শনিবার, ২৫শে জানুয়ারি, ২০২৫ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১২:০৬
Home / খোলা জানালা / ঈদ নিয়ে জীবনের গীত

ঈদ নিয়ে জীবনের গীত

Eidআল মাহমুদ : অতীত দিনের ঈদ আর ফিরে আসবে না আমার জীবনে, ফিরে আসবে না কৈশোর কিন্তু কৈশোরের স্মৃতি ফিরে আসবে। ঈদ মানেই হলো খুশি নতুন কাপড়ের গন্ধ মুরব্বিদের সালাম-কদমবুচি আর গরম পোলাওয়ের উপর কোর্মার মজাদার আয়োজন। এখনো সেই স্মৃতি চোখ বন্ধ করে ফিরিয়ে আনতে চাই। কিন্তু স্মৃতি তো কখনো একা আসে না নিয়ে আসে নানা দৃশ্য। নানা মানুষের মুখ। কেউ ভারী কেউ বিষণœ কেউ খুশিতে উপচানো। আমার মায়ের মুখটা কেমন ছিল ভাবতে আমার মনে আনন্দ শিহরণ জেগে ওঠে। ঈদের দিন আমার মা সবাইকে খাইয়ে বিলিয়ে কি যে পরিতুষ্টি উপভোগ করতেন সবাই আমার মায়ের পায়ে কদমবুচি করার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়াত। মুহূর্তের মধ্যে এই স্মৃতি চোখের সামনে এসে গেলে কী করব? তেমন পোলাও আর হয় না যেন। ঈদের দিন শুধু আমি এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একাকিত্বে ভুগতাম জানি না সেটা আমি কবি বলেই ঘটত কি না।

কারো সাথে কোথাও যেতাম না। কেউ আমার বন্ধু ছিল না। জর্জ হাইস্কুলের বারান্দায় গিয়ে একটা বই হাতে বসে পড়তাম। ঈদের দিনেও আমার আচরণ ছিল একটু আলাদা। কেউ মিশত না আমার সাথে। কেউ ঘেঁষত না আমার পাশে। আমার ঈদের দিনটা পূর্ণ হতো একটা বই পড়ে শেষ করার মধ্য দিয়ে। সেই সব বইয়ের নাম হতো রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের জীবন্ত মমির হাতের মতো। সেই ঈদের স্মৃতি এখন আর ফিরিয়ে আনা আমার জন্য অনুচিত ভাবি। কারণ কোনো ঈদই আগের বছরের ঈদের মতো হয় না। ঈদের সবচেয়ে বড় পাওনা হলো আমার কাছে অবসর। সবার থেকে দূরে থাকার একটু অবকাশ মাত্র।

আমি ঈদের দিন একা হয়ে যেতাম। সম্পূর্ণ একা। আমার এই একাকিত্ব কেউ লক্ষ করত না একমাত্র আমার মা ছাড়া। মা বলতেন, এই আমার এক ছেলে যার কোনো বন্ধু নেই। হেসে বলতেন আয় তোকে খাইয়ে দিই। তারপর কোথাও আড়ালে গিয়ে বসে তোর ওই সব বইটই পড় গিয়ে। বলে মা আমার একটি হাত ধরে টেনে এনে বসিয়ে দিতেন। পাতে তুলে দিতেন একটি রান। রানের উপরকার এক টুকরো গোশত। আর পোলাও থেকে ঘেটে বের করে দিতেন একটি-দু’টি আলু বোখারা। এই তো ছিলেন আমার মা। আমার ক্ষুৎ পিপাসার সব খবরই তার জানা ছিল।

খুব বাল্য বয়সে আমি কোরমা পোলাও খেতে পারতাম না। ঘিয়ের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠত। দাদীরা বলতেন কুকুরের পেটে ঘি-ভাত হজম হয় না, কিন্তু মা হাত ধরে টেনে রান্নাঘরের ভেতরে নিয়ে যেতেন। একটা পিঁড়ি পেতে ঠেলে বসিয়ে দিতেন। এক পেট পোলাও দিয়ে বলতেন কোরমা খাবি? তুই না হয় একটু ঝাল খা। দিতেন ঝাল খাসির গোশত। বলতেন এই নলাটা খুব ভালো করে খাবি। চেটেপুটে খেয়ে নে। আর কিন্তু পাবি না। আর আমি সবার আড়ালে বসে মায়ের দেয়া সুবিধাটুকু চেটেপুটে খেয়ে নিতাম। তারপর ভড়পেটে উঠতে উঠতে বলতাম আম্মা আমি যাই, তারপর দৌড়ে বেরিয়ে আসতাম।

হায় আর ফিরতে পারব না। আর সেই ঈদও আসবে না। ঈদের চাঁদ উঠবে, চাঁদ উঠলে ছেলেমেয়েরা নতুন কাপড় পরবে ঘি পোলাওয়ের গন্ধে বাড়িটা ম ম করে। কিন্তু শুধু আমি আর ফিরব না। আমার জন্য এসেছে অন্য এক ঈদের সালাম। আমি একাকী বসে থেকে শুধু নাতি-নাতনীদের কোলাহল শুনব আর দেখব লাইন বেঁধে কদমবুচি করছে আমার নাতি-নাতনীর দল। ‘হেই দাদা! আমাকে কত দেবে?’ বলতে বলতে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে হাসির বিদ্যুৎ।

স্মৃতির ভেতর পেছন ফিরে দেখায় অবকাশ আছে। যে বাড়িটিতে জন্মেছিলাম তার কিছু চালচিত্র এখনো চোখে ভাসে। কারণ কৈশোরের সাথে এই বাড়িটি ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। কত মুখ ছিল আত্মীয়। আজকে কোথায়? জানি না। ঈদের দিন নিজের ঘর ছাড়া চাচীদের বেড়ে দেয়া খাবার খেয়ে আসতে পারতাম না। কী সুন্দরী ছিলেন আমার চাচীরা-আম্মারা। কী হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন আমাকে! কারণ আমিই ছিলাম এ বংশের একমাত্র পুত্রসন্তান। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম কুরুরিয়া খালের পুলের উপর। নিচে তীব্র স্রোত বইছে ঈদের দিনেও কালো বাউস শিকারিরা স্রোতে নৌকা ভাসিয়ে বড়শি পেতে বসে যেতেন। সাধারণত কুরুরিয়ার খালের ওই কালো বাউস ছিল অত্যন্ত উপাদেয় মাছের জাত। দেখতাম কেউ একটা মাছ শিকার করতে পারলে ছোট্ট শহরের দিকে বিক্রির জন্য ছুটত। পথেই মাছটা বিক্রি হয়ে যেত। হায় স্মৃতির মধ্যে সব মুদ্রাই জমা পড়ে আছে। এখন আমি কয়টা ভাঙাব?

সেই পুরনো ঈদের দিনের আরো একটা কথা মনে পড়ে। ঈদের দিনে দুপুরের পর আমাদের বাড়িটা গমগম করত কিছু পাগল দরবেশজাতীয় মানুষের দ্বারা। তারা এসেই খাবার চাইত না। বিশ্রামের জন্য আমাদের যে আলাদা ঘর ছিল সেখানে ঠাঁই নিত। তারপর ধীরেসুস্থে আম্মা তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। নিজে বেড়ে খাওয়াতেন। অন্য কেউ দিতে চাইলে ওই সব ফকির-মিসকিন অখুশি হতেন। আমার মা তার হাতে চামচ তুলে নিতেন আর যতক্ষণ তৃপ্তি না হয় মানুষকে বেড়ে খাওয়াতেন। সবাই এসে আমার মায়ের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। আমার মা বলতেন খবরদার। আমাকে গুনাহগার বানাবেন না।

আমার পিতার কারণে ফকির-দরবেশরা এ বাড়িতে আসর জমাতে পারত। আমার বাপ ছিলেন তাদের মতোই একজন দরবেশ মানুষ।
আরো একটা স্মৃতি শিশুকালে আমাদের বাড়ির মুরব্বিরা ছিল গায়ের প্রধান ব্যক্তি। তারা পোশাক পরে রাস্তায় বেরিয়ে এলে তাদের পেছনে আসত গায়ের অন্যান্য বাড়ির নামাজীরা। আমরা মোটামুটি দল বেঁধেই ঈদগা ময়দানে যেতাম। ময়দানটা ছিল একটা হিন্দুপাড়ার মাঝে। আমাদের নামাজ দেখতে হিন্দু ছেলেমেয়েরা ভিড় করে দাঁড়াত। কি সুন্দর ছিল সেই সব দিন। সেই ঈদের আতরের গন্ধ মনে হয় এখনো আমার নাকেমুখে কেউ মেখে দিয়েছেন।

কোনো কিছুই তো আর ফিরে আসে না। কত ঈদ দেখেছি। অতীতের কত মান-অভিমানের কথা এখনো আমার স্মৃতিতে জাগ্রত আছে। একটি শার্ট নিয়ে অভিমান, একটি পাজামা নিয়ে ঝগড়া, টুপি নিয়ে হাতাহাতি! সবই তো চোখ বুজলেই ফিরে আসে। কিন্তু চোখ মেললে আর থাকে না। স্মৃতি হয়ে যায়।

সৌজন্যে : অন্যদিগন্ত

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি কল্যাণ ট্রাস্ট- বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা

খতিব তাজুল ইসলাম: ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...