দিগন্ত বিস্তৃত ঊষর মরু প্রান্তর। প্রখর রোদে তপ্ত বালুকারাশি। সঙ্গে লু-হাওয়ার ঝাপটা। দূর দিগন্তে পানির বেশে চিকচিক করছে মরীচিকা। সূর্যটা যেনো আজ অগ্নি বর্ষণ করছে। সূর্যের চেয়ে বালির তাপ আরও বেশি। যাকে বলে খইফোটা বালি। এমনই মরুভূমি বিদীর্ণ করে ছুটে চলেছে এক প্রবল ঘোরসওয়ার। একমনে ঘোড়া হাঁকিয়ে চলেছেন হযরত জাবের রা.। মনে তাঁর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা— তাকে গিয়ে পাবো তো, নাকি যুদ্ধে-অভিযানে চলে গেছেন কোথাও। মারাও তো যেতে পারেন! নিঃশ্বাসের বিশ্বাস কী? ইত্যকার হাজারো চিন্তায় আচ্ছন্ন জাবেরের মন।
প্রচ- গরমে ঘেমে নেয়ে উঠছেন জাবের। দরদর করে ঘাম ঝরছে। ভিজে জামাটা লেপ্টে গেছে গায়ে। উপরন্তু লাগছে লু-হাওয়ার ঝাপটা। তপ্ত বালু ছিটকে এসে পড়ছে চোখেমুখে। ঘোড়াটা বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটানা আর কতক্ষণ চলা যায়! একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার। কিন্তু মঞ্জিল না পেলে তো বিশ্রাম নেয়া যায় না। বিশাল মরুসাগরে কতো বিপদ ওঁত পেতে থাকে। মৃত্যু ঘাপটি মেরে থাকে পদে পদে। কখনো ওঠে মরুঝড়। সেকি অদ্ভুত ব্যাপার! মুহূর্তে পবর্তপ্রমাণ উঁচু হয়ে যায় বালির ঢিবি। আবার মুহূর্তেই হারিয়ে উধাও। নদীর ভাঙ্গাগড়ার চেয়ে বিচিত্র মরুর খেলা। মরুঝড়ের কবলে পড়লে আর রক্ষা নেই। বাঁচার উপায় নেই। মুহূর্তে তলিয়ে যাবে পাহাড় সমান বালুস্তূপে। তার ওপর মরুদস্যুর উৎপাত তো আছেই। পথিকের সর্বস্ব লুণ্ঠন করেই ওরা ক্ষান্ত হয় না; জীবন পর্যন্ত কেড়ে করে বেকসুর। বড়ো নিষ্ঠুর মরুদস্যুগুলো। পথিকের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি যেনো ওদের কাছে বড় মজার খেলা।
আরো আছে ব্যাঘ্র চিতা। অন্তহীন ক্ষুধা নিয়ে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। একাকী পথিক পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হিংস্র আক্রোশে ছিঁড়েফেঁড়ে খায়। বড়ো ভয়ংঙ্কর মরুশ্বাপদগুলো। আছে পথ হারানোর ভয়। মরুভূমিতে পথ হারালে আর আশা নেই। ক্ষুৎপিপাসায় মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। দিগন্তহীন মরুভূমিতে অন্তহীন পিপাসা নিয়ে ছটফট করবে। ধীরে ধীরে নেমে আসবে মৃত্যুর কালো পর্দা। বড়ো নির্মম সেই মৃত্যু!
হাজারো বিপদের ঝুঁকি নিয়ে চলছেন হযরত জাবের রা.। উদ্দেশ্য তাঁর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উনাইসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। সেদিন তিনি জানতে পেরেছেন, আব্দুল্লাহ একটি হাদিস জানেন, যা তিনি সরাসরি রাসুলের কাছে শুনেছেন। হাদিসটি তিনিও জানেন; কিন্তু স্বয়ং রাবীর কাছ থেকে শুনতে চান, যেনো সূত্রে কোনো খাদ না থাকে। সে উদ্দেশ্যে তিনি একটি ঘোড়া ক্রয় করেছেন এবং আব্দুল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চলেছেন সুদূর সিরিয়ায়।
দুস্তর মরু পারি দিয়ে, দুর্লঙ্ঘ পর্বত ডিঙ্গিয়ে তবেই পৌঁছতে হয় সিরিয়ায়। দীর্ঘ একমাসের পথ। সঙ্গে সামান্য পাথেয়—শুকনো খাবার ও পানি। এসব অবলম্বন করে পথের হাজারো বিপদ মাড়িয়ে অবশেষে তিনি পৌঁছলেন সিরিয়ায়।
প্রশাসক আব্দুল্লাহকে চেনেন সবাই। তিনি ঠিকমতোই পৌঁছে গেলেন আব্দুল্লাহর বাড়ির দোরগোড়ায়। দারোয়ানকে বললেন— যাও, তোমার মনিবকে বলো, জাবের আঙ্গিনায় দাঁড়ানো।
দারোয়ানের মুখে জাবেরের নাম শুনে আব্দুল্লাহ চমকে গেলেন। ভেবে পেলেন না, কোন জাবের। জাবের নামের সকলে একে এক ঘুরপাক খেতে লাগলো তাঁর মনে। প্রাশাসনিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই বললেন— যাও জেনে এসো, কোন জাবের? দারোয়ান জিজ্ঞাসা করলে বললেন— গিয়ে বলো, জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ।
বাল্যবন্ধু জাবেরের কথা শুনে আব্দুল্লাহ লাফিয়ে উঠলেন। সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে বেরিয়ে এলেন। ঝাঁপিয়ে পড়লেন বন্ধুর বুকে। দীর্ঘ আলিঙ্গন যেনো শেষ হবার নয়।
তখনই জাবের জিজ্ঞাসা করলেন— আচ্ছা, আমি শুনেছি, তুমি একটি হাদিস জানো, রাসুলের কাছে শুনেছো, বলো তো দেখি হাদিসটি?
—আগে বিশ্রাম নাও, খাও দাও; পরে সব হাদিস তোমাকে শোনাবো। বললেন আব্দুল্লাহ। কিন্তু জাবেরের একই কথা, আগে হাদিসটি শোনাও; আমার মন মানছে না। আব্দুল্লাহ তৎক্ষণাৎ হাদিসটি শুনিয়ে দিলেন। জাবের বললেন— আচ্ছা বন্ধু, যাই। আবার বেড়াতে আসবো তোমার কাছে। হাদিসটি শোনার জন্য এসেছিলাম; অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। তাই এবার মেহমান হতে চাই না।
আব্দুল্লাহ জানেন, জাবেরের কথা এক। শত পীড়াপীড়ি করেও লাভ হবে না। তবুও জোর অনুরোধ করলেন, অন্তত একটা দিন থেকে যাও। একটু বিশ্রাম নিয়ে যাও। কতদূর পথ সফর করে এসেছো।
—কিন্তু আমি যে ভাই ইলমি সফরকে মলিন করতে চাই না। জাবেরের নির্দ্বিধ জবাব। (আর-রিহলাহ ফি তলাবিল হাদিস : ৩৪)