বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
কদমবুচি সম্পর্কে একটি অপপ্রচারের জবাব
প্রশ্ন : আমাদের সাইটের প্রশ্নোত্তর বিভাগে অনেক আগে একটি প্রশ্নোত্তর প্রকাশিত হয়েছে কদমবুচি সম্পর্কে। যাতে আমরা কুরআনও হাদীসের আলোকে লিখেছিলাম যে, কদমবুচি করা জায়েজ নয়। হারাম। মৌলিকভাবে দুটি কারণে হারাম বলা হয়েছিল। যথা-
১-গাইরুল্লাহের সামনে মাথা নত করা হয় সে কারণে।
২-হিন্দুয়ানী রুসুম তথা বিধর্মীর অনুকরণ করার কারণে।
কিন্তু আব্দুল্লাহ আল হাসানী নামের এক ভাই আলআদাবুল মুফরাদের দুটি হাদীস দ্বারা একথা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, কদমবুচি করা জায়েজ। তার পুরো বক্তব্যটি উদ্ধৃত করা হল,
@Mufti Lutfur Rahman Faraeyzi
What about 2 Ahadith in “Al Adab al Mufrid” by Imam Bukhari R. being Hadith no.975 & 976 about kissing feet? How can one kiss feet without lowering his/her head? Without Niyah nothing is ibaadah. So your point of lowering head being haaraam & Hindu Roosoom is baseless and thus becoming mufti you people like accursed Jewish Rabbis & Christian Priests are leading ignorant Muslims astray. Similarity does not prove something alike. Before calling Hindu, Haaraam etc., please cut your own ears, nose etc., because kaafirs also have these things.
Therefore, I humbly request you to remove the statement written above as ruling and rewrite the answer according to the Sunnah.
এখানে তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তার সারমর্ম হল,
পা চুম্মন বিষয়ে ইমাম বুখারী রহঃ এর সংকলিত কিতাব “আলআদাবুল মুফরাদ”গ্রন্থের ৯৭৫ ও ৯৭৬ নং হাদীসে পা চুমু খাওয়ার কথা এসেছে। আর পায়ে চুমু খেতে হলে মাথা নুয়াতে হয়, সুতরাং কদমবুচি করা জায়েজ।
আমরা যেহেতু তা নাজায়েজ লিখেছি তাই আমরা ইহুদী খৃষ্টান পাদ্রীদের মত যাকে ইচ্ছে তাকে জায়েজ নাজায়েজে বলে অভিশপ্ত কাজ করছি। আর হিন্দু বৌদ্ধের সাথে মিলানোর আগে আমাদের নিজেদের নাক কান কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন এই ভ্রাতা।
সর্বশেষে আমাদের তিনি সুন্নাহের আলোকে জবাব দেয়ার অনুরোধ করেছেন।
মন্তব্যকারী- Abdullah Al Hasani
মেইল এড্রেস- purbachal.dhaka@gmail.com
উত্তর :
ﺑﺴﻢ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﺮﺣﻤﻦ ﺍﻟﺮﺣﻴﻢ
উলামায়ে কেরাম মূলত এসব কারণেই জাহিল আর মুর্খদের নিজে নিজে কুরআন হাদীস পড়তে নিষেধ করেছেন। উলামায়ে কেরাম পরামর্শ দেন যে, বিজ্ঞ আলেমের তত্বাবধানে কুরআন ও হাদীস পড়ার জন্য। নিজের মুর্খতা সত্বেও কুরআন হাদীসের বাংলা ইংলিশ অনুবাদ পড়ে নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবলে দ্বীন যে জগাখিচুরীতে পরিণত হবে এর জ্বলন্ত প্রমাণ হল কথিত সুন্নাহ অনুসারী আব্দুল্লাহ আল হাসানী সাহেব।
যে ঔদ্ধত্বের সাথে তিনি কুরআন ও হাদীসের আলোকে জবাব লেখার পরও ইহুদী আর খৃষ্টান পাদ্রীদের সাথে আমাদের তুলনা করলেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
শুধু উলামায়ে কেরাম নয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই বলেছেন, কুরআন পড়ে একদল গোমরাহ হবে। গোমরাহ কারা হবে? তাও আল্লাহ তাআলা বলে দিয়েছেন। কুরআনে কারীমে এসেছে-
ﻳُﻀِﻞُّ ﺑِﻪِ ﻛَﺜِﻴﺮًﺍ ﻭَﻳَﻬْﺪِﻱ ﺑِﻪِ ﻛَﺜِﻴﺮًﺍۚ ﻭَﻣَﺎ ﻳُﻀِﻞُّ ﺑِﻪِ ﺇِﻟَّﺎ ﺍﻟْﻔَﺎﺳِﻘِﻴﻦَ [ ٢: ٢٦
এ দ্বারা আল্লাহ তা’আলা অনেককে বিপথগামী করেন, আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শন করেন। তিনি অনুরূপ উপমা দ্বারা ফাসিক ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন কাউকেও বিপথগামী করেন না। {সূরা বাকারা-২৬}
এ আয়াত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে যে, কুরআন পড়েও মানুষ বিপথগামী হতে পারে। কিন্তু কে হবে বিপথগামী? তাও আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাষায় বলেছেন, সেই বিপথগামী হল, যারা ফাসিক হবে।
আরবে ফাসিক বলা হতো ঐ বকরী বা অধীনত পশুকে যে তার মনীব থেকে আনুগত্বের রশি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। সেই আনুগত্বহীন বকরী আর পশুকে বলা হয় ফাসিক।
যেহেতু ফাসিক অবাধ্য হয়, কারো কথা মানে না, তাই তাকে ফাসিক বলা হয়ে থাকে।
সুতরাং বুঝা গেল যে, ফাসিক এর সঠিক অনুবাদ হল গায়রে মুকাল্লিদ। অর্থাৎ যারা বিজ্ঞ ব্যক্তির কথা মানে না, বরং নিজে যা বুঝে সেটাকেই সঠিক বলে বিশ্বাস করে, স্বাধীনচেতা মনোভাব প্রকাশ করে তার নামই ফাসিক।
সুতরাং কুরআন পড়ে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয় কেবল গায়রে মুকাল্লিদরা। কোন মুকাল্লিদ কুরআন পড়ে বিভ্রান্ত হতে পারে না। কারণ মুকাল্লিদ ব্যক্তি নিজের বুঝকে পূর্ণাঙ্গ মনে করে না, তিনি বিজ্ঞ ব্যক্তির ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন বুঝতে চেষ্টা করে। তাই তার বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না।
যাইহোক এবার আমরা অভিযোগকৃত বিষয়টির দিকে খেয়াল করি।
কি আছে আদাবুল মুফরাদে?
১
975 – ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﻣُﻮﺳَﻰ ﺑْﻦُ ﺇِﺳْﻤَﺎﻋِﻴﻞَ ﻗَﺎﻝَ : ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﻣَﻄَﺮُ ﺑْﻦُ ﻋَﺒْﺪِ ﺍﻟﺮَّﺣْﻤَﻦِ ﺍﻟْﺄَﻋْﻨَﻖُ ﻗَﺎﻝَ : ﺣَﺪَّﺛَﺘْﻨِﻲ ﺍﻣْﺮَﺃَﺓٌ ﻣِﻦْ ﺻَﺒَﺎﺡِ ﻋَﺒْﺪِ ﺍﻟْﻘَﻴْﺲِ ﻳُﻘَﺎﻝُ ﻟَﻬَﺎ : ﺃُﻡُّ ﺃَﺑَﺎﻥَ ﺍﺑْﻨَﺔُ ﺍﻟْﻮَﺍﺯِﻉِ، ﻋَﻦْ ﺟَﺪِّﻫَﺎ، ﺃَﻥَّ ﺟَﺪَّﻫَﺎ ﺍﻟْﺰَّﺍﺭِﻉَ ﺑْﻦَ ﻋَﺎﻣِﺮٍ ﻗَﺎﻝَ : ﻗَﺪِﻣْﻨَﺎ ﻓَﻘِﻴﻞَ : ﺫَﺍﻙَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ، ﻓَﺄَﺧَﺬْﻧَﺎ ﺑِﻴَﺪَﻳْﻪِ ﻭَﺭِﺟْﻠَﻴْﻪِ ﻧُﻘَﺒِّﻠُﻬَﺎ
[ ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺸﻴﺦ ﺍﻷﻟﺒﺎﻧﻲ ] : ﺿﻌﻴﻒ ﺍﻹﺳﻨﺎﺩ
ইমাম বুখারী রহঃ এর কাছে মুসা বিন ইসমাঈল বলেন, তার কাছে মাতার বিন আব্দুর রহমান আলআনাক বলেছেন, তার কাছে উম্মে আবান বলেছেন, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন, তার দাদা ওয়াযি বিন আমির বলেন, আমি একদা রাসূল সাঃ এর খেদমতে গিয়া হাজির হলাম। আমাকে বলা হল ইনিই হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল। আমরা তখন তাঁর হস্তদয় ও পদদ্বয় ধরিয়া চুমু খেলাম। {আলআদাবুল মুফরাদ, ইসলামী ফাউন্ডেশন অনুবাদের হাদীস নং-৯৮৭, আরবী কিতাবের হাদীস নং-৯৭৫}
শায়েখ আলবানী রহঃ বলেন, হাদীসটির সনদ দুর্বল।
ﺳﻤﻴﺮ ﺑﻦ ﺃﻣﻴﻦ ﺍﻟﺰﻫﻴﺮﻱ
সামীর বিন আমীন যুহাইরী রহঃ বলেন, সনদ জঈফ, কারণ উম্মে আবান মাজহূল। {আলআদাবুল মুফরাদ বিততালিকাত}
২
976 – ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﻋَﺒْﺪُ ﺍﻟﺮَّﺣْﻤَﻦِ ﺑْﻦُ ﺍﻟْﻤُﺒَﺎﺭَﻙِ ﻗَﺎﻝَ : ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﺳُﻔْﻴَﺎﻥُ ﺑْﻦُ ﺣَﺒِﻴﺐٍ ﻗَﺎﻝَ : ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﺷُﻌْﺒَﺔُ ﻗَﺎﻝَ : ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﻋَﻤْﺮٌﻭ، ﻋَﻦْ ﺫَﻛْﻮَﺍﻥَ، ﻋَﻦْ ﺻُﻬَﻴْﺐٍ ﻗَﺎﻝَ : ﺭَﺃَﻳْﺖُ ﻋَﻠِﻴًّﺎ ﻳُﻘَﺒِّﻞُ ﻳَﺪَ ﺍﻟْﻌَﺒَّﺎﺱِ ﻭَﺭِﺟْﻠَﻴْﻪِ
[ ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺸﻴﺦ ﺍﻷﻟﺒﺎﻧﻲ ] : ﺿﻌﻴﻒ ﺍﻹﺳﻨﺎﺩ ﻣﻮﻗﻮﻑ
আব্দুর রহমান বিন মুবারক বলেছেন, তার কাছে সুফিয়ান বিন হাবীব বলেছেন, তার কাছে শুবা বলেছেন, তার কাছে আমর বলেছেন যাকওয়ান থেকে। তিনি সুহাইব থেকে বর্ণনা করেছেন, সুহাইব বলেছেন, আমি হযরত আলী রাঃ কে দেখেছি যে, তিনি হযরত আব্বাসের হস্ত ও পদদ্বয়ে চুম্বন করছেন। {আলআদাবুল মুফরাদ, ইসলামী ফাউন্ডেশন অনুবাদের হাদীস নং-৯৮৮, আরবী কিতাবের হাদীস নং-৯৭৬}
শায়েখ আলবানী রহঃ বলেন, হাদীসটি সনদ দুর্বল, সেই সাথে হাদীসটি মওকুফ।
সামীর বিন আমীন যুহাইরী রহঃ বলেন, সনদ জঈফ, কারণ সুহাইব ইবনে আব্বাস রাঃ এর মাওলা, তিনি গায়রে মারূফ। {আলআদাবুল মুফরাদ বিততালিকাত}
এই হল হাদীসটির অবস্থা। গায়রে মুকাল্লিদ আলেমদের কাছেই এ হাদীস দুর্বল এবং মওকুফ। যা তাদের কাছে দলীল হতেই পারে না।
অপরদিকে হাদীসে এসেছে যে,
ﻋَﻦْ ﺃَﻧَﺲِ ﺑْﻦِ ﻣَﺎﻟِﻚٍ، ﻗَﺎﻝَ : ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺟُﻞٌ : ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮﻝَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺍﻟﺮَّﺟُﻞُ ﻣِﻨَّﺎ ﻳَﻠْﻘَﻰ ﺃَﺧَﺎﻩُ ﺃَﻭْ ﺻَﺪِﻳﻘَﻪُ ﺃَﻳَﻨْﺤَﻨِﻲ ﻟَﻪُ؟ ﻗَﺎﻝَ : ﻻَ، ﻗَﺎﻝَ : ﺃَﻓَﻴَﻠْﺘَﺰِﻣُﻪُ ﻭَﻳُﻘَﺒِّﻠُﻪُ؟ ﻗَﺎﻝَ : ﻻَ، ﻗَﺎﻝَ : ﺃَﻓَﻴَﺄْﺧُﺬُ ﺑِﻴَﺪِﻩِ ﻭَﻳُﺼَﺎﻓِﺤُﻪُ؟ ﻗَﺎﻝَ : ﻧَﻌَﻢْ .
ﻫَﺬَﺍ ﺣَﺪِﻳﺚٌ ﺣَﺴَﻦٌ .
হযরত আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কারো যদি তার ভাই বা তার বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ হয়, তবে কি সে তার অভিবাদন এর জন্য মাথা ঝুঁকাবে? তিনি বললেন, না। লোকটি বলল, তাহলে কি তাকে লেপ্টে ধরবে এবং চুমু খাবে? তিনি বললেন, না। তাহলে কি তার হাত ধরবে এবং তার সাথে মুসাফাহা করবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
ইমাম তিরমিজী রহঃ বলেন, হাদীসটি হাসান। {সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৭২৮, বাংলা ২৭২৯, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৩০৪৪}
এ হাদীসে রাসূল সাঃ মাথা নুয়াতে এবং চুমু খাওয়াতে নিষেধ করেছেন।
এ মাসআলাটি নিয়ে বিজ্ঞ ফুক্বাহায়ে কেরাম এবং মুহাদ্দিসীনে কেরামের মাঝে মতভেদ রয়েছে।
একদল বলেছেন সম্মানার্থে জায়েজ আছে পদচুম্বন করা। কিন্তু তারা সাথে সাথে এ শর্তারোপ করেছেন যে, যেন চুমু খেতে গিয়ে রুকুর সূরত বা সেজদার সূরত না হয়ে যায়। যদি রুকু বা সেজদার সূরত হয়ে যায়, তাহলে তা জায়েজ হবে না। {আলমুজতাবা-৪/২০৫, আলমুহীতুল বুরহানী-৮/১১৮, ফাতাওয়া আলমগীরী-৫/৩৬৯}
আরেক দল ফক্বীহ ও মুহাক্কিকীনদের মতে তা জায়েজ নয়। কারণ বর্তমান প্রচলিত কদমবুচিতে রুকুর হালাত এবং সেজদার হালাত হওয়া স্পষ্ট। সেই সাথে এটি বিধর্মীদের প্রতীক। তাই তা হারাম।
আমরা বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছি। কারণ কদমবুচি করা এ উপমহাদেশে মৌলিকভাবে হিন্দুদের রুসুম। আর কদমবুচি করতে গিয়ে রুকু বা সেজদার হালাত তৈরী হয়েই যায়। আর যারাও কদমবুচিকে জায়েজ বলেছেন তাদের মতেও রুকু সেজদার হালাত হয়ে গেলে কদমবুচি করা জায়েজ নয়।
উপরোক্ত কারণে আমরা বর্তমান প্রচলিত কদমবুচিকে নাজায়েজ বলেছি দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে। সেখানে আমরা সুন্নাহের খেলাফ গেলাম কিভাবে?
আল্লাহ তাআলা জাহিল গবেষকদের হাত থেকে মুসলিম উম্মাহের ঈমান আমলকে হিফাযত করুন।
ﻭﺍﻟﻠﻪ ﺍﻋﻠﻢ ﺑﺎﻟﺼﻮﺍﺏ