লিখেছেন: আবু সাঈদ মুহাম্মাদ উমর
একটু আগেই জিলহজ্জ মাস শুরু হয়েছে। জামিয়াতুল উলূম আল-ইসলামিয় লালাখান বাজার মাদরাসা’র বিশাল মসজিদে মাগরিবের নামাজের ইমামতি করলেন বড় হুজুর ( মুফতী ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী দা.বা.)। নামাজের পর বড় হুজুর বরাবরের মত-ই ঘোষণা করলেন- “কাল থেকে আগামী ৯ জিলহজ্জ পর্যন্ত সবাইকে রোজা রাখতে হবে। এই দিনগুলোতে বোডিং থেকে কোনো খাবার দেয়া হবে না।” ছাত্র শিক্ষক সবাই তাঁর আদেশ পালনে বাধ্য। . এই রাতগুলো বিশেষ ফজিলতপূর্ণ। আর সকালে লম্বা সময় ঘুমানো যাবে তাই অনেকেই রাতজেেগ বিভিন্ন ইবাদাত বন্দেগী ও তাসবীহ তাহলীলে ব্যস্ত। আবার অনেকেই কিতাব মোতালা’য় ব্যস্ত, বিশেষ করে “ইফতা” বিভাগের ছাত্ররা। যথারিতি সেহরীর সময় খাবার দেয়া হলো। সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। দরস শুরু হবে বেলা ১১টায়। . ১১টা বাজার আগেই সবাই ঘুম থেকে জেগে দরসের প্রস্তুতি নিয়ে বসে পড়লো জামাতে। কিন্তু ‘ইফতা বিল্ডিং’-র একটি রুমের কেউ এখনো জাগেনি। ঘড়ির কাটা যখন এগারোটা ছুঁই ছুঁই এমনি মুহুর্তে সেই রুমে ঘটে গেলো অনাকাঙ্খিত একটি দুর্ঘটনা। এমনিতেই এই মাদরাসার প্রতি ভূমিখেকুদের লুলোপ দৃষ্টি আর ধর্মবিদ্ধেষীদের রয়েছে ভয়ঙ্কর চোখ রাঙানি। তারা সে ঘটনাকে পুঁজি করে মাদরাসার বিরুদ্ধে ওঠেপড়ে লাগলো। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও নিজেদের মনের মতো ব্যবহার করলো। তাগুতের পা’চাটা মিডিয়াও তাদের তালে তাল দেয়া শুরু করলো।
ঘটনায় আরো রঙ মাখাতে সে সময় আহতদের পাঠিয়ে দেয়া হলো পরপারে (আমার ধারণা)। ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন ছাত্র শিক্ষকরা। আমার মতো অনেকেই রোজার কথা ভুলে পেরেশানিতে কখন যে পানি পান করে রোজা ভেঙ্গে ফেলেছে মনেই নেই। ঘটনার প্রথম দু’তিন ঘন্টা তবুও ভালো ছিলো। কিন্তু হঠাৎ প্রশাসনের এক বড় কর্মকর্তা আসার পরেই যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো সব, পাল্টে গেলো দৃশ্যপট! তারপর থেকেই শুরু হলো ছাত্র শিক্ষকদের হয়রানি করা। এক সময় মাদরাসার চারপাশ ব্লক করে দেয়া হলো, বাহিরে আসা যাওয়া সব বন্ধ। ব্লক করার আগেই অনেকেই অহেতুক জামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয়ে (যেহেতু ঘটনা মাদরাসায় ঘটেছে তাই তিলকে তাল বানানো হবেই) বেরিয়ে গিয়েছে, খুব অল্প কজনই তখন মাদরাসায় ছিলো। তারপর তল্লাসির নামে চললো নাটকের একটি ভালো স্কৃপ্ট তৈরির কাজ। এভাবে সময় ঘড়িয়ে এশার আজান হলো, ছাত্র শিক্ষক যারা ছিলেন সবাই মসজিদে গেলেন। নামাজের পরেই গ্রেফতার করা হলো মাদরাসায় অবস্থানরত সকল শিক্ষককে আর এক ছাত্রকে। সে সংবাদ শুনার সাথে সাথেই ব্লক ফাকি দিয়ে পাহাড় টপকে কয়েকজন ফেরারী হলো। কারণ সকল বড় বড় ছাত্রদের গ্রেফতারের আদেশ ছোট এক ছাত্র শুনে এসেছে। . যারা ব্লক পেরুতে পারেনি তারা থেকে গেলো। যাদের অধিকাংশই মক্তব ও হিফজ বিভাগের ছোট ছোট ছাত্ররা। পরে জেনেছি সারাটা রাত তাদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এবং সবাইকে সকাল ৮টার ভিতরে মাদরাসা ত্যাগ করতে বলা হয়। . সর্বশেষ যে কয়জন ফেরারী হলো তাদের মাঝে কাপুরুষ অক্ষম এই অধমও ছিলো। মূল রাস্তায় যেতে বেজেগেলো প্রায় রাত পৌনে ১১টা। তারপরেও সবার মনে প্রচন্ড ভয় কাজ করছিলো। কারণ দেশ ও ধর্ম বিদ্ধেষী যে কোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে চট্রগ্রাম শহরে এই মাদরাসার ছাত্ররাই সর্ব প্রথম রুখে দাড়াতো। তাই ঘটনার পর থেকেই সেই সব মানুষরুপী হায়েনারা উৎপেতে আছে মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকদের সায়েস্তা করতে। তবে দয়াময়ের করুণায় আমাদের নাগাল তারা পায়নি- আল-হামদু-লিল্লাহ। . কয়েকজন একাই চলে গেলো শহরের নিরাপদ স্থানে। কিন্তু যাদের জন্য সেসময় শহরে কোনো নিরাপদ স্থানের পাত্তা নেই, তারা ছুটলাম শহরের বাইরে উম্মুল মাদারিসের উদ্দেশ্যে। পথে একটি দোকান থেকে সেখানে পরিচিতদের জানিয়ে দিলাম ‘আমরা আসছি’ ব্যস্ এটুকুই। সেখানে যখন পৌছলাম তখন ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ১২টা। গাড়ি থেকে নেমে দেখি কয়েকজন আমাদের অপেক্ষায় গভীর উদ্ভেগ-উৎকন্ঠায় দাড়িয়ে আছেন। তারপর আমাদের নিয়ে যওয়া হলো ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়।
সেখানের যারাই জানলো ঐ মাদরাসা থেকে এসেছি, তারাই মাদরাসার পরিস্থিতি জানতে চাইলো, সবশুনে সমবেদনা জানালো। প্রত্যেকেই আমাদের ব্যথায় ব্যথিত। যতাসাধ্য আমাদের খাতির যত্ন করলো। বিশেষকরে আমার বেলায় নিজ শহরের (সিলেট) ছোট ভাইয়েরা যা করেছে, তাদের সে ঋণ কখনো শোধ হবার নয়। তাদের মোবাইল থেকে কয়েক জায়গায় ফোন করে নিজের অবস্থান জানালাম এবং কোনো চিন্তা না করে বেশীকরে দোয়া করতে বললাম। . এভাবেই রাত কাটলো। ফজরের নামাজের পর দেখা হলো আমার মতো আরো কয়েকজনের সাথে। সবাই নির্বাক, মুখ দেখেই বুঝা যায় সারাটা রাত কেউ ঘুমায়নি, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কান্নার অশ্রু হয়ে ঝরেছে। সেখানের পরিচিতজনেরা সবাইকে জোর করেই সকালের নাস্তা করিয়ে একটু সময় ঘুমানোর তাগিদ দিলো। আধ-ঘন্টার মতো গড়াগড়ি করে ঘুম না আসায় ওঠে পড়লাম। . এবার বাড়ি ফেরার চিন্তা, কিন্তু টাকা-পয়সা কানাকড়িতো কিছুই নেই। কিছু টাকা জোগাড় করলাম আর কিছু টাকা অন্যজনের মাধ্যমে ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে আনালাম। তারপর সহজে কিভাবে গাড়ি পাওয়া যায় চেষ্টা করলাম কিন্তু লাভ হলো না, এখান থেকে যাওয়া যাবে না, শহরে যেতেই হবে। অনকেই বললেন, সামনে ঈদ তাই টিকেট পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
কিছুদিন আগে কয়েকজন মেহমানের টিকেটের খাতিরে বিআরটিসি বাস কাউন্টারের একজনের সাথে মোটামোটি সম্পর্ক হয়েছিল, সেই লোকের মোবাইল নাম্বার মেহমানদের কাছে ছিলো। সে কারনে মেহমানদের একজনের কাছে ফোন দিলাম ঐ লোকের মাধ্যমে দু’টি টিকেট জোগাড় করার জন্য। কিছুক্ষণ পর উনি জনালেন- ঐ লোক আজ ডিউটিতে নেই, তবে সে কাউন্টারে বলে রাখবে, আমরা সময় মতো সেখানে গিয়ে তার কথা বললেই টিকেট পেয়ে যাবো। যাক, আপাতত একটা চিন্তা থেকে রেহাই পাওয়া গেলো। (অথচ দু’দিনপর বাড়ি যাবো বলে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট কারা ছিলো। যা এখনো হয়তো মাদরাসায় ফেলে আসা ব্যগের মধ্যেই আছে)। . এভাবেই এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে সময় কাটাতে লাগলাম, তবে নিদৃষ্ট গন্ডির ভিতরে। আসরের নামাজের পর শুনলাম আমাদের মাদরাসার দুর্ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল হবে। প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজে আমিও শরিক হলাম। সমাবেশ ও মিছিল শেষকরার পর কাপড়ের কথা মনে পড়লো। আমি যে এতো-ই নিঃস্ব, বৃষ্টিভেজা কাপড় পাল্টানোর সাধ্যও যে নেই! ভিতরের কান্না চোখে আসড়ে পড়লো। অনেক ভেবে সেখানে অবস্থানরত সবচে পুরাতন সাথির কাছ থেকে চেয়ে তাঁর কাপড় পরলাম, লিখতে লজ্জা নেই সেই কাপড়ের মাঝে জামার নিচের গেঞ্জিও ছিলো। . সন্ধার পর একটু অন্ধকার হতেই দুঃসময়ের প্রিয়জনদের থেকে বিদায় নিলাম। সেসময় তাঁদের মুখচোরা কান্না এখনো চুখে ভাসে। রওয়ানা হলাম শহরের উদ্দেশ্যে, সরাসরি বিআরটিসি ডিপু। আল্লাহর পরিক্ষা মনেহয় আরো বাকি ছিলো, ডিপু’তে পৌঁছে জানলাম আজ আমাদের রোডের কোনো গাড়ি নেই। অনেক দৌড়া দৌড়ী করে অন্য গাড়ির টিকেট নিলাম, যদিও গাড়িটা খুব ভালো নয় এবং ছাড়বেও অনেক রাতকরে। তবুও নিতে বাধ্য। . রাত অনেক হয়েছে, দু’দিন একরাতের নির্ঘুম ক্লান্ত দেহো, পেটেও প্রচন্ড ক্ষিধা। প্যাকেটের অবস্থা হিসাব করে একটি রেস্তোরায় ডুকলাম। ভাত অর্ডার করলাম, কিছুক্ষণ পর সার্ভ করাহলো। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ভাতের প্লেটে হাত দিয়ে দেখি নিচে এখনো মাড় (ভাতের ফেন)। তবুও টাকা ও ক্ষিধার কথাভেবে খেতে হলো। . গাড়ি ছাড়ার সময় হলে সিটে গিয়ে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো। মধ্যখানে দু’বার গাড়ি নষ্ট হলো। নির্ধারিত সময় থেকে ৪-৫ ঘন্টা বেশি লাগলো। পথে থাকতেই এক ভাই শহীদ হওয়ার সংবাদ পেলাম। অবশেষে নিজ শহরে পৌছলাম। সারাটা পথ শত চেষ্ট করেও চোখের অশ্রু আটকে রাখতে পারিনি। কসম আল্লাহর এই কান্না যত না নিজের জন্য, তারচে বেশি মাদরাসা আর আল্লাহর পথের কয়েক ভাইয়ের জন্য…
জীবন পথের হাজারো স্মৃতির মধ্যে এই দুই দিনের স্মৃতি হয়তো সারাটা জীবন হৃদয়ে রক্ত ঝরাবে।