শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সন্ধ্যা ৭:৪০
Home / দেশ-বিদেশ / দেওবন্দের এদারা

দেওবন্দের এদারা

মোস্তফা কামাল গাজী
মসজিদে রশিদে ফজর পড়ে বাইরে এলাম। বসন্তের ঝকঝকে একটা সকাল। মৃদু বাতাসে একটু একটু শীত লাগছে। মসজিদের বেলে পাথরের বিশাল চত্বর। তার একপাশে ফুলের বাগান। নানা রঙের ফুল ফুটে আছে সেখানে। নাম না জানা চমৎকার কিছু হলুদ রঙের ফুল গাছের ডালে ঝুলছে। শিশিরজলে ভেজা ফুলগুলো বেশ লাগছে। তবে এতো ফুলের মাঝেও প্রজাপতি উড়ছে না কোথাও। নেই পাখির কূজন। বসন্তের সিংহভাগ সৌন্দর্যই অনুপস্থিত এখানে। তাই নিজের দেশ ও গ্রামের কথা বড্ডো মনে পড়ে। পায়চারি করতে করতে সূরা ইয়াসিন পড়ে নিলাম। ১৪২৩ হিজরিতে বিশাল এলাকা জুড়ে নির্মিত হয় এই মসজিদ। দেওবন্দের দৃষ্টিনন্দন ভবনগুলোর মাধ্যে এটি একটি। দিল্লির জামে মসজিদ, আগ্রার তাজমহল থেকে কোনো দিক দিয়ে কম নয়। তাই পর্যটকমহলের কাছে এটি সুন্দরের মধ্যমণি। এর বেসমেন্টে কওমিশিক্ষার প্রাথমিক ধাপের সর্বোচ্চ ক্লাস দাওরায়ে হাদিসের অধ্যাপনা হয়। প্রায় আঠার’শ ছাত্রের অপূর্ব মিলনলেলা নজর কাড়ে সবসময়।
মসজিদের দক্ষিণে মাদ্রাসার মূল ভবন। সেখানে ঢুকতে পুরোনো আমলের বিশাল একটা গেট। নাম, ‘মাদানি গেট’। হযরত হুসাইন আহমদ মাদানি (রঃ) এ পথ দিয়ে আসা যাওয়া করতেন। তাই এ নামে নামকরণ। ইংরেজি বর্ণ ‘এল’ আকারে পূর্ব -পশ্চিম দিকে তিনতলা বিশিষ্ট বিশাল ভবন। নাম ‘দারে জাদিদ’। মাঝখানে বিশালাকরের ‘বাবুজ জাহির’ গেট। আফগান বাদশাহ জাহির শাহের তোহফা এটি। তার নামেই নামকরণ। এর ভেরত ছোট ছোট অনেকগুলো কামরা। এর একটি কামরায় অধমের থাকার জায়গা। এর ওপরে বিখ্যাত আইনশাস্ত্র ফতোয়ায়ে শামির অধ্যয়নাগার। গেটের সামনে একটুখানি খালি জায়গা। সুন্দর বসার জায়গা। অবসর সময়ে এখানটায় বসে আড্ডা দেয়া যায় বেশ। গেটের ঠিক সামনে সাদা গম্বুজ বিশিষ্ট দরসগাহ। একসময় এখানে দাওরায়ে হাদিসের ক্লাস হতো বলে নাম ‘পুরাতন দারুল হাদিস’। নিচের দিকের সব ক’টি ক্লাস এখনো হয় এখানে। একটু সামনে এগোলে এহাতায়ে মুলছরি। দুটি বিশাল বকুল গাছ। গাছদুটি ঘিরে রয়েছে অসংখ্য দেয়াল পত্রিকা। হিন্দি, উর্দু, ফারসি, আরবি, বাংলা, ইংলিশ, তামিল ও তেলেগু ভাষার দেয়ালিকাগুলো নজর কাড়ে। ক্লাসের ফাঁকে সাহিত্যপ্রেমীদের ভীড় লেগেই থাকে। একপাশে নওদারা। স্বপ্নযোগে রসুলুল্লাহ (সঃ) এর চিহ্নিত রেখা অনুসরণে নির্মিত এটি। বরকতের উদ্দেশ্যে এখনো দেওবন্দের সকল জানাযা এখানেই পড়া হয়। এর সামনের দিকে জলপানের সুন্দর ব্যবস্থা। গরমকালে ঠাণ্ডা পানি পাওয়া যায়। এখানেই ঐতিহাসিক সে কুপটা ছিলো, যেখান থেকে স্বপ্নযোগে রাসুলুল্লাহ (সঃ) ছাত্রদের দুধপান করিয়েছেন। যারাই সে দুধ পান করেছে, দেওবন্দের ছাত্র হবার সুযোগ মিলবে একসময়। একপাশে ইফতা, তাফসির, কেরাতসহ কারিগরি শিক্ষাবিভাগ। পশ্চিমে দারুল উলুমের লাইব্রেরি, তাবলিগ বিভাগ, দারে জাদিদ কদিম এবং বর্ডিং। একটু সামনে শায়খুল হিন্দ একাডেমি আর ফার্সিখানা। নওদারার পূর্বপাশে মসজিদে কদিম এবং সদর গেট। হযরত কাসেম নানুতুবি (রঃ) এ পথে চলতেন বলে এর নাম দেয়া হয়েছে ‘কাসেমি গেট’। গেটের একপাশে দারুল উলুমের মেহমানখানা। এর পশ্চিমপাশে মসজিদে সাত্তা। হযরত কাসেম নানুতুবি (রঃ) এখানেই ইবাদত করতেন। তাঁর ইবাদতখানা আজো বিদ্যমান। মসজিদের একপাশে ছিলো ঐতিহাসিক ডালিম গাছ। যার নিচে বসে কওমি মাদ্রাসার সর্বপ্রথম দরস দেয়া হয়। যার শিক্ষক ছাত্র উভয়ের নাম ছিলো মাহমুদ। তখন ছিলো ১৮৬৬ সাল। ইংরেজদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত মুসলমানদের জীবন। নিজেদের শিক্ষা সংস্কৃতি হারাতে বসেছে কেবল। আলেমগণ ভারতবর্ষ থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশংকায় উৎকণ্ঠিত। কোনো সুরহা খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। ঠিক তখনি স্বপ্নযোগে হুজুর (সঃ) এর নির্দেশে এবং তাঁর চিহ্নিত রেখায় নির্মিত হয় বর্তমানের ঐতিহ্যবাহি কওমি ধারার অন্যতম বিদ্যাপীঠ আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম দেওবন্দ। যার শাখা এখন বিশ্বময়। দেওবন্দ মাদ্রাসা শুধু শিক্ষানিবাস নয়; একটি আন্দোলনও। এ আন্দোলনের প্রভাবে একসম ইংরেজরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।
মসজিদে রশিদের বাইরে একটা রাস্তার ওপাশেই রয়েছে আরো বড় বড় চারটে মঞ্জিল। আজমি মঞ্জিল, আফ্রিকি মঞ্জিল, শায়খুল হিন্দ মঞ্জিল এবং দারুল কুরআন। আফ্রিকি মঞ্জিল দুইতলা আর বাকি সবগুলো তিনতলা করে। এ সবগুলোই ছাত্রাবাস। ক্লাসরুম আর ছাত্রাবাস আলাদা।
জল, বিদ্যুৎ আর দু’বেলা আহার সম্পূর্ণ ফ্রি। শুধু ভর্তি পরীক্ষায় নাম এলেই হলো। এর আশপাশে রয়েছে আরো শ’খানেক মসজিদ মাদ্রাসা।
ক্লাস শেষে সবাই একসাথে বের হলে মনে হয় ফেরেশতার শুভ্র সফেদ এক কাফেলা।
লেখক : দেওবন্দ, ইউপি, ভারত।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

আজ ঐতিহাসিক ১৮ই এপ্রিল!

মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল-মামুন:: আজ ১৮ এপ্রিল, বাংলাদেরশের ইতিহাসে একটি বিজয়ের দিন। ২০০১ সালের এই দিনে ...