মিশরের রাজধানী কায়রোয় নীল নদের তীরে হাজারো বছরের ইতিহাস ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়। বিখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শোনেননি, এমন লোক হয়তো কমই পাওয়া যাবে। কিন্তু এর ইতিহাস-ঐতিহ্য-রাজনীতি ও বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে হয়তো অনেকেরই জানা নেই। আমরা এসব বিষয়ে খানিকটা বিস্তারিত আলোচনা করবো।
নীল নদের মতো আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ও যেন মিশরের অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সহস্রাধিক বছর আগের কথা। ৯৭০ সালে ফাতেমীয়রা মিশর দখল করার একটি জামে মসজিদ নির্মাণের কাজে হাত দেয়। দুই বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষে তা উদ্বোধন করা হয়। ফাতেমীয়রা নিজেদেরকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)’র কন্যা ফাতেমাতুজ্জাহরা (সাঃ আঃ)এর বংশধর বলে মনে করতো এবং এ কারণেই তারা ফাতেমাতুজ্জাহরা (সাঃ আঃ)’র নামানুসারে ঐ মসজিদটির নাম রাখে আল আযহার জামে মসজিদ। এর স্বল্প সময়ের মধ্যে মসজিদটি ইসমাঈলী শিয়া ফাতেমীয়দের আকীদা-বিশ্বাসের প্রচার-প্রসার এবং শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে রূপ লাভ করে। এ অবস্থায় মুসলিম বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষানুরাগীরা সেখানে ভীড় জমাতে থাকেন।
সালাউদ্দিন আইয়ুবি’র হামলার মধ্য দিয়ে মিশরে ফাতেমীয় শাসনের পতন ঘটলে আল আযহার শিক্ষা কেন্দ্র তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শুধু সুন্নী মাজহাব সংক্রান্ত পড়াশোনাই সেখানেই গুরুত্ব পেতে থাকে। কিন্তু মুসলীম বিশ্বের পূর্বাঞ্চলে মোংগলীয়দের হামলা এবং স্পেনে মুসলমানদের শক্তি হ্রাস পাবার ফলে ঐসব এলাকা থেকে শিক্ষানুরাগীরা আবারও আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। মিশরে ওসমানীয়দের শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয়টি অর্থনৈতিক দিক থেকে সনিয়ন্ত্রিত হবার মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়। আর ১৮৯৫ সালে শেখ মুহাম্মদ আবদুহ মিশরের গ্রান্ড মুফতির দায়িত্ব লাভের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে নতুন নতুন বিষয় যুক্ত করেন। শিক্ষা ও গবেষণার পরিধিকে বিস্তৃত করেন। কিন্তু ১৯৫৪ সালে জামাল আব্দুন্নাসের মিশরের ক্ষমতা গ্রহণের পর আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠানটির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা খর্ব করা হয় এবং গ্রান্ড মুফতিসহ গুরুত্ব পদে নিয়োগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়। অতীত ধারার ব্যত্যয় ঘটিয়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট গ্রান্ড মুফতিসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ দিতে শুরু করেন। আজও সে ধারাই অব্যাহত রয়েছে। তবে গত পঞ্চাশ বছরে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। মিশরের বিভিন্ন শহরে বিশ্ববিদ্যালয়টির শাখা খোলা হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিত্ব শেইখ মাহমুদ শালতুত, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে নতুন কয়েকটি ফ্যাকাল্টি খুলেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টি এর মধ্যে অন্যতম। তবে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এই ফ্যাকাল্টির ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তাদের মূল বিষয়ের পাশাপাশি ধর্ম বিষয়েও শিক্ষা দেয়া হয়। শেইখ শালতুতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য আলাদা শাখা প্রতিষ্ঠা করেছেন। আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়ন করছে। তাদের অধিকাংশই ধর্মীয় বিষয়ে পড়াশোনা করলেও দর্শন, অর্থনীতি, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও কম্পিউটার বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও নেহায়েৎ কম নয়।
আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় আল আযহার নামক বৃহৎ পরিসরের আল আযহার ইনস্টিটউশনের তত্ত্বাবধানে। গ্রান্ড মুফতি হলে বৃহৎ এই ইনস্টিটিউশনের প্রধান। এই ইনস্টিটিউশনের তিনটি বিভাগের একটি হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়। অন্য একটি বিভাগ ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা, ফতোয়া জারি, ম্যাগাজিন প্রকাশ ও ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালন করে থাকে। তৃতীয় আরেকটি বিভাগ রয়েছে যা বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। এই দপ্তরের অধীনে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই বিভাগের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত স্কুল-কলেজগুলোতে এমন ভাবে শিক্ষা দেয়া হয় যাতে সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
গত মার্চ মাসে আল আযহার ইনস্টিটিউশনের প্রধান বা গ্রান্ড মুফতি মুহাম্মদ সাইয়্যেদ তানতাভি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার পর মিশরের প্রেসিডেন্ট হুসনি মোবারক ড: আহমাদ আল তাইয়্যেবকে ঐ পদে নিয়োগ দিয়েছেন। আর আল-আযহার ইন্সটিটিউশনের অধীন আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ড: আব্দুল্লাহ আল হোসেইনি। নয়া মুফতি ড: আহমাদ আল তাইয়্যেবের বয়স ৬৩ এবং তিনি দক্ষিণ মিশরে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি ইসলামী দর্শন শাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন।
আল আযহার ইনস্টিটিউশনের পরিধি বৃদ্ধি পেলেও এই প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ইস্যুতে এখনও নানা সমস্যার সম্মুখীন। কোন কোন ইস্যুতে বেশ বিতর্কিতও বটে। প্রতিষ্ঠানটি তার নিজস্ব পরিচিতি, স্বকীয়তা ও প্রভাব হারাতে বসেছে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। গ্রান্ড মুফতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের বিষয়টি মিশর সরকারের হাতে থাকায় আল আযহার, সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। শেইখ তানতাভির মৃত্যুর পর অতীত ঐতিহ্য অনুযায়ী আল আযহারের নয়া শেইখ নিয়োগের বিষয়টি ওলামা পরিষদের মাধ্যমে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু হুসনি মোবারক তা হতে দেননি। মিশর সরকারের উপর নির্ভরশীলতা ও মিশর সরকারের নীতির সাথে প্রতিষ্ঠানটির পথচলা, জনগণের মাঝে আল আযহারের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক ভাবে হ্রাস পেয়েছে।
১৯৯৭ সালে মিশর, ইসরাইলের সাথে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করার পর গোটা মুসলিম বিশ্ব ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এর ফলে আরবলীগ থেকে মিশরকে বহিস্কার করা হয় এবং অধিকাংশ আরব দেশ মিশরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আল আযহার ঐ অবমানকর চুক্তির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। আল আযহারের এই পদক্ষেপে মিশরের জনগণসহ গোটা বিশ্ব বিস্মিত হয়েছিল। এরপর ২০০৩ সালে ফ্রান্সে যখন হিজাব বা ইসলামী শালীন পোশাক পরিধান নিয়ে বিতর্ক চরমে তখন আল আযহারের গ্রান্ড মুফতি এক বিতর্কিত ফতোয়া জারি করেন। তিনি ফ্রান্সের মুলমানদেরকে হিজাব ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ঐ ফতোয়াও মিশরের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
মিশরে এখন ক্ষমতার পালাবদলের সুর ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। হোসনি মোবারক তার ছেলে জামাল মোবারককে তার স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে হুসনি মোবারকের শাসনে মানুষ এখন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তারা এখন গণতান্ত্রিক ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন চায়। এ অবস্থায় হুসনি মোবারকের প্রতি আল আযহারের অব্যাহত সমর্থন, প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতাকেই আরও হ্রাস করছে। মিশরের সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্রথম ভাগে থাকা মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রভাবশালী সদস্য আব্দুল মুয়িন আব্দুল ফুতুহ আল আযহারের অবস্থান সম্পর্কে মন্তব্য করতে যেয়ে বলেছেন, সরকারের সাথে আল আযহারের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতায় মারাত্মক আঘাত হেনেছে। এখন আল আযহার থেকে যে ফতোয়াই জারি করা হচ্ছে,মানুষ সেটাকেই সরকারী ফতোয়া হিসেবে গণ্য করছে।
তবে সম্প্রতি নিয়োগপ্রাপ্ত আল আযহারের নয়া মুফতি উগ্রবাদী নন বলে একটা সুনাম রয়েছে। পাশাপাশি তিনি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। কিন্তু আল আযহারে ওহাবীদের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি চাপের মধ্যে রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি সম্প্রতি শিয়া মাজহাব সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তার অতীত কর্মকান্ড ও বক্তব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নয়া মুফতি মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য নয় বরং ঐক্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে। আল আযহারের মুফতির আসনে বসে ভবিষ্যতে তিনি মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ভূমিকা পালন করবেন, সবাই এ প্রত্যাশা করছে।