শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড, উন্নতির সোপান। শিক্ষা সুশীল সমাজ বিনির্মাণের চাবিকাঠি। সুন্দর সমাজ গড়ার পূর্বশর্ত। সকল প্রকার অন্ধকার দূর করার হাতিয়ার। মহান রাব্বুল আলামীন মহানবী (সাঃ)-কে হেরা গুহায় [ইক্বরা’ বিসমি রাব্বিকাল্লাযি খালাক্ব]-এর দ্বারা যে শিক্ষাব্যবস্থা সূচনা করেছেন, সে শিক্ষা অর্থাৎ কুরআন হাদীসের শিক্ষাই মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা আনতে পারে। আমাদের দেশের প্রচলিত কওমী মাদ্রাসা এ শিক্ষা ব্যবস্থারই বাস্তব নমুনা।
প্রতিষ্ঠাঃ
বিংশ শতাব্দির শেশ দশকের গোড়ার দিকে সম্মানিত, সর্বশ্রদ্ধ, বিশিষ্ট সমাজ সেবক কে.এম. আলাউদ্দিন সাহেব আপন আরবি-শিক্ষক, উজানীর মরহুম পীর ক্বারী ইবরাহীম সাহেব (রহ:) এর বিশেষ ছাত্র ক্বারী দারাছাত আলী (রহ:) এর অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনায় এবং এলাকাবাসীর সার্বিক সহযোগিতায় ঐতিহ্যবাহী ঢাকা নগরীর প্রাণ কেন্দ্র কদমতলী থানার মেরাজনগর এলাকায় ১৪১৪ হিঃ মোতাবেক ১৯৯২ ইং সনে দ্বীনি ইলিম তথা আল-কুরআন ও আল-হাদীসের সু-বিশাল জ্ঞান ভান্ডারের প্রচার-প্রসার ও বাস্তব জীবনে তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এবং ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র তথা আজকের পৃথিবীকে সে ঐশী আলোয় উদ্ভাসিত ও আলোকিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন জামিয়া ইসলামিয়া ইবরাহীমিয়া দারুল উলূম (মেরাজনগর মাদ্রাসা)।
আদর্শঃ
জামিয়া ইসলামিয়া ইবরাহীমিয়া দারুল উলূম (মেরাজনগর মাদ্রাসা) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের সহীহ আক্বীদা ও আদর্শ ভিত্তিক বৃহৎ ও বহুমূখী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ
১. ইলমে দ্বীনের হেফাজতে ও ব্যাপক প্রসারের মাধ্যম আল্লাহ তা‘আলার হুকুম ও সুন্নাতে নববী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক তা‘লীম ও তারবিয়াতের মাধ্যমে হক্কানী আলেম তৈরী করতঃ দেশ ও জাতির খেদমতে প্রেরণ করা।
২. আকায়েদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও ফিকহে হানাফীর সংরক্ষণ এবং কুরআন ও হাদীসের সহীহ্ তা’লীম-তারবিয়াতের যথাযথ বাস্তবায়ন করা।
৩. দ্বীন ইসলামের হিফাজত, দ্বীনের ওপর আঘাতকারী খোদাদ্রোহীদের প্রতিরোধ করে সমাজ থেকে নাস্তিক্যবাদ, শিরক, কুফর, বিদ’আত ও পাপাচারের মূলোৎপাটন এবং “ আমর বিল মা’রুফ ও নাহী আনিল মুনকার” এর মাধ্যমে দ্বীনী তৎপরতা দ্বারা সমাজে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা এবং সর্বস্তরে ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা চালানো।
জামিয়ার শিক্ষাধারাঃ
“জামিয়া ইসলামিয়া ইবরাহীমিয়া দারুল উলূম (মেরাজনগর মাদরাসা)” কোন গতানুগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম নয়। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে জামিয়া সাজিয়েছে তার পাঠদান পদ্ধতি। সুবিন্যস্ত সিলেবাসের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে মৌলিকভাবে কুরআন, হাদীস, ফিক্হ, তাফসীর, উসূল, আকাঈদ এবং বৈষয়িক পর্যায়ে আরবী সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য, বাংলা ব্যকরণ, নাহু, সরফ, বালাগাতসহ, ইংরেজী, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন ইত্যাদি সমুদয় বিষয় প্রয়োজন পরিমাণে শিক্ষা দেয়া হয়।
জামিয়ার শিক্ষা কার্যক্রমঃ
নূরানী মক্তব বিভাগ: শিশু শ্রেণি হতে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ( বাংলা, অংক, ইংরেজি, সমাজ, ভূগোল, ইতিহাস, চিত্রাঙ্কন ও সুন্দর হস্তাক্ষর প্রশিক্ষণসহ সহীহ কুরআন তেলাওয়াত, তাজবীদ, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় মাসআলা মাসাঈল ও মাসনূন দোয়াসহ সকল বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয়।
হিফজুল কুরআন বিভাগ: কুরআন শরীফ নাযেরা পড়তে সক্ষম শিক্ষার্থীদেরকে এ বিভাগে সুচিন্তিত পাঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে সুদক্ষ হাফেজ দ্বারা আন্তর্জাতিক মানের তেলাওয়াতের মশ্কসহ অনূর্ধ্ব তিন বছরে হেফজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হয়।
কিতাব বিভাগ: এটি জামিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সর্বাধিক সমৃদ্ধ, বৃহত্তর ও প্রধান বিভাগ। এ বিভাগেই তৈরি হয় জাতির কান্ডারী, আধ্যাত্মিক রাহবার। দ্বীনী শিক্ষার ক্রমমূল্যায়নের ভিত্তিতে কিতাব বিভাগে মোট পাঁচটি স্তরে বিভক্ত। ইবতিদাইয়্যাহ (প্রথিমিক), মুতাওয়াসসিতাহ (মাধ্যমিক), সানুবিয়্যাহ (উচ্চ মাধ্যমিক), ফযীলত (ডিগ্রী) ও তাকমীল (মাস্টার্স)। এ ৫টি স্তওে মোট ১৪ বছর সময়ে দ্বীনী শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীকে যোগ্য আলেম রূপে গড়ে তোলা হয় ও সনদ প্রদান করা হয়।
উচ্চতর গবেষণামূলক শিক্ষা বিভাগ
ইফতা বিভাগ:
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো ইফতা বিভাগ। এটি একটি উচ্চতর ইসলামী গবেষণামূলক বিভাগ। এখানে ইসলামী দৃষ্টি কোণ থেকে সমসাময়িক সমস্যার সমাধান দেয়া হয়। যুগের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে এ বিভাগের সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছে। যেন এ বিভাগ থেকে উত্তীর্ণ একটি ছাত্র ইসলামী আইনে হয় বিশেষজ্ঞ। ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামী রাজনীতি, যাকাত, ওয়াক্ফ, মু‘আমালাত, হুকুকুল ইবাদ ও হুকুকুল্লাহ-এক কথায় ইসলামী জীবন যাপনে প্রয়োজনীয় সকল বিধান সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান অর্জন করে।
আদব বিভাগ:
যুগ চাহিদার আলোকে দুর্বল ছাত্রদেও আরবী ভাষায় অনগল কথপোকথন, বক্তৃতা ও লিখনীতে পারদর্শীরূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি ব্যতিক্রমধর্মী আরবী ডিপ্লোমা কোর্স। সাথে বাংলা ও ইংরেজী ভাষাতেও দক্ষতা অর্জনের সমান সুযোগ রয়েছে। যাতে করে প্রত্যেকেই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে।
দ্বীনিয়াত: এ বিভাগে মহল্লার শিশুদের দ্বীনি মাসঅলা-মাসায়েলসহ বিশুদ্ধভাবে কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।
নৈশ মাদরাসা: জেনারেল শিক্ষিতদেরকে শর্ট কোর্সে স্বল্প সময়ে সহজ-সরল পদ্ধতিতে কুরআন-হাদীসের অর্থ বুঝার যোগ্য করে গড়ে তোলা হয়।
বয়স্ক শিক্ষা: এ বিভাগে যে কোনো বয়সের ব্যক্তির জন্য যে কোনো সময় দ্বীনি মাসআলা-মাসায়েল ও কুরআন শিক্ষা করার সূবর্ণ সুযোগ আছে।
মাস্তুরাত শিক্ষা:মা-বোনদেও সম্পূর্ণ পর্দাও সাথে উস্তাদেও বাসায় কুরআন শিক্ষা করা ও প্রয়োজনীয় মাসয়ালাসমূহ শিক্ষা দেয়া হয়।
জামিয়ার ছাত্র প্রশিক্ষণ কর্মসূচিঃ
ছাত্র পাঠাগার:
জামিয়ার সিলেবাসভূক্ত পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ছাত্রদের জ্ঞানের পরিসীমা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছানোর লক্ষ্যে সমকালীন অবস্থা ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগতির জন্য তথ্যবহুল বই-পুস্তক সমৃদ্ধ একটি পাঠাগার রয়েছে।
বক্তৃতা প্রশিক্ষণ:
ইলম অর্জনের পাশাপাশি তা সুন্দর সাবলীলভাবে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ছাত্র কাফেলা আয়োজন করে সাপ্তাহিক, মাসিক ও বার্ষিক বক্তৃতা প্রতিযোগিতা।
দেয়ালিকা প্রকাশ:
পাশ্চাত্যমূখী বিকৃত রুচির কলম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ইসলামী সাহিত্যেল নির্মল জ্যোতি বিবিরণের মহান লক্ষ্য নিয়ে ছাত্রদেরকে কলম সৈনিক রূপে গড়ে তোলার জন্য বাংলা ও আরবী ভাষায় নিয়মিত দেয়ালিকা প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
দাওয়াত ও তাবলীগ:
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি নিজ আমল-আখলাককে আরো উন্নত এবং সকল স্তরের মানুষকে দ্বীনের প্রতি আহ্বান করতে নিয়মিত তাবলীগী কর্মসূচী পালন করা হয়। শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে এলাকার বিভিন্ন মসজিদ ও মহল্লায় জামাত প্রেরণ করা হয় ।
আত্মশুদ্ধি মূলক কার্যক্রম:
একজন মুমিনের আত্মউৎকর্ষ ও আত্মবিকাশের জন্য আত্মশুদ্ধির কোন বিকল্প নেই। তাই জামিয়া কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝে দেশ ও বিশ্ববরেণ্য বুযুর্গদের আনায়ন করে আত্মশুদ্ধিমূলক বয়ানের ব্যবস্থা করে থাকে। বিশেষ করে এ উদ্দেশ্যে ইসলামী কাফেলার ব্যানারে প্রতি বছর তিন দিন ব্যাপি মাহফিলের আয়োজন করে থাকে ।
আল-ইহসান কোচিং সেন্টার:
এর মাধ্যমে প্রতি বছর রমযানে ইংরেজি ও আরবী ভাষা সাহিত্যের উপর প্র্যাক্টিক্যাল ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেয়া হয় । এছাড়া বিভিন্ন সময় বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
জামিয়া সেবা প্রকল্পঃ
ফতোয়া বিভাগ:
ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও বিভিন্ন ধরণের উদ্ভূত জটিল সমস্যার সমাধান দক্ষ মুফতী সাহেবগণ এ বিভাগ থেকেই দিয়ে থাকেন।
ফরায়েজ বিভাগ:
মৃত ব্যক্তির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ওয়ারিসদের মধ্যে শরীয়তের বিধান মোতাবেক সুষ্ঠু বণ্টনের রূপরেখা এ বিভাগ থেকেই প্রদান করা হয় ।
দুর্যোগকালীন সেবা:
ইতিপূর্বে সিডর, আইলা ও অন্যান্য দুর্যোগকালে জামিয়ার পক্ষ থেকে বিপদগ্রস্থদের দিকে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃতরূপে এ ধারাবাহিকতা বাকি রাখতে জামিয়া কর্তৃপক্ষ বদ্ধপরিকর।
সূত্র : মাদরাসার ওয়েবসাইট http://merajnagormadrasa.com/