শুক্রবার, ১১ই অক্টোবর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১১:৫৪
Home / কবিতা-গল্প / এক ফোঁটা জল

এক ফোঁটা জল

How-Tears-Workবাড়ী ফিরে অন্দরমহলে ঢুকতেই আঙ্গিনায় মা চাচীদের জটলা দেখে হেসে মাথা ঝাঁকালো সা’দ। এটা ওদের বাসার সাধারন চিত্র। মা যেখানে, চাচীরাও সেখানে। মায়ের ছায়ায় থাকলে দাদা বৌদের ওপর বেশি হম্বিতম্বি করার সুযোগ পান না। বড় বৌটা ভয়ই পায়না তাঁকে, কিভাবে যেন হেসে কথা বলে সব সহজ করে ফেলে। ছোটগুলো এখনো পদ্ধতিটা সেভাবে রপ্ত করতে পারেনি, তাই অন্তত বড় জায়ের কাছাকাছি থেকে শ্বশুরের মেজাজ থেকে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করে। সা’দ খেয়াল করল চাচীদের সবার হাতে দু’টো তিনটা করে কাগজ। সবাই উচ্চস্বরে মন্তব্য করছে এগুলো নিয়ে। সম্মিলিত কন্ঠস্বরের কলতান সা’দ কিছুই বুঝতে পারছেনা, কিন্তু ওরা ঠিকই বুঝে নিচ্ছে নিজেদের মধ্যকার কথাবার্তা। মায়ের গা ঘেঁষে লাজুক লাজুক চেহারা নিয়ে বসে আছে রুহি, মেজচাচার মেয়ে। সা’দকে দেখে মা হন্তদন্ত হয়ে উঠে এলেন। কাছে এসে ছেলেকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ওকে দেখে চাচীরাও এগিয়ে এলেন, ‘কি বাবা, কেমন আছিস? কতদিন পর তোকে দেখছি! চেহারাটা শুকিয়ে কি হয়েছে! দাঁড়া, রুহির মত তোকেও একটা বিয়ে করিয়ে দিতে হবে, তোর দেখাশোনার জন্য তোর সাথেই পাঠিয়ে দেব বৌকে’।

সা’দ অবাক হয়ে বলে, ‘রুহির কবে বিয়ে হোল? কই, আমাকে তো তোমরা কেউ জানাওনি!’

রুহি লজ্জা পেয়ে বড় চাচীর ঘাড়ে মুখ লুকায়।

মা সা’দকে মাথায় আদরের চাঁটি মেরে বলেন, ‘রুহির বিয়ে হলে তুই খবর পেতি না? ওর জন্য অনেকগুলো প্রস্তাব এসেছে। আমরা সবাই বায়োডাটাগুলো নিয়ে বসেছি, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা। তুই হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়। তারপর এগুলো বাছাই করতে বসব আমরা, তুই থাকবি সহকারী হিসেবে। দেখি কদ্দুর কি যোগ্যতা অর্জন হোল তোর লেখাপড়া করে’।

সা’দ বলে, ‘তাই তো। আমাদের বাড়ীর একটা মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে আর আমি দূরে থাকি দেখে কেউ আমাকে খবর দেবেনা!’ তারপর বায়োডাটার স্তুপ দেখে বলে, ‘এভাবে কি বাছাই করা যায় নাকি? আমি এগুলো সব এক দুই করে সিরিয়াল করে দেব। তারপর তোমরা একেকটা বায়োডাটা নিয়ে আলাপ করবে। আমি হব মডারেটর’।

রুহি খুশি হয়ে বলল, ‘তাহলে তো ভালোই হয় ভাইয়া। তখন আর চাচীদের এভাবে মাছের বাজারে দর কষাকষির মত চেঁচামেচি করতে হবেনা, সবাই শৃংখলাবদ্ধ হয়ে একটা ফলপ্রসূ আলাপ করতে পারবে’।

সেজচাচী রুহির দিকে প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলেন, ‘দুষ্ট মেয়ে কোথাকার! আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করা হচ্ছে!’ তারপর বড় ভাবীকে বলেন, ‘ছেলেটা এলেই ঘরের চেহারা অন্যরকম হয়ে যায়। চল ভাবী, বাবাটাকে কিছু খেতে দেই! অনেক কাজ করতে হবে তারপর’।

দুই. অনেক কাজ করা হোলনা অবশ্য। সা’দের ফিরে আসা উপলক্ষ্যে দাদা মিটিং ডাকলেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে। ছেলে বৌ, মেয়ে জামাই, নাতি নাতনী, কাজের লোকজন কেউ বাদ গেলনা সেই সভা থেকে। সবাই একত্রিত হলে দাদা বললেন, ‘আজ আমার বড় গর্বের দিন। আমার বড় ছেলের বড় ছেলে আজ দেশের বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করে ফিরল। আমি ঠিক করেছি এই উপলক্ষ্যে সমস্ত আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের খাওয়াব আগামী শুক্রবার’। খুশিতে জ্বলজ্বল করছে দাদার চেহারাটা। ভাইয়ের সাফল্যে নাতনীদের মুখে হাসি, কিন্তু একটু মেঘের ছায়াও যেন, দাদা ওদের নিয়ে কখনো এভাবে উচ্ছ্বসিত হোন না। দাদা বলে চললেন, ‘আরেকটা খুশির খবর আছে। সা’দ ফিরে আসার আগেই আমি কয়েকটা বিদেশী ইউনিভার্সিটির সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। দু’টো ইউনিভার্সিটি ওকে পি এইচ ডি করাতে আগ্রহী। আমি ঠিক করেছি ওকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠাব’।

এই খবরটা সবার কাছেই সারপ্রাইজ। বড় বৌ বলল, ‘আপনি এতকিছু কখন করলেন বাবা?’

দাদা মাথা দুলিয়ে হেসে বললেন, ‘দেখছ বৌমা, তুমি জিজ্ঞেস করছিলে না রাতদিন এত কি লেখালেখি করি? এখন বুঝলে তো!’

হঠাৎ সা’দের ছোটবোন সায়রার ক্ষীণ কন্ঠ শোনা গেল, ‘ভাইয়া কবে যাবে দাদা?’

সায়রা আর রুহি সারাক্ষণ একসাথে থাকে। রুহিকে সহ্য করতে পারেন না দাদা। তাই সায়রার ওপরেও ঈষৎ বিরক্ত তিনি। চোখমুখ গম্ভীর করে বললেন, ‘বড়দের কথার মাঝে কথা বল কেন? সা’দ এক সপ্তাহ পর যাবে’।

এইমাত্র বকা খাবার কথা ভুলে সায়রা বলে ফেলল, ‘ভাইয়া তো বাড়ী ফিরল পাঁচ বছর পর! গতবার ছুটিতে এসেছিল তাও তিন মাস আগে। এক সপ্তাহ থেকেই চলে যাবে?! অস্ট্রেলিয়া থেকে তো আর তিন মাস পর পরও আসতে পারবেনা!’

ওর কথায় সবাই দাদার শাসনের কথা ভুলে শোরগোল শুরু করে দিল। অন্যায়, মহা অন্যায় হচ্ছে এটা। কতদিন পর ছেলেটা বাড়ী ফিরল আর এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই আবার নির্বাসন! সা’দ বোনের অশ্রুপ্লাবিত চেহারার দিকে তাকাতে গিয়ে লক্ষ্য করল রুহি সবার অলক্ষ্যে সভা ছেড়ে চলে যাচ্ছে, ওর চোখের কোণে এক ফোঁটা জল।

তিন. রুহি ছাদে এসে রেলিংয়ে বসে আকাশের দিকে তাকায় যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াপাখী উড়ে যাচ্ছে পুকুরের ওপাড়ে বড় শিশুগাছটার দিকে, ওটাই ওদের বাসস্থান। রুহিদের এই দোতলা বাড়ীটা অনেক প্রাচীন। সম্ভবত এই গ্রামের সবচেয়ে পুরোনো দালান এটা। এই বাড়ীর ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে দাদার অহংকারের শেষ নেই। সাত বছর বয়স পর্যন্ত শহরেই বড় হয়েছে রুহি, তবে শহরের তেমন কিছু মনে নেই ওর। কিন্তু দাদার কিছু কিছু আচরনে ওর মনে হয় বুড়োকে একবার শহর দেখিয়ে আনতে পারত! তাহলে হয়ত অহংকার কিছুটা কমত তাঁর। যাক, চাচীরা ওর জন্য পাত্র দেখছেন। যতগুলো প্রস্তাব এসেছে তাতে অন্তত একটা তো পছন্দ হওয়ার কথা। এবার যদি দাদার অহেতুক অসন্তুষ্টি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়! সা’দ ভাইয়া উদ্যোগ নিলে চাচীদের বিশৃঙ্খলা থেকে উদ্ধার করে একটা সিদ্ধান্তে আনা সহজ হত, কিন্তু দাদা মনে হয় সে পরিবেশটাই ভেস্তে দিল। সেজন্যই কি সা’দের যাবার খবর শুনে ওর বুকের ভেতর এমন দুমড়ে মুচড়ে উথাল পাথাল কান্না উঠে আসতে চাইছে? আচ্ছা, ও কাঁদল কেন? নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছে রুহির।

সায়রা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে, বিড়ালের মত নিঃশব্দ চলাফেরা মেয়েটার, কিন্তু ওর গান শুনে বুঝতে পারে ও আসছে, ‘আমি তো আমার গল্প বলেছি, তুমি কেন কাঁদলে?’ আবারও ভাবার চেষ্টা করে রুহি, সা’দ লেখাপড়া করতে বিদেশ যাবে, এটা তো ভাল কথা, তাহলে সে কেন কাঁদল? তাহলে কি সে সা’দকে হিংসা করে, দাদা ওকে ভালবাসে বলে? নাহ, দাদার ভালোবাসা পাবার শখ মরে গেছে ওর। তাহলে কি?

সায়রা ছাদে হাঁটে আর গুন গুন করে। আরেকটা সম্ভাবনার কথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায় রুহির মনে। কিন্তু না, এটা হতেই পারেনা। পা দিয়ে মাড়িয়ে সম্ভাবনাটাকে অন্ধকারেই কবর দিয়ে দেয় সে। এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সে ভাবতেই চায়না।

চার. এত রাতে ওদের দরজায় টোকা দিচ্ছে কে? সায়রা দরজা খুলে ভাইয়ার উদ্ভ্রান্তের মত চেহারা দেখে ভয় পেয়ে যায়, ‘কিরে ভাইয়া? তোর কি হয়েছে?’

সা’দ জবাব না দিয়ে বলে, ‘রুহি কোথায়?’

সায়রা আরো অবাক হয়ে যায়, ভাইয়া তো পারতপক্ষে রুহির সাথে কথাই বলেনা, আর এখন রাতদুপুরে কি এমন প্রয়োজন হোল যে এসে ওর খোঁজ করছে! মেয়েটাও সেই সন্ধ্যা থেকেই বারান্দায়, কি যে ভাবছে আনমনে, সায়রা ওকে বিরক্ত করতে চায়নি বলে বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল, গল্প এখন শেষের দিকে, নায়ক নায়িকার বহু বছর পর দেখা হতে যাচ্ছে, এই সময় কিনা ভাইয়া এসে বাগড়া দিলো! সায়রা বিরস বদনে বলল, ‘বারান্দায়’।

সা’দ সায়রাকে পাশ কাটিয়ে বারান্দায় রওয়ানা দিলো। আরে ভাইয়ার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? সায়রা ভাইয়ার আগে বারান্দায় দৌড়ে গেল, গিয়ে দেখে সা’দের পায়ের শব্দ পেয়ে রুহি মাথায় ওড়না টেনে দিচ্ছে। রুহি ওকে চোখে চোখে প্রশ্ন করল, ‘কি ব্যাপার?’ সায়রা মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝালো, ‘আমি জানিনা’। জোৎস্নালোকিত বারান্দায় দু’বোনের মধ্যখানে এসে দাঁড়ালো সা’দ। উত্তাল অনুভূতিকে দমিয়ে রাখতে ওর কি কষ্ট হচ্ছে তা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অনুভূতির প্রাবল্যে কাঁপছে সে। রুহির দিকে তাকিয়ে সে বলে, ‘রুহি, কখনো ভাবিনি কথাটা তোমাকে বলব, সঙ্কল্প করেছিলাম বুঝতেও দেবনা। কিন্তু আজ তোমার চোখের এক ফোঁটা জল আমার সমস্ত সঙ্কল্প তছনছ করে দিল। দাদা তোমাকে বাড়ীতে আশ্রয় দিয়েছে, কিন্তু মনে স্থান দেয়নি কখনো। এটা তোমাকে কতটা কষ্ট দেয় তা তুমি মুখে না বললেও আমি তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারি। তাই ভাবতাম তোমার দূরে কোথাও বিয়ে হলেই ভাল হবে, অন্তত এই জ্বালা থেকে মুক্তি পাবে তুমি। কিন্তু আজ আমার দূরে চলে যাবার খবরে যেভাবে তোমার চোখ অশ্রুসিক্ত হোল তাতে কিছুতেই মনকে বোঝাতে পারছিনা যে তোমার প্রতি আমার যে অনুভূতি, আমার প্রতি তোমার অনুভূতি তার চেয়ে ভিন্ন। এর পর আর ভাবতেই পারছিনা যে তোমার দূরে কোথাও বিয়ে হয়ে যাবে, আর দেখবনা তোমাকে। তুমি প্লিজ একবার বল তুমি আমার সঙ্গী হবে, তাহলে আমি পথ তৈরী করে নেব। কেউ ঠেকাতে পারবেনা আমাকে’।

ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হলেও চোখের সামনে উপন্যাস রচিত হতে দেখে উত্তেজনায় দু’চোখ জ্বলজ্বল করে সায়রার। উপন্যাসের নায়িকা হিসেবে রুহিকে ওর দারুণ পছন্দ। কথা বলতে শুরু করেছে রুহি, ওর গলা আশ্চর্যজনকভাবে অনুভূতিশূন্য, ‘না ভাইয়া, তুমি ভুল করছ। সায়রার চোখে পানি দেখে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তোমার সহানুভূতির জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমাদের মাঝে কিছু হতে পারেনা’।

ছন্দপতনে চমকে যায় সায়রা। সা’দ আরো উত্তেজিত হয়ে যায়, ‘তুমি মিথ্যা বলছ রুহি! আমি তোমার চেহারা দেখেছি। তুমি তোমার অনুভূতি লুকানোর জন্য ওখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি তোমাকে ধরে ফেলেছি। কেন মিথ্যা বলছ? কেন স্বীকার করছ না, আমরা উভয়েই একই জিনিস চাই’।

রুহি কঠোর মুখ করে বলে, ‘ভাইয়া, আমি তো বলেছিই তোমার সহানুভূতির জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তুমি ভুল করছ। তুমি যা ভাবছ তা হতে পারেনা’।

সা’দ প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে, ‘তুমি মিথ্যাবাদী, তুমি মিথ্যা বলছ’, বলে চিৎকার করতে করতে ওদের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

ভাইয়ের অপমান গায়ে লাগে সায়রার, আবার রুহি কেন এমন করছে সেটাও বুঝতে পারেনা সে। মেয়েটা এত ভাল, সবার অনুভূতির প্রতি এত খেয়াল রাখে, আর সে কি’না ভাইয়াকে এভাবে ফিরিয়ে দিলো! ভাল না বাসলেও তো অন্তত একবার ভেবে দেখতে পারত!

রুদ্ধগলায় রুহি বলে, ‘সায়রা, প্লিজ দরজাটা আটকে দে’।

হায়রে, মনের দরজা আটকে এবার রুহি ঘরের দরজা আটকাচ্ছে! সায়রা ঘরের দরজা আটকে বিছানার দিকে যেতে যেতে বারান্দা থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে যায়। গিয়ে তো সে অবাক! রুহি কান্নার গমকে হাঁটু মুড়ে উপুড় হয়ে বারান্দার মেঝেতে হাত ঠেকিয়ে নিজেকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে! পাশের ঘরে মা থাকেন, মায়ের আর সায়রাদের বারান্দা দু’টো পাশাপাশি। রুহি প্রানপণে চেষ্টা করছে ওর মুখ থেকে যেন কোন শব্দ বের না হয়, চাচী যেন শব্দ শুনে জেগে না যান। সায়রা ছুটে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে, ‘ওরে মুখপুড়ি, এত ভালবাসিস আমার ভাইটাকে! তাহলে মিথ্যা বললি কেন, কেন এভাবে কষ্ট দিলি ভাইয়াকে?’ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যার্থ চেষ্টায় রুহির সাথে সাথে সায়রার শরীরটাও কাঁপছে। তবু রুহি প্রচন্ডবেগে মাথা ঝাঁকিয়ে বার বার বলতে থাকে, ‘ভালবাসিনা, না, ভালবাসতে পারিনা’।

পাঁচ. ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছে দু’বোন। সকালে উঠে সায়রা দেখে এখনও রুহির চোখের কোণে পানি চিক চিক করছে, ঘুমের মধ্যেও কাঁদছে সে! রুহির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় সায়রা, কেন যে এমন করছে মেয়েটা! দাদার ভয়েই কি’না কে জানে। ওর হাতের ছোঁয়ায় জেগে ওঠে রুহি। রাতের ঘটনা মনে পড়তেই ওর চেহারাটা আবার দুমরে মুচড়ে আসে। দ্রুত নিজেকে সামলায় সে। উঠে বসে সায়রার দু’হাত ধরে বলে, ‘লক্ষ্মী বোন আমার, গতরাতের ঘটনাটা কাউকে বলবি না, কাউকে না, চাচীকেও না, ওয়াদা কর!’

ওর চোখে গভীরভাবে তাকিয়ে সায়রা বলে, ‘আচ্ছা। কিন্তু আমাকে বলবি তুই এমন করছিস কেন?’

রুহির দু’গাল বেয়ে স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হয়, ‘আমার বাবামায়ের কথা আমার তেমন বিশেষ কিছুই মনে পড়েনা। শুধু আবছা আবছা মনে পড়ে আমার মাথা নীচে, পা ওপরে, ভীষণ ব্যাথা সারা গায়ে, মায়ের মুখটা আমার কাছাকাছি, চোখ দু’টো স্থির নিশ্চল, আমার দিকে চেয়ে রয়েছে, পুরো মুখে রক্ত, বাবা গোঙ্গাচ্ছে, হাত বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে আমার দিকে, কিন্তু বাবাও ঝুলে আছে আমার মত, কিছুতেই নাগাল পাচ্ছেনা আমার। সেই পাঁচ বছর বয়সে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে এতিম হয়ে আমি ঘুরতে লাগলাম একবার নানীর বাসায়, একবার খালার বাসায়, একবার মামার বাসায়। ওদের মায়া ছিল, কিন্তু সামর্থ্য ছিলোনা আমাকে প্রতিপালনের, নিজেরাই যেখানে জীবনযুদ্ধে পিছু হটে যাচ্ছে বার বার সেখানে আমার জন্য ওরা কি করতে পারত? একদিন এক মায়াবতী এলেন। তখন আমার বয়স সাত, তাই কিছু কিছু মনে পড়ে। উনি আমার নানী, খালা, মামীদের সাথে অনেক কথা বললেন, বার বার তাঁদের আশ্বস্ত করলেন, তারপর আমাকে নিয়ে এলেন এই বাড়ীতে। বাড়ীতে এসে পৌঁছনোর সাথে সাথে দাদার সে কি হুঙ্কার! মায়াবতী কোন জবাব দিলেন না, পুরো সময়টা আমাকে জড়িয়ে রাখলেন তাঁর বুকের ভেতর। এভাবেই তিনি আমাকে আগলে রেখে চলেছেন এতগুলো বছর ধরে। তাহলে আমি কিভাবে তাঁর বুকে ছুরি বসাতে পারি? তাঁর একটাই ছেলে। তাঁর অধিকার রয়েছে নিজের একমাত্র ছেলেকে নিজের পছন্দমত মেয়ে দেখে বিয়ে করানোর। এই অধিকারে আমি কিছুতেই হাত দিতে পারিনা, তাতে যার বুক ফাটে ফাটুক। তোকে আবার অনুরোধ করছি, তুই কোনভাবেই গতরাতের কথা কাউকে বলবিনা, চাচীকে তো অবশ্যই না। কি, এটুকু করতে পারবিনা আমার জন্য?’

সায়রার চোখে তখন প্লাবন, বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে সে কান্নায়, শুধু রুহিকে জড়িয়ে ধরে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো, বলতে পারলনা কিছুই।

ছয়. ‘বাবা, আজ থেকে বারো বছর আগে আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কোন সাহসে মেয়েটাকে আপনার বাসায় নিয়ে এলাম। আমি কোন জবাব দেইনি। আজ বলব। আজ আমাকে বলতেই হবে। শুনবেন?’

শ্বশুরমশায় নড়েচড়ে বসেন, ‘বল।’

‘আচ্ছা বলুন তো, ফারুককে আমি কত দিনই বা দেখেছি। আমার বিয়ের বছর দুই পরেই তো সে লেখাপড়া করতে শহরে চলে গেল। গিয়ে মুনিরাকে বিয়ে করল’।

‘খবরদার!’, ধমকে ওঠেন বৃদ্ধ, ‘ঐ মেয়ের নাম আমার সামনে নেবেনা!’

পিছিয়ে যায় বড় বৌ, কিন্তু বড় ছেলে এগিয়ে আসে, ‘কেন বাবা? সে গরীবের মেয়ে বলে? সে কি একদম ফেলনা টাইপের মেয়ে ছিল? না, সে ছিল মেধাবী এবং লেখাপড়া জানা, শুধু পয়সা ছিলোনা ওদের। সে তো আমার ভাইয়ের সাথে প্রেম করেনি বাবা। ফারুক নিজেই ওর বাবার কাছে প্রস্তাব দিয়ে ওকে বিয়ে করেছে। আপনাকে জানায়নি কেন? হয়ত আপনি যদি বুঝদার হতেন সে নির্ভয়ে আপনাকে জানাতে পারত। কেন জানায়নি সেটা তো আপনি নিজেই পদে পদে প্রমান করেছেন’।

বৃদ্ধ মুখ নীচু করে রাখেন।

‘বাবা, আপনি বলুন, আপনি বিয়ের খবর শুনে কি করলেন? আপনি বললেন কেউ ওদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখবেনা। আপনি আর কোনদিন ওদের মুখ দেখবেন না। ব্যাস, দেখলেন না। ওরা অর্থকষ্টে জর্জরিত ছিলো, আপনি জেনেও সাহায্য করেননি। ওদের সন্তান হোল, কিন্তু আপনার মন গললনা, আপনি নিজেও গেলেন না, আমাদেরও কাউকে যেতে দিলেন না। ওদের গাড়ী অ্যাক্সিডেন্ট হোল, মুনিরা ঘটনাস্থলে মারা গেল, ফারুক গুরুতর আহত হোল, হয়ত ভাল চিকিৎসা পেলে ওকে বাঁচানো যেত, কিন্তু আপনি আপনার জেদের ওপর অটল রইলেন। আমি লুকিয়ে কিছু টাকা পাঠালাম, আপনি জানতে পেরে আমার টাকাপয়সা বন্ধ করে দিলেন। যেটুকু পাঠিয়েছিলাম সেটা ওকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট ছিলোনা। আমার ভাইটা মরে গেল। আপনার টাকা পথের কুকুরে খায়, অথচ আমার ভাইটা টাকার অভাবে মারা গেল’, গলা ধরে আসে তাঁর, তবু বলতে থাকেন, ‘ওদের মেয়েটার প্রতি পর্যন্ত আপনার কোন মায়াদয়া হোলনা। মেয়েটা একেকবার একেকজনের বাসায় ঘুরতে লাগল। বাবা, ওদের পয়সা ছিলোনা, কিন্তু ওদের আত্মা ছিল। ওদের সন্তানকে ওরা কষ্ট হলেও ফেলে দেয়নি’।

বাবা খোঁচাটা ধরতে পারলেন, কিন্তু কথা সত্য, সুতরাং তিনি কোন উত্তর দিলেন না।

স্বামীর রুদ্ধকন্ঠ দেখে সাহস করে বড়বৌ আবার এগিয়ে এলেন, ‘বাবা, আমি ওদের মেয়েটাকে নিয়ে এলাম দু’বছর পর। মুনিরাকে আমি কোনদিন দেখিনি, ফারুকের সাথেও আমার সেভাবে ভাব হয়নি কোনদিন। তাহলে আমি ওকে কেন নিয়ে এসেছিলাম আপনি জানেন?’

বৃদ্ধ কৌতুহলী হয়ে মুখ তুলে তাকালেন, ‘কেন?’

‘আপনার জন্য!’

শ্বশুরমশায় হা হয়ে গেলেন, ‘মানে?’

‘বাবা, ওর শরীরে আপনার রক্ত। আপনার সন্তানের শেষ স্মৃতিচিহ্ন সে। আপনি যতই অস্বীকার করুন, আপনার ওপর আমার সা’দ বা সায়রার যেমন অধিকার আছে, রুহিরও অধিকার আছে। আপনি সকাল বিকাল মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন, বসে বসে তিলাওয়াত করেন, ‘ফাজালিকাল্লাজি ইয়াদু’উল ইয়াতীম’। তারপর ঘরে ফিরে আপনি একজন অসহায় এতিমকে বঞ্চিত করেন, তার প্রতি সামান্য সহানুভূতিও দেখান না। আপনি কি মনে করেন এর জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবেনা? আমি আপনাকে রক্ষা করার জন্য ওকে নিয়ে এসেছি। এখানে আমার কোন স্বার্থ নেই’।

বৃদ্ধের চোখের দু’কোণে অশ্রু জমে। পেছন ফিরে নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে তিনি শুধু টাকা আর অহংকার ছাড়া কিছুই খুঁজে পাননা। তাঁর ছেলেরা পারতপক্ষে তাঁর সাথে কথা বলতে চায়না, বৌরা লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে, নাতিনাতনীরা থাকে দূরে দূরে। ছেলে এবং বৌয়ের দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারেন এর জন্য তিনিই দায়ী।

সত্য মনে মনে স্বীকার করে নিলেও, স্বভাব কি সহজে বদলানো যায়? তিনি চেহারায় ঈষৎ বিরক্তির ভাব এনে বড় বৌয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে বল, তুমি এখন কি মনে করে আজ এত বছর পর এই প্রসঙ্গ তুললে?’

বড় বৌ বললেন, ‘বাবা, রুহি আপনার নিজের রক্ত, অথচ এতিম বলে আপনি ওর প্রতি একটুও মায়া করেননি। আজ বারো বছরেও আপনি কোনদিন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি, সায়রা ওকে ভালবাসে বলে আপনি সায়রার ওপরেও বিরক্ত। ক’দিন পর মেয়েটার বিয়ে হবে। নিজের বাড়ীতেই যদি ওর কোন আদর না থাকে, শ্বশুরবাড়ীতে ওকে কতটুকু কদর করবে? আপনিই যদি ওর সাথে এমন ব্যাবহার করেন, তাহলে ওর শ্বশুরবাড়ীর লোকজন ওর সাথে কেমন ব্যাবহার করবে? …’

দাদার ঘরে চেঁচামেচি শুনে ঘরের লোকজন তাঁর ঘরের সামনে থেকে ছুটে পালাতে থাকে, দাদা কার সাথে চিৎকার করছেন সেটা বোঝা যাচ্ছেনা, কারণ অন্য পক্ষ এত শান্ত গলায় কথা বলছে যে বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছেনা। বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে বড়চাচা আর বড়চাচী বেরিয়ে আসেন। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় দাদা মাথা নুইয়ে বসে আছেন, জানালা থেকে আলো এসে তাঁর গাল বেয়ে চুঁইয়ে পড়া অশ্রুবিন্দুতে ঠিকরে পড়ে ঝিলিক তুলেছে। এমন দৃশ্য এর আগে কেউ কোনদিন দেখেনি, তাই সবাই ভয় ভুলে চেয়ে থাকে এই অভাবনীয় দৃশ্যের দিকে।

সাত. ‘রুহি আপু, চাচীমা তোমাকে ডাকে’, আঙ্গিনায় এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে খবর দেয় ছোট চাচীর ছ’বছর বয়সী মেয়ে সুমি।

‘বড়চাচী কোথায় রে?’, চাউলের কুলাটা নামিয়ে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করে রুহি।

‘চাচীর ঘরে’, এক পায়ে লাফাতে লাফাতে উত্তর দেয় সুমি।

ওড়নার আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বড়চাচীর দরজায় নক করে রুহি। ভেতর থেকে ডাক শোনা যায়, ‘রুহি, দরজা খোলা, ভেতরে আয় মা’।

রুহি ঘরে ঢুকে হাসতে হাসতে বলে, ‘চাচীমা, আমি যেভাবেই নক করি, তুমি সবসময় ধরে ফেল কিভাবে বল তো? সুমিও তো নক করতে পারত!’

চাচীও হাসতে হাসতে উত্তর দেন, ‘তোর হাতের শব্দ আমি এত বছরে না বুঝলে ত্রিশ বছর সংসার করে আর বুঝলাম কি?’

চাচী বিছানায় বসে ছিলেন। রুহি গিয়ে তাঁর পায়ের কাছে বসে যায়। হঠাৎ ঘরের অন্য পাশ থেকে সামান্য ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ শুনে সচকিত হয়ে যায় রুহি, চোখের কোণ থেকে লক্ষ্য করে সা’দ চাচার আরামকেদারায় বসে নিজেকে নিজে জড়িয়ে ধরে সামনে পেছনে দুলছে, চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সায়রা বসে আছে ভাইয়ের পায়ের কাছে, চেহারায় সহানুভূতি। দু’জনই চুপচাপ।

চাচী বলেন, ‘আমরা তো আর বসার সময় পেলাম না। তুই বিয়ের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা কিছু করেছিস? বায়োডাটাগুলো দেখতে দিয়েছিলাম, দেখেছিলি?’

রুহি মাথা নাড়ে, ‘চাচীমা, আমি বিয়ে করতে চাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব’।

চাচীকে চিন্তিত দেখায়, ‘তোর কি কোন বায়োডাটা পছন্দ হয়েছে?’

রুহি বলে, ‘একটা হলেই হোল’।

চাচী আশ্চর্য হোন, ‘মানে?’

রুহি হাল্কা হেসে বলে, ‘যোগ্যতা না থাকলে কি আর এরা দাদার কাছে অ্যাপ্লিকেশান পাঠাত? সুতরাং, যেকোন একটার সাথে দিলেই হয়, তোমার যাকে পছন্দ’।

রুহির নির্লিপ্ততায় চাচীর চেহারায় চিন্তার ছাপ আরো স্পষ্ট হয়, ‘রুহি, বিয়েটা সারা জীবনের ব্যাপার। এভাবে হেলাফেলা করিস না’।

রুহি জোর করে হেসে বলে, ‘হেলাফেলা কোথায় করলাম চাচীমা? আমি বিয়ে করতে চাই। তুমি তোমার পছন্দমত যেটা এনে হাজির করবে আমি সেটার সাথেই বসে যাব। রাস্তা থেকে যেকোন কাউকে ধরে এনে বিয়ে দিয়ে দিলেও আমি আপত্তি করবনা। শুধু তাড়াতাড়ি কর’।

রুহির ব্যাস্ততার কারণ আন্দাজ করে মনে মনে ওর জন্য কষ্ট পান চাচী। বলেন, ‘এত তাড়াহুড়ার কি আছে? আমরা দেখি সা’দের জন্য দাদা যে দাওয়াত আয়োজন করছেন সেটা হয়ে গেলে একবার বসতে পারি কিনা সবাই মিলে’।

রুহি অনড়।

শেষে চাচী বলেন, ‘আচ্ছা, তোর যখন এত বিয়ে করার শখ, তোকে আমি যেখান থেকে পারি ছেলে জোগাড় করে সাতদিনের মধ্যেই বিয়ে দেব, আমার পছন্দের ছেলের সাথেই দেব, তখন কিন্তু বলতে পারবিনা আমি তোকে পছন্দ করার সুযোগ দেইনি’।

বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে রুহি বলে, ‘বলবনা, কখনোই বলবনা’।

চাচীর ঘরে থেকে বেরিয়ে যাবার সময় রুহি দেখে সায়রা ভাইয়ের হাঁটুর ওপর মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করেছে।

আট. দাদার মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিয়েবাড়ীর প্রস্তুতি, আত্মীয় স্বজনের আগমন, হই হল্লার মাঝে তিনি একদিন ডেকে নিয়ে রুহি আর সায়রার সাথে পুরো পনেরো মিনিট কথা বললেন! কথা শেষে ওরা চলে আসার সময় রুহির মাথার দিকে হাত উঠালেন, কিন্তু নিজের অহংবোধকে ঠেলে হাতটা ওর মাথায় রাখতে পারলেন না। তবে ওনার এতটুকু প্রচেষ্টাতেই ওরা দু’জন এত উচ্ছ্বসিত হয়ে গেল যে সবকিছু বাদ দিয়ে এই নিয়েই ওরা জল্পনা কল্পনা করল সারা রাত।

বিয়ে নিয়ে বাইরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও রুহি ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছিল প্রচন্ডভাবে। নিজের বেদনাকে সে মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে, ঠিক যেমন সে চাচীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কষ্ট পাচ্ছিল সা’দের কষ্টের কথা ভেবে। ভেবেছিল বিয়ের দিন আসার আগেই সা’দ চলে যাবে, ওকে আর রুহির বিয়ে দেখতে হবেনা। কিন্তু রুহির বিয়ে উপলক্ষ্যে সা’দের যাওয়া পিছানো হোল। বিয়ে আর ওর পাশ করা উপলক্ষ্যে দাওয়াত একই সাথে হচ্ছে। চাচীকে জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন, ‘দূর দূরান্ত থেকে একই লোকজন এক বাড়ীতে ক’বার পয়সা খরচ করে আসা যাওয়া করবে? একসাথে হলে একবারে ঘুরে চলে গেল!’ সা’দ সারাদিন হই হল্লা করে, ভাই বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রুহি মনে মনে কামনা করে সা’দ বুঝি ওর প্রতি আকর্ষন কাটিয়ে উঠেছে- হলে ভাল হয়। তবে এটা যদি হয় ভাল থাকার অভিনয় তাহলে রুহির মনে কষ্টের সীমা থাকবেনা।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে গেল। রুহি একবারও জিজ্ঞেস করেনি ছেলের নাম কি, ছেলে কি করে, ছেলের বাড়ী কোথায়, ছেলের মা বাবা ভাইবোন কি অবস্থা, কিছুই না। চাচীমা ওর নির্লিপ্ততা দেখে কি ভাববেন নিজেই বুঝে পান না।

বিয়ের আসর লোকে লোকারণ্য। সব চাচা চাচী ভাইবোনেরা রঙ্গিন প্রজাপতির মত বাড়ীময় উড়ে বেড়াচ্ছে যেন। সা’দকেও দেখা যাচ্ছে বেশ ভাল জামাকাপড় পরে উচ্ছ্বসিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেড়াক, সে খুশি থাকলেই রুহি খুশি।

মৌলভী সাহেব এসে সম্মতি নিয়ে গেলেন, সায়রার, ‘কবুল বল, কবুল বল’ ফিসফিসের জ্বালায় সে শুনতেই পেলোনা কার সাথে বিয়ে হচ্ছে, কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সম্মতি দিয়ে দিলো। এরপর সচরাচর অনুষ্ঠানের আর কিছুই হোলনা। দাদা বললেন, ‘এগুলো বিদ’আত, এগুলো থেকে দূরে থাকাই উত্তম। আমাদের লক্ষ্য দুই দিনের আনন্দ ফূর্তি নয় বরং এক জীবনের সাহচর্য’। সবাই মিলে বরবধূর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সম্মিলিত প্রার্থনা করল, নেতৃত্ব দিলেন দাদা নিজেই। ব্যাস, অনুষ্ঠান শেষ।

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর রুহিকে ওদের বাসায়ই একটা ঘরে থাকতে দেয়া হোল। পুরাতন বাড়ীতে অনেক ঘর থাকে। এই কামরায় কেউ থাকতনা। বেশ বড় একটা রুম। এটাই গুছিয়ে ফুল দিয়ে সাজিয়ে ওর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সব বোনরা চারিদিকে ঘিরে বসে গল্প করছে। চুপচাপ পড়ুয়া মেয়ে সায়রার গলাটা শোনা যাচ্ছে সবার ওপরে। রুহি জানে সায়রার কাছে ওর খুশি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই বুঝি মন খারাপের মাঝেও এই উচ্ছ্বাস।

একটু পর এই ঘরে থাকবে শুধু রুহি আর একটা অপরিচিত মানুষ যার সম্পর্কে সে কিছুই জানেনা। রুহি মনে মনে ভাবছে এতটা পাগলামী করা মনে হয় ঠিক হয়নি, কে জানে ওর কপালে কি আছে! হঠাৎ সা’দকে ঘরে ঢুকতে দেখে বোনগুলো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে পালাল। সায়রা যেতে গিয়ে দেখে রুহি শক্ত করে ওর হাতটা ধরে রেখেছে। সা’দ ওকে একা পেলে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে ভেবে চিন্তিত বোধ করে রুহি, সা’দের যে অগ্নিমূর্তি সে রাতে সে দেখেছে, আজ সে নিজেই বিধ্বস্ত, এই অবস্থায় সে সা’দকে একা সামাল দিতে পারবেনা। সা’দের পেছন পেছন বড়চাচী এসে ঢোকেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রুহি। মায়ের সামনে সে পাগলামী করতে পারবেনা।

চাচী এসে রুহির পাশে বসেন। সা’দ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, সায়রার হাত এখনো রুহির হাতে আবদ্ধ। চাচী হেসে বলেন, ‘কি রে, আমার পছন্দের পাত্র তোর পছন্দ হোল?’

রুহি ভাবে এটাই সুযোগ, চাচীমাকে দিয়ে যদি সা’দকে এখানে থেকে বিদায় করানো যায়। সে মুচকি হেসে বলে, ‘পাত্রই তো দেখলাম না, পছন্দ অপছন্দ বলব কি করে?’

চাচী আশ্চর্য হয়ে বলেন, ‘বলিস কি? আমার এত্তবড় ঢ্যাঙ্গা ছেলেটাকে তুই চোখেই দেখলিনা?’

এবার পুরাই হতভম্ব রুহি। চাচী এসব কি বলছেন?!

সায়রা বুঝতে পারে রুহি নিজের চিন্তার জগতে ডুবে থাকার কারণে খেয়ালই করেনি নিজেদের পরিবারের বাইরে কেউ ছিলোনা অনুষ্ঠানে, কোন বরপক্ষ আসেনি, মৌলভী সাহেব সম্মতি নিতে এলে রুহি যে পাত্রের নাম শোনেনি সেটা অবশ্য সায়রার দোষ। তাড়াতাড়ি কবুল বলানোর জন্য খুব জ্বালাতন করছিল সে রুহিকে। সে বলে, ‘তুই আজ থেকে আমার ভাবী হলি, কি এখনও বুঝিসনি?’

রুহি ওর দিকে এমনভাবে তাকায় যেন ভস্ম করে ফেলবে, সায়রা বলে, ‘বিশ্বাস কর, আমি কাউকে কিছুই বলিনি। ভাইয়াও বলেনি। মা নিজেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে’।

কিছুই বুঝতে পারেনা রুহি। জিজ্ঞাসে দৃষ্টিতে চাচীর দিকে তাকায়। চাচী বলেন, ‘ওরে, সেই ছোটবেলা থেকে থেকে তোকে আমি নিজের সন্তানের মত করে মানুষ করেছি। তারপর আমি কি করে তোকে আরেকজনের হাতে তুলে দেই? তাই ভাবলাম তোকে আমার কাছেই রেখে দেই!’

রুহির চোখে অশ্রুর বান ডাকে, তবু ওর জানা প্রয়োজন, ‘চাচীমা, তাহলে এই কথা সরাসরি না বলে বায়োডাটাগুলোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলে কেন?’

‘মা বল মা! এতদিনে এই অধিকার আমার হোল। অধিকার হলেই অধিকার খাটাতে হবে এমন কথা আছে নাকি? যদি এমন হত যে আমার সা’দকে তোর পছন্দ নয়, তখন আমি জোর খাটালে তোর ভাল লাগতনা নিশ্চয়ই। একই কথা আমি সা’দকেও জিজ্ঞেস করেছি, তোকে ঘরে রেখে দিতে ওর কোন আপত্তি আছে কি’না। সে কথা শুনে ছেলে আমার যেভাবে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল তাতে আমার আর বুঝতে বাকী রইলোনা আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শুধু তোর নির্লিপ্ততাটা আমি বুঝতে পারছিলাম না। আজ কবুল পড়ানোর পর সায়রা আমার কাছে সব স্বীকার করল। মা’রে এত ভালবেসেছি তোকে, কিন্তু তোর মত করে ভালবাসতে পারিনি’।

বাকরুদ্ধ হয়ে রুহি চাচীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ঋনের বোঝা যে বাড়তেই রয়েছে!

নয়. ‘তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছিলে কেন?’

‘চাচীমার আদরস্নেহের প্রতিদানে আমি তাঁর সন্তানের প্রতি তাঁর অধিকার ক্ষুন্ন করতে পারতাম না। সেটা বিশ্বাসঘাতকতা হত। আমার আর কোন উপায় ছিলোনা। আমাকে মাফ করে দিয়ো’।

‘মাফ এত সহজে করবনা’।

‘তাহলে বল, কি শর্তে মাফ করবে?’

‘আমিও তোমাকে কম কথা শোনাইনি। সেজন্য আমাকে মাফ করে দিতে হবে আগে’।

দু’জনেই হেসে ফেলে। কষ্টের সময় অতীত হয়ে গেলে পেছনে ফিরে তাকিয়ে হাসা যায় যদি সমাপ্তিটা ভাল হয়।

‘জানো রুহি, তোমার চোখের ঐ একফোঁটা জল আমাকে সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রণহারা করে ফেলেছিল। আমি ওয়াদা করছি আমি তোমাকে কখনো কাঁদাব না’।

‘আমি ওয়াদা করছি আমি আর কখনো কাঁদবনা’।

অতীতের ভুলগুলো ভুলে গিয়ে দু’জন হাসিমুখে এগিয়ে যাবার সংকল্প করে একটি সুন্দর আগামীর পথে।

– রেহনুমা বিনতে আনিস

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

৪৩ টি পতিতালয়ের মালিকের লেখা কবিতা কেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত?

ফেসবুকীয় মতামত-:: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়বিরোধী রবী ঠাকুরের কবিতা কেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত? জাতি তা জানতে চায়…… ...