ফরীদ আহমদ রেজা-
ঢাকার কলাবাগানে অবস্থিত শিবিরের মেসে আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। ছাত্রত্ব বজায় রাখার জন্যে ঢাকা ল কলেজে আইন পড়তে ভর্তি হলাম। নির্বাচন হলো এবং আমাকে ঢাকা শহরের সভাপতি নির্বাচিত করা হলো। ঢাকা শহরের অধিকাংশ সদস্যের পরামর্শের আলোকে সেক্রেটারী নিয়োগ করলাম কার্যকরী পরিষদের নতুন সদস্য আনোয়ার হোসেনকে। অত্যন্ত কর্মঠ, বুদ্ধিমান, অভিজ্ঞ এবং বিশ্বস্ত একজন ব্যক্তিকে সেক্রেটারী হিসেবে পেয়ে খুব ভালো লাগলো।
কর্মপরিষদে পেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, সলিমুল্লাহ মেডিকেলের আমিনুল ইসলাম মুকুল, কলেজসমূহের ইনচার্জ আব্দুল হক এবং অন্যান্য জোনের দায়িত্বশীলদের। তাদের সহযোগিতা, আন্তরিকতা এবং যোগ্যতা প্রশ্নের উর্ধে ছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম, ছয় মাস পর আমি চলে গেলে এরা যে কেউ যোগ্যতার সাথে ঢাকা শহর পরিচালনা করতে পারবেন। বার্ষিক পরিকল্পণা গ্রহণ করলাম। সকল থানা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সফর করলাম। নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হলো। কিন্তু কি জানতো আমার জন্যে আরো কিছু বিস্ময়কর ঘটনা অপেক্ষা করছে।
একদিন আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ আমাকে ডেকে পাঠালেন। ভূমিকা হিসেবে অনেক কথা বলার পর শেষে বললেন, ‘এনামুল হক মনজু ব্যক্তিগত কারণে কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করবেন। আমি যেন ঢাকায় অবস্থানরত পরিষদ সদস্যদের সাথে আলাপ করে তাদের মানসিক ভাবে প্রস্তুত করি। এর কোন বিকল্প নেই। দ্রুত এর ব্যবস্থা করুন।’ আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঢাকার পরিষদ সদস্যদের ডাকলাম। বিষয়টা ব্যাখ্যা করলাম। তারা সবাই কারণ জানতে চাইলেন। আমি বললাম, ‘কারণ ব্যক্তিগত। এর চেয়ে বেশি কিছু আমি বলতে পারবো না।’ তারা অনেক চাপাচাপি করলেন। বললেন, ‘কেন্দ্রীয় সভাপতি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করতে চাইলে করবেন। আমরা কারণ জানতে চাই এ জন্যে যে তা হলে হয়তো কারণ দূর করার একটা পথ আমরা খুঁজে পেতে পারি।’ আমি বললাম, ‘প্রয়োজন হলে আপনারা পরিষদের বৈঠকে তাকে কারণ জিজ্ঞেস করবেন। তবে আমার অনুরোধ, বৈঠকে আপনারা পদত্যাগের কারণ জানতে বা তা প্রত্যাহার করার জন্যে বেশি চাপাচাপি করবেন না।’ দুয়েক দিনের মধ্যে পরিষদের বৈঠক ডাকা হলো। বৈঠকে এনামুল হক মনজু পদত্যাগ করলেন। উপস্থিত সদস্যরা আমার অনুরোধ আমলে না নিয়ে কারণ জানতে এবং পদত্যাগ না করতে অনেক অনুরোধ করলেন। কিন্ত এনামুল হক মনজু তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।
কেন্দ্রীয় সভাপতি পদত্যাগের পর সংবিধান অনুযায়ী পরিষদের সদস্যদের ভোটে আহমদ আব্দুল কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। এ বৈঠকেই পরবর্তী কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচন সম্পন্ন হয় এবং সারা দেশের সদস্যদের ভোটে আহমদ আব্দুল কাদের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
আহমদ আব্দুল কাদের সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগের জন্যে পরিষদের সদস্যদের সাথে পরামর্শ শুরু করলেন। আমি তাকে প্রস্তাব দিলাম, ‘আপনি সাইফুল আলম খান মিলনকে সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে রাখুন। মেয়াদ শেষ হবার আগে তাঁকে বাদ দেয়া ভালো দেখায় না’ তিনি বললেন, ‘আপনার পরামর্শ শুনলাম। তবে অধিকাংশ পরিষদ সদস্য যার পক্ষে মতামত দিবেন তাকেই আমি সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দিতে চাই।’ আমি বললাম, ‘আর যা-ই করুন, আমাকে সেক্রেটারী জেনারেল করবেন না। আমার ছয় মাসের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন ঢাকা শহরের জন্য নতুন সভাপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে আমাকে বিদায় দেন।’ তিনি বললেন, ‘দেখা যাক পরিষদ সদস্যরা কি বলেন।’
এক সময় পরিষদের বৈঠক শুরু হলো। প্রথম এজেন্ডা সেক্রেটারী জেনারেল নিয়োগ। আহমদ আব্দুল কাদের বৈঠক শুরু করেই বললেন, ‘আমি অধিকাংশ পরিষদ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে ফরীদ আহমদ রেজার নাম ঘোষণা করছি।’ ঘোষণা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না। অন্যরা আলহামদুলিল্লাহ বলে ঘোষণাকে স্বাগত জানালেন। বৈঠকে ঠিক আমার পাশে বসেছিলেন সাইফুল আলম খান মিলন। চেয়ে দেখলাম তার ফর্সামুখ, হয়তো রাগে-দুঃখে, লাল হয়ে গেছে। পরক্ষণেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং কাউকে কিছু না বলে ঝড়ের বেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। সবাই সেটা দেখেও না দেখার ভান করলেন। কেন্দ্রীয় সভাপতি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকলেন। তারপর পরিষদের বৈঠক সেখানেই মুলতবী ঘোষণা করলেন।
পরে এক সময় আমি ফোন করলাম সাইফুল আলম খান মিলনকে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি যে ভাবে রাগ করে এবং কাউকে কিছু না বলে পরিষদের বৈঠক থেকে বেরিয়ে গেলেন, তা কি ঠিক হয়েছে?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘না ঠিক হয়নি। কিন্তু আমি সহ্য করতে পারিনি। এ জন্যে বেরিয়ে গেছি।’
পরদিন পরিষদের বৈঠক শুরু হলে সাইফুল আলম খান মিলনের সে দিন বৈঠক থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে আমি বললাম, ‘আমার সাথে তাঁর আলাপ হয়েছে, তিনি স্বীকার করেছেন এটা ঠিক হয়নি। সুতরাং এ বিষয়ে আর কথা না বাড়ানোই ভালো।’ আমার এ অনুরোধ কারো কারো মনঃপুত না হলেও অধিকাংশ সদস্য মেনে নেন। নির্বাচন এবং দায়িত্ব বন্টন সম্পন্ন হবার পর সংগঠনের নিয়মিত কাজের দিকে আমরা মন দিলাম।
হঠাৎ একদিন কে একজন খবর দিলেন, শাহ জাহান চৌধুরী (মোমেনশাহী) গোটা দেশের সদস্যদের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, শিবিরের বর্তমান নেতৃত্ব সংগঠনের মূল আদর্শ থেকে সরে গেছে। কার্যকরী পরিষদের সদস্যরা ছাত্রজীবন শেষ হবার পরও শিবির ত্যাগ করছে না। তারা ষড়যন্ত্র করে কেন্দ্রীয় সভাপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করে নেতৃত্ব দখল করে নিয়েছে। সে চিঠিতে সদস্যদের প্রতি আবেদন জানানো হয়েছে, তারা যেন সংগঠন রক্ষার তাগিদে বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে। এ চিঠির খবর পাওয়ার সাথে সাথে, আমাদের অবাক করে দিয়ে ঢাকা, সিলেট, চট্রগ্রাম, রাজশাহী প্রভৃতি এলাকা থেকে সদস্যদের দস্তখত সম্বলিত অনাস্থাপত্র আসা শুরু হয়। আমরা বুঝলাম যে একটা সুচিন্তিত পরিকল্পণা, সুসংবদ্ধ জনবল এবং আনুষঙ্গিক উপায় উপকরণ ছাড়া সারা দেশে এত দ্রুততার সাথে চিঠি প্রেরণ এবং অনাস্থা প্রস্তাব আনয়ন সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।