একটা সময় ছিল, যখন চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে কেবল উত্তর কোরিয়াকেই বোঝাত। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। হালে পাকিস্তানের সঙ্গেও বেশ দহরম-মহরম তাদের। পাকিস্তানকে চীন ‘শক্তিমান ভাইয়ের’ সঙ্গে তুলনা করেছে। এ নিয়ে ভারি মাথাব্যথা ভারতের।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রধান ইস্যুগুলোতে পাকিস্তানের পক্ষে চীনের জোরালো অবস্থানে ভারত সতর্ক। বেইজিংয়ের দুই দশকের প্রবণতা ছিল, ইসলামাবাদের সঙ্গে ঐতিহাসিক বন্ধন অটুট রাখা। একই সঙ্গে দিল্লির সঙ্গে স্পর্শকাতর ও ক্রমবর্ধমান সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখা। বেইজিং এখন তাদের এই চেষ্টা থেকে সরে আসছে।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনা ‘উরি’ হামলার পর বেড়েছে। দুই দেশের নিয়ন্ত্রণরেখায় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ও কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে একঘরে করার চেষ্টার মাধ্যমে ভারত জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
ভারত ও চীনের মধ্যে ‘পাকিস্তান পরিস্থিতি’ নিয়ে সম্পর্কের শীতলতা আরও স্পষ্ট হয় ব্রিকস সম্মেলনে। এ বছরের ১৫ অক্টোবর ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত হয় এ সম্মেলন। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিন সেই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎ হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও। তবে তা ভারত-চীনের আগের বৈঠকের মেজাজে ছিল না। এর আগে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের গুজরাটে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।
চীনের প্রতি মোদির সাম্প্রতিক অসন্তোষ শুরু হয় পাকিস্তানভিত্তিক আন্তসীমান্ত ‘জঙ্গি’ মাসুদ আজহারকে ঘিরে। ভারত দাবি করে আসছে, জইশে মুহাম্মদ নামের সংগঠনের প্রধান মাসুদ আজহার চলতি বছরের শুরুতে ভারতের পাঞ্জাবের পাঠানকোট বিমানঘাঁটিসহ বিভিন্ন জঙ্গি হামলার মূল হোতা। তবে পাকিস্তান পাঠানকোট হামলায় মাসুদ আজহারের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে দাবি করে। এর আগে ভারতের কারাগারে আটক মাসুদ আজহারকে ছাড়িয়ে নিতে তাঁর অনুসারীরা ভারতের একটি বিমানের যাত্রীদের জিম্মি করে। জিম্মি যাত্রীদের বিনিময়ে ১৯৯৯ সালে ভারত মাসুদ আজহারকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয় এবং তাঁকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
মাসুদ আজহারকে রক্ষা করতে চীন তৎপর দাবি করে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে ভারত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের এ নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা চীনের প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছিলেনও। ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার পর লস্কর-ই-তাইয়েবার তালিকাভুক্ত নেতাদের প্রতিও চীনের সমর্থন ছিল দাবি করে ভারত।
তবে চীন মনে করছে, সন্ত্রাসবাদের অজুহাতে ভারত রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। এমন ইঙ্গিত করে গত ১০ অক্টোবর চীনের ভাইস পররাষ্ট্রমন্ত্রী, খ্যাতনামা কূটনীতিক ও জাতিসংঘের সাবেক প্রতিনিধি লি বাওদং বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে দ্বৈত অবস্থান থাকা যেমন উচিত নয়, তেমনি সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য কিছু চাপিয়ে দেওয়াও উচিত নয়।’
পাল্টা জবাবে ভারত বলেছে, চীনের এসব সমর্থনের কারণে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ দমনে সক্রিয় নয়। এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত চীনে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত বর্তমানে বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের ফেলো অশোককান্থ এ বিষয়ে বলেছেন, চীনের এ সমর্থন পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদ দমনে নিষ্ক্রিয় থাকাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, কূটনৈতিক সুরক্ষা দিচ্ছে। সন্ত্রাসবাদসহ ভারতের সরাসরি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে পাকিস্তানকে আরও দায়িত্বহীন আচরণ করতে উৎসাহিত করছে।
তবে বেইজিং এ বিষয়টাকে ভিন্নভাবে দেখছে বলে মত প্রকাশ করেছেন জার্মান মার্শাল ফান্ডের চীন-পাকিস্তান বিশেষজ্ঞ এন্ড্রু স্মল। তিনি বলেন, চীন যখন দেখে পাকিস্তানের প্রতি ‘অন্যায্য চাপ’ আসছে, তারা তখন ‘পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়’।
জঙ্গি ইস্যুর পাশাপাশি পরমাণু শক্তি সরবরাহকারী গোষ্ঠী নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপে (এনএসজি) ভারতের প্রবেশের ক্ষেত্রে চীনের বাধা দেওয়ার বিষয়টিও ভারত-চীন সম্পর্ককে শীতল করে ফেলছে। ৪৮ সদস্য দেশের এই গ্রুপে ভারত বহুদিন ধরে প্রবেশের চেষ্টা করছে। গত জুনে সিউলে এনএসজির এক বৈঠকে ভারতের অন্তর্ভুক্তিতে চীন আগের মতোই বিরোধিতা করেছে। ভারতকে সদস্য পদ দিতে হলে এনএসজিতে পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলেছে এবার চীন।
ভারত-চীনের জটিল সম্পর্ককে সাম্প্রতিক এসব ঘটনা আরও আন্তরিকতাশূন্য করেছে। যেখানে সব সময় সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার একটি কোমল ভারসাম্য থাকার প্রয়োজন ছিল। দুই পক্ষই সীমান্তে বিরোধ খুব ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। গত দুই দশকেও সেখানে একটি গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়নি। বরং, তারা বিরোধপূর্ণ সীমানায় কর্মকাণ্ড আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।
ভারতের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সস্তা চীনা পণ্য বয়কটের যতই আহ্বান জানানো হোক না কেন, দুই দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ছেই। প্রধানমন্ত্রী মোদি রেলপথ, উৎপাদন ও আধুনিক নগর নির্মাণে চীনা বিনিয়োগ পেতে দৌড়-ঝাঁপ করছেন। কর্মকর্তারা বলেছেন, এ বছর ভারত ৪০০ মিলিয়ন ডলার চীনা বিনিয়োগ পেয়েছে। পরিমাণে তা খুব বেশি নয়। তবে এক দশক ধরে ভারত চীন থেকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ পেয়েছে সে তুলনায় তা দ্বিগুণ।
তবে সবকিছুর পর এটাই স্পষ্ট যে চীন-পাকিস্তানের দৃঢ় সম্পর্ক ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ।
সাবেক রাষ্ট্রদূত অশোককান্থ বলেন, আমরা জানি চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটি কৌশলগত বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে। তাদের এই কৌশলগত সম্পর্ক সহজে ক্ষয়ে যাচ্ছে না।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চীন ও পাকিস্তান তাদের সম্পর্ককে হিমালয়ের চেয়ে উঁচু, সাগরের চেয়েও গভীর এবং মধুর চেয়েও মিষ্টি বলে গর্বের সঙ্গে নানাভাবে অলংকৃত করেছে। তবে বাস্তবতা বলছে, তাদের সম্পর্ক সব সময় তা ছিল না।
১৯৯০ সালে চীনের অর্থনীতি নিম্নগামী হয়ে পড়েছিল। তখন পাকিস্তানের সঙ্গে আবেগের সম্পর্ক রক্ষা করার চেয়ে নিজ দেশের স্বার্থ বড় করে দেখেছিল চীন। চরম সতর্কতা অবলম্বন করতে দেখা যায় চীনকে। এমনকি পাকিস্তান-চীন সীমান্তের খুঞ্জারেব গিরিপথ অতিক্রমের ক্ষেত্রে চীন কড়াকড়ি আরোপ করে। ফলে খুঞ্জারেব গিরিপথ দিয়ে চলাচলকারী পাকিস্তানিরা প্রচণ্ড সমস্যার মধ্যে পড়ে। ওই সময় চীন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। বেইজিং তখন বুঝতে পারে, এই বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা প্রয়োজন। ইন্ডিয়া টুডে অবলম্বনে