মঙ্গলবার, ১৬ই এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১১:২৮
Home / শিক্ষা-গবেষণা / ইসলামে শিক্ষার সৌন্দর্য

ইসলামে শিক্ষার সৌন্দর্য

bookঅধ্যাপক ড. হাফেজ এ বি এম হিজবুল্লাহ : ইসলাম একটি জীবন বিধান। শিক্ষা জাতীয় উন্নয়নের সোপান। শিক্ষা ইসলামের অন্যতম মূল ভিত্তি। শিক্ষা ছাড়া ভালো মানুষ হওয়া যায় না। শিক্ষা ছাড়া ভালো মুসলমান বা ইনসানে কামিল হওয়া যায় না। শিক্ষা ছাড়া পূর্ণাঙ্গ ঈমানদার বান্দা হওয়া যায় না। আর তাই দেখা যায় ইসলামের প্রথম বার্তা ছিল, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাদের সৃষ্টি করছেন।’ (আলাক : ১)

রাব্বুল আলামিনের এ বার্তা থেকেই বোঝা যায়, মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে শিক্ষার গুরুত্ব। কোরআন কারিমে রয়েছে শিক্ষা সংক্রান্ত প্রচুর আয়াত। কোরআনেই বলা হয়েছে, ‘জিজ্ঞেস করুন, যারা জানে (আলিম ও জ্ঞানী) আর যারা জানে না (জাহিল ও মূর্খ) তারা উভয় কি সমান হতে পারে?’ (যুমার: ৯)। কোরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্য থেকে একমাত্র আলিমরাই আল্লাহকে ভয়মিশ্রিত সম্মান করে।’ (ফাতির : ২৮)। আলিমদের মর্যাদা সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের ইলম (জ্ঞান) দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের সুউচ্চ সম্মাননায় ভূষিত করবেন।’ (মুজাদালা : ১১)

ইলম বা জ্ঞান সম্পর্কে রয়েছে প্রচুর হাদিস। ইলম (জ্ঞান) ও আলিম (জ্ঞানী) সম্পর্কে রয়েছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রচুর বাণী। তিনিই বলেছেন, ‘প্রতিটি মুসলিমের (নর ও নারী) জন্য ইলম (শিক্ষা) অর্জন করা ফরজ।’ (ইবন মাজাহ)

এছাড়া যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে শিক্ষা অর্জন করে, তাদের জন্য রয়েছে অনেক অনেক সম্মান। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষায়, তাদের ‘নবীদের ওয়ারিস’ (উত্তরাধিকারী) বলা হয়েছে। (ইবন মাজাহ)

এখন প্রশ্ন হলো, যে কোনো শিক্ষাই কি এর অন্তর্ভুক্ত বা কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত শিক্ষা বলতে কোন শিক্ষাকে বোঝানো হয়েছে? এ প্রশ্ন অবতারণার কারণ হলো, বর্তমানে বিশ্বজুড়েই শিক্ষা নিয়ে চলছে একরকম স্নায়ুতর্ক। শিক্ষাকে দু’ধারায় বিভক্ত করা হয়েছে—এক, ধর্মীয় শিক্ষা; দুই, জাগতিক বা আধুনিক শিক্ষা। আধুনিক শিক্ষার আওতাধীন সব শিক্ষা এর অন্তর্ভুক্ত। এ শিক্ষা কার্যক্রমকে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত রাখা হয়েছে। অন্য ভাষায় এ শিক্ষা কার্যক্রমকে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা কার্যক্রম বলা হয়—যাতে ধর্মীয় কোনো বিষয়ই থাকবে না। তাই এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় শিক্ষিতজনরা ধর্মীয় শিক্ষাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। তাদের হাতে রয়েছে কোরআন-হাদিসের প্রচুর প্রমাণ। আধুনিক শিক্ষিতজনরাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, যদি তা হয় শিক্ষার মূল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই বলা যায়, কোরআন ও হাদিসে শিক্ষা সম্পর্কিত যে সম্মান ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে, নিঃসন্দেহে তারা হবেন তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতভিত্তিক শিক্ষায় জ্ঞানী। তারা সরাসরি কোরআন-হাদিসের বক্তব্য ও দাবি বাস্তবায়নে নিরলস প্রচেষ্টা চালান। তারা গবেষণা করেন কীভাবে মুসলমানরা তাদের জীবন কোরআন-হাদিস তথা শরিয়ত মোতাবেক চালাবে। তাই বলে যারা অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা অর্জন করেন, তারা বঞ্চিত হবেন—এমনটি বলা যাবে না। তারাও এর অংশীদার হতে পারেন, যদি তাদের শিক্ষা হয় ইসলামের মূল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত; ঈমানি চেতনায় জাগ্রত। কারণ সব মানুষ আলিম, হাফিজ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকিহ এবং মুফতি হবেন না। জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়েও মুসলমানদের হতে হবে বিশেষজ্ঞ। যেমন তাদের মধ্যে থাকবেন বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, প্রশাসক ইত্যাদি। এরা হবেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের একে অপরের পরিপূরক। যিনি যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, অন্যরা সে বিষয়ে তার শরণাপন্ন হবেন। তার পরমার্শ নেবেন।

বর্তমানে আমাদের সমাজে সমস্যা হলো, যারা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত, তারা আধুনিক শিক্ষায় পারদর্শী নন। অপরদিকে যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, তারা ধর্মীয় জ্ঞান সম্পর্কে অবগত থাকেন। এখানেই বাধে যত গোল। আর এখান থেকেই সৃষ্টি হয় উভয়ের মাঝে দূরত্ব। একে অপরকে আমলে নেন না, গুরুত্ব দিতে চান না। আধুনিক শিক্ষিতজনরা নিজেরাই নিজেদের মতো করে ধর্মকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে চান। এজন্য তাঁরা নিজেদের অধ্যয়ন বা গবেষণাকে যথেষ্ট মনে করেন। যদিও কোরআন-হাদিসের গভীরে যাওয়ার মতো জ্ঞান তাদের থাকে না। অপরদিকে ধর্মীয় শিক্ষাবিদরা আধুনিক শিক্ষা সম্পর্কে খুব কমই জানেন, বিধায় তাদের পক্ষে জীবনঘনিষ্ঠ অনেক বিষয়ের সমাধান দেয়া সম্ভব হয় না। তাই এখানে যদি একে অপরের পরিপূরক হিসাবে মেনে নেয়া হয়, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজেই নিষ্পত্তি করা সম্ভব। এজন্য আধুনিক শিক্ষাকে ইসলামী মূল ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হলে তাদের ঈমান সুদৃঢ় হওয়ার পাশাপাশি তারাও ইসলামের আলোকে অনেক বিষয়ের সহজ সমাধান দিতে পারবেন। আর এটা কোনো কঠিন বিষয়ও নয়।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে দেখা যায়, শিক্ষার মূল ভিত্তি হতে হবে তাওহিদ। অর্থাত্ শিক্ষার উত্স যিনি, তাঁর একত্ববাদই হবে শিক্ষার মূল ভিত্তি। কারণ আল্লাহ পাক পড়তে বলেছেন, খালিক অর্থাত্ স্রষ্টার নামে। তাওহিদি শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে থাকবে রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাস। আর তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, প্রতিটি শিক্ষা—ধর্মীয় শিক্ষাই হোক বা আধুনিক শিক্ষা—এর মূল ভিত্তি হতে হবে তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত। তাওহিদি শিক্ষা মানুষকে সত্, নীতিবান, নেক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে—যাতে থাকে ভালো মানুষের প্রতিটি উপাদান। তাই প্রতিটি বিষয়কে ইসলামের মূল উত্স কোরআন ও হাদিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা গেলে গোটা দেশ ও জাতি, এমনকি বিশ্ব উপকৃত হবে। কারণ কোরআনে সব বিষয়ের মূল দিক নির্দেশনা রয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে সেগুলো উন্মোচিত করা প্রয়োজন। বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, কোরআনের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই; বরং কোরআনে বিজ্ঞানের প্রচুর উপাদান রয়েছে, যা আজ স্বীকৃত। চিকিত্সা বিজ্ঞানেও দেখা যায় একই চিত্র। অর্থনীতি, সমাজনীতি, লোকপ্রশাসন, ভাষা-সাহিত্যসহ প্রচলিত সব বিষয়ে দিকনির্দেশনা রয়েছে কোরআন ও হাদিসে। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন কোরআন কারিমে ইরশাদ করেছেন, ‘আমি মুসলমানদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ, হিদায়াত (দিকনির্দেশনা), রহমত ও সুসংবাদ হিসেবে আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছি।’ (নাহল : ৮৯)

পশ্চিমা শিক্ষাবিদরা কোরআন থেকেই গবেষণার অনেক উপাদান গ্রহণ করেছেন এবং সেগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে অনেক এগিয়ে গেছেন। আমরা শিক্ষার উত্স সন্ধান করলেও এর বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হব। পাশাপাশি এ-ও প্রমাণিত হবে, ইসলাম ও শিক্ষার পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীরে। বিশেষ করে ইসলামের মূল কথা হলো সব মুসলিমকে অবশ্যই কমবেশি শিক্ষিত হতে হবে। কারণ শিক্ষাবিহীন ইসলাম মানুষকে কুসংস্কারের দিকে ধাবিত করে। আর ইসলামবিহীন শিক্ষা মানুষকে পরিণত করে প্রাণহীন মানুষে। এর মাধ্যমে মানুষ হয়ে পড়ে স্বস্বার্থ নির্ভর। জাগতিক উত্কর্ষ সাধনে তারা বৈধ-অবৈধের তোয়াক্কা করে না। নীতি-নৈতিকতা ভুলে শুধু ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়। তাই শিক্ষার উত্স সন্ধান করলে আমরা একটা মহাসত্য আবিষ্কারে সক্ষম হব। আর তা হলো শিক্ষার উত্স হলেন স্বয়ং স্রষ্টা মহাজ্ঞানী আল্লাহ। আর তাই আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক জ্ঞানীর ওপর আছেন এক মহাজ্ঞানী।’ (ইউসুফ : ২৬)

তিনি জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য তাঁর কাছে দোয়া করতে বলছেন এভাবে, ‘হে আমার পরওয়ারদিগার! আমাকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ কর।’ (ত্বাহা : ১১৬)

বান্দার জ্ঞান হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষমতা একমাত্র রয়েছে তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। শিক্ষার মহান শিক্ষক তিনিই। হজরত আদমকে তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আর তিনি (আল্লাহ) আদমকে শিক্ষা দিয়েছেন যাবতীয় সব নাম’ (বাকারাহ : ৩১)

তিনি মানবজাতিকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং শিক্ষা দিয়েছে বর্ণনাশৈলী। তিনি ইরশাদ করেন, ‘দয়াময় (আল্লাহ), তিনিই শিখিয়েছেন কোরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে (মানুষ) বর্ণনাশৈলী শিখিয়েছেন। (আর-রাহমান : ১-৪)

আয়াতগুলো থেকে এটা সুস্পষ্ট, সব শিক্ষার একমাত্র তিনিই শিক্ষক। মহাবিশ্বের মহাজ্ঞানী একমাত্র খালিক আল্লাহ। মাখলুক মানুষের পক্ষে সব জ্ঞান আয়ত্ত করা কখনোই সম্ভব নয়। কোনো একটি বিষয়ে হয়তো পাণ্ডিত্ব অর্জন করা যেতে পারে। কিন্তু সে একই বিষয়ের যাবতীয় জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। এ জন্যই প্রস্তাবনা হলো—সব শিক্ষাকে ইসলামী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। তা হলেই কেবল ভালো মানুষ গড়ার মাধ্যমে ভালো সমাজ গড়া সম্ভব হবে। আল্লাহ আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার তাওফিক দান করুন।

সৌজন্যে : আমার দেশ অনলাইন

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

সম্মিলিত বোর্ডের দাওরায়ে হাদীসের পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ

কমাশিসা ডেস্ক:: কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি ঘোষিত হওয়ার পর দ্বিতীয বারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ...