হাফিয মাওলানা ফখরুযযামান : চিন্তার বিষয়
এই প্রাথমিক বিষয়াবলি কি এতই মনোযোগের হকদার ছিল? অবশ্য যা কিছু হয়েছে, তা এক বিশেষ যুগের চাহিদা ছিল। মানুষের আগ্রহের বিষয়ও ছিল। তা পূরণও হয়েছে। এভাবে অন্যান্য শাস্ত্র ও গ্রন্থের কথা অনুমান করুন। এখন সেই উদ্যম নেই, নেই পরিশ্রম ও সাধনার মতো মস্তিস্কের যোগ্যতা। সেই সময় সুযোগ স্বস্তি নেই। সবচেয়ে বড় কথা প্রয়োজন নেই। জটিলপ্রিয়তার প্রতি মনের অনীহা এসেছে,নতুন নতুন গ্রন্থ রচিত হয়েছে। রচনা ও সাহিত্যের পদ্ধতি ও ধারা বদলে গেছে। পূর্ববর্তী মনীষীদের কিতাবসমূহ প্রেসে আসতে শুরু হয়েছে। সমকালীন লেখকরা সাহস করে যুগের তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে নতুন ধাচে মনোরঞ্জনের জন্যে সুন্দর সুন্দর রচনা পেশ করছেন।
এমতাবস্থায় যদি আমরা এখনো এসব অগুরুত্বপূর্ণ উপকরণসমূহ আঁকড়ে ধরে থাকি, তাহলে ইসলামি বিষয়সমূহ থেকে মনোযোগ সরে যাবে এবং আমাদের এ কর্মপদ্ধতি আমাদের পূর্বসূরী ও মুরব্বীদের সেই গর্বীয় উত্তরাধিকার ও সেই ইলমি সম্পদ ও পূঁজি নিঃশেষ করে ফেলবে। এটি প্রকৃতপক্ষে ইলমের কল্যাণকামিতা নয়; বরং নির্বোধ বন্ধুর মতো কাজ হবে।
এবার দারসে নেযামির ফেকাহ শাস্ত্রের কিতাবাদি সম্পর্কে তার মন্তব্য লক্ষ্য করি। তিনি বলেন- ফিকাহ শাস্ত্রে কানযুদ্দাকায়েক, বেকায়া, শরহে বেকায়া ও নেকায়ার উত্তম বিকল্প পূর্ববর্তী মনীষীদের কিতাবসমূহে কি পাওয়া যায়না? জামে সগীর, জামে কবীর ইত্যাদি। ইমাম মুহাম্মদ, ইবনুল হাসান শায়বানির সরাসরি লেখা কিতাবসমূহ কি সকল দিক দিয়ে সঠিক নয়? তাতে যে ইলম ও বরকত হবে,তা পরবর্তীকালের লেখকদের কিতাবসমূহে কোথায় পাওয়া যাবে? আমার ক্ষুদ্র মতে ফিকহে নূরুল ইযাহ, কুদুরী ও হেদায়া ব্যতীত অবশিষ্ট সকল কিতাব পরিবর্তন যোগ্য।
আমরা যদি আমাদের পাঠ্যসূচির মধ্যে বালাগতে ‘মুখতাছার’ আকাঈদে, ‘শরহে আকাঈদ’ উসূলে ফেকাহের ‘হুসামি’ ইত্যাদিকে পরিবর্তন না করি তাহলে এসব বিষয়ে কি আমাদের ছাত্ররা দক্ষ হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে? এসব কিতাবের কোন বিকল্প কি আমাদের সামনে নেই? এভাবে র্সাফ-নাহু,মায়ানী, ফালসাফা, ফিক্হ, তাফসির, আদব ইত্যাদি সম্পর্কে যদি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে সবগুলোর সারকথা এই দাঁড়াবে যে, প্রচলিত নেসাবে এমন কিতাব রয়েছে যাতে সুক্ষ্মতার নৈপুন্য দেখানো হয়েছে এবং সংক্ষেপকরণে রেকর্ড সৃষ্টি করা হয়েছে।
নিঃসন্দেহে মেধার প্রখরতা, সুক্ষ্মদৃষ্টি ও চুলচেরা বিশ্লেষণে দক্ষতা অর্জনের জন্যে এগুলো সবচেয়ে উপযুক্ত হলে হতে পারে; কিন্তু তা গ্রহণীয় নয়।
“আমাদের কওমি মাদরাসা সিলেবাসের আরো একটি ত্র“টির প্রতি আঙ্গুলি প্রদর্শন করে আল্লামা বিন্নুরি বলেন- বর্তমান যুগে সাহিত্য ও ইতিহাসের গুরুত্ব বেশি। এজন্যে আমাদের সিলেবাসে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি স্তরে সীরাতুন্নবী সা. তারীখে ইসলাম এরপর সাধারণ ইতিহাস ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসের প্রতি মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।
নাস্তিক্যবাদ ও ধর্মহীনতা যেমন ইসলামি বিষয়সমূহ বিকৃত করার চেষ্টা করেছে, তেমনি ইসলামের ইতিহাস ও ধর্মহীন প্রচেষ্টা অনেক বিকৃত করে দিয়েছে। এজন্যে ইসলামের ইতিহাসে গবেষণাসূলভ জ্ঞান অর্জন করা খুবই প্রয়োজন।
পরিতাপের বিষয় হল, আমরা একদিকে নবী-প্রেমের দাবিতে সর্বাগ্রে অথচ নবীচরিত পাঠে মোরা সবার পিছনে। আমাদের সিলেবাসে “সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া” ছাড়া আর কি কোন সীরাত গ্রন্থ আছে? তাই বলি নবী প্রেমের দাবি কি অবান্তর নয়?
আমি সিলেবাস সংক্রান্ত আলোচনাটি শায়খ মাদানির একটি উক্তি দ্বারাই শেষ করতে চাই। শায়খ মাদানির কোন পরিচিতি না তুলে ধরেই উক্তিটি বিবৃত করছি “আমার শিক্ষা জীবনে আমি দারুল উলুমে দেওবন্দের পাঠ্যসূচিকে উন্নতির সোপান এবং ইহাকে যথার্থ বলিয়া মনে করিয়াছি- স্বীয় যোগ্যতানুসারে তাহা হইতে উপকৃত হইয়াছি। কিন্তু পরবর্তীতে মদিনায়, মিশরের জামে আযহার, ইস্তাম্বুল ও বুখারা ইত্যাদির পাঠ্যসূচি হইতে ইহাকে প্রাচীন মনে হইয়াছে।”
তা আজ থেকে কতকাল পূর্বের কথা। আর এখন? তা কি বলতে হবে?
কওমি মাদরাসাশিক্ষার প্রতি অনীহার কারণ
কোনো একটি শিক্ষা তখনই গ্রহণযোগ্যতা ও সার্বজনীনতা লাভ করে যখন তা মানবজীবনের সফলতার সোপান হয়। মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখে। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সকল ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শন করে। সর্বোপরি একজন মানুষকে সর্বদিক দিয়ে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলে।সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়ে দেয়। আর যে শিক্ষায় এসব বিষয় অনুপস্থিত, তা গ্রহণযোগ্যতা ও সার্বজনীনতা লাভ কনা তো দূরের কথা উল্টো এর প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। অনীহা প্রকাশ করে।সর্বশেষ বিরোধীতায় লিপ্ত হয়। বর্তমানে কওমি মাদরাসাগুলো বহুলাংশে মানুষের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ।কারণ বর্তমানে কওমি মাদরাসাসমূহে আগের ন্যায় দ্বীনের সর্বক্ষেত্রে যোগ্য মানুষ তৈরি হচ্ছে না এবং আমলি দিকও একবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মাদরাসা ছাড়া অধিকাংশ মাদরাসার লেখাপড়ার মান ও শিক্ষকদের যোগ্যতা ও পাঠদান পদ্ধতি প্রশ্ন সাপেক্ষ। আর সিলেবাসের দুর্বলতা তো রয়েছেই। পুরনো আমলের অপ্রচলিত ও পরিত্যাজ্য অনেক বিষয় আঁকড়িয়ে ধরার মানসিকতা ও যুগোপযোগী বিষয়য়াবলির প্রতি অনীহা ও এগুলো থেকে নিরাপদ দূরে থাকার আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। এগুলোই হচ্ছে বর্তমান সময়ে কওমি মাদরাসাশিক্ষার প্রতি অধিকাংশ মানুষর অনীহার মূল কারণ।