নাঈমা জান্নাত : মু‘জামে কাবীর–তাবরানী, মুস্তাদরাকে হাকীম প্রভৃতি হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত একটি শিক্ষামূলক ঘটনা। যা আমাদের চলার পথে পাথেয় যোগাবে।
হযরত রাবী‘আহ আসলামী (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমত করতাম। তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে অবগত হন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে একখণ্ড জমি দিলেন এবং (এর সংলগ্নে) আবু বকর (রা.)কে একখণ্ড জমি দিলেন। যাতে আমরা উভয়ে সেই জমির আয়ের দ্বারা উপকৃত হতে পারি।
সেই জমিদ্বয়ে খেজুরগাছের ফলন হলো। আমরা সাচ্ছন্দ্যের সাথে যার যার অংশের ফলন গ্রহণ করছিলাম।
কিন্তু সীমানার কিছুটা দিকভ্রমের কারণে একটি খেজুরের কাঁদিকে কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে মতবিরোধ হলো। আমি বললাম, এটা আমার হিস্যার মধ্যে পড়েছে। আবু বকর (রা.) বললেন, এটা আমার হিস্যার মধ্যে পড়েছে।
তখন এ নিয়ে আমার ও আবু বকর (রা.)-এর মধ্যে কিছুটা কথা কাটাকাটি হল। তখন আবু বকর (রা.) আমাকে এমন একটি শব্দ বললেন, যা বলাটা তিনি অপছন্দ করলেন এবং এতে তিনি অনুতপ্ত হলেন।
তখন তিনি বললেন, “হে রাবী‘আহ! আপনি আমাকে এর অনুরূপ বলে প্রতিউত্তর করুন। যাতে এটা সমান সমান হয়ে বদলা হয়ে যায়।” আমি বললাম, “আমি তা করবো না।”
আবু বকর (রা.) বললেন, “আপনি অবশ্যই এটা বলবেন, অন্যথায় আমি আপনার বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট অনুযোগ করবো।”
আমি বললাম, “এটা আমি করবো না।”
তখন আবু বকর (রা.) জমি ফেলে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট চললেন। আমি তার পিছে পিছে যেতে লাগলাম।
সে সময় আমার আসলাম গোত্রীয় কিছু লোক আমার সাহায্যের জন্য এলেন। তারা আমাকে বললেন, আল্লাহ আবু বকরকে রহম করুন, তিনি কী নিয়ে আপনার বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট অনুযোগ করবেন? অথচ তিনিই আপনাকে যা বলার বললেন! আমি তাদেরকে বললাম, আপনারা কি জানেন, কার ব্যাপারে বলছেন? তিনি আবু বকর সিদ্দীক (রা.)–যিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের সময় তাঁর সাথী হয়ে গুহায় আশ্রয় গ্রহণকারী দু’জনের একজন রূপে ধন্য হয়েছেন। আর তিনি মুসলমানদের মধ্যে প্রবীণ। খবরদার! তিনি যেন আপনাদেরকে আমার সাথে সাহায্য করতে না দেখেন। অন্যথায় এতে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট তাও বলবেন। তাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর অসন্তুষ্টির কারণে অসন্তুষ্ট হবেন। আর তাদের দু’জনের অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহ তা‘আলা অসন্তুষ্ট হবেন। তখন রাবী‘আহ ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা বললেন, তাহলে আমাদেরকে কী করতে বলেন? তিনি বললেন, আপনারা ফিরে যান।
ইতোমধ্যে আবু বকর (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট পৌঁছলেন। আর আমি একাই তাঁর পিছনে পিছনে গেলাম। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট গিয়ে পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন।
তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার দিকে মাথা উঁচু করে বললেন, “হে রাবী‘আহ! সিদ্দীকের সাথে তোমার কী হয়েছে?
আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! এরূপ এরূপ ঘটেছে। অতঃপর তিনি আমাকে এমন একটি শব্দ বলেছেন, যা বলাটা তিনি অপছন্দ করেছেন। তখন তিনি আমাকে বললেন, আমি আপনাকে যা বলেছি, আপনি আমাকে তা বলুন। যাতে সেটার শোধ হয়ে যায়। তখন আমি তা বলতে অস্বীকার করেছি।
তা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, “ঠিকই করেছো। তুমি সেরূপ বলবে না। তবে তুমি বলো, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন হে আবু বকর।”
তখন আমি বললাম, “আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন হে আবু বকর!” তা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, সুন্দর হয়েছে।
সে সময় আবু বকর সিদ্দীক (রা.) কেঁদে ফেললেন। কান্না করতে করতে তিনি ফিরে গেলেন।
(প্রমাণপঞ্জি : মু‘জামে কাবীর–তাবরানী, হাদীস নং ২৬৪২/
মুস্তাদরাকে হাকীম, হাদীস নং ৪৪৪০ প্রভৃতি)
সুবহানাল্লাহ! কেমন তাক্বওয়ার অধিকারী ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.)। ভুলে একটি শব্দ মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে–যাকে প্রতিপক্ষ কিছু মনে করেনি, কিন্তু সেটার কারণেও পরকালে যাতে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে না হয়, তাই তার ফয়সালা দুনিয়াতেই যেন হয়ে যায়, সে জন্য কত কী না করলেন!
অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহান তা‘লীম দ্বারা এ শিক্ষা পেলাম যে, কাউকে কোনভাবে কষ্ট দেয়ার পর তিনি যদি অনুতপ্ত হন, তখন তার প্রতিশোধ না নিয়ে তাকে ক্ষমা করে দেয়া উচিত। আর তখন তার জন্য ক্ষমার উদারতা দেখিয়ে এভাবে দু‘আ করা উচিত যে, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দিন। এটা মহানুভবতার পরিচায়ক।
সূত্র : মাসিক আদর্শ নারী