নূরুল্লাহ মারুফ : শহরের অলিতে গলিতে যে হাজার হাজার মাদরাসা আছে হচ্ছে হবে- এর সঠিক হিসেব কি আদৌ কারো কাছে আছে? এক রুমের তাহফিজুল কুরআন, দুই রুমের তাখাসসুস, তিন রুমের জামিয়া, চার রুমের মডেল ইনস্টিটিউটের কোনও হিসাব কি দিতে পারবে কেউ? পারার কথা না। প্রতিদিন রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইক লাগিয়ে, বাসে বাসে উঠে মাদরাসার নামে যে চাঁদা কালেকশন হয় সেগুলোর হিসেব কী? কাদের অনুমোদনে হচ্ছে এই মাদরাসাগুলো? বুঝলাম, সরকারের কাছে আমরা কওমির নিয়ন্ত্রণ দিবো না, দিতে চাই না। কিন্তু তার মানে কি এই যে, ছাগলের চার নাম্বার বাচ্চার মতো ছেড়ে রাখবো আমরা এগুলোকে? যার যখন যেখানে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে মাদরাসা খুলে বসে থাকবে। তারপর তার এক রুমের জামিয়ায় লাওয়াতাতের ঘটনা ঘটবে। মামলা হবে। রিপোর্ট হবে। রগরগে বর্ণনা হবে। মাদরাসা বন্ধ করতে তেড়ে আসবে এলাকাবাসী। আর আমরা বসে বসে ফেইসবুকে ঝড় তুলবো। বক্তারা মাইকে গলা ফাটাবে। ‘এগুলা ষড়যন্ত্র এগুলা ষড়যন্ত্র’ বলে একযোগে চিল্লাতে থাকবো আমরা সবাই। এভাবে আর কতকালরে ভাই?
স্বীকৃতির প্রসঙ্গ আসলেই অতি আবশ্যকীয়ভাবে যে প্রশ্নটি বারবার চলে আসে এবং আসবে তা হলো স্বকীয়তা ও নিয়ন্ত্রণ। যে কোনও মাদরাসার যে কোনও ছাত্রকে যদি আজকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, সে কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি চায় কিনা? তাহলে সেও বোধকরি চোখ বন্ধ করে এ দুটি শব্দ আওড়াতে থাকবে। এ আওড়ানো’টা অবশ্য আজকে থেকে নয়। এর শুরু সেই যে ২০০৬-এ স্বীকৃতির দাবি নিয়ে মুক্তাঙ্গনে মানববন্ধন করেছিলেন শায়খুল হাদিস রহ:। ‘তখন থেকেই এ শব্দ দু’টির খুব ‘চল’ আমাদের অঙ্গনে’। ‘মুক্ত আওয়াজ’ পত্রিকাটি যখন বন্ধের দোরগোড়ায় তখন একবার মাও: মাহমুদুল হাসান সাহেবের নেতৃত্বে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি জোর প্রচারণা পেয়েছিল। মুক্ত আওয়াজের পক্ষ থেকে আমি তখন তাঁকে এবং কয়েকজন ‘আল্লামা’কে জিজ্ঞাসা করলে তারাও আমায় একই উত্তরই দিয়েছিলেন। আগে-পরে আরো অনেকের কাছেও আমি ঠিক এই উত্তরটিই পেয়েছিলাম।
স্বকীয়তা এবং নিয়ন্ত্রণ যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা নিয়ে আমার কোনও সংশয় নেই। আমরা আমাদের কওমির কোনওরূপ নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে দিতে চাই না- এও খুবই ‘বেহতর’ কথা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিয়ন্ত্রণ তাহলে করবেটা কে? কাউকে না কাউকে তো এর নিয়ন্ত্রণ নিতেই হবে। তা না হলে যে আর চলছে না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে জানতে চাইলে এরা সারাদেশে কোথায় কয়টা বিশ্ববিদ্যালয় আছে সব বলে দিতে পারবে। কওমির কেউ কি পারবে? পারাটা কি দরকার না? দেশে কওমি মাদরাসা কেন্দ্রীক চারটা পাঁচটা বোর্ড যা আছে সবগুলো মিলিয়ে তাদের নথিপত্রের হিসেব অনুযায়ী যতগুলো মাদরাসার হিসেব তারা দিতে পারবে, আমার তো ধারণা দেশে মাদরাসা আছে তারও অন্তত দ্বিগুণ তিনগুণ। আজকে যদি আমাদের ফাঁসানোর জন্য কেউ একটা ছদ্মবেশি মাদরাসা খুলে তাতে বিষ খাইয়ে ছাত্র মারার ঘটনা ঘটায়- তাহলে ঘটনা যা ঘটছে তাতে তো দেখা যাচ্ছে আমাদেরকে তখন তার পক্ষেও সাফাই গাইতে হবে। এবং গাইতে থাকবোও আমরা। অথচ তা আদৌ মাদরাসা কিনা তার কোনও আদ্যোপান্ত হিসেব আমাদের কারো কাছে নেই এবং সিস্টেম অনুযায়ী থাকার কথাও না।
এই যে নর্থ-সাউথে জঙ্গী ধরা পড়লো। তাতে কি তাদের কোনও ক্ষতি হয়েছে? হয়নি। কিচ্ছুই হয়নি। তারা বলে দিয়েছে যে, এই ছাত্ররা একটা বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠি। তাদের সাথে ইউনিভার্সিটির কোনও সম্পর্ক নেই। ব্যাস, সরকার তা মেনে নিয়েছে। আজকালের মধ্যে সামার সেমিস্টার শেষ হয়ে গেলে একদিন গিয়ে দেখে আসবেন, আগের চেয়ে আরো বেশি পরিমানে সেখানে ছাত্ররা ভর্তি হচ্ছে। লাখ লাখ টাকা দিয়ে তারা ভর্তি হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্তে তাদের যাবতীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু এন.এস.ইউ বলে কথা না। সব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোই। কেনও? কারণ তাদের কারিকুলাম, সিলেবাস, পাঠদানের স্ট্রাকচার সবই সরাকরের জানা আছে। পক্ষান্তরে আমাদের কথাটা ভাবুন। নয়জন না, একজন জঙ্গীও যদি পাওয়া যেতো কওমির, তাহলে আজকে দেখতেন কয়টা কওমি টিকে থাকতে পারতো। পাত্তাই থাকতো না কারো। গলাবাজি ছাড়া আর কোনও উপায়ও থাকতো না তখন। কিন্তু এভাবে গলাবাজি করেই বা আর কয়দিন। গলাবাজিতে যে সরকারের কিছুই আসে-যায় না তা তো সরকার বুঝিয়ে দিয়েছেই গত সাত বছরে।
শোনেন, সরকার নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কিছু ছেড়ে দিবে না। প্রাইভেট ভার্সিটিগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। প্রাইমারি লেভেল থেকে নিয়ে শুরু করে কলেজ লেভেল পর্যন্ত যত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে, এমনকি কোচিং সেন্টারগুলোও সরকার তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। সর্বশেষ গতকাল শুনলাম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে উপর মহল থেকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা হয়েছে যে, কার অনুমোদনে তানযিমুল উম্মাহ এখনো টিকে আছে। শুনেছি, তানযিমুল উম্মাহও তাদের প্রতিষ্ঠানের নামের মধ্যে পরিবর্তন এনে টিকে থাকার যুদ্ধে নেমেছে। ১৫ আগস্টে তারা শোক দিবস পালন করেছে। বঙ্গবন্ধুর নামে তারা খেলাও ছেড়েছে। এর বাইরে আরো যত প্রতিষ্ঠান আছে এবং থাকতে পারে তার সবই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়া শেষ। মসজিদগুলো তো আগেই নিয়েছে। এখন বাকি আছে শুধু কওমি মাদরাসা। আজ হোক কাল হোক, সরকার এর নিয়ন্ত্রণ নেবেই। তখন দেখা যাবে বহু মুখোশই আমাদের উন্মোচন হতে আরম্ভ করেছে। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা যে তখন হবে না কী নিশ্চয়তা আছে তার। তার আগেই কি নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া উচিত না?
২০-০৮-২০১৬ তারিখে প্রদত্ত লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে