ড. মুস্তাফিজুর রহমান ফয়সাল ::
ভুমিকা : শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। শিক্ষা একটি জীবন ঘনিষ্ঠ প্রত্যয়। তাই জীবনই হচ্ছে শিক্ষার মূল উপজীব্য। আর শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে মানুষকে শিক্ষা দান পদ্ধতি যা দ্বারা শিক্ষার্থীদের সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী তৈরী করা হবে। শিখন পদ্ধতির বারবার প্রয়োগ করে ভাল গুণাবলীর বিকাশ হবে সেখানে। ইসলামে শিক্ষা একটি বাধ্যতামূলক ধারণা। দোলনা থেকে কবর এই হচ্ছে শিক্ষার দুটি প্রান্ত সীমা। শিক্ষা অর্থে একটি নির্দিষ্ট পরিভাষা ব্যবহার না করে বেশ কয়েকটি প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়েছে। তরবিয়াহ এসেছে রাবা হতে যার অর্থ বাড়ানো, আধ্যাত্মিক পুষ্টি ইত্যাদি। তাদিব এসেছে আদুবা হতে যা দ্বারা শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়া, পরিশুদ্ধ হওয়া, সংস্কৃতিবোধ সম্পন্ন হওয়া বুঝায়। তালিম এসেছে আলিমা হতে যার অর্থ জানা, অবহিত হওয়া, শিখা যা জ্ঞানকে নিশ্চিত করে। উল্লেখিত তিনটি শব্দ দিয়ে ব্যক্তির উন্নয়ন, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা, জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞানের স্থানান্তর বুঝায়। ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য ইসলামে শিক্ষা অপরিহার্য। ওহীর প্রথম আয়াতটিই পড় দিয়ে শুরু। এরপর বলা হয়েছে “পড়, আর তোমার প্রভু বড়ই অনুগ্রহশীল। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।” (আলাক, ৯৬ : ৩-৪)।
রাসূল (সাঃ) এক সময় মুসলিম শিশুদের পাঠদানের বিনিময়ে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফেরেশতাগণ এবং শয়তান জ্ঞানের পরীক্ষায় আদম (আঃ) এর নিকট ফেল করে। এরশাদ হচ্ছে: “আর তিনি আদমকে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম শেখালেন।” (বাকারা-৩১)। যুগে যুগে মানব সমাজে রসূলগণ আল্লাহর বান্দাদের জন্য শিক্ষার ধারা অব্যাহত রাখেন। এ শিক্ষা লাভের মাধ্যমেই মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হতে সক্ষম হয়। আর মানুষ সেই আমানত বহন করার দায়িত্ব গ্রহণ করে যা গ্রহণ করতে আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতমালা অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
ইতিহাস: রাসূল (সাঃ)-এর সময় সাফা পর্বতের পাদদেশে দারুল আরকাম হচ্ছে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রাসূল (সাঃ) নিজেই এখানে শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এ শিক্ষালয়ের ছাত্র ছিলেন হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমর (রাঃ) সহ অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম। হিযরতের পর মসজিদে নববীর বারান্দায় মাদ্রাসা-ই-সোফফা প্রতিষ্ঠা করে রাসূল (সাঃ) এর পরিচালনা ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এর আদলে মদীনায় বিভিন্ন মহল্লায় মসজিদ ও সংলগ্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। এ সময় শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বিষয়ের অন্যতম ছিল পবিত্র কুরআন, হাদীস, ফারায়েজ, চিকিৎসাবিদ্যা, ইলমুল আনছাব ও তাজবীদ। এছাড়াও শরীর চর্চা, আরবের ঐতিহ্য অনুযায়ী অশ্বারোহন ও সমর বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া হতো। খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে শিক্ষার পরিমন্ডল আরও সম্প্রসারিত হয়।
উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে শিক্ষার ধারা আনুষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় দুনিয়াব্যাপী আলো ছড়ায়। সমগ্র মুসলিম দুনিয়াতেই মসজিদ কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয় এ ধরনের মসজিদ ভিত্তিক মাদ্রাসা হতেই। ৮৩০ সালে খলিফা আল মামুনের প্রতিষ্ঠিত বায়তুল হিকমা সমগ্র দুনিয়ার জন্য জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছিল। প্রাচীন গ্রীক বিজ্ঞান আরবীতে এখানেই পাওয়া যায়। ৮৫৯ সালে মরক্কোর ফেস এ জামেয়া আল কারায়িন(University of Karawin) প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনো বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের জন্মই হয়নি। ইউনোস্কো এবং গিনিচ বুক আব ওয়ার্ল্ড অনুযায়ি এটিই পৃথিবীর সর্ব প্রথম ডিগ্রী প্রদান কারী প্রতিষ্ঠান(বিশ্ববিদ্যালয় )। কওমী ধারায় থাকলেও ১৯৬৩ সালে সরকার এটিকে জাতীয়করণ করে। মালেকী মাজহাবের অনুসারি এ প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় তিউনিশিয়ার (মাগরেব) প্রাচিন মসজিদ কারায়িন এর নামে। এর পূর্বে ৭০৩ সালে তিউনিসিয়ার জয়তুনা মসজিদে একটি জামেয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। হানাফি মাজহাবের অনুসারি (মাজহাব চালু হওয়ার পর) এই কওমী মাদ্রাসাটি ১২০০ বছর চলার পর ১৯৬০ সালে হাবিব বউরগুইবার ধর্মনিরপেক্ষ সরকার বন্ধ করে দেয়। আরব বসন্তের পর আবার স্থানীয় আলেমরা সীমিত পরিসরে সেটি চালু করেন।
জামে আজহার প্রতিষ্ঠিত হয় ৯৭৫ সালে কায়রোর আল আজহার মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি মক্তব হিসেবে। এটি পৃথিবীর ২য় বিশ্ববিদ্যালয়। ১০৬৫ সালে নিজামুল মুলক(আবু আলী হাসান ইবনে আলী তুসি) প্রতিষ্ঠিত বাগদাদের জামেয়া নেজামিয়া (নেজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) তৎকালীন পৃথিবীর সবংশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ ছিল। ইমাম গাযালী, শেখ সাদীর মত অনেক জগত বিখ্যাত ব্যক্তি এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিল। মসজিদ কেন্দ্রীক মাদ্রাসার যুগ পেরিয়ে এটি প্রথম জামেয়া। এটি পৃথিবীর ৩য় বিশ্ববিদ্যালয়। বাগদাদের জামেয়া নেজামিয়ার স্রোতধারায় পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থাকে দরসে নেজামী বলা হত। প্রাথমিক ভাবে ইস্পাহান, নিসাপুর, বসরা, আমুল ইত্যাদি বিভিন্ন শহরে নেজামিয়ার তত্ত্বাবধানে মাদ্রাসা গড়ে উঠে। মধ্যযুগের সবচেয়ে বড় এউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা ৩০০০ এর উপরে ছিল। সেজন্য বাগদাদ সে সময়ে দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও উন্নয়নের সেরা জায়গা ছিল। সে সময়ে বাগদাদ নগরীর জনসংখ্যা ১০ লক্ষের উপরে ছিল, ঐ সময়ের সর্ব বৃহত জনসংখ্যার নগরী। ইউরোপের ছাত্ররা কেউ এখান থেকে পড়ে গেলে চতুপার্শ্বের লোকজন তাকে দেখতে আসত। ইউরোপে আলো জ্বালে এই ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা। এ ভাবধারায় ভারতেও প্রচুর মাদ্রাসা গড়ে উঠে।
পটভুমি; প্রেক্ষিত ভারতীয় উপমহাদেশ:
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে আরব বণিকদের মাধ্যমেই পশ্চিম ভারতের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে ইসলামের প্রবেশ ঘটতে থাকে। তাদের বাণিজ্য বসতি ধীরে ধীরে বাংলা ও মিয়ানমারের উপকূলীয় অঞ্চলেও সম্প্রসারিত হয়। তারা শানিমশপূর্ণ বাণিজ্যেই বিশ্বাসী ছিলেন। সপ্তম শতাব্দী থেকে দু -একটি বিচ্ছিন্ন আরব অভিযানের ঘটনা ঘটতে থাকে। অতঃপর ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে রাজা দাহিরকে পরাজিত করে সিন্ধু ও মুলতান অধিকারের মধ্য দিয়ে ভারত ভূখনেমব সরাসরি মুসলিম সামরিক শক্তি প্রবেশের সূত্রপাত ঘটে। ইমাম ফখরুদ্দিন রাজির ভক্ত সুলতান শিহাব উদ্দিন ঘোরীর (হিজরী ৫৯৭-৬০২) শাসনামলে ১১৭৫ সাল হতে এ শিক্ষা ব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি লাহোরে এসে ৬ মাস ছিলেন। ঘোরীর মৃত্যুর পর ১২০৬ সাল হতে সুলতান কুতুবুদ্দীন আইবেক ইসলামি শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যে অগণিত মাদরাসা স্থাপন করেন। ১২৫৮ সালে হালাকু খার নেতৃত্বে মঙ্গলরা বাগদাদ নগরী ধ্বংস করে ২ লক্ষ মানুষ হত্যা করে। টাইগ্রীস নদী কিতাবের কালীর রঙ্গে কাল হয়ে গিয়েছিল। এ সময় আলেমরা ব্যাপক হারে ভারতে হিজরত করেন। তখন প্রতিদিনই দেখা যেত উট বোঝাই করা কেতাব নিয়ে আলেমগণ ভারতে আসছেন। যাদেও বেশিরভাগই ছিলেন হানাফি মাজহাবের অনুসারি। এই আলেমদের প্রভাবে হিজরি অষ্টম শতাব্দীতে(১৩২৪-১৩৫১) সুলতান মুহাম্মদ তুঘলকের শাসনামলে ব্যাপকহারে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। ঐতিহাসিকগণের দাবী, কেবল দিল্লীতেই তখন এক হাজার মাদরাসা ছিলো। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ সকল প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় ব্যয় বহন করা হতো। এসব মাদরাসায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলা শিক্ষা দেওয়া হতো। বাদশাহ তুঘলকের স্থলাভিষিক্ত শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলক বালিকাদের জন্য পৃথক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মানতেক, আদবসহ বেশকিছু বিষয় পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। আল্লামা সাদ উদ্দিন তাফতাজানির ছাত্র কুতুব উদ্দিন রাজির বহু শিষ্য এ সময় উপমহাদেশে আসেন। মাদরাসা প্রতিষ্ঠার এই ধারাবাহিকতা মোঘল শাসনামলেও অব্যাহত থাকে। প্রায় সব মোঘল সম্রাট ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাদশাহ আওরঙ্গজেব ওরফে আলমগিরের শাসনামলকে তো দ্বীনী শিক্ষার সোনালী যোগ বলা হয়ে থাকে।
হিজরী নবম শতকের শেষ দিকে হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রাহঃ) (মূল নাম কুতুব উদ্দিন আহমদ ইবনে আবদুর রহিম)-এর সময়ে ইসলামী শিক্ষা ব্যাপকতা লাভ করে। তিনি তার বাবা মাওলানা আবদুর রহিম প্রতিষ্ঠিত(মাদ্রাসায়ে রহিমিয়া) দিল্লি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। সেখানেই শিক্ষকতা করেন।বাবার মৃত্যুও পর ১৭১৯ সালে মাদ্রাসার প্রধান হন। ইবনুল আরাবীর ওয়াহদাত আল উযুদ এবং শায়খ আহমদ সিরহিন্দীর ওয়াহদাত আল শুহুদ এর মধ্যে সংঘাত মীমাংসা করেন। ১৭৩২ সালে তিনি পূর্ণাঙ্গ অর্থে হাদীসের দারস চালু করেন। তিনি তার আল-জুয়উল লতীফ গ্রন্থে সিলেবাসভুক্ত বিষয় গুলো লেখেন : নাহু-কাফিয়া ও শরহে জামী, মানতিক-শরহে শামসিয়্যা ও শরহে মাতালি। ফালাসাফা- শরহে হিদায়াতুল হিকমাহ। কালাম-শরহে আকাঈদ নাসাফী, হাশিয়ায়ে খেয়ালী শরহে মাওয়াফিক। ফিকহ-শরহে বেকায়া, হিদায়া (সম্পূর্ণ)। উসুলে ফিকহ-মুসামী, তাওযীহ তালবীহ-এর কিয়দংশ। বালাগাত-মুখতাছার ও মুতাওয়াল। সৌরবিদ্যা ও অংক-কতিপয় পুস্তিকা, চিকিৎসা শাস্ত্র-মুজিজুল কানুন। হাদীস-মিখকাতুল মাসাবীহ, শামায়েলে তিরমিজী এবং সহীহ বুখারী শরীফের কিছু অংশ। তাফসীর-মাদারিক ও বায়যাবী। তাসাউফ-আওয়ারিক, রাসায়েলে নকশবন্দিয়া, শরহে রুবায়িয়্যাতে জামী, মুকাদ্দামায়ে শরহে লুমআত, মুকাদ্দামায়ে নাকদুন নুসূম। এদিকে ১৬৯২ সনে বিখ্যাত আলেম মোল্লা কুতুব উদ্দীনের সুযোগ্য সাহেব জাদা মোল্লা নিজাম উদ্দীন ফিরিঙ্গি মহালে দরসে নিজামীয়া শিক্ষাক্রম চালু করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে শিয়ারওা তাদের সন্তানদের ভাল লেখা পড়ার স্বার্থে এখানেই ভর্তি করতো। এমনকি কিছু হিন্দু ছাত্রও ভর্তি হয়েছিল। কারন তারা উচ্চ শিক্ষার আর কোন প্রতিষ্ঠান পায়নি। দরসে নেজামিয়ার পাঠ্যসূচী ছিল:- সরফ-মীযান, মুনশাইব, সরফে মীর, পাঞ্জেগাঙ্গ যুবদা, ফুসূলে আকবরী, শাফিয়া। নাহু-নাহুমীর, শরহে মিয়াত আমিল, হিদায়াতুন নাহু, কাফিয়া ও শরহে জামী। মানতিক-সোগরা কোবরা, ইচ্ছাগুযী, শরহে তাহযীব, কুতুবী, মীর কুতুবী ও সুল্লামুল উলূম। ফালাসাফা-মায়বুযী, সদরা ও শামছে বাযিগা। সৌরবিদ্যা ও অংক-খোলাছাতুল হিসাব, তাহরীরে উক্লিদাস, মাকালায়ে উলা, তাশবীহুল আখলাক, রিসালায়ে কুর্শিজিয়্যা, শরহে চিগমুনী বাবে আউয়াল। বালাগাত-মুখতাসারুল মা’আনী মুতাওয়াল। ফিকহ-শরহে বিকায়া (প্রথম দুই খন্ড), হিদায়া (শেষ দুই খন্ড) উসূলে ফিকহ- নুরুল আনওয়ার, তাওযীহ তাশবীহ ও মুসাল্লামুস সুবূত। কালাম-শরহে আকাঈদ নাসাফী, শরহে আকানুদ জালালী, মীর যাহিদ ও শরহে মাওয়াকিফ। তাফসীর- জালালাইন শরীফ ও বায়যাবী (বাকারা) হাদীস- মিশকাতুল মাসাবীহ।
ইংরেজ শাসন:
১৭৫৭ সালে পলাশীর আ¤্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হলেও বৃটিশরা দীর্ঘ দিন এদেশের শিক্ষা ও ভাষায় হস্তক্ষেপ করার সাহস করেনি। কৌশলে ধীরে ধীরে আগায় তারা। ১৮৫৭ সালের আজাদী আন্দোলন দমন করার পর উপমহাদেশে হাজার বছওে গড়ে উঠা শিক্ষা ব্যবস্থা যা আরবী ও ফারসী ভিত্তিক ছিল সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হয়। এ পর্যায়ে ওস্তাজুল আসাতিজা ভারতের জ্ঞান সাগর হযরত মাওলানা মামলুক আলী নানুতুবীর ছাত্র ইলমে নবুয়তের উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবি (রঃ), হযরত রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ:), হযরত মাওলানা মোহাম্মদ মাযহার (রহ:), মাওলানা ইয়াকুব নানুতুবী (রহ:) এগিয়ে আসেন। তাদের নেতৃত্বে হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রাহঃ) এর রহিমিয়া ও মোল্লা নিজাম উদ্দীন শাহলভীর দরসে নেজামি এ দুই ধারার সমন্বয় করে ১৮৬৭ সালে ঐতিহাসিক দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। যা কওমী মাদ্রাসা হিসেবে পরিচয় লাভ করে। জন্মই যার বৃটিশ শক্তির উৎখাতের চ্যালেঞ্জকে ধারণ করে। অতএব রাষ্ট্রীয় আনুকুল্যের প্রশ্নই আসেনা। একদিকে বৃটিশ বিরুধী সংগ্রামকে জাগিয়ে রাখার শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে এই দেওবন্দ। অন্যদিকে নিবিড় জ্ঞান চর্চার সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে। তারই ধারাবাহিকতায় ও আদলে গোটা পাক ভারত উপমাদেশে এ জাতীয় মাদ্রাসা গড়ে উঠে।
কওমী / দেওবন্দী :
কওম অর্থ জাতি, আর কওমী অর্থ জাতীয়। মাদ্রাসা আরবী শব্দের অর্থ বিদ্যালয়। সুতরাং কওমী মাদ্রাসা অর্থ জাতীয় বিদ্যালয়। দেওবন্দী ও উলামায়ে দেওবন্দী বলতে ওই সব মুসলমান এবং আলেমদেরকে বুঝায় যাদের চিন্তাধারা হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী শায়খ আহমাদ ছিরহিন্দী রহ. ও ইমামুল হিন্দ হযরত মাওলানা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. এবং আযহারুল হিন্দ দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসার “আকাবীরে সিত্তাহ” যথাক্রমে হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ. হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী রহ. হযরত মাওলানা শাহ রফীউদ্দীন রহ. হযরত মাওলানা যুলফিকার আলী রহ. হযরত মাওলানা আবেদ শাহ রহ. হযরত ফজলুল রহমান উসমানী রহ. প্রমুখ ও প্রতিষ্ঠাতা বৃন্দ যথা হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ. হযরত মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ. ও হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী রহ. প্রমুখের চিন্তাধারার সঙ্গে একমত হবে। চাই তারা দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসার ফারেগ হোন কিংবা অন্য মাদরাসার। দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষক কর্মচারী হোন বা অন্য কোন দীনি প্রতিষ্ঠানের উলামায়ে কওমী মাদারেছ হোন কিংবা সরকারি আলেম হোন বা আবেদ, লেখক বা সংবাদিক। মোটকথা, যাদের চিন্তা-ফিকির আকাবীরে দেওবন্দী তারাই দেওবন্দী হিসেবে পরিচিত।
কওমি মাদরাসার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
দীন ইসলামকে তার আসল অবস্থায় হেফাজত করা। উলুমুল কুরআন ও উলুমুল হাদিস তথা কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান-বিজ্ঞান সমূহের সংরক্ষণ ও তার প্রচার- প্রসার। তাআল্লুক মাআল্লাহ। সবধরণের শিরকের মূল উৎপাটন। বিদআত ও কুসংস্কারকে সমাজ থেকে উৎখাত করা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাহ ও মতাদর্শের হেফাজত ও লালন করা। ইসলামী শিক্ষার সুরক্ষার সাথে সাথে নিত্যনতুন সৃষ্ট ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, ফেতনা ইত্যাদি সম্পর্কে মুসলিমজাতিকে সতর্ক করা, তাদের হিংস্র থাবা হতে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করা।
কওমী মাদ্রাসার অবদানঃ
কওমী মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে কুরআন-হাদীসের আলোকে জ্ঞান দান করে, ত্যাগী, পরোপকারী, সমাজসেবক, অধিক ভোগ-বিলাসে নিরুৎসাহী এবং স্বল্প উপার্জনে সন্তুষ্ট থেকে জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলে। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যারা জড়িত তারা চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, ভূমি দখল, হল দখল, দুর্নীতি, মিথ্যা, প্রতারণা, ইভটিজিং, নারীর অবমাননা, ব্যাভিচার, অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা, অপকর্ম, চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবী, অপসংস্কৃতি ইত্যাদির সাথে কোন রকমের সম্পর্ক রাখে না। দুর্নীতিমুক্ত জনশক্তি উপহার ও নকলমুক্ত শিক্ষাঙ্গন এখানেই দেখা যায়। বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন এন্ড স্ট্যাটিসটিক্স কর্তৃক ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫,২৩০ টি কওমী মাদ্রাসা রয়েছে এবং তাদের ছাত্র সংখ্যা ১৪ লাখ। এজন্য রাষ্ট্রীয় বাজেটের এক টাকাও খরচ হয়না। দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ইসলামী মূল্যবোধের হেফাজতের লক্ষ্যে তাঁরা খোদায়ী মদদে বুকটান করে এগিয়ে আসেন। সন্ত্রাস, বোমা ও জঙ্গি প্রশিক্ষণের সাথে এসব মাদ্রাসার দূরতম সম্পর্কও নেই। সন্ত্রাসের কারণে এদেশের কোন মাদ্রাসা একদিনের জন্য বন্ধ হয়নি। হিংস্র ইংরেজ ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম জিহাদের ফতোয়া প্রদান করেন ওলামায়েকেরাম। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্বেও ছিলেন ওলামায়েকেরাম। কওমী ওলামায়েকেরামের কর্ম তৎপরতার কেবলমাত্র শিক্ষা-সংস্কৃতির মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিম উম্মাহর মাঝে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। আদর্শ মানুষ তৈরীতে এর জুড়ি মেলা ভার। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সুস্থ চিন্তাধারার বিকাশ, দ্বীনের প্রচার-প্রসার এবং ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ময়দানে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধিত হয় কওমী মাদ্রাসার স্বর্ণ সন্তানদের মাধ্যমে। প্রতি বছরই অসংখ্য মুফতি, মুহাদ্দিস, মুবাল্লিগ, দায়ী, খতীব, ক্বারী তৈরি হচ্ছেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন দ্বীনি কাজ করছেন। বিশেষ করে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা ইমাম পেশায় নিয়োজিত আছেন। তাদের বৈদেশিক মুদ্রায় দেশ আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছে।
কওমি মদ্রাসাসমূহে শুধু আলেম তৈরি নয়, হাজার হাজার এতিম-মিসকিনকে ভরণ-পোষণ, বিনামূল্যে বই-পুস্তক দানসহ দ্বীনি শিক্ষা দিয়ে আদর্শ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। অথচ এসব দায়িত্ব ছিল সরকারের। জাতির আদর্শিক ও রাজনৈতিক শূণ্যতা পূরণে সত্যিকারের হিম্মত ও সাহস তাদের আছে। জাতি চাইলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় কওমি মাদ্রাসার কয়েক জন ছাত্র হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর সর্বশেষ জীবিত খলিফা হাফেজ্জি হুজুর রহমাতুল্লাহ আলাইহি কে জিজ্ঞাস করেছিল এই যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে এই যুদ্ধটা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি ? তখন হাফেজ্জি হুজুর রহমাতুল্লাহ আলাই উত্তর দিয়েছিলেন-এটা হচ্ছে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ। পাকিস্তানিরা হচ্ছে জালেম আর আমরা বাঙ্গালীরা হচ্ছি মজলুম। হাফেজ্জি হুজুরের এই কথা শুনে অনেক আলেম মুক্তিযুদ্ধে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রধান মুহাদ্দিস ছিলেন শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান (রহ:)। উনিও কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন হত্যা ও নারীধর্ষনের। পরবর্তীতে ইয়াহিয়া সরকার উনাকে জোর করে সৌদি-আরব পাঠিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর উনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন ও বঙ্গবন্ধু উনাকে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রধান খতীব হিসাবে নিযুক্ত করেন। উপমহাদেশে শিয়া মতবাদের বিলুপ্তিসাধনে শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান (রহ:) এর অনেক অবদান ছিল।
ব্রাক্ষণবাড়িয়া সদরের সবচেয়ে বড় ক্বওমী মাদ্রাসা জামিয়া ইউনিসিয়ার মুহতামিম ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম (রহ:) মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন। অনেক বড় বড় আলেম তার ফতোয়া শুনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। অনেক মুক্তিযুদ্ধাকে ফখরে বাঙ্গাল (রহ:) নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন।
পাবনার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান ছিলেন দেওবন্দ মাদ্রাসাথেকে দাওরা হাদিস পাস করা মাওলানা কাসিমুদ্দিন যিনি রাজাকার বাহিনীর হাতে নির্মম ভাবে শহীদ হয়েছিলেন। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা কেন্দ্রিক আলেমদের সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারপক্ষে অনেক ফতোয়া দিয়েছিলেন। ক্বওমী মাদ্রাসার আলেমরা শুধু ফতোয়াই দেন নি অনেক কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের কে মুক্তিযুদ্ধেও পাঠিয়ে ছিলেন।
যুদ্ধের কারনে পটিয়া মাদ্রাসা ছুটি ছিল। পটিয়া মাদ্রাসার দায়িত্বে ছিলেন মুহাদ্দেস আল্লামা দানেশ (রহ:)। তিনি মেজর জিয়াউর রহমান কে পটিয়া মাদ্রাসায় আমন্ত্রন জানান। মেজর জিয়াউর রহমান ১ সপ্তাহ পটিয়া মাদ্রাসায় ছিলেন। তখন ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পটিয়া মাদ্রাসার উপর জঙ্গি বিমান দিয়ে বোমা বর্ষন করা শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এতে মাদ্রাসার সম্মানিত মুহতামিম মুহাদ্দেস আল্লামা দানেশ (রহ:) ও মাদ্রাসার ক্বারী জেবুল হাসানের একজন মেহমান শহীদ হন এবং আরো অনেক সম্মানিত শিক্ষক গুরুতর আহত হন। মাদ্রাসার সম্মানিত শিক্ষক মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহর কাছে মুক্তিযুদ্ধারা এসে দোয়া নিয়ে যেতেন।
অতএব,আজো যারা ভাবছেন, মাদরাসায় চাঁদা না-দিয়ে অথবা শক্তি খাটিয়ে মাদরাসা বন্ধ করে দিবেন, তারা জেনে রাখুন! মাদরাসা বন্ধ হবে না,আপনি নিজেই বন্ধ হয়ে যাবেন, কেননা দ্বীনকে হেফাজত করার দায়িত্ব আল্লাহ নিজের হাতে রেখেছেন।
লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস।