সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ ::
কওমী মাদরাসার স্বীকৃতির সাথে সাথে মাদরাসাগুলোর নিবন্ধনের বিষয়টিও এসেছে এবং ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে কেউ কেউ এ নিয়ে কোন যৌক্তিক আলোচনা ও পর্যালোচনা না করেই আবেগি তরুণদের উস্কে দিতে এবং স্বীকৃতি গণদাবীকে বানচাল করতে খুব সুকৌশলে “বাংলা লিংক সিম” থিউরি আবিস্কার করে আলোচিত হবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু উচিত ছিল যথোপযুক্ত পরিবেশে এ নিয়ে বিশদ আলোচনার। লাভ লোকসান ও নিবন্ধের ধরণ নিয়ে রোডম্যাপ উপস্থাপনার। কিন্তু তা না করে ইমোশনাল বক্তব্য এই মুহূর্তে হাস্যকর।
ফলে নিবন্ধনের ব্যাপারে সর্বত্র একটা ভীতি দেখা যাচ্ছে। আমি এটাও মনে করি আলেমদের ভেতর এই ভীতিটাও যৌক্তিক। এবং এটাও মনে করি যে, আলোচনা ও বিশ্লেষণ করে নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তাটি যাচাই করা এবং ভীতির জায়গাটি চিহ্নিত করা একান্ত দরকার। এটি করতে পারলে নিবন্ধন নিয়ে উদ্ভূত এ সংকটটির ব্যাপারে আমরা একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারবো।
নিবন্ধনের প্রক্রিয়াটি দু’ভাবে হতে পারে।
(এক) নিবন্ধন করা বা নিবন্ধন বাতিল করার বিষয়টি কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে দিয়ে সরকার সরাসরি নিজের হাতে রেখে দেবে। অথবা নামমাত্র বোর্ডের হাতে রেখে মূল ক্ষমতাটি নিজের হাতে রেখে দিবে। আমি এ প্রক্রিয়াটি সমর্থন করি না এবং মনে করি এভাবে হলে কওমী মাদরাসাগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা কোনভাবেই হতে দেওয়া যায় না।
(দুই) নিবন্ধন সংক্রান্ত বিষয়টি সরকার উলামায়ে কেরাম দ্বারা গঠিত কওমী মাদরাসা কর্তৃপক্ষের হাতে সম্পূর্ণরূপে ন্যস্ত করে দিবে। কর্তৃপক্ষের উলামায়ে কেরাম সারা দেশের বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের সাথে আলোচনা করে এ শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও মান সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি যৌক্তিক ও কল্যাণকর নীতিমালা তৈরী করবেন। সরকার শুধুমাত্র এ নীতিমালাকে বৈধতা দিবে।
ব্যস্, এখানে সরকারের আর কোন হাত থাকবে না। এবার যারা এ নীতিমালায় উত্তীর্ণ হবেন তারাই কেবল নিবন্ধিত হতে পারবেন। (যা কওমি মাদরাসা শিক্ষা নীতির ৬টি শর্তে ও খসড়া অথরিটি আইনে দ্বিতীয় রেজিস্টেশন প্রদ্ধতিটি স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
এ নীতিমালা তৈরি করতে গিয়ে আয়সামর্থ, শিক্ষকসামর্থ, ভবনসামর্থ, বিষয়বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি বিষয়গুলো সামনে রাখা যেতে পারে। বিষয়বাধ্যবাধকতা দ্বারা আমি বোঝাচ্ছি- কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দিবে যে, এই এই বিষয়গুলো অবশ্যই পড়াতে হবে। বিষয়গুলোর জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী আলাদা আলাদা স্তর নির্ধারণ করা যেতে পারে।
শিক্ষাব্যবস্থাটিকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ এ তিন স্তরে ভাগ করে দিয়ে নীতিমালার কতটুকু কোন স্তরের জন্য প্রযোজ্য তা ঠিক করে দেওয়া হবে। নিচের স্তর থেকে উপরের স্তরে উন্নীত করতে হলে যথাযথ এবিলিটি দেখিয়ে বোর্ড থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
এখানে একটা সমস্যা হলো ইতিমধ্যে যে মাদরাসাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সেগুলোকে এ নীতিমালার আওতায় এনে নিবন্ধন দিতে হলে আবশ্যকভাবে একটা সংকট দেখা। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাগুলোর জন্য এ নীতিমালার বাধ্যবাধকতা না রেখে তাদেরকে নীতিমালার দ্বারা কাঙ্ক্ষিত উন্নতিতে উঠে আসার জন্য সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে।
এবং আবারো বলছি- নীতিমালা প্রণয়ণের এ কাজটি সম্পূর্ণরূপে উলামায়ে কেরাম দ্বারা গঠিত কওমী কর্তৃপক্ষের হাতে থাকবে। সরকারের কোন ধরণের হস্তক্ষেপ থাকতে পারবে না। এবং কর্তৃপক্ষের সুপারিশ ছাড়া সরকার এর মধ্যে কোন ধরণের রদবদল করতে পারবে না।
আমি মনে করি এ ধরণের নিবন্ধন হলে সমস্যা নেই; বরং আমি বলবো এরকম একটি নিবন্ধননীতি হওয়া উচিত। এর মাধ্যমে কল্যাণ হবে, ক্ষতির কোন আশংকা নেই।
যদি এমন আশংকা হয় যে, সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার পর নিবন্ধনের এ প্রক্রিয়াটি না দিয়ে প্রথম প্রক্রিয়াতেই যাবে। এমন যদি আশংকা হয় তাহলে আমি বলবো শিক্ষা নীতিমালার বাহিরে নিশ্চয়তার জন্য মূল স্বীকৃতির আইনের সাথে নিবন্ধনের এ প্রক্রিয়াটিকে শর্তযুক্ত করে আরো মজুবত করে পরিস্কারভাবে দেওয়া যেতে পারে। এ পরামর্শ দিয়ে বড়দের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের যথার্থ পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তাহলে স্বীকৃতি এলে অটোমেটিক সাথে নিবন্ধনের কাঙ্ক্ষিত সে রূপটিও চলে আসবে।
এবার আসি নতুন থিউরিতে :
“কওমি মাদরাসা বাংলালিংকের সিম নয় যে, রেজিস্টশন করতে হবে” এটি বেফাকের জাতীয় উলামা মাশায়েখ সম্মেলনে একটি আলোচিত মন্তব্য।
ভার্চুয়াল জগতে দেখলাম এ নিয়ে ব্যাপক প্রসংশা। এটা নাকি সময়ের সেরা বক্তৃতা হিসেবে আবেগী তরুণদের হৃদয় ছুয়ে গেছে। আসলেই আমরা কতোটা আবেগপ্রবণ জাতি আর হুজুগি এই বক্তৃতা আর বক্তৃতা নিয়ে উচ্ছাস তার প্রমাণ বহন করে।
তাহলে কথা থাকে, আমরা যারা কাজি অফিসে বিয়ের রেজিস্টেশন করেছি, তা কেন রেজিস্টেশন করতে হচ্ছে এবং সবাই করছেন। তাছাড়া ইসলামে এই নিয়ম কি আছে। আমাদের আকাবির আসলাফগণ কি যুগ যুগ ধরে নিকাহ রেজিস্টেশন করে আসছিলেন? তাহলে সরকারের আইন মেনে কেন লাখ লাখ মাদরাসা শিক্ষিত আলেমরা বিবাহে কাবিননামা করছেন। এর অর্থ কি বিবাহ বা বৌ বাংলালিংকের সিম?
রেজিস্টেশন করলেই কি বাংলালিংকের সিম হয়ে যায় এটা কেমন যুক্তি? হাস্যকর বক্তৃতা। রেজিস্টেশন করলেই যদি বাংলালিংকের সিম হয়ে যায় তাহলে এটা কেন করা হচ্ছে। সিমের সাথে প্রতিষ্ঠান বা গুরুত্বপূর্ণ কাজের রেজিস্টেশনের তুলনা শিশুসুলভ বক্তৃতা। তিনি যে চরম আবেগি একজন মানুষ তা এমন কথা প্রমাণ করে। বাস্তবতার সাথে সম্পৃক্ত কোন মানুষ বাস্তবতার আলোকে এমন হুজুগী কথা বলতে পারেন না।
বিয়ের কথা বাদ দিলাম। বাংলাদেশে অসংখ্য ইসলামি পত্রিকা আছে, যা সরকারি রেজিস্টেশন নেয়া। ঐ বক্তারও একটি মাসিক রেজিস্টশনকৃত পত্রিকা আছে। তাহলে সেটাও কি বাংলালিংক সিম সমতুল্য। বাংলালিংক সিম বলে রেজিস্টেশন বিষয়কে যদি হালকা বুঝানো উনার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে কি উনার মাসিক পত্রিকাকে সে দৃষ্টিকোন থেকেই সরকারি শর্ত মেনে রেজিস্টেশন করিয়েছেন?
রেজিস্টেশনের ফিরিস্তি বললে অনেক লম্বা হয়ে যাবে? আমরা যখন কথা বলি কিংবা মাইক পেলে বাস্তবতা আর নিজের অবস্থানের কথা ভুলে যাই। এসব আবেগি ছেলেমানুষি বক্তৃতাই ৫মে শাপলা ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছিল। কেউ কেউ তো আল্লামা আহমদ শফীকে আর বাবুনগরীকে ৫মে থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন। কেউ সংসদ ভবনে আগুন ও বঙ্গবভনের ইট খুলে আনার আবেগের ছুটে হুমকি দিতেও কার্পন্য করেন নি।
যাক যে কথা বলেছিলাম, বাংলালিংক সিমের থিউরি যিনি দিয়েছেন, তার কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলও রয়েছে। গণতন্ত্রের নানান শর্ত মেনেই কুফরি তরিয় রেজিস্টেশন করেছেন। দলটিও কি বাংলালিংকের সিম? কিংবা তার চেয়েও কম মূল্যের যে কুফরি নানা বিষয়ে সম্মতি দিয়ে নির্বাচন কমিশনে রেজিস্টেশন করতে হয়েছে! কারন রাজনীতি করলে আপনি সে রেজিস্টশন করতে বাধ্য। যে রাষ্ট্র আপনার গণমানুষের সংগঠনকে বাধ্য করতে পেরেছে কুফরি বিষয় মেনে রেজিস্টেশন করতে। কারন সরকার বা রাষ্ট্র চাইলে, আপনি আপনার সবকিছু রেজিস্টেশন করতে বাধ্য। গাড়ি, বাড়ি, নারী। ভোটার আইডি কার্ড বা জন্ম নিবন্ধন কার্ডওতো একটি রেজিস্টেশন প্রক্রিয়া। তাহলে আমরা সবাই কি এখন বাংলালিংক সিম? এসব কথা না বলে বাস্তব কথা বলুন। যেমন জমি রেজিস্টেশন করার সময় যে কোন সময় তা সরকার একুয়ার করার বা হস্তক্ষেপ করার শর্তেই রেজিস্টার করতে হচ্ছে। কারন এটা দেশের আইন। সকল নাগরিক মানতে বাধ্য।
এভাবে তো সরকার চাইলে সংসদে কওমি মাদরাসা রেজিস্টেশন আইন বিল পাশ করতে পারে। তখন মানতে বাধ্য হতে হবে। কওমি মাদরাসা তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আপন স্বকীয়তা হারাবে। তারচেয়ে এটা কি ভাল নয় যে “কওমি মাদরাসা কতৃপক্ষ আইন” বিল পাশ হয়ে সরকারের খবরদারিমুক্ত আলেমদের তত্বাবধানে রেজিস্টেশনের স্থায়ী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া। এতে করে কওমি মাদরাসা স্থায়ীভাবে আরো বেশি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার স্বকীয় ঐতিহ্যকে মজবুতভাবে আকড়ে থাকতে পারবে।