শুক্রবার, ৩রা মে, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ৩:৪৮
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / পলাশী যুদ্ধের সেই তিন ঘণ্টা : ২৩ জুন ১৭৫৭

পলাশী যুদ্ধের সেই তিন ঘণ্টা : ২৩ জুন ১৭৫৭

palassy warবাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টি হয়। চিরকালই হয়েছে। কিন্তু একবার একটা হঠাৎ বৃষ্টি এসে আমাদের ভাগ্যকে চিরদিনের মত উল্টোদিকে টেনে নিয়ে গেছে। সেটাও হয়তো সামলানো যেত যদি তিন ঘণ্টা সময় পাওয়া যেত।ভাবতে অবাক লাগে। মাত্র তিন ঘণ্টা সময় পাওয়া গেল না বলে আমাদের ভাগ্য চিরদিনের জন্য বদলে গেল। সে গল্পই আজ আপনাদের শোনাব। আজ হয়ত এটা গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। একদিন যা ছিল জীবন, উন্মত্ত ঘটনার ঘনঘটায় আমাদের স্বাধীনতা-পরাধীনতা, উন্নতি-অবনতির নিয়ামক, আজ তা গল্প হয়ে গেছে।

মস্তবড় এক ময়দান। নাম পলাশী। মাঝখানে এক আমবাগান। নাম লক্ষবাগ। লক্ষবাগ আমবাগানের দক্ষিণ ধারে ছাউনি ফেলেছেন লর্ড ক্লাইভ তাঁর মোট তিন হাজার (মতান্তরে একত্রিশ শ’) সৈন্য নিয়ে যায় ৮০০ জন ইংরেজ ও পর্তুগীজ, বাকী সবাই মাদ্রাজি, পাঠান, রাজপুত, আফগান, রোহিলা, জাঠ, এবং কিছু বাঙালি। বিশাল পুরুষ লর্ড ক্লাইভ, তীক্ষ্ণ ধীশক্তিবলে যিনি সামান্য কেরানি থেকে হয়ে উঠেছেন একটি জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা।

স্বজাতি এবং ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির স্বার্থের চেয়ে বড় কিছু যাঁর পৃথিবীতে নেই তাঁর জীবনে আজ, ১৭৫৭ সালের ২২শে জুন, এই সন্ধ্যার মতো অস্থির সময় আর আসেনি। কাল যুদ্ধ হবে। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার পঞ্চাশ হাজার (মতান্তরে ত্রিশ হাজার) সৈন্যের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন মাত্র তিন হাজার সৈন্য নিয়ে। ওদের ৩২, ২৪, আর ১৮ পাউণ্ডের ৫৩টি কামানের বিরুদ্ধে তাঁর আছে ছোট্ট ৬ পাউণ্ডের মাত্র ৮টি কামান। পারবেন কি তিনি?

নিশ্চয়ই পারবেন। তাঁর আসল শক্তি তো সেনাবাহিনী নয়। তাঁর আসল শক্তি হলো মীরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, জগতশেঠ, ঘসেটি বেগম, নন্দকুমার, ইয়ার লাতিফ, মানিকচাঁদ, কৃষ্ণবল্লভ। তরুণ উদ্ধত নবাবের প্রতি এরা আহত কেউটের মতো রাগে ফুঁসছে, ষড়যন্ত্রের বিষে ভরে তুলেছে আকাশ বাতাস। আর সেই সাথে ক্ষমতার লোভ তো আছেই। এইসব শক্তি নিয়ে রাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধনীতির দাবাখেলায় সর্বস্ব বাজি রেখেছিলেন লর্ড ক্লাইভ।

এই হলো ইতিহাস। আমাদের মাতৃভূমির কর্তৃত্ব এক তুর্কো-আরবের হাত থেকে ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার সর্পিল পথে ইংরেজ বেনিয়াদের হাতে যাবার কলঙ্কিত ইতিহাস।সেই তিন ঘণ্টা

ফিরে আসি পলাশীতে।

১৭৫৭ – ২৩শে জুনের সকাল। আটটায় যুদ্ধ শুরু হল। মীরমদন এবং কাশ্মীরী মোহনলালের বারো হাজার সৈন্য ও গোলাবর্ষণের মুখে ইংরেজ বাহিনী আমবাগানে লুকিয়ে পড়ল। অবিরাম গোলাবর্ষণ এবং অগ্রসরমান মীরমদন ও মোহনলালকে বাধা দেবার শক্তি লর্ড ক্লাইভ আর অ্যাডমিরাল ওয়াট্সনের তখন নেই। আর ঠিক সেই মুহূর্তে এল সেই বৃষ্টি। সব গোলা বারুদ গেল ভিজে। সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল মীরমদন, মোহনলাল এবং ফরাসি সৈনাধ্যক্ষ সিনফ্রে। কিন্তু এই আধঘণ্টার যুদ্ধেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে ইংরেজের পরাজয় আসন্ন। পরমুহূর্তে এল আঘাত। মীরমদন মরণাহত হলেন। তাঁকে নবাবের তাঁবুতে আনা হল। মারা যাবার মুহূর্তে তিনি নবাবকে জানিয়ে গেলেন বাকি সব সেনাপতি এবং তাদের সৈন্যদল দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে, তবু শুধু মোহনলালই ইংরেজদের জন্য যথেষ্ট।

ওদিকে মোহনলাল আমবাগানে ইংরেজদের ঘিরে এনেছেন। মাত্র সময় আধঘণ্টা, তাহলেই ইংরেজদের চূড়ান্ত পরাজয় । কিন্তু এই আধঘণ্টা সময় তিনি পেলেন না। নবাবের আদেশ এল যুদ্ধ বন্ধ করতে। মনে পড়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডানকার্কের কথা। লর্ড গর্টের অধীনে তিন লক্ষ বৃটিশ সৈনিক যখন সর্বহারা হয়ে শুধুমাত্র পরনের কাপড়টি নিয়ে ডিঙ্গি নৌকা, স্পিডবোট, ছোট্টজাহাজ, মাছধরা জাহাজ, প্রমোদতরী যুদ্ধ জাহাজে শুধু প্রাণটা নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ফিরে আসতে ব্যস্ত, যখন জার্মান বিমানগুলো অনায়াসে ওপর থেকে বোমা ফেলে তাদের ধ্বংস করতে পারে, ঠিক তখনই হিটলারের আদেশ এসেছিল ”বন্ধ কর”।

দিশেহারা জার্মান সেনাপতিরা ছুটে গিয়েছিলেন হিটলারের কাছে। লাভ হয়নি। চূড়ান্ত বিজয়ের মুখে লাগাম টেনে ধরা দিশেহারা উদ্ভ্রান্ত মোহনলাল ছুটে গিয়েছিলেন নবাবের কাছে। লাভ হয়নি। ততক্ষণে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ আর রায়দুর্লভ নবাবকে বুঝিয়েছেন বিজয় তো সুনিশ্চিতই, সৈন্যরা ক্লান্ত হয়েছে, কাল আবার যুদ্ধ হবে।

পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। ঘটনার চাপে আবেগপ্রবণ নবাব তখন মানসিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত। মোহনলালের সৈন্যরা অস্ত্র সংবরণ করে তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছে। মীরজাফরের ইঙ্গিতে ক্লাইভ, ওয়াট্সন আর মেজর কিলপ্যাট্রিক পালটা আঘাত হানল। রায়দুর্লভ ইয়ার লতিফের সৈন্যরা খামাকা ছুটাছুটি করে নবাবের সৈন্যদের মধ্যে পরাজয়ের আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল। রাজবল্লভ নবাবকে নানা কুকথায় ক্রমাগত আতঙ্কিত ও উদভ্রান্ত করে তুলল, মীরজাফর সসৈন্যে ইংরেজদের পক্ষে যোগ দিল, দিশেহারা নবাব মুর্শিদাবাদের দিকে পালালেন। নবাবহীন মোহনলাল ও সিনফ্রে হতোদ্যম হয়ে পড়লেন। বিকেল পাঁচটায় নবাবের তাঁবুতে উড়ল ইউনিয়ন জ্যাক, বিলেতের পতাকা।

মুর্শিদাবাদ মহল থেকে স্ত্রী লুৎফা আর শিশুকন্যা জহুরাকে নিয়ে নবাব রওয়ানা হলেন পাটনা। ভগবানগোলা পার হয়ে গোদাগাড়ি থেকে নৌকা নিয়ে মহানন্দা নদীতে উজানে চললেন পাটনার দিকে। পাটনা কেন ? কারণ পাটনায় তখন নবাবের অনুগত পঞ্চাশ হাজার সৈন্য রাখা ছিল। কেন ? কারণ কিছুদিন আগে পারস্য সম্রাট আহমদ শাহ্ আবদালী দিল্লী দখল করেন। বাংলার দিকে আসতে পারেন এই ভেবে নির্ভীক নবাব ঘরে বাইরে শত ষড়যন্ত্রের মধ্যেও আহমদ শাহ্ আবদালীর মতো শক্তিশালী সম্রাটকে বাধা দেবার জন্য নিজের অর্ধেক সৈন্যকে এগিয়ে রাখেন পাটনায়।

এদিকে পলাশীর ঘটনা চতুর্দিকে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে। শুনে ভাগলপুর (বিহার) থেকে মঁসিয়ে লালী সসৈন্যে এগিয়ে আসছেন মহানন্দার দিকে। নবাবকে উদ্ধার করে পাটনা পৌঁছে দেবেন অনুগত পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের কাছে। এই সেই ফরাসি মঁসিয়ে লালী, ইংরেজদের কুমন্ত্রণায় ভুলে যাঁকে নবাব কিছুদিন আগে সসৈন্যে নির্বাসিত করেছিলেন ভাগলপুরে। যাবার আগে অশ্রুসজল নেত্রে বলেছিলেন “নবাব! আপনি রাজনীতির ভুল পথে পা বাড়ালেন” !!

অগ্রসরমান নবাব ও মঁসিয়ে লালী’র মধ্যে মাত্র তিন ঘণ্টার ব্যবধান। তার পরেই লালীর শক্তিশালী আশ্রয়ে পৌঁছবেন নবাব। পাটনায় গিয়ে মিলিত হবেন অনুগত হর্ষোৎফুল্ল পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের সাথে। ফিরে আসবেন উন্মত্ত কালবৈশাখীর তাণ্ডবে। পালটা আঘাতে গুঁড়িয়ে দেবেন মীরজাফর-ক্লাইভের ষড়যন্ত্রের দুর্গ। আর ভুল হবে না। কারণ ততদিনে শত্রুর মুখ চেনা হয়ে গেছে তাঁর। বাংলার মাটি থেকে উপড়ে ফেলবেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি। বাংলা ইংরেজদের উপনিবেশ হবে না। ভারতবর্ষ হবে না পরাধীন একশ’ নব্বই বছরের জন্য। নীলচাষ হবে না। আঙুল কাটা হবে না মসলিন তাঁতীদের।

শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে গেছে।

সেই তিন ঘণ্টা এখনও স্তব্ধ হয়ে মহানন্দার ধারে দাঁড়িয়ে আছে ॥

(নবাব রাজবেশ ছেড়ে সাধারণ কাপড়ে রওনা হয়েছিলেন, কিন্তু জুতোটা বদলাতে ভুলে গিয়েছিলেন। সেটা দেখে মাঝি তাঁকে চিনতে পারে, মিথ্যে কথায় তাঁকে ভুলিয়ে মীরজাফর-ইংরেজের হাতে তুলে দেয়. পরে কারাগারে মুহম্মদী বেগ তাঁকে খুন করে)

লেখক: হাসান মাহমুদ

সদস্য – ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস উপদেষ্টা বোর্ড সাধারণ সম্পাদক- মুসলিমস ফেসিং টুমরো- ক্যানাডা

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

‘দেওবন্দের মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই স্বীকৃতি বাস্তবায়ন হচ্ছে’

কমাশিসা ডেস্ক: বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সহকারী মহাসচিব ও জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসার শাইখুল হাদিস মাওলানা ...