প্যারিসের অনেক মসজিদের সামনেই এখন পুলিশের কড়া পাহারা। এমনকি যেসব পুরুষ মহিলা সেখানে নামাজ পড়তে আসেন, তাদেরকেও রাখা হচ্ছে নজরদারিতে।
এখন এসব মসজিদে বা নামাজ আদায়ের কক্ষগুলোর ব্যাপারে আরো স্বচ্ছতার দাবি উঠেছে। এই আহবান উঠেছে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতর থেকেই।
ফরাসি মুসলিম ধর্ম বিষয়ক কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আনওয়া কিবিবেশ বলছেন, এখন ফ্রান্সের মুসলিমরা গভীর পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। এসব মসজিদের তহবিল ব্যবস্থাপনা আর ইমাম নিয়োগের বিষয়টি তদারকির জন্য আলাদা একটি ফাউন্ডেশন স্থাপনেরও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
তিনি বলছেন, নতুন ফাউন্ডেশন ইমামদের যোগ্যতা আর অতীত যাচাই করে দেখবে, বিশেষ করে তারা কোন মতাদর্শের অনুসারী সেটি যাচাই করবে। তাদের জন্য একটি চার্টার নির্ধারণ করে দেবে, যা একটি খোলামেলা ইসলাম, সহনশীল ইসলাম, এমন ইসলামের জন্য কাজ করবে, যা ফরাসি মূল্যবোধকে সম্মান করতে পারবে।
গত বছরের শেষের দিকে প্যারিসে ভয়াবহ হামলার ঘটনার পর ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, যা এখনো বহাল রয়েছে। কিন্তু কথিত ইসলামিক স্টেটের নামে একাধিক হামলার ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর ।
ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সেই সবচেয়ে বেশি মুসলিমদের বাস এবং দেশটিতে আড়াই হাজারের বেশি মসজিদ রয়েছে। কিন্তু গতবছরের নভেম্বরে প্যারিসে ভয়াবহ হামলার পর থেকেই সেদেশের মসজিদগুলোর উপর নজরদারি শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।
বিদেশী অর্থায়নে পরিচালিত হয় এরকম কুড়িটির বেশি মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে, ফ্রান্সের মসজিদগুলোর তহবিল লেনদেন তদারকির জন্য একটি বিশেষ কাউন্সিল ঘোষণা করা হবে। যা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
এরপর বিদেশী অর্থায়নে পরিচালিত হয়, এমন কুড়িটির বেশি মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এরকম একটি মসজিদ উত্তর ফ্রান্সের জেনোভিলিয়ে শহরের এল হুদা মসজিদ।
প্যারিস এ্যাটাকের পর এখানে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ছুরি, নানা জিহাদি বই উদ্ধার করে। এরপরই জঙ্গিদের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এই মসজিদটি বন্ধ করে দেয়া হয়। যদিও কোন গ্রুপের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতা, তা এখনো জানানো হয়নি।
তবে মসজিদ বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ, যিনি এই মসজিদেই নিয়মিত নামাজ পড়তেন ।
তিনি বলছেন, কেন এটা বন্ধ করা হলো, সেটা সবাই জানতে চায়। আমরা যারা আশেপাশে কাজ করি, আমরা এখানে নামাজ পড়তে যেতে পারতাম। কিন্তু এখন আমরা সেটি আর পারি না। মুসলিম ধর্মবিশ্বাসের স্থান বন্ধ করে দেয়া কোন সমাধান হতে পারে না। বরং উল্টোভাবে, ইসলামের সঠিক বানী পৌঁছে দিতেই মসজিদগুলোকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সেই সবচেয়ে বেশি মুসলিমের বসবাস এবং দেশটিতে আড়াই হাজারের বেশি মসজিদ রয়েছে।
সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ জানতে পেরেছে, এর কুড়িটির বেশি মসজিদ বিদেশী সাহায্যে পরিচালিত হয়, মরক্কো, তুরস্ক, আলজেরিয়া বা সৌদি আরব থেকেই বেশি অনুদান আসে। বছরে ৬০ লাখের বেশি ইউরো এসব মসজিদে আসে, যার বেশিরভাগই ইমামদের বেতন হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যে ইমামদের নিয়োগ করাও হয় বিদেশ থেকেই। আর এই ক্ষেত্রেই কড়াকড়ি আরোপ করতে চায় ফ্রান্সের কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু এই কড়াকড়ি কি সন্ত্রাস দমনের সমাধান হবে নাকি নিছক রাজনৈতিক দেখানোপনা?
ইসলাম ভীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মারওয়ান মোহামেদ মনে করে, জঙ্গি হুমকি মোকাবেলায় এই উদ্যোগ কোন কাজে আসবে না।
তিনি বলছেন, বর্তমানে যেসব আইনকানুন আছে, সেগুলোর মাধ্যমেই কর্তৃপক্ষ যেকোনো সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে। কারণ ধর্মের বিষয়ে অন্ধ কোন আইন তো নেই। বরং শুধুমাত্র মুসলিম হিসাবে সনাক্ত করে, দাড়ি দেখে ব্যবস্থা নিলে সেটা ঠিক হবে না। উগ্রপন্থার কারণ মসজিদে নয়, সমাজের ভেতরে রয়েছে। কারণ মুসলিমদের নানাভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। আগে সমাজের ভেতরের সেসব বৈষম্য দূর করা দরকার।
সামনের বছর ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। ফ্রান্সে কথিত ইসলামিক স্টেটের নামে সাম্প্রতিক একাধিক হামলার ঘটনার পর এদেশের মুসলিমরা মনে করেন, নির্বাচনের সামনে তারা হয়তো আরো কোণঠাসা হয়ে পড়বেন। কারণ ডানপন্থীদের চাপে হয়তো সরকার আরো কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।
ফলে অনেকের আশংকা, জাতীয় নিরাপত্তার নাম করে হয়তো ফ্রান্সের মুসলিমদের উপর উপর বিধি নিষেধ হয়তো আরো বাড়বে, যা হয়তো ফ্রান্সকে ইসলামপন্থী উগ্রবাদীদের জন্য সহজ লক্ষ্য করে তুলতে পারে।
সৌজন্যে : বিবিসি বাংলা