মিজানুর রহমান সোহেল : দেশে স্বল্পমূল্যে দ্রুতগতির ইন্টারনেট দেওয়ার জন্য কাজ করছে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার। তবে বৃহস্পতিবার ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল সিম ব্যবহার ভয়েস, এসএমএস, ইন্টারনেটসহ সকল ধরণের সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে মোবাইল সিমভিত্তিক সব ধরনের সেবার ওপর গ্রাহকের খরচ আরও একদফা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্টারনেটের মূল্য বৃদ্ধির খবর পেয়ে ফেসবুকে ইতিমধ্যে অনেকেই ক্ষোভ ঝেড়েছেন। এছাড়া খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এই সিদ্ধান্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের সাথে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করেছেন।
নতুন প্রস্তাবনা অনুযায়ী, মোবাইল ফোনের সিমের প্রতিটি সেবার সঙ্গে যোগ হবে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক), ১ শতাংশ সারচার্জ এবং ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক। এই শুল্কটি নতুন বাজেটে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে ১০০ টাকার টকটাইম বা ইন্টারনেট কিনতে গুনতে হবে ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটেও অর্থমন্ত্রী একইভাবে সিমকার্ড ও রিমভিত্তিক সেবার ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক করারোপ করেছিলেন। পরে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং টেলিযোগাযোগ শিল্প সংশ্লিষ্টদের কঠোর সমালোচনার মুখে অর্থমন্ত্রী সেই কর ৩ শতাংশে নামিয়ে আনেন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসআরও জারির মাধ্যমে নতুন করে ১ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করে আবারও গ্রাহকের ঘাড়ে করের বোঝা বাড়ানো হয়। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সেই এক শতাংশ সারচার্জ রেখে আরও ২ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এর ফলে ১০০ টাকা মূল্যের একটি ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে একজন গ্রাহককে পরিশোধ করতে হবে ১২১ টাকা। দেখা যাচ্ছে, নতুন করারোপের ফলে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের মূল্য সাধারণ গ্রাহকের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, নতুন করারোপের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহকরা। বর্তমানে মোবাইল অপারেটররা গড়ে এক গিগাবাইট ডাটা ব্যবহারের দাম রাখছে ২৭৫ টাকা। একজন গ্রাহককে এই এক জিবি ডাটা প্যাকেজ কিনতে বর্তমানে ১৯ শতাংশ করসহ পরিশোধ করতে হয় ৩২৭ টাকা ২৫ পয়সা। অর্থাৎ, কর বাবদ বাড়তি পরিশোধ করতে হয় ৫২ টাকা ২৫ পয়সা। নতুন অর্থবছরে দুই শতাংশ সম্পূরক কর বৃদ্ধির কারণে গ্রাহককে পরিশোধ করতে হবে ৩৩২ টাকা ৭৫ পয়সা। অর্থাৎ, এক জিবি ডাটা প্যাকেজের জন্য গ্রাহককে বাড়তি ৫৭ টাকা ৭৫ পয়সা কর পরিশোধ করতে হবে।
একাধিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোবাইল ইন্টারনেটের বড় অংশের গ্রাহক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ফলে এই শিক্ষার্থীদের জন্য ৫৭ টাকা বাড়তি কর একটি বড় বোঝা হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে দেশে আত্মীয়স্বজনের যোগাযোগের মাধ্যম মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে স্কাইপি কিংবা ভাইবারে যোগাযোগ করে থাকেন। প্রবাসীদের আত্মীয়স্বজনের বেশিরভাগই থাকেন গ্রামে। এই গ্রামের স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষকেও মোবাইল সেবার জন্য অতিরিক্ত করের বোঝা বহন করতে হবে।
এ ব্যাপারে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বলেন, বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিকাশের পর্যায়ে রয়েছে। এখন ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর থেকে ভ্যাট, ট্যাক্স সার্বিকভাবে প্রত্যাহার করা উচিত। সেখানে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রতি বছর বাড়তি করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভ্রান্তনীতির ফল। এর ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ ব্যাহত হবে। তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, সাধারণ গ্রাহকদের ওপর এ ধরনের করারোপ ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে সরকারের প্রতিশ্রুতির সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের প্রধান করপোরেট অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন বলেন, সিম ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৩ থেকে ৫ শতাংশে বৃদ্ধির ফলে গ্রাহকের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপের সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশের মোবাইল ফোনশিল্পের ওপর করের বোঝা খুবই বেশি, আরও কর বসানো হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে এই শিল্পের ভূমিকা ব্যাহত হবে।
গ্রাহকের ঘাড়ে এই বাড়তি করের বোঝায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বর্তমানে বিদেশ সফরে থাকা অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল ফোন অপারেটরস বাংলাদেশ অ্যামটবের মহাসচিব ও প্রধান নির্বাহী টিআইএম নুরুল কবীর। তিনি বলেন, সিমকার্ড কিংবা রিমের ওপর দুই শতাংশ সম্পূরক কর সার্বিকভাবে মোবাইল সেবার খরচ বাড়িয়ে দেবে। এর ফলে গ্রাহকদের কাছে ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণ কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, অনেক গ্রাহক বাড়তি করসহ মূল্য পরিশোধে সমর্থ হবেন না, ফলে তারা সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। সেবা সম্প্রসারিত না করতে পারলে মোবাইল অপারেটররাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের করারোপ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এর আগে গত ২৬ এপ্রিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সম্মেলন কক্ষে এক প্রাক-বাজেট আলোচনা সভায় ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর আরোপিত ভ্যাট মওকুফের দাবি জানিয়েছিলেন মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) প্রতিনিধিরা। সভায় বক্তব্যে অ্যামটব মহাসচিব টিআইএম নুরুল কবির বলেছিলেন, বর্তমানে ইন্টারনেট ও মডেম ব্যবহারের জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। সকল পর্যায়ে ইন্টারনেট বা মডেম ব্যবহারের ওপর ভ্যাট মুওকুফ করা হোক। এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ইন্টারনেট ও মডেম ব্যবহারের ওপর ভ্যাট উঠিয়ে নিলে সাধারণ মানুষের কাছে তা সহজলভ্য হবে। এর ফলে অপারেটরদের আয় বৃদ্ধি এবং তথ্য প্রযুক্তির প্রসার ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু ভ্যাট মওকুফের পরিবর্তে উল্টা নতুন করে সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করা হলো।
প্রসঙ্গত, বিটিআরসির প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে গত এপ্রিল পর্যন্ত মোট ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা ৬ কোটি ২০ লাখ ৪ হাজার। এর আগে মার্চে ছিল ৬ কোটি ১২ লাখ ৮৮ হাজার। ফেব্রুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৮৩ লাখ, আর জানুয়ারিতে ৫ কোটি ৬১ লাখ। গতবছর মার্চে বাংলাদেশে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৬২ হাজার মানুষ ইন্টারনেট সেবা কিনতেন। এই হিসেবে বছরে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। বিটিআরসির তথ্যে দেখা যায়, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৯৫ শতাংশ এ সেবা নিচ্ছেন মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।
সৌজন্যে : প্রিয় টেক, প্রিয়.কম