আলী হাসান তৈয়ব : চলতি মাসের ৩ তারিখ (প্রথম বুধবার) আট কলামে বড় দুইটি হৃদয়স্পর্শী ছবি দিয়ে আমরা সবাইকে আহ্বান জানিয়েছিলাম বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে যেতে। এ কাজে মুসল্লিদের উদ্বুদ্ধ করতে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম দেশের সম্মানিত আলেম-ইমামদের। মুহতারাম ইমামদের কয়েকটি উদ্যোগে অংশগ্রহণের জন্য বিকাশ নম্বরও আমরা তুলে ধরেছিলাম এ পাতায়। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের সে আহ্বানে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। বন্যার্ত মানুষের পাশে ছুটে গেছে অনেক কাফেলা। ইমাম-আলেমরা নিজ নিজ মুসল্লিদের সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেছেন বন্যাপ্লাবিত এলাকায়।
বেশ কিছু কাফেলার মিডিয়া পার্টনার ছিল আলোকিত বাংলাদেশ। সব স্পটে স্থানীয় প্রশাসন জনপ্রনিধিদের আন্তরিক সহযোগিতায় দারুণ শৃঙ্খলা ও চমৎকার ব্যবস্থাপনায় সম্পন্ন হয় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। এমনি এক কাফেলায় গেল বৃহস্পতিবার আমিও গিয়েছিলাম বগুড়ার যমুনাতীরের সারিয়াকান্দি ও সোনাতলায়।
রাজধানীর কলাবাগান থানার কাঁঠালবাগান এলাকার ১০টি মসজিদের ইমাম-খতিবরা উদ্যোগ নেন বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়াবার। মুসল্লিদের উদ্বুদ্ধ করেন সাহায্যের হাত বাড়াতে। ব্যাপক সাড়া মেলে। তারা এর আগেও শীতকালে গরম বস্ত্র বিতরণ করেছেন। ত্রাণের ট্রাক আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১২ জনের কাফেলা নিয়ে আমরা রওনা দিই গাড়িতে। মাইক্রো ও হোন্ডায় চলে যাই দুর্গম চরে। যমুনার পেটে বিলীন হয়েছে বহু পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই। সহায়-সম্বলহীন অসংখ্য বনি আদম আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধের আশপাশে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় চেয়ারম্যান ও থানার এসআই। সাতবেকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে থামে আমাদের ত্রাণের ট্রাক। আগে থেকেই ত্রাণ নিতে অসংখ্য মানুষের সারি। নারী-শিশু-বৃদ্ধদের দীর্ঘ লাইন। ৬০০ পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হয় চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিড়াসহ ওষুধসামগ্রীর বড় প্যাকেট। একজন ইমাম নিজ থেকে বিতরণ করেন নগদ ৫০ হাজার টাকা।
মিরপুরের কয়েকজন ইমামও একই উদ্যোগ নিয়েছেন। কামরাঙ্গীরচর ও বারিধারার কয়েকজন ইমামও নিয়েছেন এমন উদ্যোগ। কাফেলা ছুটেছে এবং এখনও ছুটছে দুর্গত মানুষের উদ্দেশে। বড় আনন্দের কথা, ইমামরা এখন শুধু মসজিদেই মুসল্লিদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন না, জনকল্যাণমূলক সামাজিক কাজেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রকৃত অর্থে ইসলাম যে ইমামের কথা বলে, যে মসজিদের চিত্র তুলে ধরে ইসলামী ইতিহাসের সোনালি পাতাগুলো, তাতে মসজিদ মানে জনকল্যাণের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। ইমাম মানে জনকল্যাণের সবচেয়ে বড় উদ্যোক্তা। নবীজি (সা.) প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রে সামাজিক কল্যাণকর্মে মসজিদে নববিই ছিল কেন্দ্র। হাদিস ও সিরাতের গ্রন্থগুলোয় অসংখ্য তথ্য সংরক্ষিত আছে। মসজিদে নববিতে শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হতো না, আরও হতো শিক্ষাদীক্ষা, বিয়ে-শাদি, বিচার-আচার, দূতদের সঙ্গে সংলাপ, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সব কাজের পরামর্শ, অন্নহীনের অন্নের ব্যবস্থা, আবাসহীনের আবাসের ব্যবস্থা, বৃদ্ধ ও বিধবাদের আশ্রয়, এমনকি বন্দিদের কয়েদ করেও রাখা হতো মসজিদে। মসজিদে নববি প্রাঙ্গণে সুফফা নামে ইতিহাসখ্যাত স্থানটি ছিল মূলত দুস্থ, অনাথ ও এতিমদের শিক্ষালয় এবং আশ্রয়কেন্দ্র।
পুরো বিশ্বের বিপরীতে এক নবীজি (সা.) যে তাওহিদের অমীয় বাণী প্রচার করেছেন, আল্লাহর আমানত তথা ইসলামের শান্তির বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, বিশ্বের সব পরাশক্তির কাছে, তাতেও তিনি শিক্ষার সঙ্গে সেবাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। নবুয়ত লাভের আগে কৈশোরে তিনি সমাজসেবার জন্য হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠা করেন। যার প্রধান প্রতিজ্ঞাই ছিল অসহায়ের সাহায্য করা। বিশ্বস্ততা ও সমাজসেবার জন্যই তিনি নবী হওয়ার আগে মক্কার মোশরেকদের কাছে ‘আল-আমিন’ তথা মহাবিশ্বাসী হিসেবে আস্থা অর্জন করেছিলেন। নবুয়ত লাভকালে প্রথম অহিপ্রাপ্তির সময় জিবরাঈল (আ.) কে বিশালাকায় অবয়বে দেখে তিনি অত্যন্ত সন্ত্রস্ত হন। গায়ে জ্বর নিয়ে স্ত্রীর কাছে ছুটে যান। পুণ্যবতী জীবনসঙ্গীর উদ্দেশে বলেন, ‘আমি নিজের জীবনের আশঙ্কা করছি।’ খাদিজা (রা.) বলেন, ‘কখনোই নয়! আল্লাহর কসম, তিনি আপনাকে অপদস্থ করবেন না। আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, অভাবগ্রস্তের অভাব দূর করেন, দুস্থকে সহায়তা করেন, ঘোর সংকটেও সত্যের ওপর অটল থাকেন।’ (বোখারি)। মহানবী (সা.) এর পুরো নবুয়তকাল এবং ইসলামী খেলাফতের পুরো মেয়াদের ইতিহাসে মানবসেবা ও জনকল্যাণের অসংখ্য নজির ছড়িয়ে রয়েছে। অশান্তিভরা পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সে আদর্শ এবং আত্মত্যাগের সে শিক্ষাচর্চার কোনো বিকল্প নেই।
চলে গেছে সর্বগ্রাসী বন্যা। রেখে গেছে অন্তহীন দুর্ভোগ। দেশের উত্তর-দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে বন্যাদুর্গত ৩০ লাখের বেশি মানুষের অসহায়ত্ব বলে বোঝানোর মতো নয়। কারও ভিটেমাটি তলিয়ে গেছে। নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। কারও ভেসে গেছে ক্ষেতের ফসল, উঠানের শাকসবজি আর গোয়ালের গবাদি পশু। নেই কোনো অবলম্বন, আহার্য। সর্বশেষ এ সপ্তাহের দুইদিনের ভারিবর্ষণে দক্ষিণ বাংলার হাজার হাজার চিংড়িঘের প্লাবিত হয়েছে। লাখো মানুষের হাহাকারে আকাশ ভারি হয়ে উঠেছে। সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। ত্রাণমন্ত্রণালয় থেকে বিপুল ত্রাণ পাঠানো হয়েছে। তথাপি বিশাল চাহিদার তুলনায় তা ছিল অপর্যাপ্ত। প্রধানমন্ত্রী নিজে আহ্বান জানিয়েছেন, সবাইকে তাদের পাশে দাঁড়াতে। অনেকেই ত্রাণ নিয়ে ছুটে গেছেন। বন্যাপরবর্তী অবস্থা আরও করুণ। সহায়হীন মুহূর্তে তাদের পাশে দাঁড়ানো এখন আরও বেশি দরকার। সরকারের উচিত গৃহ-সম্বলহীন পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর দায়িত্বও অনেক। সব সামাজিক ও কল্যাণ সংস্থাগুলোর উচিত, দ্রুত দুর্গত মানুষের পাশে সাহায্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
সৌজন্যে : আলোকিত বাংলাদেশ