চাত্যে অশালীনতা ও লজ্জাহীনতার স্রোতের মধ্যেও লজ্জাশীলতা বজায় রাখার ও শালীন পোশাকে সজ্জিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
মার্কিন নওমুসলিম আমিনা জাহিরাহ তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, “আমি খ্রিস্টান হিসেবে জন্ম নিয়েছিলাম। কিন্তু মাত্র ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত এই পরিচয় বজায় রেখেছিলাম। কিন্তু এ ধর্মের মধ্যে আমি আমার চাহিদাগুলোর জবাব দেখতে পাইনি, তাই এ ধর্ম পরিত্যাগ করে নাস্তিক হয়ে পড়ি। কিন্তু কিছুকাল পর জীবনের কাজে আসবে এমন একটি ধর্ম খোঁজা শুরু করি। আলহামদুল্লিাহ, আল্লাহ আমাকে যৌবনেই ইসলাম ধর্ম উপহার দিয়েছেন।”
ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর সাবেক ব্রান্ডি চেজ বা বর্তমান আমিনা জাহিরাহ’র শিল্পচর্চা ও লেখালেখির ধারায়ও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। তিনি বলেছেন, “আমার আঁকা কার্টুনগুলো মার্কিন সমাজের রীতি অনুযায়ী ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। এখন কার্টুন ও গল্প রচনার বিষয়বস্তু এবং চরিত্রের ক্ষেত্রে আমি আগে দেখি যে সেগুলো ভালো না মন্দ। আগে আমার কবিতায় ধর্ম ও খোদার প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ বা কটাক্ষ থাকত। আর এখন লেখালেখিতে মহান আল্লাহর সৌন্দর্য এবং অন্যদের কাছে ইসলামের আনন্দ ও প্রশান্তি তুলে ধরা আমার খুবই প্রিয় কাজ।”
আমিনা জাহিরাহ আরো বলেছেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আমার কোনো কোনো বইকে ইসলাম ধর্ম বোঝা ও এর নানা দিক সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে প্রেরণাদায়ক বলে উল্লেখ করেছেন অনেক অমুসলমান। আমার পরিবার মুসলমান না হওয়া সত্ত্বেও আমার লেখা গল্প ও কবিতা পড়ে এবং আমার শিল্পকর্মগুলো দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। তারা বলছেন, মুসলমান না হওয়া সত্ত্বেও তারা আমার শিল্পকর্মের বার্তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন।”
ইসলাম মুসলমানদের মধ্যে গঠনমূলক সহাবস্থান ও সমচিন্তাকে গুরুত্ব দেয়। ইসলাম সৃষ্টির সেবাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পন্থা বলে মনে করে ও ইবাদতের মর্যাদা দেয়। যে মানুষ আল্লাহকে জানা ও চেনার ক্ষেত্রে যত বেশি অগ্রসর হয় সে তত বেশি মানব সেবায় নিবেদিত হয়। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর বান্দাদের সেবায় নিয়োজিত হওয়া এমন দুটি পুণ্য গুণ যে এর চেয়ে বড় কিছু নেই।”
পরকাল ও ইসলামে বিশ্বাসী আমিনা জাহিরাহও অন্যদের সহায়তা ও মুসলমানদের সাহায্য করাকে জীবনের অন্যতম প্রধান মূল নীতি বলে মনে করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “দুনিয়াতে আমরা যা দিয়েছি ও নিয়েছি সে জন্য অবশেষে কিয়ামত বা বিচার দিবসে জবাবদিহি করতে হবে। কোনো একটি দেশের সীমান্ত ও নির্ভরতার বিষয়গুলো প্রতিদিনই বদলে যেতে পারে, কিন্তু ইসলামের মূল নীতিমালা সব সময়ই অপরিবর্তনীয়। ইসলাম আমাদের শেখায় প্রথমে মুসলিম ভাইবোনদের সাহায্য কর। এরপর সাহায্যের হাত অন্যদের দিকে বাড়িয়ে দিতে হবে। তাই আমি মনে করি মুসলমানদের উচিত আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ হওয়া।”
মার্কিন নওমুসলিম আমিনা জাহিরাহ নানা সমস্যা ও চাপ সত্ত্বেও ইসলামকে বেছে নিয়েছেন ধর্ম হিসেবে। ইসলামের যে আলো ও সৌন্দর্য তিনি পেয়েছেন তা তিনি ছড়িয়ে দিতে চান অন্যদের মাঝেও। আর অন্য অনেক মার্কিন মুসলমানের মত এ কাজে সক্রিয় রয়েছেন জাহিরাহ। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, মার্কিন মুসলমানরা সাধারণত দয়ার্দ্র এবং তাদের বেশিরভাগই সত্যবাদী ও সৎকর্মশীল। তাই তারা অমুসলমানদের কাছে ইসলাম প্রচারের সময় এ ব্যাপারে যত্নবান যে তারা যেন ভয় না পান বা তাদের মধ্যে বিকর্ষণ সৃষ্টি না হয়। যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের সমাজ অনেক বড়। তারা তাদের মূল্যবোধকে অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে ভালবাসেন এবং পূর্ণাঙ্গ ও খাঁটি ইসলামকেই তুলে ধরতে চান। ফলে বেশিরভাগ সময়ই অমুসলমানরা তাদের দাওয়াত গ্রহণ করেন।
ইসলাম নারীকে যে অধিকার দিয়েছে তা নওমুসলিমদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। অন্য ধর্মের তুলনায় নারীর প্রতি ইসলামের বিশেষ সম্মান ও অধিকারকে তারা নিজেরাই বেশি অনুভব করেন নওমুসলিম হিসেবে। মার্কিন নওমুসলিম আমিনা জাহিরাহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “নওমুসলিম মহিলারা তাদের পোশাক-আশাকে, চালচলনে বা ব্যবহারে এটা ফুটিয়ে তোলেন যে ইসলাম তাদের কাছে কতই না প্রিয়! যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ শহরের মানুষই ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণায় প্রভাবিত হন। সৌদি আরবে কোনো নারীকে তার সন্তান থেকে দূরে রাখা হয়েছে বা আফগানিস্তানে কোনো কারাগারে এক ব্যক্তিকে নির্যাতন করা হয়েছে এমন চাঞ্চল্যকর খবর শুনে তারা ভাবেন মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলো বিপজ্জনক এবং বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি। কিন্তু ইসলাম নারীর জন্য অবমাননাকর সব বিষয়কে নিষিদ্ধ করেছে এবং নারীকে আত্মমর্যাদাশীল ও আত্মবিশ্বাসী হওয়ার পথ দেখায়।”
আসলে পাশ্চাত্যে আধ্যাত্মিক শূন্যতাই সেখানকার মানুষকে ইসলামের প্রতি দিনকে দিন গভীর আগ্রহী করে তুলছে। শত শত বছর ধরে তারা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক শূন্যতায় এবং পরিচিতির সংকটে ভুগছে। আধ্যাত্মিক পিপাসায় কাতর পশ্চিমা নাগরিকরা বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের মত প্রাচ্যের ধর্মগুলোকেও পরখ করে দেখছেন। কিন্তু এসব ধর্ম তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি দিতে পারছে না বলে পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ জুড়াচ্ছেন। এ ধর্মের মধ্যেই তারা ফিরে পাচ্ছেন তাদের হারানো আত্মাকে।
সৌজন্যে : পার্সটুডে