বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৫:৫৭
Home / খোলা জানালা / আলেম সমাজের বাংলা সাহিত্যচর্চা

আলেম সমাজের বাংলা সাহিত্যচর্চা

13227368_501124483414070_6415587202253255924_oআবদুস সাত্তার আইনী : বাঙালি আলেমসমাজ কবে থেকে সাহিত্যিক ধ্যান-ধারণা নিয়ে বাংলা ভাষাচর্চা শুরু করেছিল তার নির্দিষ্ট দিন-তারিখ নেই। তবে যত দূর জানা যায়, উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে আলেমসমাজ সংকীর্ণ পরিসরে হলেও বাংলা ভাষাচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং বাংলা ভাষায় লেখালেখি ও প্রকাশনায় আত্মনিয়োগ করে।

ইসলাম ধর্মকেন্দ্রিক প্রথম বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করেন মাওলানা কাজী আবদুল খালেক (রহ.)। সিপাহি বিপ্লবের মাত্র কুড়ি বছর পর ১৮৭৭ সালে তিনি ‘আখবারে মোহাম্মদী’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। সূচনালগ্নে আলেমসমাজের মাতৃভাষাচর্চার ক্ষেত্রে ‘আখবারে মোহাম্মদী’ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। তারপর এ ক্ষেত্রে আমরা দুজন আলেমকে অগ্রপথিক ও পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করতে পারি। তাঁদের প্রথমজন হলেন মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজুদ্দীন আহমদ এবং দ্বিতীয়জন হলেন মাওলানা মোহাম্মদ মুনীরুয্যামান ইসলামাবাদী। মুন্সী রিয়াজুদ্দীন শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। পরে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতায় গমন করেন এবং ‘মুসলমান’ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ‘সওদাগর’ নামের একটি বাণিজ্যিক পত্রিকার কার্যভার গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর তিনি ‘নবসুধাকর’ পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং বাঙালি মুসলিম সমাজের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরতে থাকেন।

মুন্সী রিয়াজুদ্দীন আহমদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৮৯ সালে কলকাতা থেকে ‘সুধাকর’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি একের পর এক সম্পাদনা করেন ‘ইসলাম প্রচার’ ও ‘সাপ্তাহিক সোলতান’। জীবনের শেষ পর্যায়েও দক্ষতার সঙ্গে তিনি সম্পাদনা করেন ‘নবযুগ’ ও ‘বয়াতবন্ধু’ পত্রিকা। এসব পত্রিকার বেশির ভাগ লেখকই ছিলেন আলেমসমাজের সদস্য। মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকতা ছাড়াও বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :

১. ‘পদ্য-প্রসূন’ (কবিতা),

২. ‘বোধোদয়তত্ত্ব’,

৩. ‘গ্রীস-তুরস্ক যুদ্ধ’,

৪. ‘আমির জনের ঘরকন্না’,

৫. ‘বিলাতী মুসলমান’,

৬. ‘মুসলমান সাহিত্যের ইতিহাস’,

৭. ‘আমার সংসারজীবন’,

৮. ‘হক নসিহত’,

৯. ‘হযরত মোহাম্মদ মোস্তফার জীবনচরিত’ এবং

১০. ‘কৃষকবন্ধুু’।

মুন্সী রিয়াজুদ্দীন আহমদের তীক্ষ পাণ্ডিত্য ও চিত্তাকর্ষক রচনাশৈলী সে সময় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি একবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বোধোদয়’ গ্রন্থের কয়েকটি ভুল নির্দেশ করে পত্র লিখলে বিদ্যাসাগর ওই গ্রন্থ সংশোধন করে মুন্সী রিয়াজুদ্দীনের পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আলেমসমাজের এই কীর্তিমান পথিকৃৎ সাহিত্যিক ১৯৩৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। =

মাওলানা মুনীরুয্যামান ইসলামাবাদীর জীবন কর্মবহুল, বর্ণাঢ্য; কখনো কখনো দুঃখময়। প্রকৃতপক্ষে যে কয়জন মনীষীর সাহিত্য-সাধনা ও কর্মোদ্যোগের মাধ্যমে উনিশ শতকের শেষার্ধে বাংলার মুসলিম নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল তিনি তাঁদের অন্যতম। তিনি নিজ প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এবং বাংলায় সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে বিভিন্ন বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও বিপ্লবী দল গঠনের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করে এবং পাঞ্জাবের লাহোরে অন্তরীণ করে রাখে। মুসলিম জাগরণের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ মাওলানা ইসলামাবাদীর কর্মজীবন ছিল ঘটনাবহুল ও বৈচিত্র্যময়। তিনি ছিলেন একাধারে রাজনীতিক, ইসলাম-প্রচারক, লেখক, সাংবাদিক, সমাজসেবক এবং একজন বিশিষ্ট বাগ্মী। ১৯০৩ সালে তিনি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সঙ্গে ‘সাপ্তাহিক সোলতান’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। কিছুদিন পত্রিকাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক বছর পর তিনি আবার পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। ১৯২৬ সালে ‘সোলতান’ দৈনিক পত্রিকারূপে আত্মপ্রকাশ করে। মাওলানা ইসলামাবাদী ১৯০৬ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন। ১৯১২ সালে তিনি ‘হাবলুল মতীন’ সম্পাদনা করেন। ১৯১৫ সালে ‘আল-ইসলাম’ পত্রিকা প্রকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৯ সালে তিনি ‘দৈনিক আমীর’ পত্রিকা প্রকাশ করেন।

মাওলানা মুনীরুয্যামান ইসলামাবাদী দীর্ঘজীবনের বিভিন্ন সময়ে ৪২টির মতো গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ১. ‘ভারতে মুসলমান সভ্যতা’, ২. ‘সমাজ-সংস্কার’, ৩. ‘ইসলাম জগতের অভ্যুত্থান’, ৪. ‘ভারতে ইসলাম প্রচার’, ৫. ‘কোরআন ও বিজ্ঞান’, ৬. ‘ভূগোলশাস্ত্রে মুসলমান’, ৭. ‘কোরআনে স্বাধীনতার বাণী’, ৮. ‘ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে মুসলমানদের অংশ’ (৩ খণ্ড) এবং ৯. ‘আত্মজীবনী’। ১৯৫০ সালের ২২ অক্টোবর এই মনীষী মৃত্যুবরণ করেন।

মওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন বহু প্রতিভার অধিকারী, স্বাধীনতার বীর সেনানী, আপসহীন রাজনীতিক, নির্ভীক সাংবাদিক, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সফল সম্পাদক। তিনি ১৮৬৯ সালের ৯ জুন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার হাকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষ করেই ১৯০১ সালে তিনি সাংবাদিকতায় যোগ দেন। ১৯১০ সালে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’র সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯১৪ সালে তিনি ‘আঞ্জুমানে উলামায়ে বাংলা’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘আল-ইসলাম’-এর যুগ্ম সম্পাদক ও প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২১ সালে তাঁর সম্পাদনায় ‘দৈনিক যমানা’ প্রকাশিত হয়। এটি ছিল উর্দু পত্রিকা। ১৯২১ সালেই ‘অগ্রসর’ নামের একটি প্রবন্ধ প্রকাশের কারণে আকরম খাঁ কারাগারে অন্তরীণ হন। মুক্তি পান ১৯২২ সালে। ১৯২৭ সালে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’কে আরো উন্নত ও রুচিশীল করে প্রকাশ করার জন্য এটিকে ‘মাসিক মোহাম্মদী’তে রূপ দেন। ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার প্রকাশনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর সাংবাদিকজীবনের অমর কীর্তি ‘দৈনিক আজাদ’-এর প্রকাশ ও সম্পাদনা। মওলানা আকরম খাঁর সাহিত্য-সাধনা মুসলিম বাংলার জাতীয় জাগরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। আরবি, ফারসি, উর্দু ও সংস্কৃত ভাষায় ব্যুত্পন্ন আকরম খাঁ রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজচিন্তামূলক গ্রন্থ রচনায় পারদর্শিতার পরিচয় দেন। ‘হযরত মুহাম্মদ সা. জীবনী’, ‘মোস্তফা চরিত’ এবং পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত ‘তাফসিরুল কোরআন’ বাংলা সাহিত্যে তাঁর অক্ষয় কীর্তি। এ দুটি ছাড়া তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো : ১. ‘সমস্যা ও সমাধান’, ২. ‘মোসলেম বাংলার সামাজিক ইতিহাস’, ৩. ‘মুক্তি ও ইসলাম’, ৪. ‘বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রীষ্টান ধর্ম’। ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম ধর্ম পালনে তিনি কোনো মাজহাবের অনুসারী ছিলেন না। ১৯৬৮ সালের ১৮ আগস্ট এই মনীষী মৃত্যুবরণ করেন।

মাওলানা আব্দুর রহীম ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও লেখক। লেখালেখির শৈলীতে এবং বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে মৃত্যুর পর এখনো তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ৪২ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্য-সাধনায় তিনি ৬০টিরও বেশি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো : ১. ‘হাদীস সংকলনের ইতিহাস’, ২. ‘হাদীস শরীফ’, ৩. ‘সুন্নত ও বিদয়াত’, ৪. ‘শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ৫. ‘ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার’, ৬. ‘খিলাফতে রাশেদা’, ৭. ‘নারী’, ৮. ‘ইসলামের অর্থনীতি’, ৯. ‘মহাসত্যের সন্ধানে’, ১০. ‘পরিবার ও পারিবারিক জীবন’। এ ছাড়া তিনি নিয়মিত লিখেছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। যেমন : দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেহাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, সাপ্তাহিক মীযান, সওগাত, সুন্নত আল-জামাত, নয়াজামানা, নাজাত, মাসিক মদীনা, মঞ্জিল, আল-ফুরকান, কোরআনুল হুদা ইত্যাদি।

মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী ও মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের তিন কিংবদন্তি। শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) মনে করতেন, মাতৃভাষায় ইসলামচর্চা ছাড়া ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণ সাধন করা সম্ভব নয়। তিনি বহু মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং উর্দু ও আরবি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন। নূর মোহাম্মদ আজমী কর্তৃক ‘মেশকাত শরীফ’-এর বাংলা অনুবাদ এবং তাঁর মৌলিক রচনা ‘হাদীসের তত্ত্ব ও ইতিহাস’ সর্বজনবিদিত ও গ্রহণযোগ্য।

বর্তমানে জীবন্ত কিংবদন্তিরূপে আমাদের সামনে রয়েছেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ ও মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ। বাংলা ভাষায় রাসুল (সা.)-এর জীবনী তথা সিরাতচর্চার ক্ষেত্রে মুহিউদ্দীন খান এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। তিনি ১৯৬১ সালে ‘মাসিক মদিনা’ প্রতিষ্ঠা করেন। পত্রিকাটির প্রকাশ আজও অব্যাহত আছে এবং বাংলা ভাষায় ইসলামচর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলছে। মুহিউদ্দীন খান এক শরও বেশি গ্রন্থের প্রণেতা ও অনুবাদক।

মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বাংলা সাহিত্যচর্চায় অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর অনেক রচনা পাঠে অনবদ্য সাহিত্যসুখ অনুভব করা যায়। মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে আলেমসমাজকে দেখিয়েছেন এক নতুন পথ। তাঁর অসংখ্য শিষ্য বাংলা সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেছেন।

আমরা মনে করি, বাঙালি আলেমসমাজের বাংলা ভাষাচর্চা, সাহিত্যচর্চা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তাঁদের অবদান ও উদ্যোগ ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক গবেষণা জরুরি। একই সঙ্গে সরকারের উচিত আলেমসমাজের সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন করা। তাঁদের প্রতিভার সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া। বিভিন্ন সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করার মতো অনেক মূল্যবান উপাদান তাঁদের গ্রন্থগুলোতে বিদ্যমান। (তথ্যসূত্র : ১. ইসলামী বিশ্বকোষ, বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ২. সেরা মুসলিম মনীষীদের জীবনকথা, নাসির হেলাল, প্রথম খণ্ড। ৩. প্রত্যয়ী কাফেলা : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০১৫ উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সাময়িকী, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক আল জান্নাত –

সৌজন্যে : দৈনিক কালের কণ্ঠ

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও পাবেন ৫% সুদের গৃহঋণ

কমাশিসা: সরকারি চাকরীজীবিদের মত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরও গৃহ নির্মাণে ৫ শতাংশ ...