হাফিয মাওলানা ফখরুযযামান :আমাদের পাঠ্যসূচি কি যুগ চাহিদা পূরণে সক্ষম?
আমরা যদি আমাদের সিলেবাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে, তা বর্তমান যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে দ্বীনকে সার্বিকভাবে উপস্থাপনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। তা হয়ত অনেকের কাছে কটুবাক্য বলে মনে হতে পারে। তবুও তা বাস্তব। আর এ কথা আমার নয় বরং তা পূর্বের যুগশ্রেষ্ঠ অনেক মনীষীগণ-যারা আমাদের সবার কাছে স্মরণীয় বরণীয় এবং অনুস্মরণীয় তাদেরই উক্তি- যাদের বিচরণ বর্তমান বিশ্বের সর্বত্র। যাদের চিন্তা-চেতনা ব্যাপৃত বিশ্বব্যাপী। আমি এ সম্পর্কে নিম্নে কয়েকটি উক্তি উল্লেখ করছি।
ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফোরাম লণ্ডন এর চেয়ারম্যান ঈসা মানসূরী মাদাসায়ে দারুর রাশাদ এর নতুন বিভাগ সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদবির রাহ. এডুকেশন সেন্টার এর উদ্বোধন উপলক্ষে ১লা জানুয়ারি ২০০৪ ঈসায়ী, রোজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ইসলামিক ফাউণ্ডেশন মিলনায়তনে নতুন শতাব্দীর চাহিদা ও উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব শীর্ষক সেমিনারে পাশ্চাত্যের বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও ইসলামের ওপর তাদের সাঁড়াশী আক্রমণে আমরা যে শুধু অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখছি কোনো ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি না, এ প্রসঙ্গে বলেন, “কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সময়ের এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আঞ্জাম দেওয়ার পরিবর্তে আমাদের উলামায়ে কেরামের একটি শ্রেণী দেড়শত বছর পূর্বের পুরাতন ও বিলুপ্ত,চিন্তু-চেতনা ও দর্শন সংক্রান্ত অনর্থক আলোচনায় লিপ্ত। ইসলাম ধর্ম আত্মপ্রকাশের সময় যেমন খ্রিস্টান আলিমগণ গ্রীক দর্শন চর্চার অনর্থক কাজে লিপ্ত ছিল।”
আমাদের পশ্চাদ্ধাবনকে আবুল হাসান আলী নদবি রাহ. দেওবন্দের উলামায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে এভাবে উল্লেখ করেন “আপনাদের নিকট গ্রীক দর্শনের প্রাণী বিদ্যা, রসায়ন ও জ্যোতির্বিদ্যার নির্দিষ্ট বুলি সম্বলিত যে কয়েকটি পাতা রয়েছে তার বিপরীত পশ্চিমাদের নিকট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষ দর্শনের এক বিরাট জগত রয়েছে। ফলে আজ আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষ পশ্চিমাদের দর্শনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। এর আসল কারণ আমাদেরই দুর্বলতা। আজ যেখানে আমরা ইসলামের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করে শ্রেষ্ঠ হিসাবে গড়ে ওঠে ইসলাম সম্পর্কে সর্বশ্রেণীর মানুষের সন্দেহ-সংশয়ের অপনোদন করে ইসলামকে কার্যকরী ও শক্তিশালী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ছিল।
আমরা সেখানে আজ ফেকাহের মুস্তাহাব-সুন্নাত সম্পর্কিত, শাফেয়ী-হানফিদের মধ্যে বিতর্কিত কিছু বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে এগুলোকে প্রমাণাদিসহ উপস্থাপন করে এর পেছনে নিজেদের মেধাকে ব্যয় করাকে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় বলেন মনে করছি এবং তা করতে পেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি।অথচ হাজার হাজার লক্ষ-লক্ষ বনী আদম আজ ঈমান হারাচ্ছে, সন্দেহ-সংশয় তাদের নিত্যসঙ্গী।তাদেরকে সঠিক পথে আনার আমাদের কোন ফিকির নেই।
এ সম্পর্কে আমাদের সবার মধ্যমণি যার জ্ঞান গরীমা সবার কাছে স্বীকৃত, যার বাণীকে কেউ বিনা বাক্যে মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করেনা- সেই মহান ব্যক্তিত্ব আল্লামা কাশমিরী রাহ.র কথাটিই আমি এখানে উল্লেখ করছি “আল্লামা কাশমিরী রাহ. একবার লাহোরের আমরোদ শাহ সফর করেন। তাঁর নাম শুনে সাধারণ, ছাত্র-শিক্ষক প্রফেসর সকল ধরনের লোক সমবেত হয়ে সাক্ষাৎ করতে আসে। তারা তাঁর সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের মনে যত প্রকার খটকা ছিল, প্রশ্ন ছিল, সবই মাওলানার সামনে পেশ করলেন। এগুলো শুনে মাওলানা কাশ্মিরির অন্তরে এমন ব্যথা জাগল, মুফতিশফী সাহেব বর্ণনা করেন, তাঁর সফর সঙ্গী আমিও ছিলাম। সকালে আমি সাক্ষাতে গেলে তিনি একটি বাক্য বার বার বলছিলেন; যিন্দেগী বরবাদ গায়ে, যিন্দেগী বরবাদ গায়ে”। (আমার জীবন বৃথা গেল,আমার জীবন বৃথা গেল।) মাওলানা শফী সাহেব তখন বললেন, হযরত! আপনি কি বলছেন? আপনি তো গোটা জীবন হাদিসের খেদমত করেছেন, আপনার লাখ লাখ ছাত্র রয়েছে। তাঁদের কেউ মুফাসসির,কেউ মুহাদ্দিস, মুফতি, লেখক, গবেষক ইত্যাদি। দেশে-বিদেশে সর্বত্র তাঁরা ছড়িয়ে রয়েছেন। এইতো আপনার কর্মসূচি। তো আপনার জীবন কী করে বৃথা গেল? প্রত্যুত্তরে আল্লামা কাশ্মীরী বলেন; আমরা হাদিস পড়াচ্ছি, কিতাব পড়াচ্ছি। এ মাসআলার মধ্যে হানফিদের পক্ষে এ দলীল আছে, শাফেয়ীদের পক্ষে এই দলীল রয়েছে। প্রত্যেক মাযহাবের দলীল পেশ করে হানফি মাযহাবের প্রাধন্য প্রমাণ করি অথচ এসব মাসআলা সুন্নাত ও মুস্তাহাব পর্যায়ের। কিন্তু আমি আজ বাইরে বের হয়ে জনসাধারণের সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে বুঝতে পারলাম। তাঁদের কেউ আল্লাহকে অস্বীকার করছে, নবীকে অস্বীকার করছে, শিরক করছে, কেউ কুরআনকে অস্বীকার করছে। তাদের মধ্যে সুন্নাত-মুস্তাহাব মাসআলার বিরোধ নিয়ে আলোচনা চলছে না। তাঁরা সমাজের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে,তাদের জন্যে আমি কি কর্মসূচি দিয়েছি? তাদের সন্দেহ নিরসনের জন্যে কী কী ধারা বর্ণনা করেছি?আল্লাহকে অস্বীকার না করার জন্যে আমি কী মূলনীতি উপস্থাপন করেছি? বর্তমানে আমাদের জরুরি বিষয় হল- জনসাধারণের প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে বের করা। তাদেরকে দ্বীনের প্রতি ফিরিয়ে আনার জন্যে মূলনীতি, কর্মসূচি ও কর্মধারা প্রণয়ন করে তাদেরকে এহেন কাজ থেকে সরিয়ে এনে ইসলামের গণ্ডির ভেতরে প্রবেশ করাতে হবে।
এ ছিল আল্লামা কাশ্মীরীর তাঁর সময়কালের অনুভূতি। আমরা বর্তমান সময়ে অবস্থান করে কি এতটুকু বুঝছি বা বুঝার চেষ্টা করছি। সেই বাস্তব অবস্থাকে অস্বীকার করে, বর্তমানের সমস্যবলির সমাধানকল্পে এগিয়ে না এলে বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষার ভবিষ্যৎ কুয়াশাচ্ছন্ন। আর এসবের বাস্তবতা স্বীকার করে কর্মসূচি প্রণয়ন করে ওই আঙ্গীকে সিলেবাস প্রণয়ন করে আগামী প্রজন্মকে এর উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে আমাদের ইসলামি শিক্ষার ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আজ যেখানে আমরা ইসলামের প্রতিটি বিভাগে গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার কথা ছিল। সেখানে দেখা যায় পাশ্চাত্যবিদরা, অভিশপ্ত ইহুদিরা ইসলামের নামে গবেষণা ইনষ্টিটিউট খুলছে। তারা তাদের ইউনিভার্সিটিগুলোতে ইসলামি স্টাডিজ নামে আলাদা বিভাগ খুলছে এবং তাতে মুসলমানের সন্তানদের পাঠদান করছে। কী আশ্চর্যের কথা! মুসলিম সন্তানরা ইসলাম শিখছে ইহুদি-খ্রিস্টানদের কাছ থেকে। এরা তাদেরকে কী শিখাচ্ছে? ইসলামের নামে গোমরাহী বৈ কী?
এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কানাডাতে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। তা হচ্ছে মেকেগাল ইউনিভার্সিটি। এই ইউনিভার্সিটির কার্যক্রম ও এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাকিস্তানের প্রাক্তন চিফ জাস্টিজ মুফতি তাকী উসমানি তাঁর ঐতিহাসিক সফরনামা জাহানে দীদা তে উল্লেখ করেছেন যে,এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ সমগ্র বিশ্বে প্রসিদ্ধ। বর্তমান যুগের অনেক প্রসিদ্ধ“মুসতাশ্রিক” (প্রাচ্য বিশারদ) এখান থেকেই ডিগ্রি লাভ করেছে। অনেক মুসলমান পণ্ডিতও এখান থেকে ইসলামিয়াতে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে গর্ববোধ করে। সুতরাং মুসলিম বিশ্বের অনেক আধুনিকমনা লেখক যারা মুসতাশরিকদের ন্যায় চিন্তাধারার অধিকারী তারা এই প্রতিষ্ঠানের ফসল।
এখানে শিক্ষা দেওয়া হয়-
১. মধ্যপ্রচ্যের ইতিহাস।
২. বিংশ শতাব্দীর আরবদের চিন্তাধারা।
৩. মুসলিম ভারতের ইতিহাস।
৪. ইতিহাস-ঐতিহ্য। এতে পবিত্র কুরআন, পবিত্র সীরাত, আকাঈদ এবং বিভিন্ন সংস্থার ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত।
৫. ইসলামি সভ্যতার আদর্শ যুগের ইতিহাস।
৬. ফাতেমিদের ইতিহাস।
৭. মধ্যযুগীয় ইসলামি সভ্যতার ইতিহাস।
৮. ইসলামি চিন্তাধারার উত্থানের নিরীক্ষা।
এ ছাড়া তাফসির, ইসলামি দর্শন, উসূলে ফিকাহ, তাসাউফ, শিয়া মতাদর্শ, ইসমাঈলী চিন্তাধারা, ইরান ও পাকিস্তানে ইসলামের উত্থানের, ইসলামের পুনর্জাগরনের আন্দোলনসমূহ, মৌলবাদের আন্দোলন।মুসলিম দেশসমূহের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মতো বিষয়বস্তু ও বিভিন্ন শ্রেণীতে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
মুফতি সাহেব বলেন, এ বিষয়তো পরিস্কার যে, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ইসলামকে সত্য ধর্ম মনে করে তার হিদায়াত ও শিক্ষানির্দেশ দ্বারা উপকৃত হওয়া নয়। এখানকার বেশিরভাগ অমুসলিম।যারা নিজেদের গবেষণা ও সন্ধানের বিষয়বস্তু ইসলাম ও মুসলমানকে বানিয়েছে। এখন যদি আমরা একটু অনুসন্ধিৎসু নয়নে চিন্তা করি যে, তাদের সুবিন্যস্ত এসব কার্যক্রমের বিপরীত আমাদের কতটুকু প্রস্তুতি রয়েছে। আমাদের আজ অসহায়ের মতো তাকানো ছাড়া আর কি আছে। বিধর্মীদের বুদ্ধিভিত্তিক এসব সাঁড়াশি আক্রমণের বিপরীত আমরা সেই কবেকার পরিত্যক্ত বিষয়াবলিকে আঁকড়িয়ে ধরে নিজেদেরকে দ্বীনের মহান রক্ষক ও সেবক ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি আর নিশ্চিন্তে আরামে ইসলামি শিক্ষার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়ার নীল ও রঙ্গীন স্বপ্ন দেখছি। আমাদের সেই স্বপ্নীল মোহ কখন যে ভঙ্গ হবে। তা আল্লাহ মালুম।
আমাদের চিন্তা-গবেষণা, আকিদা আমল ইত্যাদি শিক্ষা ক্ষেত্রে যে দৈন্যতা রয়েছে তা কি অস্বীকার করতে পারব? এছাড়া ইসলামি অর্থনীতি শিক্ষার ব্যাপারে যদি আমরা একটু খেয়াল দিয়ে তাকাই তাহলে আমাদের অসহায়ত্ব কত নগ্নভাবে প্রকাশ পাবে; তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একেতো আধুনিক অর্থনীতির বিষয়াবলি- শেয়ারবাজার, কোম্পানি ব্যবসা, বীমা, ব্যাঙ্কিং ইত্যাদির ওপর যেমন আমাদের পাঠ্যসূচিতে কোনো বই নেই। তেমনি পুরাতন ধাঁচের কিতাবাদিতে এ সম্পর্কে যেসব আলোচনা রয়েছে,এর প্রতিও আমাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। হেদায়া ও মুসলিম শরিফের ব্যাবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত অধ্যায় পড়ানোর সময় আমাদের কী ভূমিকা থাকে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া সমাজনীতি,রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি বিষয় যেন অন্য জগতের কোনো কিছু। আর ইসলামি রাজনীতিতো আজকাল নির্ধারিত কিছু ফ্যাশন ও কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ। শরহে আকাঈদ ও হেদায়ার আদাবুল কাযী তে এ সম্পর্কিত যা কিছু রয়েছে তা বৎসরের শেষে পৃষ্ঠা উল্টানোর মাধ্যমে আঞ্জাম দেওয়া হয়। আর অনেক মাদরাসায় তো পৃষ্ঠা উল্টানোরও সুযোগ হয় না। তাইতো আজ ইসলামি রাজনীতির নামে কত রকম নোংরা খেলা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে।