এনামুল হক্ব মাসুদ::
তিলে তিলে চলছে মানব হত্যার মহোৎসব! বিষাক্ত রাসায়নিক রং মাখিয়ে খিরা ফলমুল ও নানান সবজি খাইয়ে গোটা জনগোষ্ঠীর ভিতর ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে কেন্সার! দেখার কেউ নেই, বাঁধা দেবারও কেউ নেই! অরাজকতা আর নৈরাজ্যবাদীতাই যেন দেশটির নিয়তি।
(প্লিজ জনস্বার্থে পোষ্টটি সবাই কপি/শেয়ার করুন)
দূরপাল্লার বাস ছুটছে রাজধানীর সায়দাবাদ থেকে কুমিল্লার দিকে। গত মাসের শেষ দিককার ঘটনা। কাঁচপুর ব্রিজের কাছে ২৫/৩০ প্যাকেট খিরা নিয়ে বাসে উঠলো হকার। তৃৃষ্ণার্ত মুখে আকর্ষণ তৈরির মতো কচি, সবুজ’ কয়েক প্যাকেট খিরা হাতে তার। কয়েকজন যাত্রী কয়েক প্যাকেট শসা নিয়ে নিলেন। হকারের কাছ এক প্যাকেট চাইতেই সহযাত্রী উন্নয়নকর্মী সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন পাশের সিট থেকে বলে উঠলেন, আরে এসব খিরা খাইয়েন না, এগুলোতে রং দেওয়া।’ শোভনের কথা শেষ হতে না হতেই হকারও কোনো রাখঢাক না করে বলল, জ্বী স্যার রং দিসি, মিছা কথা কমু না।’
হকার রশিদ। দীর্ঘদিন কাঁচপুর এলাকায় মৌসুমি ফল বিক্রি করেন যানবাহনে। বাসের পেছন অংশ থেকে শসা বিক্রি করে রশিদ যখন সামনের অংশে আবার আসে তখন ছবি তুলতে চাইলেই স্যার এইট্যা কইরেন না, এইটা কইরেন না’ বলতে বলতে তাড়াহুড়া করে বাস থেকে ছুটে নেমে চলে গেল।
খাদ্যে নানান রকম ভেজালের কথা এতদিন শোনা গেলেও এভাবে তৃণমূল ব্যবসাতে খিরা-শসা-আমড়ায় রং মেশানোর কারণ অনুসন্ধানে চলে আসে অনেক না জানা কাহিনী। টানা প্রায় ১৫ দিন থেকে থেকে রাজধানীর সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত বাসপথ, ঢাকা থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত বাস পথ, সদরঘাট, মহাখালী, ফার্মগেইট, মগবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে পুরো নগরী এবং এর আশপাশে বিষাক্ত ডাইংয়ের রং মিশিয়ে মানুষের হাতে শসা, খিরা, আমড়া তুলে দিচ্ছে হকাররা।
যাত্রাবাড়িতে কথা হয় হকার জামসেদের সাথে। জামসেদ অকপটে জানায় শসায় রং মাখানোর আদ্যোপান্ত কাহিনী।
জামসেদ জানায়, রাজধানীর যাত্রাবাড়ি, সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রং মাখানো খিরা, শসা, আমড়া বিক্রির বেশ কয়েকটি আড়ত গড়ে উঠেছে। সেসব আড়তে সারা দিনে কয়েক মন শসা, খিরা, আমড়া দিনে কাটা হয়। এরপর বড় কোনো পাত্রে তাদের ভাষায় মিষ্টি রং’ মিশিয়ে রাখা হয়। হকাররা সেসব আড়ত থেকে প্রতি প্যাকেট ৫ টাকা দরে এসব শসা-খিরা-আমড়া কেনেন। তারপর যাত্রীদের কাছ থেকে বিক্রি করেন ৮ থেকে ১০ টাকা দরে প্রতিটি প্যাকেট।
জামসেদ কাছাকাছি একটি আড়তের দিকে নিয়ে গেল। বেশ অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে বলেন, ভেতরে যাবেন না, ছবি তুলবেন না। এইখানে কারও মাস্তানি খাটে না। জানে মাইরা ফেলবো টের পাইলে।’
অনুসন্ধানের পথ ধরে পরিবর্তন অনুসন্ধানী দল পিছু নেয় হকার এরশাদের। টানা দুই দিন নানাভাবে কথা বলার পর রাজি হয় শসা-খিরা-আমড়াতে রং মিশিয়ে তাজা রাখার প্রণালী বিস্তারিত হাতেনাতে দেখাতে।
এরশাদের পিছু ধরে কাঁচপুর ব্রিজ থেকে উত্তরের জনবসতিপূর্ণ বাজার মহল্লা পেরিয়ে কিছু দূর গিয়ে এরশাদ একশত টাকা চায়। একটু অপেক্ষা করতে বলে ছুটে গিয়ে খানিক পরই হাতে কাগজে মোড়া ছোট একটি পুটলি নিয়ে আসে। জানায় রং কেনা হয়েছে। এরশাদ জানান, এই এলাকার অনেক দোকানেই এই রং পাওয়া যায়।
এরশাদ নিয়ে যায় তার ছোট মেস বাড়িতে। সেখানে কয়েকটি শসা নিয়ে বসে সে। ছোট এক বালতিতে আধা বালতি পানি নেয়। কাগজের পুটলি থেকে রং বের করে। কমলা রং এর গুঁড়া। এক চিমটি রং নিয়ে বালতির পানিতে ছাড়ার সাথে সাথে পানির রং গাঢ় সবুজ আকার ধারণ করে। তাতে কাটা কয়েকটি শসা দিয়ে আবার সাথে সাথে তুলে নেয়। এরশাদ জানায়, কাজ হয়ে গেছে। এভাবেই কয়েক সেকেন্ড রং পানিতে চুবিয়ে নিলে ৪/৫ ঘণ্টা এই শসা তাজা সতেজ সবুজ থাকবে। এরশাদের রং মাখানো খিরা আর রং ছাড়া কয়েক টুকরো হাতে নিয়ে বোঝা যায় যে রং মাখানো খিরা তুলনামূলক একটু শক্ত। কিন্তু খুব ভাল করে খেয়াল না করলে বিষয়টি বোঝা যায় না।
এরশাদ কয়েকবার তার এই রং মাখানোর কৌশল দেখাতে দেখাতে জানান, শুধু কাঁচপুর ব্রিজ এলাকাতেই তারা একশ’ হকার আছেন। প্রত্যেকে রং মেশানো ফল সবজি বিক্রি করে। এরশাদ আরও বলেন, প্রত্যেকে দিনে ৮০ থেকে ১২০/৩০ প্যাকেট শসা, খিরা, আমড়া বিক্রি করেন। প্রায় সবাই সব সময় রং মাখায়। এসবে যে রং মাখানো তা ক্রেতারাও অনেকে জানেন, জেনেও খান। কারণ রং না মাখালে কাটা খিরা, শসা, আমড়া কিছুক্ষণ পরই চুপসে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তা ক্রেতারা পছন্দ করে না।
পুলিশ কিছু বলে না?-জানতে চাইলে এরশাদ দম্ভের সাথে বলেন, পুলিশ তাদের ভয় পায়। পুলিশ আটকাইলে মাইরা সব হকার মিইলা ভর্তা বানাইয়া দিবো’- বলেন এরশাদ।
তিনি জানান, এই এলাকায় কেন সব জায়গাতেই হকারদের কেউ কিছু বলেতে পারবে না। কারণ আওয়ামী লীগ বা বিএনপির যে কোনো সমাবেশ শত শত হকার দরকার হয়। তারা সব দলের সমাবেশেই ভাড়ায় খাটেন। সব এলাকায় হকারের একজন সর্দার থাকেন। সর্দারই সব ম্যানেজ করেন। পুলিশ টাকা চাওয়ারও সাহস পায় না।
অবলীলায় এরশাদ স্বীকার করে যান, তিনিও জানেন এই রং মাখানো শসা খেলে বেশি ক্ষতি হয় শিশুদের। এমনকি শিশুদের কিডনিও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
মাঠের এই অনুসন্ধান ধরে কথা হয় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা’র সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহানের সাথে। এই সংগঠনটি (পবা) দীর্ঘ দিন ধরে মাঠ পর্যায়ে খাদ্যে ভেজাল, ফরমালিন ও রাসয়নিক ব্যাবহার নিয়ে গবেষণা ও চিহ্নিতকরণের কাজ করছে।
আবদুস সোবহান বলেন, তারা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, শসা খিরা বা আমড়ায় ব্যবহূত রংটি শরীরে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক রং। যা ডাইং এবং সুতা কারখানায় কাপড় রং করার কাজে ব্যবহার হয়। এটি খাবারকেও ভিন্ন রং ধারণ করাতে পারে।
আবদুস সোবহান মনে করেন, এ ধরনের রং আমাদানি, বাজারজাতকরণ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়িদের হাতের নাগালে যাওয়া এখনই ঠেকাতে না পারলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
পবা সূত্র জানায়, অনেকটা কাপড় সাদাকরণ রাসায়নিক হাইডঙ্রে কাছাকাছি রসায়নিক ফল-সবজিতে ব্যবহার করা হয়।
রাজধানীর নামীদামিসহ অনেক রেস্টুরেন্টেও সালাদ করার জন্য যে শসা- খিরা ব্যবহার করা হয় তাও তাজা, কচি বোঝাতে বিষাক্ত ডায়িং কালার রং ব্যবহার করার অভিযোগ আছে পবা’র কাছে।
মানুষের শরীরে এইসব রং কি ধরনের ক্ষতি করতে পারে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও খাত্যিমান চিকিতসক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, এ ধরনের রং থেকে লিভারের জটিল রোগ, কিডনির সমস্যাসহ শরীরের নানান রকম মৃত্যুঘাতী রোগ হতে পারে। এই রং শরীরে ঢুকে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের জন্ম দিতে পারে। তাছাড়া জন্ডিস, টায়ফয়েডের মতো রোগ হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
ডা. স্বপ্নীল বলেন, স্বল্প সময়ে এই রংয়ের প্রভাব টের পাওয়া না গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে এর বিরূপ প্রভাব পরবেই।
খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ এবং রাসায়নিক বন্ধে মূল দায়িত্ব পালন করার কথা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের ( B.S.T.I ) এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মো. সাইফুল হাসিব কোনো আশার কথা শোনাতে পারেননি।
( Anamul Hoque Masud)