বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১১:৪০
Home / কবিতা-গল্প / শাহজাদার জ্ঞান পিপাসা

শাহজাদার জ্ঞান পিপাসা

Islam_and_Scienceবাদশা হারুনুর রশিদের এক ছেলে ছিলো। যৌবনের শুরু থেকেই সে ছিলো নেক্কার ও পরহেযগার। তাঁর অন্তরে ছিলো আখেরাতের চিন্তা। রাজপ্রাসাদে থেকেও সে সাধারণ কাপড় পরিধান করতো। শুকনো রুটি ভিজিয়ে খেয়ে নিতো। দুনিয়ার রঙ-তামাশার প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিলো না। সে ছিলো দরবেশ প্রকৃতির। কিন্তু লোকেরা তাকে পাগল মনে করতো। একবার কিছু লোক বাদশাকে কুমন্ত্রণা দিলো, আপনার ছেলে তো উচ্ছন্নে যাচ্ছে। ওকে বোঝান; প্রয়োজনে কিছুটা কঠোরতা করুন, যেনো ঠিক হয়ে যায়। সে তো আপনার নাম ডুবিয়ে ছাড়বে।

বাদশা তাকে ডেকে ধমকের সুরে বললেন— তুমি এসব কী শুরু করেছো? তোমার কারণে আমার নাম ডুবছে, লোকসমাজে লজ্জা পেতে হচ্ছে। ছেলে বললো— আব্বাজান, যদি অনুমতি হয় আমি কোথাও চলে যাই। ইলমের জন্য আমি আগে থেকেই চলে যেতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু অনুমতি ছাড়া যাই কীভাবে? আমি আর আপনাকে লজ্জায় ফেলতে চাই না। অনুমতি দিন কোথাও চলে যাই। রেগেমেগে বাদশা বলে দিলেন— ঠিক আছে, যাও, চলে যাও। পরে স্ত্রীর মাধ্যমে বুঝিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু ছেলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে আর থাকবে না।

বিদায় বেলায় মা তাকে একটি কুরআন শরীফ আর একটা আংটি দিয়ে বলে দিলেন— বাবা, তুমি কুরআনখানি করবে, আর কখনো বিপদে পড়লে আংটিটি বেচে দিবে। ছেলে জিনিস দু‘টো নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সে ছিলো খুবই সুদর্শন। দুনিয়ার সব নেয়ামত আল্লাহ পাক তাকে দিয়েছেন। আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস, স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য সবই ছিলো তাঁর। কিন্তু সবকিছু দু’পায়ে ঠেলে দিয়েছে সে। কারণ তাঁর অন্তরে ছিলো আল্লাহর ভালোবাসা ও আখেরাতের ভয়। ইলমের প্রতি ছিলো সীমাহীন আকর্ষণ।

শাহী প্রাসাদের রাজকীয় জীবন ছেড়ে সে পথে বেরিয়ে পড়লো ইলমের জন্য। অনেক দূরের এক অঞ্চলে গিয়ে উঠলো। সেখানে ছিলো বড়ো বড়ো আলেমদের বসবাস। সে নিয়ত করলো মসজিদে থেকে উস্তাদের কাছে পড়বে। অতিরিক্ত কোনো দায়িত্ব উস্তাদের ওপর চাপাবে না। সপ্তাহে একদিন মজুরি করবে, বাকি ছয়দিন সে-মজুরির অর্থে দিন-গুজরান করবে। ছয়টা রুটি কিনে প্রতিদিন একটা করে খাবে। এভাবেই তাঁর দিন কেটে যাবে। ছেলেটি সেভাবে চলতে লাগলো। সপ্তাহে একদিন কাজ করে, বাকি ছয় দিন পড়ে।

একলোক বলেন— আমার ঘর বানানোর প্রয়োজন হলে মজুর আনতে যাই। দেখি এক সুদর্শন যুবক বসে কুরআন তেলাওয়াত করছে। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। নিজের অজান্তেই বলে উঠলাম— এ তো মানুষ নয়; এ যে সম্মানিত ফেরেশতা! তাকে দিনমজুর বলে মনে হয়নি, বরং সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে বলেই মনে হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম— তুমি কি মজুরি করতে এসেছো?

: হ্যাঁ, চাচাজান, দুনিয়াতে আমরা সবাই তো মজুর।

: তুমি কি আমার বাড়িতে কাজ করবে?

: হ্যাঁ, কাজ করবো; তবে আমার দু’টো শর্ত আছে। প্রথমত আমাকে এই পরিমাণ মজুরি দিতে হবে, কমও দিতে পারবেন না আবার বেশিও না। আর আমাকে নামাযের সময় দিতে হবে। আমি ধীরে সুস্থে নামায পড়বো, কিছু বলা যাবে না।

আমি শর্তদুটি মঞ্জুর করে ছেলেটিকে কাজে নিলাম। সন্ধ্যায় দেখা গেলো সে একাই কয়েকজনের কাজ করে ফেলেছে। কাজ দেখে খুশি হয়ে বেশি মজুরি দিতে চাইলাম কিন্তু সে কিছুতেই নিলো না। ধার্যকৃত মজুরি নিয়েই চলে গেলো। পরের দিন আবারো তাকে আনতে গেলে জানতে পারলাম, সে আসলে তালিবে ইলম; কুরআন-হাদীস পড়ে। সপ্তাহে ছুটির দিন শুধু মজুরি করে। তা দিয়ে বাকি ছয়দিন চলে। ই’তেকাফের নিয়তে মসজিদে থাকে। কারো কাছে হাত পাতে না।

পরের সপ্তাহে গিয়ে তাঁকে পাওয়া গেলো। বাড়িতে নিয়ে এলাম। এবার ভাবলাম দেখবো, কীভাবে সে এতো দ্রুত কাজ করে। আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন তাঁর কাজ। কী আশ্চর্য! অন্য মিস্ত্রিদের যেখানে একটা ইট বসাতে অনেক সময় লাগে¬—প্রথমে ইট বসায়; তারপর সল ধরে সোজা করে মশলা লাগায়। ওকে দেখলেন, কেবল মশলা লাগিয়ে ইট বসাচ্ছে আর ইট আপনা-আপনি সোজা হয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম সত্যিই বড়ো কামেল যুবক।

পরের সপ্তাহে আবার গেলাম তাঁকে আনতে। দেখি সে নেই। লোকদের জিজ্ঞাসা করলে তারা বললো— সে ভীষণ অসুস্থ। মসজিদে পড়ে আছে। আমি মসজিদে গেলাম, দেখলাম মাথার নিচে ইট দিয়ে ছেঁড়া চাটাইয়ে শুয়ে আছে। প্রচ- জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। চেহারা লালচে দেখাচ্ছে। ইট সরিয়ে তার মাথাটা কোলে তুলে নিলাম। অনুযোগ করে বললাম— তুমি কেনো আমাকে খবর দাওনি? আমি ওষুধ-পত্রের ব্যবস্থা করতাম। সে বলে উঠলো— চাচাজান, যে ডাক্তার সুস্থ করেন তিনিই দিয়েছেন অসুখ। শুনে আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বললাম— তোমাকে ভালো কোথাও নিয়ে যাই। তার স্পষ্ট জবাব, কোথায় নিয়ে যাবেন? আমি তো মুসাফির; মঞ্জিল আমার অতি নিকটে, পাথেয় সামান্য।

: আচ্ছা তুমি কী বলতে চাও খুলে বলো। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

সে বললো— চাচাজান, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, আমার মৃত্যু সমাসন্ন। আপনার কাছে আমার একটা আবদার—আমার একটা আমানত জায়গামত পৌঁছে দেবেন।

: কী সেই আমানত? বললে যুবক আমার হাতে একটি কুরআন শরিফ ও একটি আংটি তুলে দিলো।

: কার কাছে পৌঁছাবো?

: বাদশার কাছে। বলেই সে দোয়া-মোনাজাতে লেগে গেলো। বলতে লাগলো— হে আল্লাহ, তুমি তো জানো, আমি রাজপ্রাসাদের আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস ছেড়ে তোমাকে পাওয়ার আশায় চলে এসেছি। তোমার জন্য কতো কষ্ট সয়েছি। এখন তোমার দরবারে হাজিরির সময়। আমার ভয় হচ্ছে, আবার ফিরিয়ে দেয়া হয় কি না। তোমাকে ছাড়া তো আমার কেউ নেই! আমাকে দয়া করো। আমি তো সেই মুসাফির যার সফর লম্বা কিন্তু পাথেয় সামান্য। তাঁর কথায় আমার চোখে পানি চলে এলো। এরই মাঝে কালিমা পড়তে পড়তে সে ইন্তিকাল করলো। তখন বুঝতে পারলাম এ যে আমাদের শাহজাদা। ইলমের উদ্দেশ্য ঘর ছেড়েছে। অবর্ণনীয় কষ্ট সয়েছে। আমি তাঁর কাফন-দাফন শেষ করে বাদশা হারুনুর রশিদের দরবারে গেলাম। দেখি তিনি সওয়ারিতে করে কোথাও যাচ্ছেন। সালাম দিয়ে বললাম— আমিরুল মুমিনীন, দয়া করে আমার একটা কথা শুনুন। তিনি সওয়ারি থামালে তাকে কুরআন শরিফ আর আংটিটি দেখালাম। দেখেই তাঁর চেহারা বির্বণ হয়ে গেলো। বললেন— দরবারে দেখা করো। পরে রাজ দরবারে দেখা করতে গেলে তিনি বলে উঠলেন— তুমি বোধহয় দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছো? বলো, কী হয়েছে? আমি তাকে পুরো ঘটনা শোনালাম—কীভাবে সে ছয়দিন ইলম অর্জন করতো, সপ্তাহে একদিন মজুরি করতো, কারো কাছে হাত পাততো না আর মসজিদে থাকতো। শেষ পর্যন্ত ছেঁড়া চাটাইয়ে ইটের ওপর মাথা রেখে কালিমা পড়তে পড়তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। ঘটনা শুনে বাদশা হারুনুর রশিদের চোখে পানি এসে গেলো। তিনি প্রচ- আফসোস করে বললেন— ছেলে আমার অল্প বয়সে যা বুঝেছে আমি বুড়ো বাপও বুঝতে পারিনি। (খুতুবাতে ফকির, খ- ১১)

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

৪৩ টি পতিতালয়ের মালিকের লেখা কবিতা কেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত?

ফেসবুকীয় মতামত-:: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়বিরোধী রবী ঠাকুরের কবিতা কেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত? জাতি তা জানতে চায়…… ...