রবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ৯:১৩
Home / আকাবির-আসলাফ / উসূলে হাশতগানা ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার কার্যকারিতা
দারুল উলূম দেওবন্দ

উসূলে হাশতগানা ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার কার্যকারিতা

দারুল উলূম দেওবন্দ
দারুল উলূম দেওবন্দ

দারুল উলুম দেওবন্দের ওয়েব সাইট থেকে

ভাষান্তর: কাজি মুহাম্মাদ হানীফ

উসূলে হাশতেগানা এর রচয়িতা

মহান শিক্ষাসাধক ও সংস্কারক কাসেমুল উলূম ওয়াল খায়রাত হযরত কাসেম নানুতুবী রহ. পরাধীন ভারতে ধ্বসে পড়া ইসলামি শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার মহান লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে গণ-চাঁদার উপর ভিত্তি করে শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। সময় ও অবস্থার প্রেক্ষাপটে সে ধারাকে সুশৃঙ্খলভাবে টিকিয়ে রাখা এবং তার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এ সকল দীনী প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ করে দারুল উলূম দেওবন্দের জন্য তিনি তাঁর বিদগ্ধ চিন্তার আলোকে কতিপয় মূলনীতি প্রবর্তন করেছিলেন। ইতিহাসে এই মূলনীতিগুলোই ‘উসূলে হাশতগানা’ বা ‘মূলনীতি অষ্টক’ নামে পরিচিত। রচয়িতা তার দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার আলোকে এবং সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় অনুদানের প্রাচীন ধারার পরিবর্তে গণচাঁদার বিষয়টির প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। সেই নীতিমালায় তিনি এ কথাও উল্লেখ করেছেন, যে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য মৌলিকভাবে এ সকল নীতিমালাকে অত্যাবশ্যকীয় মনে করতে হবে।

মূলনীতি অষ্টকঃ

১.যথাসম্ভব মাদরাসার কর্মচারী ও কর্মকর্তাদেরকে অধিকহারে চাঁদা আদায়ের বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজেও এর জন্য চেষ্টা করতে হবে, অন্যের মাধ্যমেও চেষ্টা করাতে হবে। মাদরাসার হিতাকাঙ্খীদেরও এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

২.যেভাবেই হোক মাদরাসার ছাত্রদের খানা চালু রাখতে হবে বরং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি করার ব্যাপারে হিতাকাঙ্খী ও কল্যাণকামীদের সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

৩.মাদরাসার উপদেষ্টাগণকে মাদরাসার উন্নতি, অগ্রগতি এবং সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজের মত প্রতিষ্ঠার একগুঁয়েমী যাতে কারো মাঝে না হয় এ দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আল্লাহ না করুন যদি এমন অবস্থা দেখা দেয় যে, উপদেষ্টাগণ নিজ নিজ মতের বিরোধিতা কিংবা অন্যের মতামতের সমর্থন করার বিষয়টি সহনশীলভাবে গ্রহণ করতে না পারেন তাহলে এ প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিমূল নড়বড়ে হয়ে পড়বে। আর যথাসম্ভব মুক্ত মনে পরামর্শ দিতে হবে এবং মাদরাসার শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি লক্ষণীয় হতে হবে।  নিজেরমত প্রতিষ্ঠার মনোবৃত্তি না থাকতে হবে। এ জন্য পরামর্শদাতাকে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তার মতামত গ্রহণীয় হওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই আশাবাদী না হতে হবে। পক্ষান্তরে শ্রোতাদেরকে মুক্তমন ও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তা  শুনতে হবে। অর্থাৎ এরূপ মনোবৃত্তি রাখতে হবে যে, যদি অন্যের মত যুক্তিযুক্ত ও বোধগম্য হয়, তাহলে নিজের মতের বিপরীত হলেও তা গ্রহণ করে নেওয়া হবে। আর মুহতামিম বা পরিচালকের জন্য পরামর্শসাপেক্ষে সম্পাদনীয় বিষয়ে উপদেষ্টাগণের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া অবশ্যই জরুরী। তবে মুহতামিম নিয়মিত উপদেষ্টাদের থেকেও পরামর্শ করতে পারবেন কিংবা তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত এমন কোন বিদগ্ধ জ্ঞানী আলেম থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন যিনি সকল দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের জন্য হিতাকাঙ্খী ও কল্যাণকামী। তবে যদি ঘটনাক্রমে উপদেষ্টা পরিষদের সকল সদস্যের সাথে পরামর্শ করার সুযোগ না হয় এবং প্রয়োজনমাফিক উপদেষ্টা পরিষদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যের সাথে পরামর্শক্রমে কাজ করে ফেলা হয়, তাহলে কেবল এ জন্য অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত হবে না যে, ‘আমার সাথে পরামর্শ করা হল না কেন?’ কিন্তু যদি মুহতামিম কারো সঙ্গেই পরামর্শ না করেন, তাহলে অবশ্যই উপদেষ্টা পরিষদ আপত্তি করতে পারবে।

৪.মাদরাসার সকল শিক্ষককে অবশ্যই সমমনা ও একই চিন্তা চেতনার অনুসারী হতে হবে। সমকালীন (দুনিয়াদার) আলেমদের ন্যায় নিজ স্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার দুরভিসন্ধিতে লিপ্ত না হতে হবে। আল্লাহ না করুন যদি কখনো এরূপ অবস্থা দেখা দেয়, তাহলে মাদরাসার জন্য এটি মোটেও কল্যাণকর হবে না।

৫.পূর্ব থেকে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারিত রয়েছে কিংবা পরবর্তীতে পরামর্শের ভিত্তিতে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করা হবে, তা যাতে সমাপ্ত হয়; এই ভিত্তিতেই পাঠদান করতে হবে। অন্যথায় এ প্রতিষ্ঠান সুপ্রতিষ্ঠিতই হবে না, আর যদি হয়ও তবু তা ফায়দাজনক হবে না।

৬.এ প্রতিষ্ঠানের জন্য যতদিন পর্যন্ত কোন স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হবে; ততদিন পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার শর্তে তা এমনিভাবেই চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু যদি স্থায়ী আয়ের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যেমন কোন জায়গীর লাভ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, মিল ফ্যাক্টরী গড়ে তোলা কিংবা বিশ্বস্ত কোন আমীর উমারার অনুদানের অঙ্গীকার ইত্যাদি, তাহলে এরূপ মনে হচ্ছে যে, আল্লাহর প্রতি ভয় ও আশার দোদুল্যমান অবস্থা; যা মূলতঃ আল্লাহমুখী হওয়ার মূল পুঁজি, তা হাত ছাড়া হয়ে যাবে এবং গায়েবী সাহায্যের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। তদুপরি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও কর্মচারীগণের মাঝে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও কলহ বিবাদ দেখা দিবে। বস্তুতঃ আয় আমদানি ও গৃহাদি নির্মাণের বিষয়ে অনেকটাই অনাড়ম্বরতা ও উপায় উপকরণহীন অবস্থা বহাল রাখার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

৭.সরকার ও আমীর উমারাদের সংশ্লিষ্টতাও এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে হচ্ছে।

৮.যথা সম্ভব এমন ব্যক্তিদের চাঁদাই প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক বরকতময় হবে বলে মনে হচ্ছে; যাদের চাঁদাদানের মাধ্যমে সুখ্যাতি লাভের প্রত্যাশা থাকবে না। বস্তুতঃ চাঁদাদাতাগণের নেক নিয়ত প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক স্থায়ীত্বের কারণ হবে বলে মনে হয়।

হযরত মাও. কারী তাইয়্যিব রাহ. এই আটটি মূলনীতির অত্যন্ত পান্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা করেছেন, যা ‘‘আজাদীয়ে হিন্দ কা খামোশ রাহনূমা” (ভারত স্বাধীনতার নীরব পথ প্রদর্শক) নামে একটি পৃথক পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।

আজ থেকে নিয়ে শত বৎসর পূর্বে পরাধীন ভারতের মুসলিম ও ইসলামি শিক্ষার ধ্বংস সাধনে তৎপর সরকারের মুকাবেলায় নিস্কণ্টকভাবে ইসলামী শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার এবং পরাধীনতার গ্লানিতে মুসলিম জাতির মৃত চেতনাকে পুনঃজাগরিত করার এই যে নীরব কর্মকান্ড হযরত নানুতুবী রাহ. শুরু করেছিলেন এবং ইংরেজ সরকারের শ্যেনদৃষ্টির মাঝেও প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি যে মূলনীতিগুলো পেশ করেছিলেন, তাকে হয়ত তাঁর অসাধারণ দূরদর্শীতা বলতে হবে, নচেৎ তাকে ইলহামী বিষয় বলতে হবে। এই নীতিমালার মাঝে সময়ের প্রেক্ষাপটে যে অসীম দূরদর্শীতা ও দার্শনিক বিচক্ষণতা রয়েছে তা ব্যাখ্যা করতে গেলে বৃহৎ কলেবরের গ্রন্থ হয়ে যাবে। খিলফত আন্দোলনের তৎপরতা চলাকালে মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর দারুল উলুমে এসেছিলেন। তিনি এই ‘উসূলে হাশতেগানা’ পড়ে চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে  দিয়ে বলেছিলেন, এগুলো কেবল মানবিক মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তি নির্ভর মূলনীতি নয় এগুলো তো নিরেট ইলহাম ও মারিফাতের প্র¯্রবণ থেকে উৎসারিত চিন্তা। আশ্চর্যের বিষয় যে, শত বৎসর পর অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আমরা এসে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি; এই বুজুর্গ শত বৎসর পূর্বেই তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার কার্যকারিতাঃ

পরাধীন ভারতে সাম্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে ক্ষয়প্রাপ্ত ইসলামি শিক্ষাধারাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য হযরত নানুতুবী রাহ. কর্তৃক প্রণীত দিক নির্দেশনামূলক এই নীতিমালা যে মৃতসঞ্জিবনীবৎ ছিল একথা বলাই বাহুল্য। আর এ নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের সঠিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা বিস্তার, তাহযীব ও তামাদ্দুনের সংরক্ষণ, কুসংস্কার উচ্ছেদ, দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে দ্বীনি পরিবেশ গঠন, আযাদী আন্দোলনের পটভূমি তৈরী, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে অসামান্য অবদান রেখেছে, তার খতিয়ান তৈরী করলেই এসব নীতিমালার সুফল সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।

তবু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এসকল নীতিমালা পরাধীনতার অক্টোপাশে বন্দীদশার শিকার হয়ে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা ও এক চরম অসহায়জনক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রচনা করা হয়েছিল। কালের প্রেক্ষিতে তার তাৎপর্য যত গভীরই হোক এবং তার ফলাফল যত ব্যাপক ও বিস্তৃতই হোক; সর্বকালেই যে সেগুলো তেমনি আবেদনশীল থাকবে তা নাও হতে পারে। পরাধীনতার আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে যা নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে; স্বাধীন ও মুক্ত জীবনেও তা অপরবর্তনীয় রূপে আঁকড়ে থাকতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই।

সুতরাং আজকের পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে সেগুলো পুনঃমূল্যায়ন করে দেখেতে দোষ কি? বরং যুগ ও পরিবেশের পরিবর্তনের নিরিখে সে সকল ধারার কার্যকারিতা কতটুকু অবশিষ্ট আছে এবং বর্তমানের চাহিদার আলোকে আমাদের শিক্ষাধারার জন্য সেগুলো কতটুকু উপযোগী তা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখাই সময়ের দাবী।

সরকারী অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার কারণে ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা অর্থনৈতিক দৈন্যের শিকার হয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া সরকারী অনুদানে পরিচালিত আলিয়া মাদ্রাসাসমূহের উপর সরকারী হস্তেক্ষেপের ফলে সেগুলো দ্বারা ইসলামী মূল্যবোধের বিকাশের সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ। ত্রিতৃবাদে বিশ্বাসী পরপর ২৬ জন খ্রিস্টান প্রিন্সিপ্যাল যেখানে আলিয়া মাদ্রাসার পরিচালনায় ছিলেন সেখানে একেশ্বরবাদী মুসলামানদের শিক্ষা-দীক্ষার উন্নতি ও পরাধীন জাতির মাঝে স্বাধীনতার চেতনা উজ্জীবিত করার জন্য তা কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে তা ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন রাখে না। এমতাবস্থায় মুসলমানদের স্বকীয় শিক্ষাধারাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে সরকারি অনুদান গ্রহণ করার কোন অর্থ হয় না। আবার শিক্ষাকে বিসর্জন দিয়ে জাতিকে অশিক্ষা ও কুশিক্ষার অন্ধকারে হারিয়ে যেতেও দেওয়া যায়না। একারণেই সে মূলনীতিতে গণ-চাঁদার বিষয়টির উপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সম্ভবতঃ একই কারণ সরকার ও আমীর উমরাদের অংশ গ্রহণকেও প্রতিষ্ঠানের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তাছাড়া গণজাগরণ সৃষ্টির জন্য গণসংযোগ ছিল একান্ত অপরিহার্য; একারণেও জনগণের চাঁদার উপর গুরুত্ব দেওয়া ছিল সময়ের একটি নিরাপদ উপায়। কিন্তু  গণ-চাঁদার এই ধারাকে চিরদিন অবিকল অব্যাহত রাখতে হবে এর কোন অর্থ নেই। এদেশে বহু স্বায়ত্বশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েও সরকারি অর্থানুকূল্য পাচ্ছে। অথচ স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে আমরা কেন পাব না এই অর্থনৈতিক সুবিধা? সরকার তার মত চাপিয়ে দেবে এই ভয়ে আমরা আমাদের প্রাপ্য নাগরিক অধিকারটুকুর দাবি জানাতেও নারাজ। কেন? ইউনিভার্সিটির শিক্ষা সিলেবাস ও তার প্রশাসনিক নীতিতে কি সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে? আমরা হয়তো তাও জানি না।

মুসলিম বিদ্বেষী সা¤্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠী মুসলমানদেরকে সকল দিক থেকে পঙ্গু করে দেওয়ার জণ্য সব ধরনের চেষ্টা চালাতে মোটেও কার্পণ্য করেনি। মুসলমানদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া ছিল তখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অচল করে দেওয়ার দূরভিসন্ধিতেই তারা ইতিপূর্বে সকল ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। সুতরাং এমতাবস্থায় মাদ্রাসার জন্য কোন স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করার অর্থ ছিল ইংরেজদের কোপ  দৃষ্টিতে নিপতিত হওয়া। অর্থলিপ্সু ইংরেজরা স্থায়ী আয়ের উৎসের সন্ধান পেলে তা বাজেয়াপ্ত করতে কালবিলম্ব করবে না। ফলে আবার বন্ধ হয়ে যাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। সম্ভবত স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করতে নিষেধ করার পেছনে এটিও একটি কারণ ছিল। অবশ্য তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ-এর যে বিষয়টি সে ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে তা আংশিক স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করার পরও বহাল থাকে। তাছাড়া স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি ইসলামী শরীয়তের পরিপন্থীও নয়। আজকের যুগ-মানসিকতার আলোকে একান্ত সাহায্য নিভর হওয়ার অর্থ; মানুষের দৃষ্টিতে ইসলামী শিক্ষার গুরুত্বকে হালকা করে দেওয়া। তদুপরি তখন মানুষ যতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ সকল প্রতিষ্ঠানে দান করার জন্য আগ্রহী ছিল বর্তমানে সে অবস্থা অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে বরং এখন আলেম উলামাদের যথেষ্ট লাঞ্চনা গঞ্জনা সহ্য করেই চাঁদা আদায়ের জন্য ধনীদের দ্বারস্থ হতে হয়। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানও দিন দিন বাড়ছে, ফলে চাঁদার চাপও বাড়ছে। আরও অনেক ধরনের স্বার্থান্বেষী চাঁদাবাজও সমাজে আত্মপ্রকাশ করেছে। ফলে চাঁদার বিষয়টি ক্রমাম্বয়েই স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে ফেলছে। আমাদের তাওয়াক্কুলও বস্তবাদী সভ্যতার চাপে আগের তুলনায় অনেক খানি হ্রাস পেয়েছে। এমতাবস্থায় কিছু স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করে, আর কিছুটা তাওয়াক্কুলের জন্য রেখে দিলে (যদি তা শরীয়তের পরিপন্থী না হয়) ঐ মূলনীতিরও কিছুটা রক্ষা হল, আর আমরাও লঞ্চনার হাত থেকে অনেকটা রেহাই পেলাম। ইসলামী শিক্ষাও হয়ত এ পন্থায় অনেকখানি গুরুত্ববহ হয়ে উঠবে। ধনবানদের দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিয়ে তাদেরকে অনুদানের ভিত্তিতে পরিচালনা কমিটির অন্তর্ভূক্ত করে ক্রমান্বয়ে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, তাও ভেবে দেখা উচিৎ নয় কি? এতে কি আট মূলনীতির একটি ধারা লঙ্ঘিত হচেছ না?  যারা চাঁদা দিয়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় কিংবা সুনাম সুখ্যাতি কুঁড়াতে চায় এমন লোকের চাঁদা কি আমরা গ্রহণ করছি না? এধরনের ব্যক্তিদের চাঁদা গ্রহণ না করার কথাও কিন্তু সেই মূলনীতিতে উল্লেখ রয়েছে। তাহলে আংশিক স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা গ্রহনের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে দোষ কি?

তবে সেই মূলনীতিগুলোতে কিছু কিছু ধারা এমনও রয়েছে যা আগের চেয়ে এখন আরও বেশি প্রয়োজনীয়। যেমন ছাত্রদের আবাসিক সুবিধা, আহার্যের ব্যবস্থা, শিক্ষা-উপকরণ সরবরাহ এগুলো আগের তুলনায় এখন আরো বেশী প্রয়োজন। সিলেবাস পূর্ণ করার যে ধারাটি রয়েছে তার গুরুত্ব এখনও সমানভাবে বিদ্যমান। কিন্তু যেখানে সে ধারাতেই উল্লেখ রয়েছে যে, বর্তমানে যে সিলেবাস নির্ধারিত রয়েছে কিংবা পরে পরামর্শক্রমে যে সিলেবাস নির্ধারণ করা হবে তা অবশ্যই পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু যুগ চাহিদার প্রশ্নে সিলেবাস নবায়নের বিষয়টি নিয়ে আমরা অদৌ কি কোন চিন্তা করছি? অথচ এ বিষয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন এখন অনেক বেশী।

যদিও এ সিলেবাসের উদ্দেশ্যের কথা ক্বারী তাইয়্যিব রাহ. এভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, ‘এর উদ্দেশ্য ছাত্রদের মাঝে জ্ঞান আহরণের যোগ্যতা সৃষ্টি করা, সব বিষয়ের জ্ঞান দান করা নয়।’ তবু সময়ের প্রয়োজনে যদি কোন পরিবর্তনের বা সংযোজনের প্রয়োজন হয়; তাহলে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে অসুবিধা কোথায়? আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, হযরত নানুতুবি রাহ. পূর্বপ্রচলিত সিলেবাসে সময়ের চাহিদা অনুসারে সংস্কার করেই দারুল উলূমের নেসাব তৈরী করেছিলেন। আর সময়ের চাহিদা পূরণ করে নেসাব তৈরী করেই তিনি ইতিহাসের সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন।

তাই বলতে হয়, আমরা সময় ও অবস্থার প্রেক্ষাপটে এ সকল মূলনীতির সবগুলোই পূর্ণাঙ্গভাবে মানতে পারছি না। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তা লঙ্ঘিত হয়েই যাচ্ছে। অত:এব সুস্থ চিন্তার আলোকে এগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতঃ একটি সুস্পষ্ট গতিপথ নির্ধারণ করা উচিৎ বলে আমরা মনে করি।

দারুল উলূমের নেজামে তা’লীম বা শিক্ষা ব্যবস্থা:

শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে দারুল উলূমের প্রাচীন প্রথাসমূহের যথেষ্ট সংস্কার সাধন করা হয় এবং একটি অত্যাধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। নি¤েœ তার কতিপয় বিশেষ দিকের উল্লেখ করা গেল।

১.জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অনুদানের উপর ভিত্তি করে একটি নতুন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন দান করা হয়। যার ফলে সকল প্রকার সরকারি প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং শিক্ষা তার নিজস্ব গতিতে অগ্রসর হওয়ার অবাধ সুযোগ লাভ করে।

২.বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফলে শিক্ষা আয়-উপার্জনের পন্থা বলে যে ধারণা জন্ম নিয়েছিল তার বিপরীতে কেবল জ্ঞান আহরণের জন্য এবং ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষ ও নৈতিক উন্নতির জন্য শিক্ষা অর্জন করতে হবে এরূপ একটি দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির মাধ্যমে শিক্ষার মাহাত্ম্যকে তুলে ধরা এবং শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্যকে একটি সুন্দর খাতে প্রবাহিত করার জন্য এ প্রতিষ্ঠানে একটি ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা হয়। অর্থাৎ এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের মাঝে এ চেতনাকে বদ্ধমূল করে দেওয়া হয় যে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল সঠিক জ্ঞান আহরণ করতঃ সে নিরিখে নিজের জীবনকে গড়ে তোলা এবং মহান প্রতিপালকের নির্দেশিত পথে নিজেকে পরিচালিত করে তার সন্তুষ্টি লাভ করা। সনদ, সার্টিফিকেট, চাকুরীÑবাকুরী আদৌ শিক্ষার মূল উদ্দ্যেশ্য নয়। ফলে এ ধারার প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকাংশেই দুর্নীতির প্রভাব থেকে মুক্ত থেকেছে।

৩.সর্বশ্রেণির ও সকল বয়সের মানুষই যাতে এ প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করতে পারে, এ ধরনের একটি ব্যাপক ববস্থা এ প্রতিষ্ঠানে রাখা হয় এবং সকল মত ও পথের অনুসারীরাই যাতে এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করতে পারে, এতটুকু উদার ব্যবস্থা রাখা হয়।

৪.ক্লাসভিত্তিক পাঠদানের পাশাপাশি পরীক্ষা গ্রহণের কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে প্রতিযোগিতামূলক লেখা পড়ার দ্বার উন্মুক্ত হয় এবং অল্প সময়ে অনেক ছাত্রকে শিক্ষাদানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

৫.সনদ প্রদানের ধারা প্রবর্তন করা হয়। এতে ছাত্রদের উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায় ও শিক্ষার একটি মান সূচিত হয়। তা ছাড়া সমাজও প্রকৃত আলেমদেরকে সনাক্ত করতে সমর্থ হয়।

৬.ছাত্রদের উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতামূলক লেখা পড়ার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কৃতি ছাত্রদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করা হয়।

৭.সিলেবাসে দ্বীনী বিষয়সমূহের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ এবং পঠিত ও অর্জিত বিষয়ের উপর আমল করার ব্যাপারে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দান করা হয় এবং আমল আখলাকের প্রতি অধিক গুরুত্ব দানের ফলে আদর্শবান, আমলদার, দ্বীনদার, নৈতিক মানোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী তৈরির পথ সুগম হয়।

৮.পাঠাবস্থায় অর্থনৈতিক চাপ যাতে ছাত্রকে বিব্রত না করে এবং তার অধ্যয়নে বিঘœ সৃষ্টি করতে না পারে, তা ছাড়া গরীব অসহায় ছাত্ররা যাতে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়ে যায়, এ জন্য ছাত্রদের যাবতীয় ব্যয়ভার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বহন করার এক অভিনব পন্থাও এ প্রতিষ্ঠানে চালু করা হয়।

৯.জীবিকার প্রয়োজনে শিক্ষা সমাপনের পর এ প্রতিষ্ঠানের সনদ প্রাপ্তরা যাতে আদর্শ বিক্রি করতে বাধ্য না হয়ে পড়ে এবং জীবিকার সমস্যায় হাবুডুবু না খায়, এ জন্য উপযোগী কারীগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও এ প্রতিষ্ঠানে রাখা হয়।

১০.সামর্থবানরা যাতে উচ্চতর গবেষণামূলক শিক্ষা লাভে ব্রতী হতে পারে এবং গবেষণার মাধ্যমে যুগ-সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে পারে, এ জন্য উচ্চতর গবেষণামূলক শিক্ষার সুব্যবস্থা করা হয়।

মূলতঃ সময়ের প্রেক্ষিতে এগুলো ছিল অভিনব প্রয়াস। আর এরূপ একটি শিক্ষব্যবস্থা ও সুষ্ঠু পরিচালনা নীতি অবলম্বনের ফলে অতি অল্প দিনে এ শিক্ষাধারা ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি এশিয়া মহাদেশের গন্ডি  পেরিয়ে বর্তমান ইউরোপ আমেরিকাতেও এ শিক্ষা ধারার অনুকরণে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান। যেখান থেকে নির্ভেজাল দ্বীনী শিক্ষা লাভ করছে অসংখ্য তালিবে ইলম। যারা সারা দুনিয়ায় নিঃস্বার্থভাবে সহীহ দ্বীনের মুখপত্র হিসাবে খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে জরুরী কিছু কথা!

কমাশিসা ডেস্ক: শুক্রবার ২৫সেপ্টেম্বার ২০২০. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনি যখন কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির ...