শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১২:৫৩
Home / কওমি অঙ্গন / কওমি মাদরাসা : সমাজবান্ধব শিক্ষার দরিদ্রবান্ধব চিত্রায়ন

কওমি মাদরাসা : সমাজবান্ধব শিক্ষার দরিদ্রবান্ধব চিত্রায়ন

madrasahরোকন রাইয়ান : মিরপুর মাদরাসা দারুর রাশাদের সাবেক ছাত্র আল আমিন। বাবা প্রাইমারি স্কুল টিচার। ভালো ব্যবসাও আছে। তাকে এলাকার স্কুল পড়–য়া এক চাচাত ভাই বলেছিল, মাদরাসায় কেন পড়িস! এখানে তো পড়ে গরিবরা। আল আমিন সেদিন তার কথার কোনো জবাব দেয়নি। লজ্জায় লাল হয়েছে। একদিন দুইজনেরই পড়ালেখা শেষ হয়। আল আমিন এক মাদরাসায় চাকরি নেন। বেশ সুনামের সঙ্গেই শিক্ষকতা করেন। টাকা পাঠান বাড়িতে। কিন্তু সেই চাচাত ভাই অনার্স মাস্টার্স শেষ করে বাড়িতে বসা। অনেক জায়গায় বায়োডাটা নিয়ে ঘোরাঘুরিও করেছেন। চাকরি হয়নি। শেষে এলাকার এক বেসরকারি স্কুলে চাকরি ঠিক হয়। তবে সেখানে ঘুষ দিতে হবে পাঁচ লাখ টাকা। সে জন্য ফসলি জমি বেচেন তার বাবা।

সেই ঘটনা দেখে আল আমিনের মুখ লাল হয়নি। মুচকি হেসে চাচাতো ভাইকে বলেছেন- মাদরাসায় তো গরিবরা পড়ে, পড়া শেষে মাদরাসা তাকে ধনী বানায়। কিন্তু স্কুল তো তোদের গরিব বানাল। আল আমিন বলেন, মাদরাসায় গরিবরাই পড়ে এটা উড়ো কথার মতোই। একটা প্রতিষ্ঠানকে ধনী-গরিবে চিহ্নিত করা বেমানান।

বিষয়টিকে এভাবেই দেখলেন রাজধানীর জামিয়া ইকরার ২০১০ সালের দাওরা সমাপনকারী মাওলানা মুহাম্মদ আনুপ। তার মতামত হলো কোনো একটা প্রতিষ্ঠানকে ধনী-গরিবে চিহ্নিত করা বোকামি। এখানে সব ধরনের লোকই আসবে। শিক্ষা নেবে। তিনি তার উদাহরণ টেনে বলেন, আমার বাবা ঢাকার কেরাণীগঞ্জে আটটি ব্রিকফিল্ড-এর মালিক, একটি রিয়েল অ্যাস্টেট কোম্পানিও রয়েছে। ঢাকায় বাড়ি এবং গাড়িও রয়েছে। কিন্তু আমাকে তিনি কওমিতে পড়িয়েছেন। এর জন্য কারো তশকিলেরও দরকার হয়নি।

দেশে তিন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার একটি কওমি মাদরাসা। সাম্প্রতিককালে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগের স্রোত উঠেছে। বড় অভিযোগ এ শিক্ষা ব্যবস্থা দরিদ্রবান্ধব। এখানে কেবল এতিম আর গরিবরাই আসে। দান খয়রাতে নির্ভরশীল থাকে মাদরাসাগুলো। এর আগে সরকারি বা জরিপ সংস্থাগুলোর কোনো ধরনের পদক্ষেপ না থাকায় বিষয়টি এভাবেই নিয়েছে সাধারণ মানুষ। তবে লিখনীর পক্ষ থেকে একটি জরিপ করলে বেড়িয়ে আসে বড় ধরনের পার্থক্য। বেড়িয়ে আসে অবাক করা তথ্যও। জানা যায়, এক সময় ছোট পরিসরে মাদরাসাগুলো প্রতিষ্ঠিত হলেও বছর দশেক পর থেকেই এটি সমাজের সব শ্রেণীর মধ্যে বিস্তৃত হতে থাকে। বর্তমানে মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে ধনিক শ্রেণীর সংশ্লিষ্টতা বাড়ছেই না বাড়ছে অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাদরাসার সংখ্যাও। সমাজের নিন্মশ্রেণীর পাশাপাশি এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এলিট শ্রেণী। আর এর প্রধান কারণ মাদরাসাছাত্রদের নীতি আদর্শ ও নৈতিকতা।

বেফাকুল মাদারিস ও শিক্ষা জরিপ সংস্থা বেনবেইস-এর তথ্যমতে বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার ছাত্র সংখ্যা ১৪ থেকে ২০ লক্ষাধিক। নুরানি, হিফজখানা মিলিয়ে মাদরাসার সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ হাজার। বিপুল সংখ্যক এই মাদরাসার ভেতর থেকে এতিম-গরিব চিহ্নিত করা দুষ্কর। তবে রাজধানীসহ আশপাশের প্রায় ৫০টি মাদরাসার জরিপে দেখা যায় ৮০ পার্সেন্ট ছাত্র আসছে উচ্চ ফ্যামিলি থেকে। উল্লেখিত মাদরাসাগুলোতে এতিমের সংখ্যা ১০ পার্সেন্ট। জরিপকৃত মাদরাসাগুলোর অধিকাংশ শিক্ষকই জানিয়েছেন, কওমি মাদরাসায় ফ্রি খাওয়ার একটা ব্যবস্থা রয়েছে। এটা তারা সমাজের দায়বদ্ধতা থেকেই করে থাকেন। কেননা এসব মাদরাসায় বিশাল একটা শ্রেণী ডোনেশন করে থাকে। তাদের ডোনেশন সঠিক খাতে ব্যয়ের জন্যই এই ব্যবস্থা।
অধিকাংশ মাদরাসাতেই ছাত্রদের ফ্রি খাবার নির্ধারণ করা হয় মেধার ভিত্তিতে। গড় নাম্বার আশির উপরে থাকলে ফ্রি খাবারের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু এদের মধ্যেও অনেকেই টাকা দিয়ে খায় বলে জানা গেছে। তবে দেশের প্রায় সব মাদরাসাতেই সকালের নাস্তা ও আবাসিক চার্জ দিয়ে থাকতে হয়।

রাজধানীর বৃহৎ মাদরাসা জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ মুহাম্মদপুরের দাওরায়ে হাদিসের ছাত্র মাওলানা ওমর শাহ জানান, জামিয়া রাহমানিয়ায় ১২০০ ছাত্র রয়েছে। এদের মধ্যে বোর্ডিং থেকে খাবার ক্রয় করে খায় ৭৩২ জন শিক্ষার্থী। বিশেষ ব্যবস্থায় ফ্রি খাবার পায় ৪৪২ জন। বাকিরা হোটেল বা অন্যান্য বাসাবাড়ি থেকে ক্রয় করে খান।

জরিপে অংশ নেয়া ছাত্ররা আরও জানিয়েছেন, ইদানীং গরিব পরিবারগুলোর মধ্যে এই কথা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কওমি মাদরাসায় পড়লে চাকরি পাওয়া যায় না। সে কারণে দেখা যায় ওই পরিবারগুলোর চাহিদা থাকে অন্যদিকে। আর উচ্চ শ্রেণির কর্তারা ঝুঁকছেন মাদরাসাগুলোর দিকে। যারা অধিকাংশই সরকারি চাকুরে বা বড় ব্যবসায়ী।

এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ‘ইত্তেফাকুল উলামা বৃহত্তর মোমেনশাহী’র শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা লাবীব আবদুল্লাহ বলেন, মানুষ যাই করুক দিন শেষে একটা আত্মতৃপ্তি খোঁজে, এ জন্যই মাদরাসায় আসে। আর যারা একে গরিববান্ধব বলেন তাদের বলব, আমাদের রাষ্ট্রই তো বিদেশি ঋণের ওপর চলে। এখানকার প্রতিটি মানুষ বেড়ে উঠে ঋণ আর ধার করা টাকায়। একটা প্রতিষ্ঠানের বেলায় এমন প্রশ অনুচিৎ। ইদানীং কওমি মাদরাসায় যারা পড়েন তাদের অনেকের আসবাব ও চলাফেরার স্টাইল অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো।
জরিপে আরও জানা যায়, ইদানীং দেশের সব জেলাতেই উন্নত কাঠামো ও অত্যাধুনিক কারিকুলামে তৈরি হচ্ছে অনেক মাদরাসা। যেসবে উন্নত খাবার ও আবাসন সুবিধাসহ যোগ হচ্ছে নানান সুবিধা। এসব মাদরাসায় ফ্রি থাকা-খাওয়ার কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। খাবার ও আবাসিক চার্জ পড়ে ৩ থেকে ৪ হাজারের মতো। এছাড়াও সারা দেশে অবস্থিত মহিলা মাদরাসাগুলোতে কোনো প্রকার ফ্রি খাবারের সুযোগ নেই। আশ্চর্য হলেও সত্য এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে দিনদিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। এমনি একটি মাদরাসা রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত। নাম ‘মাদরাসাহ কুরআনিল কারিম’। এর প্রিন্সিপাল মাওলানা আতিকুল্লাহ জানান, আমার মাদরাসায় প্রায় ২০০ জন ছাত্র রয়েছে। মাদরাসার বয়স চার বছর। এখানে সব ছাত্রই আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা চার্জ দিয়ে থাকছে। তিনি তৃপ্তি প্রকাশ করে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ ভালো রেজাল্টের কারণে এখানে ছাত্র সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

কওমিকে যারা দরিদ্রবান্ধব বলে অপপ্রচার করেন তাদের জন্য চমৎকার জবাব রয়েছে মাদরাসার ইতিহাসে। কেবল এটাই নয় কওমি ছাত্রদের মধ্যে থেকে উঠে আসা ব্যক্তিরা সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদে রয়েছেন এবং সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন এমন লোকের সংখ্যাও হাতেগোনা নয়। জানা যায়, কওমি মাদরাসা থেকে ইতোপূর্বে মাওলানা উবায়দুল হক জালালাবাদি, মাওলানা আতাউর রহমান খান, মাওলানা রুহুল আমিন মাদানী, মুফতি ফজলুল হক আমিনী, মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, মুফতি শহিদুল ইসলাম, মাওলানা শাহীনুর পাশা প্রমুখের মতো অনেক আলেম সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং এলাকা ও সমাজ উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। রাজনীতির ময়দানেও আলেমরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন এবং তাদের ডাকে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশের নজিরও রয়েছে। মাদরাসা ছাত্ররা এসব স্মরণ করে বলেন, প্রশাসনের বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে সামান্য সহানুভূতি পেলে এমন অনেক আলেম রাষ্ট্রের উঁচু পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা রাখেন।

কওমি মাদরাসার আলেম বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের চেয়ারম্যান মুফতি গোলাম রব্বানী এ বিষয়ে বলেন, আসলে কওমি মাদরাসাকে যারা দরিদ্রবান্ধব বলেন আর অবহেলার দৃষ্টিতে দেখেন তাদের জানার পরিধি কম। এটা অনস্বীকার্য যে একটা শিক্ষায় সব ধরনের ছেলেরাই আসে। সেখানে গরিব আর মেধাহীন শিক্ষার্থীও থাকে। এটা স্কুল কলেজেও অহরহ আছে। এর জন্য কওমিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আর সমাজের মূল জায়গাগুলোয় তারা আসতে পারছেন না এর কারণ এদেরকে কোনঠাসা করে রাখার প্রবণতা। সরকার কওমি সনদের স্বীকৃতি দিচ্ছে না। ফলে এরা বড় কাজে আসার সুযোগ কম পাচ্ছে। তবে অনেক ছেলেই কিন্তু বিকল্প উপায়ে এসব জায়গায় আসছে। যেমন আমার কথাই ধরি, কওমি শেষ করে আলিয়া থেকে আলিম পড়ে ঢাবিতে যখন ১১০০ নাম্বারের পরীক্ষা দিলাম তখন আমার কেবল ইতিহাস বিষয়টা বাড়তি পড়তে হয়েছিল। এছাড়া অন্য সাবজেক্টগুলো পড়তে হয়নি। তার মানে এর চাহিদাগুলো কওমিতেই পূরণ হয়ে গেছে। সুতরাং এখানে কেবল কিছুই হচ্ছে না, হবে না এসব গৎবাঁধা শব্দে কওমি আটকিয়ে লাভ নেই। তাদেরকে সুযোগ করে দেয়া উচিত। তাহলে এরা রাষ্ট্রেরই সম্পদে পরিণত হবে।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে জরুরী কিছু কথা!

কমাশিসা ডেস্ক: শুক্রবার ২৫সেপ্টেম্বার ২০২০. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনি যখন কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির ...