মুফতি রেজাউল কারীম আবরার
শবে মেরাজ উপলক্ষে আমাদের সমাজে কিছু নামায এবং রোযা প্রসিদ্ধ রয়েছে। বিশেষত মেরাজের রাতে মসজিদের মিম্বরে মিম্বরে কিছু হাদীস এ রাতের বিশেষ ফযীলত সম্পর্কে শুনানো হয়। ‘মকসুদুল মুমীনীন’ এবং ‘বারো চান্দের ফযীলত’ নামক অনির্ভরযোগ্য কিতাবাদির কারণে এ ধরণের বেদয়াত আমল সমাজে প্রচলিত হয়ে গেছে। প্রথমে ‘বারো চান্দের ফযীলত’ থেকে বর্ণনাগুলো শুনি। সেখানে বলা হয়েছে-
“এক বর্ণনায় রয়েছে: শবে মি’রাজের রাত্রিতে দুই রাকায়াতের সূরা ফাতিহার পরে তিনবার করিয়া সূরা ইখলাস পাঠ করিবে। এবং দুই রাকায়াতের পর ২০০ বার দরুদ শরীফ পাঠ করিবে এবং হাত তুলিয়া আল্লাহর কাছে মুনাজাত করিবে। এই নামাযী ব্যক্তি অসংখ্য সওয়াব লাভ করিবে, তাহার ঈমান মুজবুত হইবে এবং আল্লাহর রহ,ত বর্ষিত হইতে থাকিবে।
অন্য এক বর্ণনায় বর্ণিহ হইয়াছে, শবে মি’রাজের রজনীতে দুই রাকয়াতের নিয়তে মোট চার রাকয়াত নামায আদায় করিবে। এই নামাযের প্রত্যেক রাকায়াতে সূরা ফাতিহার পরে যে কোনো সূরা মিলাইয়া পাঠ করিবে। নামায শেষ করতঃ কালেমায়ে তামজীদ, দরুদ শরীফ ও তওবায়ে ইস্তিগফার প্রত্যেকটি ১০০ বার করিয়া পাঠ করিবে। অতঃপর সিজদায় যাইয়া আল্লাহ তায়ালার দরবারে যেই সমস্ত বিষয় নেক আকাংখা করিবে, তিনি তাহা কবুল করিবেন”। (বার চান্দের ফযীলত, পৃষ্টা নং ২৩)
এ ধরণের কোন নামাযের কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। সবগুলো মানুষের বানানো এবং বানোয়াট। প্রথমত শবে মেরাজ কোনোদিন? সেটা নির্ধারিত নয়। বিস্তর মতবিরোধ রয়েছে। শবে মেরাজের নামায সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো সম্পর্কে কিছু মুহাদ্দিসদের বক্তব্য নকল করছি।
প্রথমেই বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন,
لم يرد في فضل شهر رجب، ولا في صيامه، ولا في صيام شيء منه، – معين، ولا في قيام ليلة مخصوصة فيه – حديث صحيح يصلح للحجة، وقد سبقني إلى الجزم بذلك الإمام أبو إسماعيل الهروي الحافظ، رويناه عنه بإسناد صحيح، وكذلك رويناه عن غيره،
অর্থাৎ রজব মাসের মর্যাদা, সে মাসে রোযা রাখা এবং সে মাসের বিশেষ কোনো রাতের নামাযের ফযীলত সম্পর্কে দলীলযোগ্য কোনো সহীহ হাদীস নেই। আমার পূর্বে দৃঢ়তার সাথে এমনটা বলেছেন হাফেজ ইমাম আবু ইসমাইল আল হারাওয়ী। আমরা তাঁর থেকে সহীহ সনদে এমনটা বর্ণনা করেছি। এমনভাবে অন্য থেকেও এমনটা বর্ণিত হয়েছে। (তাবয়িনুল আািব বিমা ওয়ারাদা ফি শরহি রজব, পৃষ্টা নং ২, মাকতাবাতুশ শামেলা।)
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী এখানে স্পষ্ট বলেছেন যে, রজব কোনো রাতের বিশেষ নামাযের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। শবে মেরাজ যেহেতু আমাদের দেশে সাতাশ তারিখে পালন করা হয়, সুতরাং এ রাতের বিশেষ নামায সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।
আল্লামা ইববে রজব হাম্ভলী রহ. বলেন,
ومن أحكام رجب ما ورد فيه من الصلاة والزكاة والصيام والإعتمار فأما الصلاة فلم يصح في شهر رجب صلاة مخصوصة تختص به
অর্থাৎ রজব মাসের বিশেষ কোনো নামায সহীহভাবে প্রমাণিত নয়। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্টা নং ১৬৪, দারুল হাদীস কাহেরা।)
শবে মেরাজের বিশেষ নামাযের যে বর্ণনা পূর্বে ‘বার চান্দের ফযীলত’ এর হাওয়ালায় উল্লেখ করা হয়েছে, তার আরবী পাঠ হলো নিম্নরূপ:
من صلى فيه اثنتي عشرة ركعة يقرأ في كل ركعة فاتحة
لكتاب وسورة ويتشهد في كل ركعتين ويسلم في آخرهن ثم يقول سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر مائة مرة ويستغفر مائة مرة ويصلي على النبي مائة مرة ويدعو لنفسه ما شاء ويصبح صائما فإن الله يستجيب دعاءه كله إلا أن يدعو في معصية
বর্ণনাটি সম্পর্কে আল্লামা আবদুল হাই লাভনভী রহ. বলেন,
أخرجه البيهقي من طريق عيسى غنجار عن محمد بن الفضل بن عطية وهو من المتهمين بالكذب عن أبان وهو أيضا متهم عن أنس مرفوعا وأدخله ابن حجر في تبين العجب في الموضوعات
অর্থাৎ বর্ণানাটি ইমাম বায়হাকী মুহাম্মাদ বিন ফাযল বিন আতীয়া এর ও সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি মিথ্যার অভিযোগে অভিযোক্ত। মুহাম্মাদ বিন ফাযল বর্ণনা করেন আবান থেকে। তিনিও মিথ্যার অভিযোগে অভিযোক্ত। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ‘তাবয়িনুল আযাব’- এ হাদীসটিকে জাল বলেছেন। (দেখুন, তাবয়িনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফি শাহরি রাজাব, পৃষ্টা নং ২১. মাকতাবাতুশ শামেলা। আল আছারুল মারফুআ, পৃষ্টা নং ৪৮)
এ ধরণের আরেকটি বর্ণনা হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. উল্লেখ করেছেন এবং জাল বলেছেন।
মোটকথা হলো, শবে মেরাজ উপলক্ষে কোনো বিশেষ নামায বা রোযা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। এছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের এ উপলক্ষে বিশেষ কোনো আমলের নির্দেশ দেননি। এজন্য শবে মেরাজ উপলক্ষে বিশেষ কোনো ইবাদত করা বেদয়াত।