রোজা ও ঈদ উদযাপনে মক্কা নগরীকে অনুসরণ করা যাবে কি না- এ নিয়ে বৃহৎ কয়েকটি কওমি মাদরাসাসহ সাত-আটটি বড় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের লিখিত মতামতও গ্রহণ করেছে ইফা। একটি অনলাইনভিত্তিক নিউজপোর্টালের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় বসবাসরত একজন প্রকৌশলী গত বছরের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা এক চিঠিতে রোজা ও ঈদ উদযাপন করতে রাষ্ট্রীয় ঘোষণার আহ্বান জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ওই চিঠি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালের কাছে পাঠায়। গত ১৬ নভেম্বর ইফাবার গবেষণা বিভাগ বিষয়টির আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণার নিমিত্তে মজলিসে দাওয়াতুল হকের আমির আল্লামা মাহমুদুল হাসান পরিচালিত জামিয়া ইসলামি দারুল উলুম মাদানিয়ার ফতোয়া বিভাগে পাঠানো হয়। ২৩ জানুয়ারি ইসলামি বিধিবিধান মোতাবেক ব্যাখ্যা দিয়ে ফতোয়া দেন মাদ্রাসার ইফতা বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র মাওলানা ফখরুল আমীন বিন ইবরাহীম। এই ফতোয়াপত্র সত্যায়ন করেন মুফতি মাহমুদুল হাসান, মুফতি সাদিকুল ইসলামসহ ১১ জন ফতোয়া বিশেষজ্ঞ।
সূত্রমতে, বিগত বছরগুলোয় সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে চাঁদপুরের ৩৯ গ্রামসহ দেশের কয়েকটি স্থানে রোযা শুরু হয় এবং ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা পালিত হয়। পাশাপাশি অধিকাংশ মুসলমান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। তবে এ নিয়ে রাষ্ট্রীয় ঘোষণার দাবি জানান মোহাম্মদপুর এলাকার ওই প্রকৌশলী। নিরাপত্তার কারণে এই আবেদনকারীর নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেননি সূত্র।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মক্কার সঙ্গে একই সময়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ধর্মীয় ব্যাখ্যা জানতে আগ্রহী। এ কারণেই আবেদনকারীর চিঠি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছানোর পর এটি ইফাবার কাছে পাঠানো হয়। এরপর ইফাবা নিজস্ব বিশেষজ্ঞ ছাড়াও কওমি মাদ্রাসার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চায়। ফতোয়া চাওয়া হয় মাওলানা মাহমুদুল হাসানের মাদরাসার ফতোয়া বিভাগে। ১৬ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটির বিভাগীয় পরিচালক ডা. খিজির হায়াত খান স্বাক্ষরিত চিঠিতে মতামত চাওয়া হয়।
লিখিত ফতোয়ার এক পর্যায়ে বলা হয়েছে, ‘আগে দেখা চাঁদের বিষয়টি যাচাই করা ছাড়াই প্রতি বছর চোখ বন্ধ করে যারা সৌদি আরবের সঙ্গে সবাইকে রোযা ও ঈদ উদযাপন করতে বলেন, মাসয়ালাটি জানা ও বোঝার প্রশ্নে তারা যে জ্ঞানস্বল্পতার শিকার তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।’
এতে আরও বলা হয়ৎ, ‘বড় আফসোসের বিষয় হলো, তারা নিজ দেশের ওলামা-মাশায়েখসহ সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রোযা ও ঈদ উদযাপন করে থাকেন, অথচ এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাও সর্বসম্মতিক্রমে অবশ্য পরিত্যাজ্য। সুতরাং এসব অনধিকার চর্চাকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কথায় কর্ণপাত করার কোনো অর্থ হয় না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খিজির হায়াত খান বলেন, ‘আমরা দেশের বিজ্ঞ আলেমদের কাছ থেকে এ বিষয়ে মতামত নিয়েছি। তারা কুরআন ও হাদিসের আলোকে লিখিত মতামত দিয়েছেন। আমরা হুবহু কম্পাইল করে এগুলো যত দ্রুত সম্ভব প্রকাশ করব।’
কবে নাগাদ প্রকাশিত হবে- উত্তরে খিজির হায়াত বলেন, ‘আমি সঠিক দিনক্ষণ বলতে পারবো না। তবে যতদূর জানি কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে।’
সূত্রমতে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন মূলত কওমিপন্থিদের অবস্থান জানতেই এ নিয়ে ফতোয়া চেয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির কারও কারও মক্কার সঙ্গে একই দিনে ঈদ উদযাপনে আগ্রহ রয়েছে। তবে যাত্রাবাড়ীর মাদ্রাসার ফতোয়ায় এর সম্ভাবনা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আসা অন্য মতামতগুলোর বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। এ নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কোনও সিদ্ধান্তে আসছে না বলেই জানান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা খিজির হায়াত।
তিনি বলেন, ‘রোযা ও ঈদ উদযাপনে একই সময় নির্ধারিত হবে কি না, এ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত আমরা দেব না। আমরা আলেম-ওলামাদের ফতোয়াগুলোকে একসঙ্গে প্রকাশ করব। সেখানেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।’
অসুস্থ থাকায় ইফাবার মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে বিলুপ্ত বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশনের সদস্য সচিব গহরডাঙ্গা মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা রুহুল আমিন বলেন, ‘এ ধরনের ফতোয়া বা সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ উদযাপনের কোনও যৌক্তিকতা নেই। এগুলো হচ্ছে সহিষ্ণু মুসলমানদেরকে উস্কানি দেওয়ার চক্রান্ত। এসব তো মীমাংসিত বিষয়। এসব নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠবে। যারা এমন করে তাদের বলি, সৌদি আরবের মত তারাও এদেশে রাজতন্ত্র কায়েম করুক।’
এ নিয়ে ইফাবার মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারিভাবে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ যাবত যেভাবে রোযা-ঈদ হয়ে আসছে, সেভাবেই হবে। তবে হয়তো কেউ কেউ চান সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে করতে। এটি হলে নৈরাজ্য হতে পারে।’ প্রকাশিতব্য ফতোয়া পুস্তিকাতেও চাঁদ দেখার পক্ষেই অবস্থান হবে, এমনটি আশা করছেন এই কর্মকর্তা।
তবে এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল মারুফ। তিনি বলেন, ‘এটি পরিবর্তন হোক বা না হোক, এ বিষয়ে আলোচনা তো করতে হবে। সামীম মোহাম্মদ আফজাল কোনও আলোচনা করেন না। নিজের পছন্দের লোকজন দিয়ে উনি কাজ করান। উনি ওআইসির নিয়ম মানছেন না। এসব পুস্তিকা করে লাভ নেই। গ্রহণযোগ্য হবে না। এটার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরে আলোচনা হতে হবে।’
তার বক্তব্য নিয়ে জানতে সামীম মোহাম্মদ আফজালকে ফোন করা হলেও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। সূত্র. বাংলা ট্রিবিউন