ইবরাহিম খলিল : টুকরো কাগজটি দেখে আঁতকে উঠলো ছেলেটি। হৃদয়টা তার মোচড় দিয়ে উঠলো। কী আশ্চর্য! ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা কাগজের টুকরোটি ময়লা নোংরায় পড়ে আছে! যেনো চিৎকার করে তাকে ডাকছে। তেমনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে সে টুকরোটি তুলে নিলো। পাক কালামের অবমাননায় হৃদয় তার ভীত উৎকণ্ঠিত হলো। পরে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করলো এবং আতর লাগিয়ে উঁচু তাকে রেখে দিলো।
আল্লাহ পাকের অপার কুদরত বোঝা দায়! পাক কালামের এই সম্মানটুকুর কারণে আল্লাহ পাক তার অন্তরে কুরআনের প্রেম ঢেলে দিলেন। কুরআন মুখস্থ করার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে পড়লো। কিন্তু কোথায় পড়বে? কার কাছে পড়বে? সে শুনেছে ভারতের পানিপথ হিফযে কুরআনের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু নোয়াখালি থেকে পানিপথ, সে তো অনেক দূরের পথ! একটা বালকের পক্ষে এতদূর যাওয়া অসম্ভব না হলেও কঠিন তো বটেই। তাছাড়া মুরুব্বিদের অনুমতির ব্যাপার আছে। এতটুকুন ছেলেকে এতদূর যাওয়ার অনুমতি তাঁরা দেবেন না নিশ্চিয়ই।
কিন্তু বালক মুহাম্মদুল্লাহ হাল ছাড়ার পাত্র নন। দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় তিনি উদ্দীপ্ত হলেন—যে কোনো উপায়ে পানিপথ যাবেন। এক্ষেত্রে শেখ সা’দির একটি কবিতা তাকে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করলো। বুস্তার এক কবিতায় তিনি পড়েছেন, যার অর্থ হলো— কোনো কিছু পাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা নিয়ে যখন নিজের সবকিছু তুমি উজাড় করে দেবে, অচিরেই তা তোমার পদতলে এসে ধরা দেবে।
কবিতাটি পড়ে তিনি এতোটাই উদ্দীপ্ত হলেন যে, তখনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, পানিপথ যাবেন।
একদিন দেড় টাকা সম্বল করে আল্লাহর ওপর ভরসা করে তিনি গোপনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। নোয়াখালি থেকে পায়ে হেঁটে চাঁদপুর এলেন। সেখানে এক পীর সাহেবের খাদেম সঙ্গে তার পরিচয় হয়। খাদেম পীর সাহেবকে না জানিয়ে তার ভারতস্থ বাড়িতে যাচ্ছিলো। উভয়ে স্টীমারের অপেক্ষায় ছিলেন। খাদেম তার মনোবাসনা জানতে পেরে তাকে সঙ্গে নেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলো এবং নিজের সঙ্গে তার জন্যও একটা টিকেট ক্রয় করলো। কিন্তু স্টীমার ছাড়ার পূর্বেই খাদেমকে পীর সাহেবের লোকেরা ধরে নিয়ে গেলো।
এবার তিনি একাকী স্টীমারে খুলনা রওয়ানা হলেন। সেখান থেকে রেল লাইন ধরে হেঁটে হেঁটে যশোরের দিকে এগুতে লাগলেন। কিন্তু নোয়াপাড়া পৌঁছলে একটা পাগলা কুকুর তার পায়ে কামড় দিলো। স্থানীয় লোকজন প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে খুলনা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলো। সেকালে কুকুরের কামড়ের চিকিৎসা ভারতের কেশওয়ারি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও ছিলো না। তাই খুলনার ডাক্তারগণ তাকে সেখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। হাসপাতালে যাতায়াত পাসও কর্তৃপক্ষ তৈরি করে দিলেন।
পানিপথ হয়েই কেশওয়ার যেতে হয়। সেখানে তিনি চৌদ্দ দিন ছিলেন। সম্পূর্ণ একাকী হাসপাতালে কাটালেন দীর্ঘ চৌদ্দদিন। রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন, কী করবেন এখন? কুদরতের কারিশমা তাকে পানিপথ পৌঁছে দিয়েছে। সেজন্য অবশ্য কুকুরের কামড় খেতে হয়েছে। এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়! তাই চিকিৎসা শেষে ফেরার পথে তিনি পানিপথে নেমে গেলেন। রেল থেকে নেমেই ছিঁড়ে ফেললেন টিকেটখানি।
পরে খোঁজ নিয়ে ঠিক ঠিক পৌঁছে যান কাক্সিক্ষত মাদরাসায়। আল্লাহ তাআলার অপার অনুগ্রহ ও মনের দুর্বার আকর্ষণে তিনি মঞ্জিলে মকসুদে উপনীত হন। একান্ত সহায় সম্বলহীন অবস্থায়ও তিনি কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হন। সেখানে তিনি রঈসুল মুহাদ্দিসীন, ইমামুল কুররা হযরত মাওলানা আব্দুর রহমান পানিপথি রহ.-এর ছেলে হযরত ক্বারি আব্দুস সালাম পানিপথি-এর কাছে পবিত্র কুরআনের চৌদ্দ পারা হিফয করেন। এরপর প্রাণপ্রিয় উস্তাদের ইন্তিকাল হয়ে যায়। পরে অবশিষ্ট কুরআন হিফয করে সাহারানপুর মুযাহেরুল উলূম মাদরাসায় ভর্তি হন। ভাবীকালে এই বালকই ‘হাফেজ্জি হুজুর’ অভিধায় ভূষিত হন। (আদর্শ ছাত্র : ৭৮)