শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ২:০৩
Home / প্রতিদিন / ইসলামী ফিকহের নবসম্পাদন : প্রেক্ষিত একুশশতক (৩য় পর্ব)

ইসলামী ফিকহের নবসম্পাদন : প্রেক্ষিত একুশশতক (৩য় পর্ব)

মুসা আল হাফিজমুসা আল হাফিজ ::

ইসলামী ফিকাহ ও সাহাবায়ে কেরাম: নসসমূহের নিগূঢ় তত্ত্ব ও তাৎপর্যজ্ঞানে সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন স্বচ্ছ, সুস্পষ্ট ও সবচেয়ে অগ্রবর্তী। তাদের চোখের সম্মুখে কুরআনে কারীম নাযিল হয়েছে এবং রাসূলপাক সা. আয়াতসমূহের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন।

ইসলামী জ্ঞানের প্রতিটি শাখার গোড়াপত্তন তাদের হাতে। এই জ্ঞানের মর্যাদা ও সারসত্তা তাদের চিন্তা চেতনায় সর্বোচ্ছ গুরুত্বের আসন পেয়েছিল। এর উৎস স্বয়ং রাব্বুল আলামীন- এই উপলব্ধির তীব্রতা, প্রচন্ডতা ও ওজস্বিতায় তাদের সত্ত্বা ছিল দ্রবীভূত, অস্তিত্ব ছিল প্রতিনিয়ত জাগ্রত। যার ফলে জ্ঞানের প্রতিটি বিষয়কে তারা গুরুত্ব দিয়েছেন সর্বাংশে, পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও সততার সাথে। অতএব তাদের জ্ঞানজিজ্ঞাসাগুলোর জবাব ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়েছে। তারা যে প্রশ্নগুলো নবীজির কাছে করেছেন এর উত্তরে আয়াতে কুরআনী নাযিল হয়েছে। অতএব এটাই ছিল সবচেয়ে সমীচিন যে, এই মুবারক জামাতের মাধ্যমই নসসমূহের ইল্লত নির্গতকরণ একটি কাঠামো পাবে। আর এ কাজের পথ ও পদ্ধতি সমূহের তাত্ত্বিক বুনিয়াদ তারাই গঠন করবেন। হলোও তাই। দেখা গেলো সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হাকাইক ও দাকাইকের ক্ষেত্রে গভীরতার অধিকারী, ফেকাহতফিদ্দীনে বুৎপত্তিসম্পন্নদের একটি ‘নফর’ ফিকহে ইসলামীর সাধনায় আত্মনিয়োগ করলেন। এ কাজে সবচেয়ে অগ্রবর্তী ছিলেন হযরত উমর রা.। তার সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলতেন যে- ‘সমস্ত আরবের ইলম এক পাল্লায় আর উমরের ইলম এক পাল্লায় রাখা  হলে ভারী হবে উমরের পাল্লাই’।

সারা বিশ্বে ইলমে ফেকাহের প্রচলিত ভাবধারাসমূহের উৎসমূলে উমর রা. রয়েছেন। সেই সময় ইলমে ফেকাহ ছিল প্রত্যেকের জীবনের অপরিহার্য দিক। ফলতঃ ইসলামী জ্ঞানের কেন্দ্রসমূহে ফিকাহের চর্চায় সমুদ্রতুল্য ফেকাহতের অধিকারী একেক সাহাবাকে কেন্দ্র করে গবেষণা ও পর্যালোচনার মাহফিল জমে উঠলো। মক্কা শরীফের শায়খ ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.। মদীনা শরীফে হযরত যায়েদ বিন সাবিত রা.ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.। কুফায় হযরত আলী রা. ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ও আবু মুসা আশয়ারী রা.। সিরিয়ায় হযরত আবুদ দারদা রা. ও হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. প্রমুখের মাধ্যমে ইলমে ফিকাহ এর দেহ গঠন ও সত্ত্বার স্ফূরণ। যদিও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বহু অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি সত্ত্বেও জটিল বিষয়সমূহ নিয়ে ইজতেহাদ করতেন মাত্র ছয়জন। তারা হলেন- হযরত উমর রা., হযরত আলী রা., আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., উবাই ইবনে কাব রা., যায়েদ ইবনে সাবিত রা. এবং হযরত আবু মুসা আশয়ারী রা.। মুহাদ্দীসগণের সর্ববাদী সম্মত রায় যে এদের মধ্যে সেরা উমর রা.,আলী রা.।

সাহাবায়ে কেরামের ইজতেহাদ ছিলো। বুখারীর ভাষ্যকার কাস্তালানী রাহ. দাদার উত্তরাধিকারী সম্বন্ধে লিখেন- হযরত উমর রা. এ মাসআলা সম্পর্কে দীর্ঘদিন গবেষণা করে প্রায় ১০০ টি সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেন। কুরআনের কোনো আয়াতের মাসআলায় সন্দেহ দেখা দিলে রাসূলের সা. নিকট উত্তমরূপে বুঝে নিতেন। যতক্ষণ পুরোপুরি না বুঝলেন, ততক্ষণ প্রশ্ন করতে থাকতেন। এরূপ করা আর কারো দ্বারা সম্ভব হতো না। ফারায়েযের জটিল মাসআলা সম্পর্কে তিনি এতো জিজ্ঞাসা করেন যে, রাসূল সা. বলেন উমর সূরা নিসার শেষ আয়াতটি তোমার জন্য যথেষ্ট হবে বলে বিশ্বাস। কিন্তু সেটা ছিল সুশৃঙ্খল, সমন্বয়ধর্মী ও সুচিন্তাপ্রসূত। হযরত উমর রা. এর যুগে মুজতাহীদের সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পায়। সেই সময়ে রোম পারস্য জয়ের ফলে দুটি ভিন্নধর্মী সভ্যতার সাথে ইসলামের তাখাল্লুতের প্রেক্ষিতে নতুন নতুন প্রশ্ন ও পরিস্থিতি দেখা দেয়। শরীয়তের আলোকে নতুন পরিস্থিতিকে ঢেলে সাজাবার দরকার পড়েছিল এবং নবউদ্ভুত বিষয়াবলী সম্পর্কে ইজতেহাদ হয়ে উঠেছিল অপরিহার্য। হযরত উমর রা. এই সময়ে পরিষদভিত্তিক ইজতেহাদের ব্যবস্থা করেন এবং তার মজলিসে শূরার প্রত্যেক সদস্য ছিলেন মুজতাহিদ।পরিষদভিত্তিক পর্যালোচনার মাধ্যমে মাসআলার সমাধান হতো। আল্লামা বালাজুরী রাহ. ‘কিতাবুল আশরাফে’ লিখেছেন- হযরত উমর রা. কোন মাসআলায় সাহাবীদের অনুমোদন ব্যতিরেখে মীমাংসা করেননি। সাহাবায়ে কেরাম নসসমূূহের ইল্লত নির্ণয় করে সমাধান পেশ করতেন। যে সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সা. রাসূল হিসেবে স্পষ্ট কোন সিদ্ধান্ত পেশ করেননি, গবেষণার দ্বারা সেগুলোর স্থান-কাল পাত্রভেদে প্রয়োজনানুরূপ নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহনে সেই পরিষদ সচেষ্ট ছিল। সেই পরিষদ বহু নতুন বিষয়ে ইজতেহাদ করেছে। বিশ্বস্ত উপায়ে বর্র্ণিত এ রকম ইজতিহাদী সমাধানের সংখ্যা একহাজারের চেয়েও বেশি। এর মধ্যে একহাজার মাসআলা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ও সুষ্টভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যে, চার মাযহাবের ইমামগণ ঐকমত সহকারে তা গ্রহণ করেছেন। মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবায় এই মাসআলাগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এগুলোয় সাহায্যে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ফারুকী ফিকাহের একটি পৃথক পুস্তিকা সংকলন করে স্বীয় কিতাব ‘ইযালাতুল খিফার’ পরিশিষ্টে সংযোজন করেছেন। ‘হুযযাতুল্লাহিল বালিগায়’ তিনি লিখেছেন- ‘হযরত উমরের রা. নীতি ছিলো তিনি সাহাবাদের সাথে প্রত্যেক মাসআলা নিয়েই পরামর্শ ও বিতর্ক করতেন। সন্দেহাতীতভাবে যে সিদ্ধান্ত গৃহিত হতো তাই ফতুয়া আকারে প্রচার করা হতো। ছোট থেকে ছোট কোনো বিষয়ও পরিষদভিত্তিক ইজতিহাদের বিষয়বস্তু হতে পারতো। এ নিয়ে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত পর্যন্ত বিতর্ক বিলম্বিত হতে পারতো’। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বায়হাকীর বর্ণনাকে আনা যায়। তিনি লিখেছেন- ‘যানাবাতের গোসলের বিশেষ একটি সুরত সম্পর্কে সাহাবীদের মধ্যে মতভেদ ছিলো উমর রা. মুহাজির ও আনসারদের সকলকে সমবেত করে বিষয়টি উত্থাপন করলেন। সাহাবাদের প্রায় সকলেই একটি সিদ্ধান্তে একমত হলেন। একমাত্র আলী ও মুয়াজ রা. এর বিরোধিতা করলেন। হযরত উমর রা. তখন দাঁড়িয়ে বললেন- আপনারা বদরের মুজাহিদ ও বিশিষ্ট সাহাবী। আপনাদের মধ্যেই এখতেলাফ থাকলে পরবর্তি যুগের অবস্থা কি হবে। অনন্তর সকলে মিলে বিষয়টি উম্মুল মুমিনীনের উপর ছেড়ে দিলেন । তাদের সিদ্ধান্তের উপরই রায় গৃহিত হলো।

অনুরূপভাবে জানাযার তাকবীর সম্পর্কে মতভেদ দেখা দিলে সাহাবাদের সম্মেলন ডাকা হলো। অবশেষে সকলে বললেন যে রাসূল সা. কর্তৃক পঠিত সর্বশেষ জানাযা অনুযায়ী মীমাংসা হবে। অনুসন্ধানে জানা গেলো শেষ জানাযার তিনি চার তাকবীর বলেছিলেন। এইভাবে ব্যাপক পর্যালোচনা সত্যিকারে নীতিমালা ও ঐকবদ্ধ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেই ইজতিহাদের চর্চা হয়েছিল। তবে একাদশ হিজরী থেকে সূচীত হয়ে চল্লিশ হিজরী পর্যন্ত সাহাবায়ে কেরামের ইজতিহাদের এ সময়কালে কোনো মাসআলায় সাহাবায়ে কেরামের সম্মিলীত কোনো সিদ্ধান্ত না থাকলে মুজতাহিদে সাহাবায়ে কেরাম সে মাসআলায় হাদীসের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত মতামত পেশ করতেন। যা পরে কিয়াসের ভিত্তিরূপে গৃহিত হয়। একচল্লিশ হিজরী তথা মুয়াবিয়া রা. এর শাসনামল থেকে শুরু করে হিজরী প্রথম শতকের শেষ সময় পর্যন্ত ফিকহে ইসলামের তৃতীয় যুগ। এ সময় বড় বড় সাহাবারা দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেছেন। এবং ইসলামী জাহান ফিকাহ সংকলনের প্রয়োজনীয়তাকে খুবই অনুভব করলেন। কারণ জীবিত সাহাবায়ে কেরাম তখন দুনিয়ার প্রান্তিক দিগন্তে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের নিয়ে আগের মতো পরামর্শভিত্তিক ইজতিহাদ সম্ভব হচ্ছিলোনা। একেক জায়গায় একেক সমস্যা ছিলো। সাহাবায়ে কেরামও এগুলোর সমাধান দিলেন নিজ নিজ ইজতিহাদ মতো। ফলে একজন থেকে আরেকজনের সমাধান ভিন্নতর হতে থাকলো। এ অবস্থায় সাহাবীরাও একদিকে ধারাবাহিকভাবে বিদায় হয়ে যাচ্ছিলেন। ৫৭ হিজরীতে মদীনায় হযরত আয়শা রা.। ৭৩ হিজরীতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.। ৫৭ হিজরীতে হযরত আবু হুরায়রা রা.এর ইন্তেকালের পর মদীনায় ইজতিহাদ করতেন তাবেয়ী বুজুর্গগণ। যেমন- হযরত সাইদ ইবনুল মুসাইয়িব রাহ. (ইন্তেকাল ৯৪ হিজরী)। আবু বকর ইবনে আব্দুর রহমান রাহ. (ইন্তেকাল ৯৪ হিজরী)। ওরওয়া ইবনে যুবাইর আসলামী রাহ. (ইন্তেকাল ৯৪ হিজরী)। ওবায়দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ রাহ. (ইন্তেকাল ৯৮ হিজরী)। সালিম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.। (ইন্তেকাল ১০৬ হিজরী)। সুলাইমান ইবনে ইয়াসির রাহ. (ইন্তেকাল ১০৭ হিজরী)। কাসিম ইবনে মুহাম্মদ আবু বাকর রাহ. (ইন্তেকাল ১০৬ হিজরী)। অপরদিকে মক্কা মুকাররমায় ৬৮ হিজরীতে রঈসুল মুফাসিসরীন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর ইন্তেকালের পরে মুজাহিদ ইবনে যুবায়ের রা. (ইন্তেকাল ১০৩ হিজরী)। ইকরিমা রা. (ইন্তেকাল ১০৭ হিজরী)। আতা ইবনে আবু রাবা রা. (ইন্তেকাল ১১৪ হিজরী)। প্রমুখ ইজতিহাদের ধারা অব্যাহত রেখে চলছিলেন। বসরায় আনাস ইবনে মালিক আনসারী রা. ৯৩ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। মিসরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. ৬৫ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। পরে তাবেয়ী ফকীহরা ফতুয়া দান ও বিধান রূপান্তরে ধর্মীয় সমাধান উপস্থাপন করতেন। এ সময়কালের হযরত উমর রা. এর পরিষদভিত্তিক ইজতিহাদের কর্মপদ্ধতি পরবর্তীতে আবু হানিফা রাহ. অনুসরণ করেন এবং পুরোটাই পরিষদভিত্তিক ইজতিহাদের উপর হানাফী ফিকাহ স্থাপন করেন।

ইল্লত বুঝার পদ্ধতি: আপন জ্ঞানমণ্ডল, বিবেক ও চিন্তাশক্তি কুরআন হাদীসের আহকামের ইল্লত বুঝতে এগুলো সহায়ক হলেও এগুলোকেই অবলম্বন করে ইল্লত বের করা যায় না। এতে হিতে বিপরীত হয়। কাবার যাত্রী তুর্কিস্থানের দিগন্তে নিখোঁজ হয়ে যায়।

ইসলাম যদি মানুষের নিজস্ব বোধ বুদ্ধির উপর ইল্লত বের করার দায়িত্ব দিয়ে দিতো, তাহলে ইসলামী ফিকাহের পরিণতি হতো সেইসব আইন কানুনের মতো, মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত হওয়ার কারণে যেগুলো কমিউনিজমের মতো যাদুঘরের অলংকার কিংবা গণতন্ত্রের মতো পৃথিবীতে ব্যর্থতার মহড়া প্রদর্শন করছে। ইসলাম এ জন্যে এতটুকু ফাঁক রাখেনি যে, কুরআন হাদীসের উপর কেউ চাকুর কসরত করবে এবং মনগড়া তাসাররুফের মাধ্যমে যাচ্ছেতাই বিশ্লেষণের বাজার গরম করবে। কিন্তু তারপরও অনেকেই এমনটা করেছেন। করেছেন আর ব্যর্থতার তালিকা প্রলম্বিত করেছেন। করতে গিয়েছেন আর নিজের ফাঁদে পৈত্রিক পা দুটি খুইয়েছেন। কেউ কেউ ‘আকিমুস সালাহ’ এই আমরের হুকুমের ইল্লত সাব্যস্ত করেছেন চরিত্র সংশোধনকে। ফল দাঁড়িয়েছে তালীম বা শিক্ষা সুহবতের মাধ্যমে যখন চরিত্র সংশোধন হয়ে যায়, তখন তার জন্য নামাযের প্রয়োজনীয়তাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। ওযুর ইল্লত সাব্যস্ত করেছেন পরিচ্ছন্নতা অর্জনকে। ফল দাঁড়িয়েছে নিজেরা পরিচ্ছন্ন থাকলে ওযু করার আর প্রয়োজনীয়তা মনে করেননি। এভাবে দ্বীনের বিবিন্ন মনগড়া তাসাররুফের ফলে তাহরীফাত হয়ে দ্বীনের যে কাঠামো রূপ লাভ করে, তার মধ্যে ইসলাম থাকে না, সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম মাথা তুলে দাঁড়ায়। এ কারণে শরীয়তের নস থেকে ইল্লত বের করার তিনটি ধাপ নির্ধারিত । এগুলোর আাওতার ভেতর জ্ঞানমন্ডল, বিবেক ও চিন্তাশক্তির যৌক্তিক চর্চা ও সুগভীর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ধাপগুলো হচ্ছে তাখরীজে মানাত, তানকীহে মানাত, তাহকীকে মানাত। মুজতাহিদ সর্বপ্রথম নস এর মাঝে অনুসন্ধান চালিয়ে সংশ্লিষ্ট ইল্লত বের করবেন। এটি তানকীহে মানাত। এরপর নির্ণিত প্রকৃত কারণকে ভিত্তি বানিয়ে মাসআলা বের করা হবে। যেখানে নির্ণত প্রকৃত কারণ পাওয়া যাবে, সেখানেই নসে বর্ণিত হুকুম প্রয়োগ হবে। এটি তাহকীকে মানাত।

মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী দা. বা. লিখেছেন- ‘তাখরীজে মানাত করা সহজ। তাহকীকে মানাতও তত মুশকিল নয় । তবে তানকীহে মানাতের কাজ অতিশয় জটিল। মুজতাহিদদের মধ্যে যে মতবিরোধ হয়, তা সাধারণত তানকীহে মানাতের কারণেই হয়ে থাকে। এ বিষয়ে এক একজনের নীতিমালা এক এক রকম। হানাফী উলামায়ে কেরামের মতে ইল্লতটি ক্রিয়াশীল ও প্রভাবসৃষ্টিকারী হতে হবে। ক্রিয়াশীল হওয়া ছাড়া কোন ইল্লত গ্রহনযোগ্য নয়। ক্রিয়াশীল ও প্রভাবসৃষ্টিকারীর অর্থ হলো কুরআন হাদীস অথবা ইজমা দ্বারা কোন ইল্লতের প্রভাবসৃষ্টিকারী হওয়া প্রমানিত হতে হবে। যথা: শরীর থেকে নাপাকি বের হয়ে গড়িয়ে পড়া ওযু ভঙ্গের ইল্লত। কুরআন মজীদে এই ইল্লতের প্রভাব প্রকাশিত হয়েছে। ঘরের অন্দরে সর্বদা ঘুরাফিরা করা নাপাক না হওয়ার ইল্লত। যার প্রভাব হাদীসে অর্থাৎ বিড়ালের ঝুটার মাসআলায় প্রকাশিত।’ তবে শাফেয়ী ইমামদের মতে ইল্লতের প্রভাব সৃষ্টিকারী হওয়া জরুরী নয়, বরং মুজতাহিদকর্তৃক কোন বিষয় সম্পর্কে ইল্লত হওয়ার ধারণা পোষণই যথেষ্ট। প্রথম মতের ভিত্তিতে আমল করা হলে ভুলের আশংকা অতি ক্ষীণ। দ্বিতীয় মত অনুযায়ী আমলের ক্ষেত্রে মুজতাহিদের ধারণা ভুল হওয়া স্বাভাবিক।

ইসলাম সহজতার ধারক: মানুষের সাধ্যের বাইরে কোন বিধান শরীয়ত চাপিয়ে দেয়নি এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে উপকরণগুলো জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে শরীয়ত সেগুলোকে যথাসম্ভব বৈধতা দিতে চায়। ইসলামী শরীয়ত স্থান, কাল, পাত্রভেদ ও ভেদের মাত্রাকে মূল্যায়ন করে ও সবিশেষ গুরুত্ব দেয়। এ ভিত্তিতে মাসআলাসমূহকে প্রয়োজনে নুতনভাবে বিন্যাস করে ও পাল্টায়। এই প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতি ও মাসআলার পরিবর্তিত প্রয়োগ ইসলামী আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূূলনীতি। এর পাশাপাশি মানুষ যেহেতু বিভিন্ন শ্রেণী, বৈচিত্রময় সংস্কৃতি, বহুমুখী জীবনমান ও অবস্থানের ধারক, অতএব শরীয়ত সবার উপর সমান মাত্রায় বিষয়সমূহকে প্রত্যেক পরিস্থিতির জন্য আবশ্যক করেনি। বরং মানুষকে তার স্ব স্ব অবস্থানে রেখে নীতিমালা প্রয়োগ করেছে। শরীয়তের প্রকৃতি হলো ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের বুঝা হালকা করতে চান’ ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চাননা’ (সূরা: মায়েদা)। কুরআনের ঘোষণা ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না’ (সূরা: বাকারা)।

জটিলতা- তা যে কোন যুগেই দেখা দিক, সংকট- তা যে কোন প্রকৃতিতেই আত্মপ্রকাশ করুক ইসলাম এর সুরাহা করতে চায় সহজতা অবলম্বনের মাধ্যমে। যে কোন যুগে উদ্ভুত সংকটময় পরিস্থিতির কালোপযোগী সমাধান- এটাও এই সহজতার অংশ। এ কারণে উসূলে ফেকাহের অন্যতম এক মূূূলনীতি হলো-‘জটিলতা সহজীকরণ সৃষ্টি করে’। এই মূলনীতি কিয়ামত পর্যন্ত জটিল পরিস্থিতির সহজাত ও মানুষের পক্ষে অনুকুল সমাধান পেশ করবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহে দেখা দেয়া সংকট এ ভিত্তিতে মানবীয় সামর্থ ও স্বাভাবিকতার অনুকুলে সমাধান হয়েছে। যেমন দাঁড়িয়ে নামায পড়তে হয়, এটা অপরিহার্য । কিন্তু অতিশয় পীড়িত মানুষ, যে দাঁড়াতে পারছেনা, কিভাবে সে নামায আদায় করবে? পরিস্থিতিটি কঠিন। দাঁড়ানোর অপরিহার্যতা, যা নসের মাধ্যমে প্রমাণিত, এর উপর কঠোরতা করার সুযোগ ছিল। এমনও সম্ভব ছিল যে, দাঁড়ানো যেহেতু অপরিহার্য, অতএব এখন যেভাবে পারে নামায পড়ুক, পরে সুস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে কাযা করবে। কিন্তু শরীয়ত যেহেতু সহজতা চায়, এই উসূলের ভিত্তিতে পীড়িত মানুষের জন্যে প্রয়োজনে বসে, শুয়ে, ইশারায় যেভাবে সম্ভব, নামায পড়ার অনুমতি দেয়া হলো। ঠিক তেমনিভাবে খাদ্যাভাবে মৃত্যুমুখী মানুষের জন্যে জান বাচাঁনো পরিমাণ মৃত জন্তুর গোশত খাওয়ার বৈধতা এই উসূলের ভিত্তিতেই।

মহিলাদের অপবিত্রতাকালীন নামাযের কাযা পড়া দুস্কর, তাই এর কাযা মওকুফ এই উসূলের ভিত্তিতেই। শরীয়তের আরেকটি মূলনীতি হচ্ছে ক্ষেত্রভেদে হুকুমের পরিবর্তন। এটিও কিন্তু মানুষের সাধ্য ও পরিস্থিতির চাহিদাকে অগ্রাধিকার দানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রণীত। মুকিম অবস্থায় চার রাকাআত নামায পড়তে হয়, সফর অবস্থায় পড়তে হয় দু’রাকাত, নামাযের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতে এই বিভাজন মূলত উপরোক্ত উসূলের দাবিতে। ইসলামী ফিকাহের আরেকটি মূলনীতি হচ্ছে ‘ছাড় দেয়া’। শরীয়ত বহু জিনিষের ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত হুকুম প্রদান করা থেকে বিরত থেকেছে। যেন স্থান, কাল, পাত্রভেদে সেটার উপর আমল করা সম্ভব হয়। নবী করীম সা. ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য কিছু সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা তোমরা লঙ্ঘন করোনা এবং কতগুলো জিনিষ ফরয করে দিয়েছেন তা নষ্ট করো না। কতগুলো বস্তু হারাম করে দিয়েছেন তাতে লিপ্ত হয়ো না আর কতগুলো বিষয়ে চুপ রয়েছেন তোমাদের উপর সহজ করে দিতে, ভুলবশত নয়, সেগুলোর হুকুমের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করোনা। (দারে কুতনী)।

অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা স্বীয় গ্রন্থে যেগুলো হালাল করেছেন, সেগুলো হালাল, আর যেগুলো হারাম করেছেন সেগুলো হারাম। আর যেগুলো সম্পর্কে কোন হুকুম দেননি, বরং চুপ রয়েছেন সেগুলো তোমাদের জন্য ছাড়। সুতরাং তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত ছাড় গ্রহণ করো’। উপরোক্ত উসূলসমূহ যেহেতু সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য, অতএব পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উদ্ভাবিত নব নব উপকরণ এবং দেখা দেয়া নয়া নয়া পরিস্থিতি ও সংকটের ক্ষেত্রে উক্ত মূলনীতির ভিত্তিতে সমাধান পেশের দরজা উন্মুক্ত থাকা আবশ্যক। সেই দরজা শরীয়ত খোলা রেখেছে এবং নিত্য নতুন বিষয়ে সমাধান পেশের জন্য কিছু মূলনীতি প্রদান করেছে। যেমন: ইজমা, কিয়াস, ইস্তিহসান, মাসালিহে মুরসাল ইত্যাদি।

 আরও পড়ুন :

ইসলামী ফিকহের নবসম্পাদন : প্রেক্ষিত একুশশতক (১ম পর্ব)

ইসলামী ফিকহের নবসম্পাদন : প্রেক্ষিত একুশশতক (২য় পর্ব)

About Abul Kalam Azad

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...