বুধবার, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সকাল ৬:৪০
Home / অনুসন্ধান / নুসরাত হত্যাকান্ডের ধারাবাহিক রিপোর্ট!

নুসরাত হত্যাকান্ডের ধারাবাহিক রিপোর্ট!

পিবিআই ব্রিফিং ১৩ এপ্রিল ঢাকা:

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে দুই কারণে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় বলে জানিয়েছেন পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।

শনিবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। এ সময় পিবিআই এবং পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

পিবিআই প্রধান জানান, দুই কারণে রাফিকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। প্রথমত হলো- অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা করে নুসরাত আলেম সমাজকে হেয় করেছে বলে মনে করে তারা। দ্বিতীয় কারণ হলো অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ শামীম দীর্ঘদিন ধরে রাফিকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। রাফি তা বারবারই প্রত্যাখ্যান করছিল। এই ক্ষোভ থেকে শামীম তাকে হত্যা করার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়।

তিনি বলেন, অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ্দৌলার নির্দেশেই আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে। বোরকা এবং হাত মোজা পরে তার শরীরে যারা আগুন দেয় তারা রাফিরই সহপাঠী। এদের মধ্যে অন্তত দুইজন ছাত্র এবং দুইজন ছাত্রী।

সংবাদ সম্মেলনে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে এজাহারভুক্ত ৮ আসামির মধ্যে ৭ জন রয়েছে। এজাহারের বাইরে থেকে ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের বাইরে থাকা এজাহারভুক্ত একমাত্র আসামি হাফেজ আব্দুল কাদেরসহ আরও কমপক্ষে ৬ জনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

তথ্য অনুযায়ী, গ্রেফতারকৃত এজাহারভুক্ত আসামিরা হলো- মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা (৫৫), মাদ্রাসার ছাত্র নূর উদ্দিন (২০) ও শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম (৪৫), মাদ্রসার সাবেক ছাত্র জোবায়ের আহম্মেদ (২০) ও জাবেদ হোসেন (১৯) এবং মাদ্রাসাটির শিক্ষক আফসার উদ্দিন (৩৫)।

সন্দেহভাজন হিসেবে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হলো- আলাউদ্দিন, কেফায়েত উল্লাহ জনি, সাইদুল ইসলাম, আরিফুল ইসলাম, উম্মে সুলতানা পপি, নূর হোসেন ওরফে হোনা মিয়া।

পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জানান, গত ৪ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার সঙ্গে কারাগারে দেখা করে কয়েকজন। এদের মধ্যে ছিল শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ হোসেন, হাফেজ আবদুল কাদেরসহ কয়েকজন। এ সময় রাফিকে হত্যার নির্দেশ দেয় সিরাজ। রাফিকে পুড়িয়ে মারার প্রস্তাব দেয় শামীম। কীভাবে পোড়ানো হবে সে বিষয়ে নূরউদ্দিন ও শামীমের নেতৃত্বে তার বিশদ পরিকল্পনা করা হয়।

পিবিআই প্রধান জানান, গত ২৭ মার্চ নূরসাতকে শ্লীলতাহনির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ কারাগারে যান। তাকে বাঁচানোর জন্য মাকসুদ আলম, নূর উদ্দিন এবং শামীমসহ অনেকে নানা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় স্মারকলিপি দেয়ার পর ৪ এপ্রিল নূর উদ্দিন, শামীম, জাবেদ এবং কাদেরসহ কয়েকজন কারাগারে গিয়ে সিরাজ উদ্দৌলার সঙ্গে দেখা করেন। পরদিন ৫ এপ্রিল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টায় মাদ্রাসার পশ্চিম হোস্টেলে বসে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে।

তিনি বলেন, সেখানেই রাফিকে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই বৈঠকে যারা ছিলেন তারা বিষয়টি আরও ৫ জনের কাছে শেয়ার করে। এদের মধ্যে দুইজন মাদ্রাসা ছাত্রী এবং দুইজন মাদ্রাসা ছাত্রী ছিলেন। এদের মধ্যে এক ছাত্রীয় দায়িত্ব পড়ে ৩টি বোরকা আনা এবং কেরোসিন সরবরাহ করা। ঘটনার দিন ৬ এপ্রিল তিনটি বোরকা এবং পলিথিনে করে কোরোসিন এনে ওই ছাত্রী সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বাথরুমে লুকিয়ে রাখে। পরে এগুলো ছাদে গিয়ে শামীমের কাছে হস্তান্তর করেন। ওই সময় শামীমের সঙ্গে আরও দুইজন ছিলেন।

পিবিআইয়ের ডিআইজি বলেন, পরীক্ষার শুরুর কিছুক্ষন আগে পরিকল্পনা অনুযায়ী চম্পা বা শম্পা গিয়ে রাফিকে খবর দেয়া যে তার (রাফি) বন্ধবী নিশাদতে ছাদে মারধর করা হচ্ছে। এই খবর শোনার পর রাফি ছাদে গেলে তাকে তার (রাফি) ওড়না দিয়ে বেঁধে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ঘটনার বিষয়ে মৃত্যর আগে রাফি তার ভাইয়ের কাছে যে বর্ণনা দিয়েছেন হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সদের কাছেও একই ধরনের বর্ণনা দিয়েছে। মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি বারবার একটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। সেটি হলো ‘ওস্তাদ’। আমরা ওই ওস্তাদকেও খুঁজছি।

তিনি বলেন, ঘাতকদের ধারণা ছিল হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তারা তা সামাল দিতে পারবে। এর আগেও তারা একাধিক ঘটনা সামাল দিয়েছিল। চুন হামলার কারণে রাফি একবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেটি তারা (হামলাকারীরা) সামলে নিয়েছেন। শ্লীলতাহানির ঘটনাটিও তারা সামলে ফেলছিলেন। এসব কারণে তারা মনে করেছিল, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিও তারা ‘ম্যানেজ’ করে ফেলবে।

সংবাদ সম্মেলনে ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জানান, ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষা শুরুর আগে থেকেই ওই মাদ্রাসায় লুকিয়ে ছিল হত্যাকারীরা। মাদ্রাসা কমপ্লেক্সের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে দুটি টয়লেটে লুকিয়ে ছিল তারা। চার হত্যাকারীর মধ্যে একজন মেয়ে বাকি তিনজনকে বোরকা ও কোরোসিন এনে দেয়। আর চম্পা বা শম্পা নামের একটি মেয়ে (পঞ্চম জন) পরীক্ষার হলে গিয়ে নুসরাতকে বলে তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদে মারধর করা হচ্ছে। এই কথা শুনে নুসরাত দৌড়ে ছাদে যান।

তিনি বলেন, এরপর তার হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। অগ্নিসংযোগের পরপরই ঘাতকরা সবার সামনে মাদ্রাসার মূল গেট দিয়ে পালিয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া চারজন এবং নুসরাতকে ডেকে ছাদে নিয়ে আসা চম্পা অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর সবার সামনে দিয়েই মাদ্রাসার মূল গেট দিয়ে পালিয়ে যায়। গেট নিরাপদ রাখতে আগে থেকেই সেখানে পাহারা ও গেট স্বাভাবিক করার কাজে ছিল নূর উদ্দিন ও হাফেজ আবদুল কাদেরসহ পাঁচজন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর সবাই গা ঢাকা দেয়।

বনজ কমুার মজুমদার আরও বলেন, আমরা এখন পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাটি তদন্ত করছি। এর আগে শ্লীলতাহানির অভিযোগে যে মামলাটি হয়েছিল সেটিও তদন্ত করব। কারণ একটি ঘটনার সঙ্গে আরেকটি ঘটনা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

উল্লেখ্য, ১০৮ ঘণ্টা চিকিৎসাধীন থাকার পর ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাফি।

৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। পরিকল্পিতভাবে তাকে ছাদে নিয়ে বোরকা পরা ৪-৫ জন তাকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়।

অস্বীকৃতি জানালে তারা রাফির গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। অগ্নিদগ্ধ রাফিকে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখান থেকে ফেনী সদর হাসপাতালে এবং পরে ওইদিন রাতে ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। একপর্যায়ে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এ ঘটনায় ৮ এপ্রিল রাতে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা ও পৌর কাউন্সিলর মুকছুদ আলমসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন অগ্নিদগ্ধ রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।

এর আগে ২৭ মার্চ ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা। এ ঘটনায় ছাত্রীর মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। আগুনে পোড়ানোর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পৃথক সময়ে ৯ জনের ৫ দিন করে এবং অধ্যক্ষ সিরাজের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

একজনের (জাবেদ হোসেন) রিমান্ড শুনানি আগামি সোমবার অনুষ্ঠিত হবে। তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। অন্য দুইজনকে (শামীম এবং নূর উদ্দিন) শনিবার সন্ধা পর্যন্ত আদালতে হাজির করা হয়নি।

সুত্র: যুগান্তর অনলাইন

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...