হাফিয মাওলানা ফখরুযযামান : দারসে নেযামির ত্রুটি ও এর প্রতিকার
আমার বুকের এমন পাটা নেই যে, দারসে নেযামিতে কী কী ত্রুটি রয়েছে তা নির্ণয় করে ব্যবস্থাপত্র দিব। তা হবে পাগলের প্রলাপ মাত্র। তবে যে সব মনীষীদেরকে আল্লাহ সে যোগ্যতা দিয়েছেন।যাদেরকে আমরা এর যোগ্য বলে ভাবি। যাদের কাছে জাতি সময়ের চাহিদানুযায়ী ব্যবস্থাপত্র পেতে চায়। তাদেরই কিছু উক্তি আমি নিম্নে উল্লেখ করছি মাত্র। আশা করি এতে দোষের কিছু নেই। ওইসব উক্তিকারী ব্যক্তিগণ যেমন আমাদের বাংলাদেশের অধিবাসী, তেমনি রয়েছেন আমাদের পাশ্ববর্তী ভারত পাকিস্তানেরও।
আমি প্রথমেই আমাদেরই স্বজাতি, স্বদেশী আলিম, যার নামের সাথে বাংলাদেশের আলিমসহ প্রায় সকল নাগরিক কমবেশি পরিচিত। সেই আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরি রাহ.’র উক্তিটিই উল্লেখ করছি।তিনি বলেন, “আমি দারসে নেযামির পক্ষপাতি, তাছাড়া অন্য কোন শিক্ষা ধারার পক্ষপাতি নই্; কিন্তু দারসে নেযামির হাকীকত আজকাল লোকেরা বুঝছে না। পূর্ব যামানার একটি শখছিয়াত (ব্যক্তিত্ব)-কে হাকীকত মনে করছে। দারসে নেযামির হাকীকত এই যে, শুধু “মা’কূলাত” অর্থাৎ যুক্তি ও তর্ক শাস্ত্র বা জ্ঞান-বিজ্ঞান অথবা শুধু “মানকূলাত” অর্থাৎ কুরআন-হাদিস পড়ানো উচিত নয়। বরং মানকূলাত ও মা’কূলাত একত্রে পড়নো উচিত। মা’কূলাতের কোনো সীমা নেই। যামানা যেমন বাড়তে থাকবে,মা’কূলাত তেমন বাড়তে থাকবে- যা দ্বারা আকল বাড়ে। আল্লাহমুখী বিজ্ঞানই বিজ্ঞান। নাস্তিকতার বিজ্ঞান বিজ্ঞান নয়, ধৃষ্ঠতা ও অন্ধত্ব বৈ আর কিছু নয়। কাজেই হাদিস ও কুরআনের আলোর দ্বারা আলোকিত সমস্ত মা’কূলাত (যুক্তি-তর্কশাস্ত্র) ও সাধারণ বিজ্ঞানকে আলোকিত করতে হবে এবং হাল ধরে রাখতে হবে।”
এ-তো গেল ফরিদপুরি সাহেবের দারসে নেযামি সম্পর্কে তাঁর ইজমালী মন্তব্য। এখন আমি দেওবন্দের প্রথম সারির সূর্য সন্তানদের এ ব্যাপারে বিষয়ভিত্তিক মন্তব্য পেশ করছি।
প্রথমেই আমি আল্লামা ইউসূফ বিন্নুরির কথা উল্লেখ করছি। তিনি বলেন, দ্বীনি মাদরাসাগুলোতে বর্তমানে যে নেসাব চালূ রয়েছে, হাদিস ও ফিক্হের কিতাবাদি বাদ দিলে অধিকাংশই হিজরি সপ্তম শতাব্দী ও তার পরের যুগের স্মারক। যখন থেকে প্রকৃত অর্থে মুসলমানদের অধঃপতন ও নিম্নগামিতা শুরু হয়, উম্মতের প্রথম যুগের মনীষীদের যেসব গ্রন্থাদিতে ইলমের প্রাণ শক্তি বজায় ছিল, ভাষা ছিল সাবলীল ও স্বচ্ছ, সূত্র ও নিয়ম ছিল সুস্পষ্ট, যাতে বাক্যগত দুর্বোধ্যতা ছিল না; অপ্রয়োজনীয় আলোচনা ছিল না; যা অধ্যয়ন করলে সঠিক অর্থেই মন মস্তিষ্ক প্রভাবিত হত; সময় নষ্ট হত না; মস্তিষ্কে চাপপড়ার আশঙ্কা ছিল না; সে সবের জায়গায় এমন সব কিতাব এসেছে যাতে বেশি নৈপুণ্য মনে করা হয়েছে সংক্ষেপকরণকে। বেশি জোর দেওয়া হয়েছে শাব্দিক আলোচনার ওপর, শাব্দিক চুলচেরা বিশ্লেষণ শরু হয়েছে। এরূপ বললে অত্যুক্তি হবে না যে, কাগজ যদিও অল্প ব্যয় করা হয়েছে, কিন্তু তা আয়ত্ত করতে সময় ও মেধা বেশি ব্যয় করা হয়েছে। এটিকে বিরাট দক্ষতা মনে করা হয়েছে যে, পাঠ এতই সুক্ষ্ম ও গভীর হতে হবে যার জন্যে ব্যাখ্যা ও টীকা টিপ্পনির প্রয়োজন পড়ে। কয়েকটি ব্যাখ্যা ছাড়া তা উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না। এ যদি বিদ্যা বিলাসিতা না হয়, তাহলে আর কি হতে পারে? আমার স্থুল চিন্তায় এ ছিল ইলমের সবচেয়ে বড় বিপদ। এতে ইল্ম ও ইসলামি জ্ঞানের বিরাট ক্ষতি হয়েছে।
আমাদের বর্তমান পাঠ্যসূচির গুরুত্বপূর্ণ নাহবের কিতাব শরহে জামি ও কাফিয়া সম্পর্কে তার মন্তব্য শুনি। তিনি বলেন, ইবনে হাজিবের কাফিয়ার কথাই ধরুন। এর পঞ্চাশের অধিক ব্যাখ্যা গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এ সবের মধ্যে অন্যতম মুল্লা জামীর শরাহ আর এর টীকা গ্রন্থসমূহের তালিকা তৈরি করতে পূরো এক খাতা লাগবে। এরপর তার শরহে আবদুল গফুরের কথা ধরুন। এর তাকমিলাহ লিখেছেন আবদুল হাকীম সিয়ালকোটি। এ দুয়ের শরাহ “দাফেউত তাওয়াহহুমাত” দেখুন। তেমনি ইবনে মালিকের আলফিয়া এর শরাহসমূহ, আবার শরাহের শরাহ এরপর এর শরাহ সাব্বান দেখুন সপ্তমখণ্ডে। সারা জীবন এটিই দেখে শেষ করতে হবে।