হাফিয মাওলানা ফখরুযযামান : উপমহাদেশে দীনিশিক্ষা কার্যক্রম
আল্লামা মানাযির আহসান গীলানি রাহ.’র ‘নেযামে তালিম ও তারবিয়াত’ নামক গ্রন্থ পড়লে যা বুঝা যায়Ñ তা হল এই যে, ভারতবর্ষে মুসলিম সালতানাতকালে এখানকার দ্বীনি শিক্ষার বেশিরভাগ আমীর উমারা ও বড় বড় জমিদার ও বণিকদের ব্যক্তিগত খরচে নিজ নিজ বাড়িতে বন্দোবস্ত করা হত। এর জন্যে নিয়মতান্ত্রিক কোনো প্রতিষ্ঠান বা মাদরাসা ছিল না যেমন, তেমনি এর জন্যে বৎসরও নির্ধারিত ছিল না; বরং ছাত্র-শিক্ষকের দ্বারস্ত হলে তিনি তার মেধা অনুযায়ী পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করে পড়াতেন। এ পাঠ্যসূচি সময় সময় পরিবর্তন হত। কোনো বিষয়ের নতুন কোনো কিতাব লিখা হলে তা পূর্ববর্তী কিতাবাদির তুলনায় বিন্ন্যাস ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী হলে তা পূর্ববর্তী কোনো কিতাবের স্থলাভিষিক্ত হত। এতে কখনো কেউ কোনো ধরনের আপত্তি জানায়নি; বরং তা সাদরে গ্রহণ করত এবং এর প্রতি উৎসাহি হত। ফলে দেখা যায় ওই সময়ে ভারত উপমহাদেশে ইসলামি জ্ঞানসমূহের বিভিন্ন শাখায় অজস্র কিতাবাদি রচিত হয়। যা আজ পর্যন্ত কওমি মাদরাসাশিক্ষার সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। তেমনি মুসলিমবিশ্বেও তা সমভাবে সমাদৃত। এ সময়েই তো গড়ে ওঠেছিলেনكنزالعمال এর গ্রন্থকার। ফতওয়ায়ে قاضي خان এর রচয়িতাগণ। حجة الله البالغة এর লিখকসহভারতবর্ষের উল্লেখযোগ্য একঝাক উজ্জ্বল তারকা। দেখা যায় এ সময়ে রচিত কিতাবাদি যেমন ছিল আরবি ভাষায় তেমনি ছিল ফার্সি ভাষায়ও। কারণ সে সময়ের জাতীয় ভাষা হিসাবে ফার্সি ছিল স্বীকৃত।তাই তারা ধর্মীয় ভাষা আরবির পাশাপাশি সমভাবে আপন জাতীয় ভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন।ফলে সমাজের সর্বক্ষেত্রে ছিল তাদের অবাধ বিচরণ। তারাই ছিল সমাজের নিয়ন্ত্রক। তারাই ছিল রাজদণ্ড পরিবর্তনকারী। তারাই ছিল সমাজের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সম্প্রদায়। সবার কাছে বরণীয়,গ্রহণীয় ও অনুকরণীয়। কিন্তু আজ এ দিকটির প্রতি অমনোযোগী হওয়ায় আমরা লাঞ্চনার শিকার,বঞ্চনার বস্তু। আজ দ্বীন ও দ্বীনি শিক্ষিতরা উপেক্ষিত, অবহেলিত, নিগৃহিত। এর কারণ একটু পরে আলোচনা করছি।
১৮৫৭ সালে শামেলিতে সাময়িক পরাজয়ের পর উলামায়ে কেরাম সম্মুখ যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরোধিতা পরিহার করে ঈমান, আকিদা সংরক্ষণে ব্রতী হন। কওমি মাদরাসাশিক্ষা প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আল্লামা কাসিম নানুতবি রাহ.’র উক্তিটিই এখানে উল্লেখ করছি, “রাজত্ব তো গিয়েছে এখন মুসলমানদের ইমান ও আকিদা সংরক্ষণ করা হোক” আর এ দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই আমাদের পূর্বসূরীরা ভারতে দ্বীনি মাদ্রাসার জাল বিছিয়ে দিয়ে ব্রিটিশ রাজত্বের শিকড় কেটে দেওয়ার জন্যে মুজাহিদ তৈরির কাজে লেগে যান। সে প্রচেষ্টারই ফলশ্রুতিতে প্রায় একশ বছর পর ভারত স্বাধীন হয়।ব্রিটিশরা শুধু ধর্মবিমুখ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে ক্ষান্ত হয়নি; বরং তারা ধর্মের ছদ্মাবরণে তাদেরই আজ্ঞাবহ আরেকদল লোক তৈরির বন্দোবস্ত হিসাবে আলিয়া মাদরাসা নামে অন্য এক শিক্ষাধারা চালু করে। এর দ্বারা শিক্ষিতরা মূলত তাদেরই সহায়ক হিসাবে ভূমিকা রাখবে। তারা তাদের সেই মিশনে যে পূর্ণ সফল- তা কি অস্বীকার করা যাবে? আর এদেরকেই তারা উলামায়ে হক্কানির বিকল্প হিসাবে দাঁড় করায়। সে লক্ষে তারা তাদেরই তত্ত্ববধানে প্রতিষ্ঠা করে কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা। যা আলিয়া মাদরাসাসমূহের মধ্যে প্রথম।
১৮৬৬ সালে দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর কিছুদিন পর মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর। এরও পরে নদওয়াতুল উলামা লক্ষ্মৌ। এসব মাদরাসা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্তরা তখনকার সময়ে বিশ্বব্যাপী দ্বীনের বহুমুখী খিদমাত আঞ্জাম দেন। তাঁরা যেমন ছিলেন ইলম ও আমলের ময়দানে অগ্র সৈনিক। তেমনি লিখনির জগতে ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। সমভাবে তাঁরা রাজনীতি, সমরনীতি ও বক্তৃতার ক্ষেত্রে বীর সেনানী। সেই বিরল প্রতিভাদের মাধ্যমেই লিখা হয় معارف القرآن، بيان القرآن، تفسير مظهري،إعلاء السنن، معارف الحديث، معارف السنن، فيـض الباري، أوجزالمسالك. ইত্যাদি তাফসির-হাদিসসহ বিভিন্ন বিষয়ের গ্রন্থাবলি। এদেরই কর্ম দেখে মিশরের অধিবাসী মুসলিম বিশ্বের গ্রহণীয় আলিম আল্লামা রশিদ রেযা বলেছিলেন, “আমাদের ভারতীয় মুসলিম ভাইরা ইলমে হাদিসের খিদমাতে এগিয়ে না হলে হয়তো ইলমে হাদিস তার মূল শিক্ষা হারিয়ে ফেলত”।
তাই বলে কি ওইসব মনীষীরা যেসব পাঠ্যবই পড়ে উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিলেন, তারা কি এগুলোকে অপরিবর্তনীয় মনে করতেন। তারা কি এগুলোতে কোন ধরনের সংযোজন-বিয়োজনের বিপক্ষে ছিলেন। না কখনো নয়; বরং দেখা যায় তারা নিজেরাই এসব পাঠ্যবই এর অনেকগুলোকে বাদ দিয়ে নতুন নতুন গ্রন্থাদি সিলেবাসের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। যা দারুল উলুম দেওবন্দ, মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর, নদওয়াতুল উলামা লক্ষেèৗসহ ভারত ও পাকিস্তানের প্রায় সব বোর্ড ও প্রতিষ্ঠানে তা অব্যাহত রয়েছে। ফলে তারা আপন আপন দেশে সম্মানজনক অবস্থানসহ দ্বীনের বহুমুখী খিদমাত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা এ থেকে ব্যতিক্রম কেন?
প্রাথমিককালে দরসে নেযামিতে কি কি বই ছিল তা খতিয়ে দেখলেই পরিবর্তনের ফিরিস্তি আমাদের চোখে ভেসে উঠবে। আর প্রাথমিককালে দরসে নেযামিতে কি কি বই অন্তর্ভুক্ত ছিল তা “তারীখে দরসে নিযামি” নামক উর্দূ ভাষায় রচিত গ্রন্থের ২৬ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে। তা একটু দেখে নেয়ার স্বনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই। আর বর্তমানে কওমি মাদরাসাসমূহে প্রচলিত নেসাবে যেসব কিতাবাদি রয়েছে,সেগুলোর সাথে মূল দারসে নেযামিকে মিলালেই পরিবর্তনের বিষয়টা সকলের কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে। তখন কিন্তু বর্তমান নেসাবকে দরসে নেযামি বলতে চাইবেন না। এরপরও বলি, এ পরিবর্তনেরধারা কচ্ছপগতি। তা আরো গতিময় হলে আমরা বর্তমানে আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য থেকে দূরে বহু দূরে অবস্থান করতাম না। আর বেশি দূরে যেতে চাইনা। যে দেওবন্দের নামে আমরা পাগল পারা, যার নাম শুনলে আমাদের বুক গর্বে ফুলে ওঠে, যেখানে যেতে আমরা উদগ্রীব, আমরা গর্ব ভরে স্ব স্ব পাঠে যার আলোচনা করি। সে দেওবন্দের নেসাবে এক যুগের ভিতর কি কি পরিবর্তন এসেছে তা কি আমাদের জানা? সেই অজানাকে জেনে কি আমরা ভবিষ্যৎ চলার পাথেয় গ্রহণ করব না? না এখনো সেই কত কালের পুরাতন, বর্তমান যুগচহিদার দাবি পূরণে অক্ষম কিতাবাদিকে আঁকড়িয়ে ধরে থাকাকেই চরম ও পরম সাফল্য ও সফলতা মনে করব?
দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য
যে জাতি আপন ঊষাকালে اقرأ (পড়ো) ও علم بالقلم দ্বারা সম্বোধিত। সে জাতির জন্যে ১৪০০ শতাব্দী পরে দেওবন্দের মতো পাড়া গাঁয়ে একটি প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র লেখা-পড়ার লক্ষ্যে খোলার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই; বরং দেওবন্দ যে পড়া-পড়ানো ছাড়া মুসলিম জাতিসত্তার এক বৃহৎ ও মহান পরিকল্পনা নিয়ে শুভ যাত্রা করেছিল তা আমরা শায়খুল হিন্দের জবানিতেই শুনি। যিনি ছিলেন দেওবন্দের প্রথম সূর্যসন্তান, যার পৃষ্ঠপোষকতায়ই দেওবন্দ এক মহা মহীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। যার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দেওবন্দকে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর যোগ্য করেছিল। যার আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে দেওবন্দ মুসলিমবিশ্বের আন্তর্জাতিক বিদ্যাপীঠের মর্যাদা লাভে সক্ষম হয়। তিনি বলেন; “হযরতুল উস্তাদ (হযরত কাসিম নানুতবি) এ মাদরাসা (দেওবন্দ)-কে কি শুধু দারস-তাদরিস,তালিম-তা’আল্লুমের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? মাদরাসা আমার সামনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমি যতটুকু জানি ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে পরাজয়ের পর এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এর উদ্দেশ্য এমন একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যার তত্ত্বাবধানে এমন একদল লোক তৈরি করা, যাদের দ্বারা ৫৭ এর অপূরণীয় ক্ষতি কিছুটা হলেও লাঘব করা যাবে।
আমি ওই সব লোকদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না যারা দারস-তাদরিসকে একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে স্থির করে নিয়েছে। তবে আমি সেই পথই নির্বাচন করেছি যার জন্যে উস্তাদজি দারুল উলুম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্থাৎ বহুমুখী প্রতিভা সৃষ্টি।
সেই প্রতিভার চাহিদা কি সব সময় এক থাকে? না সময়ের পরিবর্তনে চাহিদার পরিবর্তন হয়? আর পরিবর্তিত চাহিদা কি পূর্বতন সিলেবাস দ্বারা সৃষ্টি করা সম্ভব? দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে “দারসে নেযামি” আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেভাবে পূর্ণজন্ম লাভ করেছিল। তেমনি বর্তমান কওমি মাদরাসার সিলেবাসে যুগ চাহিদা ও বর্তমান প্রজন্মের মন-মানসিকতার প্রতি লক্ষ্য রেখে, পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতির দিকে নজর দিয়ে, ইসলাম ও মুসলমানদের ভবিষ্যৎ পানে তাকিয়ে, ইসলামকেবিশ্বদরবারে উপস্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে, বিজ্ঞান ও কম্পিউটারভিত্তিক বিশ্বকে নিজেদের আয়ত্বে আনার মানসে- বিস্তর সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন রয়েছে কি না? তা ভেবে দেখার সকরুণ আকুতি রইল।