এহতেশামুল হক ক্বাসিমী::
দারসে নেযামীর প্রতিটা ক্লাসের শুরু থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে অধ্যয়ন করে যারা তাকমীল ফিল হাদীস সমাপন করেন, তাদেরকে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিভাষায় ফাযিল বা ফারিগ বলা হয়। তাদেরকে ‘মাওলানা’ উপাধিতেও ভূষিত করা হয়। আর যারা দারসে নেযামীর পাঠ মাঝপথে গিয়ে চুকিয়ে ফেলেন, শেষতক পৌছুতে পারেন না, তাদেরকে মৌলভী বা মুনশী বলা হয়।
যারা দারসে নেযামীর পাঠ মিনালবিদায়া ইলান্নেহায়া সমাপ্ত করেন, বয়েস চল্লিশ হওয়া পর্যন্ত তারা ‘নবীন আলেম’ র অন্তর্ভুক্ত থাকেন।
যারা নবীন আলেম তাদের করণীয় ও বর্জনীয় কী হতে পারে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী হওয়া চাই ? তাদের ব্যাপারে আকাবির ও আসলাফের মন্তব্য ও পরামর্শ, চিন্তা ও দর্শন কী ? সে বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করাই লিখনীর মূল প্রতিপাদ্য।
প্রথমেই বলি, যারা নতুন ফারিগ হন, স্বভাবগতভাবেই তাদের এক নবজীবন শুরু হয়। এই নবজীবনের সূচনা অনেক কঠিন। এই সূচনায় অনেককেই দেখা যায় নানাবিধ টেনশনে ভোগেন। শিক্ষা সমাপন শেষে কে কী করবেন, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগতে থাকেন। কাউকে তো চরম হীনমন্যতায় পেয়ে বসে। কেউ কেউ কর্মসংস্থানের খোঁজে নাকাল হয়ে পড়েন। কেউ তো বা নিজের জীবনকে অসার বেকার অথর্ব ভাবেন। ফলে তালীমি যিন্দেগীর আমলিয়্যাত বিসর্জন দিয়ে পুরোধমে দুনিয়াদার হয়ে বসেন। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক!
নবীন আলেমদের এমন হলে চলবে না। সর্বদা হিম্মত ও ধর্য্যের পারাকাস্টা প্রদর্শন করতে হবে। পর্বতসম হিম্মত ও সমুদ্রসম ধর্য্য না থাকলে সফলতার এভারেস্ট জয় করা যায় না। সুতরাং নো টেনশন! শুধু একটু সচেতনতার প্রয়োজন।
একাডেমিক শিক্ষাজীবন শেষে আমাদেরকে প্রথমেই ভাবতে হবে কী পেলাম আর কী হারালাম। প্রাপ্তি ও ঘাটতির একটা প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। প্রাপ্তির জাম্বিল অপূর্ণ থাকলে আগে তাকে পূরণ করতে হবে মনোযোগে অধ্যবসায়ের সাথে। তারপর কর্মজীবনে পদার্পণ করলে অবশ্যই সফল হবেন। ইনশাআল্লাহ।
উদাহরণস্বরূপ বলি, নবীন আলেমদের কারো যদি নাহু-সারফ তথা আরবী ব্যাকরণে ঘাটতি থাকে বা অন্য কোনো শাস্ত্রে থাকে দুর্বলতা, তাহলে যেভাবেই হোক কর্মজীবনে দাখেলার আগে তাকে একজন শাস্ত্রবিশেষজ্ঞ আলেমের তত্বাবধানে থাকতে হবে এবং তার বাতানো পথ অবলম্বন করে ঘাটতি গুলোকে প্রাপ্তি দিয়ে রূপান্তর করে নিতে হবে। অতঃপর অধ্যাবসায়ের সাথে অন্তত একযুগ পর্যন্ত নির্বাচিত শাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি অবিরাম মুতালাআ করে যেতে হবে।
কারো যদি আমলে ঘাটতি থাকে , তাহলে প্রথমে তাকে আত্মশুদ্ধির পথ বেছে নিতে হবে। এলক্ষ্য অর্জনে তাকে একজন হক্কানী পীরের হাতে বায়আত গ্রহণ করতে হবে অথবা দাওয়াত ও তাবলীগে সময় দিতে হবে। নূন্যতম তিন চিল্লা বা প্রয়োজনে সাল লাগাতে হবে। চলবে……………
(২য় পর্ব)
১৯ রজব১৪২৮ হিজরী। দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষাসমাপনকারী তালিবানে উলূমের বিদায়ী অনুষ্ঠান। বিদায়ী কাফেলার তালিকায় অামি অধমও ছিলাম।
বিদায়ী অনুষ্ঠানে উস্তাযে মুহতারাম আল্লামা মুফতী সাঈদ আহমদ পালন পুরী দাঃ বাঃ অত্যন্ত সারগর্ভ একটি নসীহত পেশ করেন। ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বিদায়ী কাফেলার উদ্দেশ্যে বলেন, প্রকৃত আলেম হওয়ার জন্য দু’টি শর্ত রয়েছেঃ
এক. আরাবিয়্যাত পর উবূরিয়্যাত তথা আরবী ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন।
দুই. মানতিকিয়্যাত মে মাহারত তথা যুক্তিবিদ্যায় দক্ষতা অর্জন।
এই শর্তদুটি যাদের হাসিল হবে না তারা প্রকৃত আলিম হতে পারবে না।
মাদরাসায় দীর্ঘজীবন লেখাপড়া করেও যদি আরবী ভাষা শেখা না যায় তাহলে আলিম এবং জাহিলের মাঝে আর কোনো পার্থক্যই বাকি থাকে না। সাধারণ মানুষ উর্দু- বাংলা তরজমা দেখে কুরআন- হাদীসের অর্থ বুঝার চেষ্টা করে। আপনি আলিম হয়েও যদি তরজমা দেখে কুরআন হাদীসের অর্থ জানতে হয় তাহলে আপনি এবং ঐ সাধারণ ব্যক্তি উভয়ই সমান হয়ে গেলেন! এক কাতারে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
দ্বিতীয়তঃ মাদরাসায় পড়ে আপনি আরবী ভাষা শিখলেন ঠিকই, কিন্তু মানতিকশাস্ত্রে তেমন দক্ষতা অর্জন করতে পারলেন না, তাহলে আপনার মাঝে এবং আরবের সাধারণ মানুষের মাঝে কোনো তফাৎই থাকবে না। আপনাকে আলিম বললে আরবের সকল সাধারণ মানুষকেও আলিম বলতে হবে। বরং তাদেরকে আপনার চেয়েও বড় আলিম বলা লাগবে। কারণ তারা আহলে লেসান। আপনার চেয়ে আরবী ভাষা তারা বেশি জানে ও বুঝে। সুতরাং শুধু আরবী ভাষা জানলেই কাউকে আলিম বলা যাবে না। আলিম হতে হলে তাকে আরবী ভাষা জানার পাশাপাশি শরীয়তের তাদকীকাত বা সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয়াবলী জানতে হবে এবং বুঝতে হবে। আর এগুলো সঠিকভাবে বুঝতে হলে তাকে অবশ্যই মানতিকশাস্ত্রে চলনসই যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
প্রিয় ফারিগীন! যাদের আরবী ভাষার যোগ্যতা নেই, তাদের জন্য দাওরায়ে হাদীসে ভর্তি হওয়া জায়েয নেই। দাওরায়ে হাদীসে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা তারাই রাখে, যারা আরবী ভাষা শুদ্ধ করে লিখতে বলতে এবং পড়তে পারে। তাকমীল ফিল হাদীসে পড়বে আর হাদীসের ইবারতে ভুল করবে এটা শরীয়ত বিশেষজ্ঞ কোনো আলিমই মেনে নিতে পারেন না। শরীয়তও এটা বরদাশত করে না।
(৩য় পর্ব)
পালনপুরী হুজুর দাঃ বাঃ শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষে ফুযালায়ে কেরামকে তিন ভাগে বিভক্ত করেনঃ
প্রথমভাগ হলেন প্রখর মেধাবী তালিবান, যারা সর্বদা মুমতাজ বা ষ্টার মার্ক পেয়ে পেয়ে একাডেমিক শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। তারা তাকমীল ফিল হাদীস সমাপন করে হয়ত উচ্চশিক্ষা লাভ করবেন , বিভিন্ন শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করবেন, নতুবা দারস ও তাদরীসে লেগে যাবেন। এই দুইটার যেকোনো একটা তাদেরকে বেছে নিতে হবে। অন্যান্য মাশগালা গ্রহণ করা বা প্রচলিত দাওয়াত ও তাবলীগে কোমর বেধে লেগে যাওয়া তাদের জন্য সমীচীন হবে না।
দ্বিতীয় ভাগ হলেন ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ তালিবান। তারা প্রথমে দাওয়াত ও তাবলীগে কিছু সময় লাগাবেন । তারপর মসজিদে ইমামতি বা মুয়াজ্জিনী করবেন। দারস ও তাদরীসে যথাসম্ভব যোগ দেবেন না।
তৃতীয় ভাগ হলেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডিভিশনে উত্তীর্ণ ফাযিলগণ। তারা অন্তত এক সাল তাবলীগে সময় লাগিয়ে দুনিয়াবী কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়বেন। পাঠদানের জন্য দ্বীনী প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হওয়া তাদের জন্য সমীচীন নয়। কারণ, ছেলে বাপের মতই হয়ে থাকে। যেমন আরবীতে একটা প্রবাদ আছে, ‘আল ওয়ালাদু সিররুন লিআবীহি’। বাপ যদি দুর্বল হন, ছেলেও দুর্বল হবে। তদ্রুপ উস্তায যদি দুর্বল হন, শাগরিদদের দুর্বল হওয়াটাই স্বাভাবিক। তখন ছাত্র- উস্তায ‘যাউফাত তালিবু ওয়াল মাতলুব’র মিসদাক হয়ে যাবেন। এবিষয়টি আজকাল বেশিরভাগ মাদরাসা সমূহে বিবেচনা করা হয় না, বিধায় শিক্ষার মানে দিন দিন ধ্বস নামছে।
তবে প্রত্যেকভাগকে দৈনিক একটি আয়াতের তাফসীর, একটি হাদীসের ব্যাখ্যা ও ফেকাহর একটি মাসআলা অবশ্যই মুতালাআ করতে হবে। কারণ এই তিনটাই হলো প্রকৃত ইলিম। বাকি সব হলো এগুলোর খাদেম।
চলবে………..