সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ : পৃথিবীতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত হিসাবে অমর হয়ে থাকে। যুগে যুগে দুনিয়াতে এমন কিছু আর্দশিক মানুষের জন্ম হয় যারা সত্য সুন্দর ন্যায়ের জন্য সমাজ দেশ রাষ্ট সীমানা সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লড়ে যান। তেমনি একজন আলেমের নাম মুফতি মাহমুদ। যিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পাকিস্তানের সভাপতি ও বিরোধী দলের নেতা ছিলেন।
যিনি পাকিস্থানের নাগরিক হওয়ার পরেও বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। ৭১এর উত্তাল মার্চে বিরোধী দলের এই নেতা ইয়াহিয়া-ভুট্টুর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর সাথে ঢাকাতে এসে বৈঠক করে বঙ্গবন্ধুর দাবির প্রতি প্রকাশ্য সাংবাদিকদের কাছে সমর্থন পেশ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে পূর্ব পাকিস্তানের দ্বায়িত্ব হস্তান্তরের আহব্বান জানান। নিজ দলের ঢাকার নেতাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা পক্ষে ও বঙ্গবন্ধুর সাথে কাজ করার নির্দেশ দেন।
পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির নেতা, তারেক ওয়াহিদ বাট লিখেছেন, পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মুফতি মাহমুদ সাহেবের বক্তব্য সব সময় বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে ছিল। ফলে সে সময় জামায়াতে ইসলামী ও পিপলস পার্টি মিলে মুফতি মাহমুদের পেশওয়ারস্থ অফিসে আক্রমণ করে। লেখকের এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় সিলেটের জকিগঞ্জের মাওলানা আব্দুস সালামের কথায়। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমি করাচি ইউসুফ বিননুরী মাদ্রাসার ছাত্র। একদিন মুফতি মাহমুদ সাহেব মাদ্রাসায় এলে তাঁকে এক নেতা শেখ মুজিব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, ‘গাদ্দারকে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁকে কি এখনো।হত্যা করা হয়নি? এ কথা শুনে মুফতি মাহমুদ সাহেব অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন, গাদ্দার কে? গাদ্দার কে? মুজিব গাদ্দার নয়, তিনি একজন সুন্নি মুসলমান। প্রত্যেক মুসলমানের জানমালের হেফাজত করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। (সূত্রঃ নিউ ওয়াল্ড ওয়ার্ডার ইসলাম আওর ইসলাম, তারিক ওয়াহিদ বার্ট)
.
মুফতি মাহমুদ (রহ.) ১৩ মার্চ এক বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় ইয়াহিয়া-ভূট্টোর নীতিকে ভুল আখ্যা দিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানানো প্রেসিডেন্টের অবশ্যই কর্তব্য। তিনিই পাকিস্থানের প্রথম কোন জাতীয় নেতা যিনি শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনের প্রতি সবাত্মক সমর্থন প্রদান করেন। (সূত্রঃ কাইদে জমিয়ত মুফতি মাহমুদ, আশফাক হাশেমী/ সাপ্তাহিক কওমী ডাইজেস্ট )
একাত্তরের যুদ্ধের শুরুতেই ২৩মার্চ পাকিস্তান শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তানে।এসে শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে কয়েক দফা একাধিক বৈঠক করেন পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সেক্রেটারী মুফতি মাহমুদ। প্রথম বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পরে হোটের ইন্টারকলে উভয়ে একাধিক বৈঠকে করেন । এসব বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের এই অকৃতিম বন্ধু মাওলানা বাংলাদেশের অধিকার আদায়ের দাবীকে সমর্থণ করে সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং আলাদা শায়াত্ব শাসনের পক্ষে কথা বলেন। একাত্তরের ১৩ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন দমনের জন্য ঔপনিবেশিক সরকার যে আদেশ জারি করেছিল, তার মোকাবিলায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিরোধী দলীয় নেতা মুফতি মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সামরিক আইন প্রত্যাহার, ২৫ মার্চের আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। এদিনই আলেম-ওলামাদের সংগঠন ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম’ পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে শীতলক্ষ্যায় লক্ষাধিক মানুষ দীর্ঘ নৌ-মিছিল করে স্বাধীনতা আন্দোলনকে এগিয়ে দেয়। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ, ৭ মার্চ ২০০৭ইং)
.
মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমারা বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকের পর মুফতি মাহমুদের সাথে বৈঠক করে বাংলাদেশ পাকিস্তান যুদ্ধের ব্যপারে জিজ্ঞাসা করলাম । তিনি তখন জমিয়তের নেতা কর্মিদের বললেন , পাকিস্তান শাসকদের বন্ধু এখন আমেরিকা। আমিরিকা যাদের বন্ধু তারা আমাদের শত্রু । তোমারা বাংলাদেশের পক্ষে লড়াই কর । তোমরা এদেশে থাকতে হবে। এদেশের পক্ষেই কাজ করে যাবে। শেখ সাহেবের আন্দোলনে শরিক হবে।” এর পর এদেশে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামই আলেমদের একমাত্র দল যা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। তাই বাকশালের সময় বঙ্গবন্ধু সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করলেও আলেমদের প্রতি শ্রদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধের পক্ষে কাজ করার কারনে জমিয়তকে নিষিদ্ধ করেন নি। (সূত্রঃআলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, শাকের হোসাইন শিবলী)
বঙ্গবন্ধু কোনোদিনই বাম রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবস্থানটা যখন বটবৃক্ষের মতো হয়ে গেলো তখন বামরা দলবেঁধে তাঁর ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একাত্তরে তিনি পাকিস্তানের জেলে বন্দি থাকতেই তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ, ড. কামাল হোসেন প্রমুখদের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু শেখ সাহেব জেল থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে ফেরার পর একদিন তাজ উদ্দিন আহমদকে ধমক দিয়ে বললেন- ‘তাজ উদ্দিন ঐ বেটি (ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী) যা বলেছে তুই চোখ বুজে মেনে নিলি, কী লিখেছে তা দেখে কি দস্তখত করেছিস? জিজ্ঞেসও করিস নাই কিসে দস্তখত দিচ্ছিস?’ (গিয়াস কামাল চৌধুরী, সাক্ষাৎকার, ইকরা-দ্বিতীয় সংখ্যা, মার্চ ২০০১, বার্মিংহাম, ইউকে)
.
‘একাত্তরে পাকিস্তান সরকার এবং তাঁর সহচর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের লোকেরা বঙ্গবন্ধুকে ইসলাম বিরোধী ভারতের দালাল প্রমাণের চেষ্টা করে। এর মূল কারণ, শেখ মুজিবুর রহমানকে ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারলে সাধারণ মানুষ রাজাকার, আল-বদর, আল- শামসে যাবে না। তাদের বক্তব্য কিছু সরলপ্রাণ মুসলমানের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও বেশিরভাগ মুসলিম জনতা তা প্রত্যাখান করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। পাকিস্তানের তৎকালিন বিশ্ববিখ্যাত আলেম মুফতি মাহমুদ (যিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ওল- পাকিস্তানের সেক্রেটারী ছিলেন) তখন শেখ মুজিবের পক্ষে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানে ইয়াহিয়া- ভূট্টোর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন।
পাকিস্তানীদের ২৫মার্চ গনহত্যার প্রতিবাদে তিনি লাহোরে বাংলাদেশের পক্ষে মুফতি মাহমুদ বিক্ষোভ করেন। তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হয়েও বাংলাদেশের ও মুক্তিযুদ্ধের অকৃতিম বন্ধু ছিলেন । যা ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে অমর হয়ে আছেন। কিন্তু হ্যায় আজ বিদেশি বন্ধুদের তালিকায় মুফতি মাহমুদ রহ. কোথায় ? (সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও উলামায়েকেরাম, সৈয়দ মবনু)
লেখক: চিকিৎসক,গবেষক, গ্রন্থপ্রণেতা