ফারুক মঈনউদ্দীন::
ব্যাংকিং ব্যবস্থা যে একটিমাত্র বিষয়ের ওপর ভর করে গড়ে উঠেছিল, সেটি হচ্ছে আস্থা বা বিশ্বাস। অর্থাৎ মানুষ আদিযুগে নগদ অর্থকড়ি কিংবা সোনাদানা ঘরে জমিয়ে বা লুকিয়ে রাখার চেয়ে গির্জা বা মন্দিরের সিন্দুকে অধিকতর নিরাপদ মনে করত। কিন্তু কোনো আয় বা প্রতিদান ছাড়া এ রকম অলাভজনকভাবে সম্পদ জমিয়ে না রেখে তার বিপরীতে বিশ্বাসের সঙ্গে লাভ বা সুদ আয় শ্রেয়তর বিবেচিত হয়েছিল বলেই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের জন্ম। এই বিশ্বাসের কারণেই হয়তো ব্যাংকের ম্যানেজার কিংবা ক্যাশিয়াররাও এককালে ছোট শহরগুলোতে সম্মান ও সমীহের পাত্র ছিলেন।
তেমনিভাবে বিশ্বাসের কারণেই ব্যাংকগুলো তাদের কাছে গচ্ছিত অর্থ অন্যদের হাওলাত দিতে শুরু করে। আমানতকারীরা যেমন বিশ্বাস করত যে চাওয়ামাত্রই ব্যাংক তাদের গচ্ছিত টাকা ফেরত দেবে, তেমনি ব্যাংকও বিশ্বাস করত যে হাওলাতকারীরা সঠিক সময়ে তাদের ঋণের অর্থ কিংবা কিস্তি পরিশোধ করবে। তবে এই পারস্পরিক বিশ্বাসের মধ্যে কিছুটা হলেও পার্থক্য আছে। আমানতকারীরা কেবলই আস্থার ভিত্তিতে কোনো জামানত ছাড়াই ব্যাংকের কাছে টাকা গচ্ছিত রাখে, অন্যদিকে ব্যাংকগুলো বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঋণ দিলেও তার বিপরীতে সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে কিছু সম্পদ বন্ধক রাখার চেষ্টা করে। এর কারণ একটিই—ব্যাংক যে টাকা ঋণ হিসেবে দেয়, সেটি ব্যাংকের নিজস্ব টাকা নয়, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই এই জামানতের ব্যবস্থা।
ব্যাংকগুলোর কার্যপরিধি যত দিন পর্যন্ত কেবল আমানত গ্রহণ, ঋণদান এবং এসবের সঙ্গে সম্পর্কিত সেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তত দিন ব্যাংক এবং গ্রাহকের মধ্যকার পারস্পরিক আস্থা মোটামুটি অটুট ছিল বলা যায়। কিন্তু তবু এই আস্থায় চিড় ধরলে, কিংবা ব্যাংকগুলো নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে লোকসান দিতে থাকলে ব্যাংক লালবাতি জ্বালত। ভারতের স্বাধীনতার আগে ১৯১৩ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ছোট, মাঝারি আঞ্চলিক মিলিয়ে চার শতাধিক ব্যাংক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পর্যাপ্ত প্রবিধি এবং যথাযথ নজরদারির অভাবে এসব ব্যাংক বন্ধ হলেও ১৯৪৯ সালের ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যাক্ট জারি হওয়ার পরও ব্যাংক-পতন বন্ধ হয়নি। দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের পর থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত বছরে গড়ে ৪০টি ব্যাংক লালবাতি জ্বেলেছিল। এমনকি মহাপরাক্রমশালী খোদ আমেরিকায়ও ২০০৮-এর সাব-প্রাইম সংকটের জের ধরে কেবল ২০০৯ সালেই ছোট ও মাঝারি আয়তনের মোট ১৩৩টি ব্যাংকের পতন ঘটে, অথচ ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫।
ব্যাংকিং সেবার ক্রম জটিলতর বিবর্তন এবং বিশ্বের দেশে দেশে অর্থবাজারে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সংকট ও কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনের পর ব্যাংকিং সেবা ও পেশায় নৈতিকতার প্রশ্নটি জোরদারভাবে সামনে উঠে আসে। কারণ, নিকট অতীতের দুনিয়া কাঁপানো কমপক্ষে দুটি আর্থিক সংকটের (১৯৯৭-এর এশিয়ান আর্থিক সংকট এবং ২০০৮-এর সাব–প্রাইম সংকট) পর দেখা গেছে, এসবের সঙ্গে একশ্রেণির ব্যাংক এবং তাদের নীতিগর্হিত কার্যকলাপ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এ ছাড়া কেবল ব্যাংকবিশেষের অভ্যন্তরীণ অপকর্মের কারণেও ব্যাংকিং কর্মকােণ্ড নৈতিকতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এ রকম সর্বশেষ কেলেঙ্কারিটি ঘটেছে ওয়েলস ফারগো ব্যাংকে। ব্যাংকটির কর্মকর্তারা ব্যবসায়িক লক্ষ্য পূরণ করে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার জন্য গত পাঁচ বছরে প্রায় ১৫ লাখ অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে তাদের গ্রাহকদের নামে তাদের অজান্তে। এমনকি হিসাবগুলো চালু দেখানোর জন্য আগের হিসাব থেকে নতুন হিসাবে আংশিক অর্থও স্থানান্তর করে দিয়েছে। এ ছাড়া গ্রাহকদের না জানিয়ে তাদের নামে ক্রেডিট কার্ডের জন্য দরখাস্ত করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৫ হাজারের ওপর। এ ঘটনা উদ্ঘাটিত হলে ব্যাংকটিকে জরিমানা করা হয়েছে সাড়ে ১৮ কোটি ডলার, যার মধ্যে ৫০ লাখ ডলার ছিল গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ। ব্যাংকটি ইতিমধ্যে তাদের ৫ হাজার ৩০০ কর্মীকে বরখাস্ত করেছে, এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা যায়।
ওয়েলস ফারগো ব্যাংকে যখন এমন কাণ্ড চলছিল, তখন (২০১২) আরেক তদন্তে উদ্ঘাটিত হয়, লাইবর (এলআইবিওআর-লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফারড রেট: বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত স্বল্পমেয়াদি ঋণের ভিত্তিহার) রেট নিয়ে কারচুপি করে বার্কলেজ, ডয়চে ব্যাংক, ইউবিএস, র্যাবোব্যাংক, রয়্যাল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ডসহ কিছু নামী ব্যাংক কয়েক বছর ধরে নিজেরা লাভবান হয়েছে এবং তাদের খদ্দরদেরও অন্যায্য মুনাফা করতে সুযোগ করে দিয়েছে। এই লেখার স্বল্পপরিসরে এই কারচুপির বিস্তারিত বর্ণনা করার অবকাশ নেই। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়, শত শত ব্রোকার, ব্যবসায়ী, ব্যাংক কর্মকর্তা এবং কমপক্ষে দুটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে বরখাস্ত করা হয়। গত বছরের প্রথম দিকে ফাঁস হয়, এইচএসবিসির সুইস শাখা তার ধনাঢ্য গ্রাহকদের কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য কীভাবে পরামর্শকের ভূমিকায় নিয়োজিত ছিল। শ দেড়েক গ্রাহকের অপরাধলব্ধ অর্থ জমা রাখার অভিযোগও বেরিয়ে আসে তাদের বিরুদ্ধে। আমাদের দেশের সাড়াজাগানো হল–মার্ক কিংবা বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যাংকিং কেলেঙ্কারির কথা নতুনভাবে বলার প্রয়োজন নেই। দেশ ও বিদেশের চমকপ্রদ এ–জাতীয় ঘটনা দিয়ে এই তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়, কিন্তু তার প্রয়োজন নেই, কেবল কয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ট।
আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর ভর করে যে ব্যাংকিং ব্যবসা গড়ে উঠেছিল, এ–জাতীয় ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে সেই ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতার বিষয়টিকে কেউ কেউ বিরোধাভাস বলে উল্লেখ করছেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের আমন্ত্রণে নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতায় ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর দুভুরি সুব্বারাও Oxymoron শব্দটি ব্যবহার করে বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে বর্তমান ব্যাংকিং এবং নৈতিকতার বিষয়টি যে পরস্পরবিরোধী, সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। ব্যাংকিংও যে একধরনের ব্যবসা, এটি যেমন সত্য, তেমনি ব্যাংক যে অন্যের আমানত নিয়ে ব্যবসা করে, সেটিও অনস্বীকার্য। ঠিক এ কারণে অন্য ব্যবসা–প্রয়াসের চেয়ে ব্যাংকের কাছ থেকে মানুষ অধিকতর নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করে। মূল দায়িত্ব বিস্মৃত হয়ে ব্যাংকগুলো যখন শেয়ারবাজারের মতো একটা ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করতে বেশি উৎসাহী হয়ে বিপর্যয় ডেকে আনে, সেটিকেও নৈতিকতার পরিপন্থী বলে চিহ্নিত করা হয়। ব্যাংকগুলোই যে ১৯২৯ সালে আমেরিকার শেয়ারবাজারের মহা ধসের মূল হোতা, সেটি উপলব্ধি করে এই ঝুঁকিপূর্ণ খেলা থেকে ব্যাংকিং খাতকে দূরে রাখার উদ্দেশ্যে ১৯৩৩ সালে কার্যকর করা হয়েছিল গ্লাস-স্টিগাল অ্যাক্ট, যা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মধ্যে সুস্পষ্ট ভেদরেখা টেনে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৯ সালে এই আইন রদ করে ব্যাংকের নিজস্ব আলাদা ব্রোকারেজ এবং ইনভেস্টমেন্ট হাউস গঠন করার নতুন পদ্ধতি চালু করা হয়। ব্যাংকের মালিকানাধীন হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকের সংবিধিবদ্ধ একটা ভেদরেখা তৈরি করা হয়, যাতে ব্যাংকগুলো সরাসরি শেয়ার ব্যবসায় জড়াতে না পারে।
কিন্তু ব্যাংকিং এবং নৈতিকতার বিষয়টিকে বিরোধাভাসী কিংবা পরস্পরবিরোধী বলার মধ্যেও সম্পূর্ণ সত্য নেই। কারণ, এই আপাতনৈতিকতা–বিরোধী কর্মের জন্য কেবল আর্থ খাতকে দায়ী করা সংগত নয়। মূলত নৈতিকতা–বিগর্হিত কাজের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং ব্যাংকারদের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমারেখা নির্ধারণ করা উচিত। প্রথাগত ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে কেবল উচ্চবিত্ত মুষ্টিমেয় গ্রহীতার মধ্যে ঋণসুবিধা সীমিত রাখা, সহায়ক জামানতবিহীন সাধারণ মানুষ এবং দরিদ্রদের জন্য ঋণ গ্রহণের সুযোগ না রাখা, মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকি গ্রহণ করে ব্যাংককে বিপদগ্রস্ত করা কিংবা দেশ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর কোনো উদ্যোগে ঋণসুবিধা দেওয়া—এসবকেই ব্যাংকিং খাতের অনৈতিক কর্ম বলে চিহ্নিত করা যায়। আবার ব্যাংক কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত অনৈতিক কর্ম এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপ এড়াতে না পেরে অনৈতিকতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া—এসবের মধ্যেও পার্থক্য নির্ণয় করা উচিত। তবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি এই আলোচনার আওতাভুক্ত নয়।
ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতা নিশ্চিত করার বিষয়টির সুরাহা করা দুঃসাধ্য বলেই হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান ‘মানবিক ব্যাংকিং’ বলে একটি ধারণা চালু করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। মানবিক ব্যাংকিং বলতে যে কেবল সামাজিক দায়বদ্ধতার অধীনে দান-খয়রাত কিংবা রাজনৈতিক নির্দেশে আদায়–অযোগ্য কৃষিঋণ বিতরণ বোঝায় তা নয়, স্বল্প খরচে সাধারণ বঞ্চিত অবহেলিত মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়াই যে মানবিক ব্যাংকিং, সেটিই নিশ্চিত করার প্রয়াস এই উদ্যোগ।
সুব্বারাও তাঁর ভাষণে বলেন, ‘…আর্থ খাতের লোকজন সহজাতভাবে অন্যদের চেয়ে কম বা বেশি নীতিপরায়ণ নন। কিন্তু এই খাতের প্রণোদনা কাঠামোটি এমনই যে এটি অনৈতিক আচরণকে কেবল অনুমোদনই করে না, এমনকি উৎসাহও জোগায়। তবে এমন পরিস্থিতি অনিবার্য নয়, এটিকে শুদ্ধ করা যায়। নৈতিক আচরণের প্রতি আর্থ খাতের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা সম্ভব যদি [ব্যবসা] প্রতিষ্ঠান, আর্থিক খাত এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা—এই তিনটি মহল স্থির সংকল্পবদ্ধ হয়।’
ব্যাংকিংয়ে নৈতিকতার বিষয়টিকে পরস্পরবিরোধী বলে যে ধারণাটি প্রচারিত হচ্ছে, তা দূর করার জন্য ব্যাংকগুলোকে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে, কেবল মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত করার মানসিকতা পরিহার করতে হবে, কার্যক্রমের সব পর্যায়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে, স্বল্প মেয়াদে মুনাফার লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেকোনো ধরনের ঝুঁকি নেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, ব্যাংক যেমন কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়, তেমনি জনগণ তথা সাধারণ আমানতকারীদের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতি লক্ষ রেখে দেশ, সমাজ ও অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য নৈতিক ব্যবসা পরিচালনা করাই ব্যাংকের দায়িত্ব। আর এ কারণেই অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় ব্যাংকের ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট কঠোর ও নিবিড়।
লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com