ঘটনা ছিল ৫ মে ২০১৩’র আর ক্ষোভ কথা লিখেছিলাম ৫ দিন পর, ১১ মে ২০১৩। আর যায় কোথায়! অতি আবেগে বেগ হারানো ভাইজানরা আর স্থির থাকতে পারলেন না ! দালাল, আলেম বিদ্বেষী, গোমরাহ—–কত্ত বিশেষণ! আমি আমার এই জীবনে কোনো লেখার জন্য এতবেশি গালি হজম করিনি যত গালি আমাকে হজম করতে হয়েছিল এই লেখাটির জন্যে! অরেব্বাপরে! সামনে পাইলে আমাকে আস্ত গিলে ফেলেন-অবস্থা!
সময় গড়াতে লাগল। লক্ষ্য করলাম টিউব লাইটগুলোও জ্বলতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। আর এখন? তিন বছর আগের লেখাটি আবার কপি পেস্ট করতে ইচ্ছে করল। অতি সমজদার যারা সেদিন ইসলামী গালি-গালাজের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন আমার রূহের উপর দিয়ে, তাদের জীবন্ত বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম পুরোনো লেখাটিকে। হিসাবটা মেলাতে যেনো সুবিধা হয় একটু…!
হেফাজতের রক্ত, অজ্ঞাত নৃশংসতা, দায় কার?
এক
হঠকারিতা কীভাবে একটি সম্ভাবনার গলাটিপে ধরতে পারে, তার নগদ প্রমাণ ৫ মে। সারা দেশে ঝড়তোলা হেফাজতে ইসলাম নামের ধুমকেতুটি ছড়িয়ে পড়েছিল ইথারের বাঁকে বাঁকে। দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষ সরাসরি সমর্থন নিয়ে যুক্ত হয়েছিল হেফাজতের সাথে। আপাদমস্তক অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আল্লামা শাহ আহমদ শফীর আহবানে এক প্লাট ফরমে চলে এসেছিলেন বহুধাবিভক্ত উলামায়ে কেরাম। এটা ছিল আহমদ শফীর এখলাস’র বৈশিষ্ঠ। আন্দোলন চলছিল নিয়মতান্ত্রিক ধারায়, অহিংস পথে। কিন্তু ৫ তারিখের ঘটনাপ্রবাহ হেফাজতে ইসলামকে এনে দাঁড় করিয়েছে এমন এক মেরুতে, যেখান থেকে আবারো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারা অসম্ভব না হলেও অনেক কঠিন।
নিজগৃহে পরবাসী আলেমসমাজকে আল্লামা আহমদ শফী যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক ততটা উপর থেকেই সেদিন মাটিতে ফেলে দিয়েছে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সুবিধাভোগী ক্ষমতালোভী মুখোশধারী কিছু লোক। ৫ তারিখের আঘাতে বিক্ষত উলামা আর ছাত্রসমাজ যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে ছটফট করে আর তারা আছেন আখের গোছানোয় ব্যস্ত। চিহ্নিত এরা হয়েই আছেন। এখনই সময় মুখোশ খুলে দেয়ার। গুটি কতেক সুবিধাবাদীর কোনোই অধিকার নেই আল্লামা শফীর ইমেজ নিয়ে খেলা করার। তাদের কোনো অধিকারই নেই এদেশের হাজার হাজার আলেম-উলামার আবেগকে পূঁজি করে ক্ষমতার রাজনীতির দাবা খেলার। তাদের কোনো অধিকারই থাকতে পারে না লক্ষ লক্ষ কওমী ছাত্রকে উপরে উঠার সিঁড়ি বানাবার।
দুই
স্মরণ করা যায় ২২ ফেব্রুয়ারি যখন আহমদ শফী ডাক দিয়েছিলেন, সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান নেমে এসেছিল রাস্তায়। ‘নবী অবমাননার বিচার চাই’ স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল আকাশ বাতাস। কিন্তু সেদিনই শান্তিপূর্ণ সেই কর্মসুচিতে চিহ্ণিত অনুপ্রবেশকারীরা হামলা করে বসেছিল কয়েকটি শহীদ মিনারে। কোথাও কোথাও জাতীয় পতাকায় আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। হেফাজত ব্যর্থ হলো অনুপ্রবেশকারী সেই সন্ত্রাসীদেরকে চিহ্ণিত করতে। অন্তত এ থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্ক তো হওয়া উচিত ছিল।
হেফাজতের দ্বিতীয় কর্মসুচি ছিল ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমূখে লংমার্চ। সরকারের সর্বপ্রকার বাঁধা উপেক্ষা করে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই সমাপ্ত হয়েছিল ১৫ লক্ষাধিক লোকের ৬ এপ্রিলের কর্মসূচি। এতবড় একটা প্রোগ্রাম শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করতে পারায় হেফাজত প্রশংসিত হয়েছিল দেশে-বিদেশে। কিন্তু ৫ মে’র অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহ হেফাজতে ইসলামের পাশে প্রমাণ সাইজের একটি প্রশ্ন চিহ্ন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
চুপ করে বসে থাকবার মতো ধৈর্য আমাদের নেই। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার আর কোনো সুযোগ নেই। আমরা আমাদের জীবন নিয়ে খেলবার ইজারা কাউকে দিইনি। অপ্রিয় সত্যটা সামনে আসা দরকার। ছেলেরা কারো খেলার পুতুল হতে পারে না।
তিন
ষ্পট লাইন ৫ মে। হেফাজতের পূর্ব নির্ধারিত ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি সুশৃংখলভাবেই পালিত হচ্ছিল। এ দিন ঢাকায় কোনো কর্মসূচি ছিল না। অবরোধের ব্যাখ্যায় হেফাজতের প্রেসনোটে পরিষ্কার করেই বলা ছিল ”ঢাকা থেকে কোনো যানবাহন বাইরে যাবে না। বাইরের কোনো যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ করবে না”। সমাবেশের কোনো কর্মসূচি তো অবশ্যই ছিল না। হঠাৎ করে জানা গেলো বিকেল ৩ টায় শাপলা চত্বরে সমাবেশ হবে। অনেকগুলো দুঃখজনক লোমহর্ষক ঘটনা না ঘটলে আমরা কোনো প্রশ্ন তুলতাম না। যেহেতু বুড়িগংগা দিয়ে অনেক জল(!) গড়িয়ে গেছে, সে কারণে সময়ের প্রয়োজনে ব্যাপারটির ময়নাতদন্ত দরকার।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমরা জেনেছি শাপলা চত্বরে সমাবেশ বা অবস্থানের কোনো নির্দেশনা আহমদ শফীর ছিল না। ৫ তারিখ দুপুরে নীতি নির্ধারনী সভায় তিনি পরিষ্কার করে বলেছিলেন, বিকেল ৩ টায় অবরোধ কর্মসূচি সমাপ্ত করে কর্মীরা যার যার বাড়ি চলে যাবে।
তখন সভায় অতি উৎসাহী দু’একজন নেতা ৬টা থেকে ৬টা অবরোধ কর্মসূচির কথা মনে করিয়ে দিলে আল্লামা শফী কিছুটা রাগত স্বরেই বলেছিলেন, আমাদের এই কর্মসূচি কি বিশ্ব ইজতেমা থেকেও বড় কিছু? অথচ খারাপ আবহাওয়ার কারণে তিন দিনের ইজতেমাকে এক দিনে শেষ করতে দেখা গেছে।
কিন্তু আমিরে হেফাজতের অসম্মতিকে গুরুত্ব না দিয়ে অতি উৎসাহী কিছু নেতা সমাবেশ মঞ্চে গিয়ে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে বসেন। তাঁরা বলতে থাকেন, আল্লামা শফীর নির্দেশ না আসা পর্যন্ত অবস্থান চলবে। চলতে থাকল অবস্থান। আর অবশেষে…
চার
এখানে ৫ তারিখ এবং তৎপরবর্তী সুক্ষ্ণ কিছু দিক আলোচনার দাবি রাখে। যে প্রশ্নগুলোর জবাব জানা দরকার।
১) ওইদিন যেহেতু শাপলা চত্বরে পূর্ব নির্ধারিত কোনো কর্মসূচিই ছিল না, তাহলে পুলিশ কেনো তাৎক্ষণিকভাবে সমাবেশের অনুমতি দিল?
২) আল্লামা আহমদ শফীর অনিচ্ছাসত্তেও সমাবেশ আর অবস্থান কর্মসূচির জন্য সেদিন কারা কারা তৎপর ছিলেন? কী তাদের আসল উদ্দেশ্য? তাদের গন্তব্য কোথায়?
৩) আহমদ শফী তো সমাবেশ স্থলের দিকে রওয়ানা হয়েছিলেন। পলাশী থেকে তাঁকে কারা ফিরিয়ে দিয়েছিল? তাকে সমাবেশে আসতে দেয়া হল না কেনো? নিরাপত্তাহীনতার ঠুনকো অজুহাতে কারা তাকে আটকে রেখেছিল সেদিন?
৪) রাত আটটার দিকেই যখন বোঝা যাচ্ছিল যে কোনো সময় অপারেশন শুরু হতে পারে, তাহলে নেতৃবৃন্দ তখন নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য মঞ্চ থেকে সটকে পড়া ছাড়া আর কী করছিলেন?
৫) যখন অপারেশন শুরু হল, তখন বাঘা বাঘা নেতারা কে কোথায় ছিলেন?
এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে বের করতে হবে। এটা করতে হবে আলেম-উলামার ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে। এটা করতে হবে গাদ্দারদের চিহ্নিত করবার জন্যে। এটা করতে হবে মুনাফিকদের চেহারা থেকে মুখোশ সরানোর প্রয়োজনে। আমি মনেকরি চলমান আন্দোলনের সাফল্যের স্বার্থে, আগামীর প্রয়োজনে এই বিষয়গুলো পরিষ্কার হওয়া দরকার।
অন্যদিকে… বায়তুল মোকাররাম, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, পল্টন জুড়ে সারাদিন চলতে ছিল তাণ্ডবলীলা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই বললেন, সংঘর্ষের জন্য দায়ী জামাত শিবির। শিবিরের ছেলেরাই সেনদিন ভাঙচুর করেছে, তাহলে হেফাজত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলা কেনো? মামলা তো হবে জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে।
অতি প্রাসঙ্গিক বা দুঃখজনক, দু’ভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়, ব্যাপারটি হল, রাতে শাপলায় অবস্থানরত নিরীহ-নিরস্ত্র-ঘুমন্ত মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ল পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির দশ হাজার সদস্য। সারাদিন যখন (সরকারের ভাষায়)জামাত শিবির রাজধানী জুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছিল, তখন কোথায় ছিল এই দশ হাজারী বাহিনী? কেনো দিনের বেলা ওদেরকে ছাড় দিয়ে রাতের বেলা এদের উপর ঝাপিয়ে পড়া? কার ইংগিতে? কাদেরকে খুশি করার জন্য?
পাঁচ
৫ তারিখ রাতে আসলেই কতটা কী ঘটেছে, সেটার সঠিক তথ্য জানবার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। বাতাসে গুজবের শেষ নেই। দেশের মানুষ অস্বস্তিকর আতংকে দিন কাটাচ্ছে। আমরা আশা করতে চাই অনেকগুলো প্রাণ হননের সকল অনুমান আর ধারণা যেনো মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ৫ তারিখ রাতে সেখানে যেনো আসলেই কোনো বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটার সংবাদ সত্য না হয়।
কিন্তু কথা হলো সে দিন যদি ১১ জন মানুষও মারা গিয়ে থাকে, তাহলে তার দায়টা কার? কারো না কারো তো দায় নিতেই হবে। আমরা মনে করছি এর দায় নিতে হবে তিন পক্ষকে।
১) হেফাজত নেতৃবৃন্দ। কারণ তাদের অপরিণামদর্শী হঠকারী সিদ্ধান্তই এ জন্য দায়ী। কোনো রকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া শাপলায় অবস্থানের এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়া তাদের অজ্ঞতা এবং অদুরদর্শীতারই প্রমাণ।
২) সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। কারণ সরকারের এই ডাকসাইটে নেতা বিকেল বেলা হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, সন্ধ্যার আগেই যেনো হেফাজতিরা ঢাকা ত্যাগ করে । তা নাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি বললেন, এবার তবু ঢাকা আসতে দিয়েছি, আগামীবার ঘর থেকেও বের হতে দেব না। যে কারণে কিছুটা জেদ চেপে বসেছিল হেফাজত নেতাকর্মীর।
৩) বেগম জিয়া। কারণ তিনি তার রাজনৈতিক প্রয়োজনে সেদিন সন্ধ্যারাতে তার নেতাকর্মীকে আহবান জানিয়েছিলেন সবাই যেনো হেফাজতীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। যদিও নেত্রীর কথা তার কোনো কর্মীকে মানতে দেখা যায়নি কিন্তু এটা করে তিনি সরকারকে পরোক্ষভাবে প্ররোচিত করেছিলেন শাপলাকে রাতের মধ্যেই হেফাজতমুক্ত করতে।
ছয়
বায়তুল মোকাররামের বইয়ের দোকানে যখন আগুন দেয়া হল। কারা দিয়েছে সেটা ভিডিও ফুটেজ দেখেই সনাক্ত করা সম্ভব। আমি মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করি কোনো কওমী মাদরাসার ছেলে জীবন গেলেও কোরআন পুড়ানোর মতো জঘন্য কাজ করতে পারে না।
কিন্তু যখন আগুনে পুড়তে লাগল পবিত্র কোরআন আর হাদিসের পাতাগুলো, আর এর দায় এসে চাপল হেফাজতের ঘাড়ে, তখন হেফাজত নেতৃবৃন্দ কী করলেন? তাঁরা কি উদ্যোগ নিয়েছিলেন এই ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্ণিত করে জাতিকে জানিয়ে দেয়ার যে, হেফাজতের কোনো কর্মী কোরআনে আগুন দেয়ার মতো বর্বর কাজে জড়িয়ে নেই।
যদি বলেন, আমরা সেটা কী করে করবো? এতোগুলো মানুষকে আমরা সামাল দেবো কেমন করে? তাহলে সোজা প্রশ্ন, কে আপনাদের বলেছে এভাবে আন্দোলনের ডাক দিতে? যতটা সামাল দেয়া সম্ভব ততটাই আগাতেন। ঢাকার বাইরের প্রোগ্রাম বাইরেই রাখতেন। কে বলেছিল ভেতরে নিয়ে যেতে?
বলবেন, মিডিয়া আমাদের সাথে নেই। তারা মূল ঘটনাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে। তারা আসল অপরাধীদের আড়াল করে হেফাজতের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে।
তাই যদি বলেন, আমি বলব ঠিকই করছে। অন্তত এ থেকে যদি আপনাদের শিক্ষাটা হয়। আপনারা এখনো টেলিভিশন চ্যানেল করা জায়েজ কি জায়েজ না, সেই ফতওয়া নিয়ে কিতাব টানাটানি করছেন। মক্বতজায়ে হাল শুধু কিতাবেই পড়া আর পড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে এমন অবস্থা হয়ই, হবেই। অবাক হবার কী আছে!
সাত
৫ মে দিন গড়িয়ে রাত। শাপলা চত্বরে চলছে হেফাজতের সমাবেশ। সারা বিশ্বের নজর তখন ঢাকার মতিঝিলে। শ্বাসরুদ্ধকর এক একটা মুহূর্ত। কখন কী ঘটে বা যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটতে চলেছে-এমন একটা অবস্থা বিরাজ করছিল তখন। সবগুলো টেলিভিশনের ক্যামেরা তখন মতিঝিলে। কয়েকটি চ্যানেল ছিলো লাইভ সম্প্রচারে। টান টান উত্তেজনা আর আতংকে দেশবাসীর চোখে ঘুম নেই। কিন্তু ঘুমিয়ে ছিল এই সমাজের অবহেলিত কিছু মানুষ। চার তারিখ রাত থেকে তারা ঘুমায়নি। তাদের অনেকের পেটে খাবার ছিল না। কেই ছিল আধাপেটা। পেটে ক্ষিধা থাকলে চোখে ঘুম আসে না। তাদের এসছিল কারণ, গেল দুইদিন তারা ঘুমায়নি। ক্লান্তিতে অবশ হয়ে এসেছিলো তাদের শরীর।
অঘোরে ঘুমাচ্ছিল তারা বৃষ্টিভেজা রাস্তায়, ইটের উপর মাথা রেখে। তারা জানতো না এই ঘুমই তাদের কারো কারো জীবনের শেষ ঘুম। তারা বুঝতে পারেনি এই ঘুম থেকে তারা যখন জাগবে, তখন দেখবে কেয়ামতের মাঠের দিকে দৌড়াচ্ছে মানুষ। তারা জানতো না তারা যাদের আহবানে ছুটে এসেছে, তারা কেউ তখন আশেপাশে নেই!
অজানা আতংক নিয়ে দেশবাসীর চোখ তখন টেলিভিশনের পর্দায়। আস্তে আস্তে নিভে যেতে লাগল সবগুলো বাতি! বন্ধ হয়ে গেল টিভি চ্যানেলগুলোর লাইভ সম্প্রচার! অজানা আতংক তখন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল পেরিয়ে বিশ্ববাজারে। রাত তখন সাড়ে বারোটা। জানা গেল আইন-শৃংখলা বাহিনী শাপলা চত্বরে অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে! মিডিয়া সেটা প্রচার করতে লাগল। আমি নিশ্চিত আল্লামা আহমদ শফী ছাড়া সকল নেতারাই সেটা দেখতে পাচ্ছিলেন বা জানছিলেন। কিন্তু অজানা কারণে তারা ছিলেন নির্বিকার।
রাত তখন পৌনে তিনটা। ভূতুড়ে অন্ধকার তখন মতিঝিলে। অন্ধকারে গোঠা জাতি। অন্ধকারে তখন কিছু মানুষের ভাগ্য। বন্ধ করে দেয়া হল টিভি চ্যানেলগুলোর লাইভ সম্প্রচার। আর ঠিক তখনই এক সাথে গর্জে উঠল হাজার হাজার অস্ত্র। সাথে সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দ। লাইভ প্রচার বন্ধ থাকলেও লাইভ ধারা বর্ণনায় ছিল কিছু চ্যানেল। আমি অন করে রেখেছিলাম একাত্তর। ঢাকা থেকে ৩শ কিলোমিটার দূরে বসেই কানে আসছিল বিকট শব্দগুলো। সেই সাথে কিছু মানুষের গগণবিধারী চিৎকার! ইয়া আল্লাহ ! ইয়া আল্লাহ!!… মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যেই নিরব হয়ে গেল সরব শাপলা। তারমধ্যেই যা হবার হয়েগেছে…কতটা নৃশংসতা চলেছে তখন, আল্লাহই জানেন।
আট
সে রাতে আসলেই কী ঘটেছে শাপলায়? আমরা এখনো জানি না। সরকার বা হেফাজতের তরফ থেকেও নিশ্চিত করে কিছু বলা হচ্ছে না। সরকার থেকে চারদিন পর অর্থাৎ ১০ মে ২০১৩ প্রেসনোট দিয়ে বলা হয়েছে সারা দিনে সর্বসাকুল্যে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে!! আবার হেফাজতের পক্ষ থেকে যে তথ্যগুলো দেয়া হচ্ছে, সেগুলো দায়িত্বহীন কথাবার্তা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেউ বলছেন শত শত আবার কেউ হাজার হাজার। আজ ১০ মে ২০১৩ এই লেখাটি যখন টাইপ করছি তখন পর্যন্ত হেফাজতের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট করে মৃতের সংখ্যা জানানো হয়নি। ঘটনা ঘটল ৬ তারিখ ভোর রাতে। চার দিন হয়ে গেছে। এখনো হেফাজত নেতারা কেনো পরিসংখ্যান দিতে পারছেন না। তাদের দাবি অনুযায়ী যতলোক শহীদ হয়েছে, তাদের তালিকা কেনো প্রকাশ করছেন না। জবাব কী?
এখানে একটি কথা না বললেই নয়। ঘটনার পরদিনই আওয়ামীলীগের মুখপাত্র মাহবুবুল আলম হানিফ অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীন স্টাইলে বলে বসলেন, কোনো হতাহতের ঘটনা ছাড়াই শেষ হয়েছে শাপলা অপারেশন! সারা বিশ্ব যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশ দেখল, গগনবিধারী চিৎকার শুনল, রক্তাক্ত মানুষকে রাস্তায় কাতরাতে দেখল, সেখানে আওয়ামীলীগের এই যুগ্ন সম্পাদক হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটতে দেখেননি! বিবেকের দৈন্যতা কোন পর্যায়ে নেমে গেলে একজন দায়িত্বশীল লোক এমন দায়িত্বহীন কথা বলতে পারে!
আমরা হানিফ সাহেবের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এই ম্যাসেজটি দিতে চাই যে, দেশের আপামর মানুষের মনের ভাষা বুঝবার চেষ্টা করুন। অতি বামদের পাল্লায় পড়ে আওয়ামীলীগের মতো একটি দল যে লাইনে হাঁটছে, সে পথে অগ্রসর হতে থাকলে সামনে শুধু পাথুরে পাহাড়ই মিলবে। আর পাথরে মাথা টুকতে হয় না, তাহলে মাথাটাই ফেটে যায়।
হেফাজত নেতৃবৃন্দকে আমরা বিনয়ের সাথে বলি, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা পাইকারী ধাচের দায়সারা কথাবার্তা বন্ধ করুন। যে ছেলেগুলো আপনাদের ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন দিয়েছে, তাদের প্রতি আপনাদের যদি ন্যূনতম দায়িত্ববোধও থেকে থাকে, তাহলে তাদের তালিকা প্রকাশ করুন। আমরা জানতে চাই আমার কতটি ভাই সে রাতে শহীদ হয়েছে? আমরা জানতে চাই তাদের পরিচয়। এটা জানা দরকার এ জন্য যে, আপনাদের অতীত কার্যকলাপ থেকে আমরা জানি আপনারা এদের ব্যবহারই করতে জানেন। দায়িত্ব নিতে জানেন না। এর আগে আপনারা কখনো কারো দায়িত্ব নেননি। আগামীতেও নেবেন না।
আপনারা তাদের তালিকাটা দিন। আমরা তাদের বাড়ি যাব। গিয়ে দাঁড়াব ছেলে হারানো মায়ের সামনে, হাত জোড় করে। বলবো, মা, তোমার ছেলে নবীর ইজ্জত রক্ষার আন্দোলনে গিয়ে স্বার্থপর নেতৃত্বের অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে চলেগেছে অপারে। তুমি দুঃখ করো না মা। তোমার ছেলে শহীদ হয়েছে। কিন্তু এই জাতিকে চিনিয়ে দিয়ে গেছে কিছু মুনাফিকের চেহারা। ভবিষ্যতে এটা কাজ দেবে।
নয়
আমি জানি অনেক কর্কশ ভাষা ব্যবহার করছি। জেনে বুঝেই করছি। আবেগ তাড়িত হয়ে নয়। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে জীবনেও না দেখা অসহায় সেই মুখগুলে। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পারছি তাদের ছটফট করতে থাকার দৃশ্যগুলো। শুনতে পারছি তাদের শেষ নি:শ্বাসের শব্দগুলো। কিছুতেই মানাতে পারছি না মনকে। জেনেশুনে এভাবে মৃত্যুর মুখে ছেড়ে দেয়া!
হেফাজতের সেই সকল নেতারা, যারা মিডিয়ায় চিৎকার করতে করতে গলা ভেঙে ফেলছিলেন, তখন কোথায় ছিলেন তারা? পুরো আন্দোলনের কলকাটি নাড়া মাইনুদ্দিন রুহি আর মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেবরা তখন ছিলেন কোথায়? তারা কেনো শহীদ হলেন না? কার স্বার্থে কাদের ইংগিতে তারা আমার ভাইগুলোকে অসহায়ের মতো গুলির মুখে ফেলে রেখে কাপুরুষের মতো পালিয়ে গেলেন? আর গেলেনই যখন, এদেরকে সাথে নিয়ে গেলেন না কেনো?
কার নাড়ির টান কোন দিকে, আমরা জানি তো। এই তো সেই মাইনুদ্দিন রুহি না, যিনি মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রাহ)কে ইসলামী ঐক্যজোট থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে আলাদা ইসলামী ঐক্যজোট প্রতিষ্ঠিত করিয়েছিলেন। এই মুফতি ফয়জুল্লাহ ১৮ দলীয় জোটের শরীক না?
সমস্যা ছিলো না। তিনি ১৮ দল করলেন না ৩৬ দল করলেন, কী আসে যায় কিন্তু আহমদ শফীর ডাকে ছুটে আসা ছেলেদের তিনি এভাবে হত্যা করাতে পারেন না। এর জবাব তাকে দিতেই হবে। সময় বড় বে-রহম হয়ে থাকে।
দশ
সরি উলামায়ে কেরাম। কথাগুলো আমি না বললে অন্য কেউ ঠিকই বলত। ইতো:মধ্যে কথা শুরুও হয়েছে। ক’জনের মুখ বন্ধ করবেন? তারচে’ ভাল হবে ত্রুটিগুলো শুধরে নিলে। অবশ্য যদি বোধগুলো জেগে উঠে, তো। মনে পড়ছে হাফেজ্জি হুজুরের তওবার রাজনীতির কথা। এখন সময় জাতিগতভাবে তওবার আন্দোলন শুরু করার। এ তওবা নিজের জন্য, এ তওবা জাতির জন্য।
________________ ১১ মে ২০১৩