অনলাইন ডেস্ক :: বংশ পরম্পরায় পাওয়া জমি, ঘরবাড়ি ও লবণ চাষের জমি রক্ষার চেষ্টায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সোমবার প্রাণ হারান চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের চারজন। পুরো এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। প্রাণহানির এ ঘটনার পরও তারা ভীত নন। যে কোনও মূল্যে তারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বাধা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে ওই এলাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়া ছাড়াও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে বলে দাবি করছেন স্থানীয় জনগণ ও বিশেষজ্ঞরা।
সোমবারের সংঘর্ষে ছোট দুই ভাই ও জামাতাকে হারিয়েছেন গণ্ডামারার বদি আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের আবাদি জমি বিক্রির জন্য বাধ্য করতে কিছু দালাল নিয়োগ দিয়েছে এস আলম গ্রুপ। আমাদের ভয় দেখানোর জন্য রবিবার রাতে এস আলম গ্রুপ সমর্থিত গুণ্ডারা কিছু বিক্ষোভকারীকে তুলে নিয়ে যায়। এই ঘটনার জের ধরেই সোমবার বসতভিটা রক্ষা কমিটির ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতাকারীরা।’
সোমবারের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শের আলী বলেন, ‘আমাদের অনেকেরই নিজেদের চাষবাসের জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে আমরা চাষ করি। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ বন্ধ করতে না পারলে আমরা না খেয়ে মারা যাবো।’
গুলিবিদ্ধ আবদুল খালেকের স্ত্রী রেনু আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী লবণ চাষের জমিতে কাজ করে। আমরা দিন আনি দিন খাই। সে কাজের জায়গা হারালে আমাদের যাওয়ার কোনও জায়গা থাকবে না।’
গণ্ডামারা ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদের সেক্রেটারি নুরুল হক শিকদার বলেন, ‘আমরা জান দেবো, তবু জমি দেবো না। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে আমার বসতভিটা, চাষের জমি ছিনিয়ে নিতে দেবো না। এই এলাকায় কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে দেবো না। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে পরিবেশের ক্ষতি করতে দেবো না। নিজেদের দাবি থেকে আমরা এক ইঞ্চিও নড়বো না, আন্দোলন আরও জোরদার করবো।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ দানেশ বলেন, ‘কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র কোনওভাবেই পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ নয়। বরং এটি বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। তাই উন্নত দেশগুলো কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প উদ্যোগ বেছে নিচ্ছে।’
ড. দানেশ বলেন, ‘এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডসহ দূষিত পদার্থ বহনকারী বাতাস বের হয়ে আসে। সালফার ডাই অক্সাইড বাতাসে জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে এসিড বৃষ্টি ঘটায়, যা ফসল ও গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষতি করে। জলজ বাস্তুতন্ত্রেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়।’
চট্টগ্রামে সরকারি মহসীন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চট্টগ্রাম শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, ‘কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধারণা খুবই সেকেলে। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসা ছাই আকাশে জমে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণে বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে বনায়নের ক্ষতি হবে এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগ ছড়াবে।’
মঙ্গলবার গণ্ডাপাড়ার হরিপাড়া ও রহমানিয়া মাদ্রাসা চত্বরে কয়েক শ’ মানুষ সোমবারের ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন। রক্ত ঝরলেও জমি কেড়ে নিতে দেবেন না বলে স্লোগান দেন তারা। তারা প্রাণহানির ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করেন।
তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ব্যানারে চেরাগী পাহাড় এলাকায় সোমবারের ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হয়। ছাত্র ঐক্য ফোরাম বাঁশখালী উপজেলায় সকাল-সন্ধ্যা ধর্মঘট পালন করে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী গ্রামবাসীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে সোমবার চারজন নিহত হন। এ ঘটনায় ১১ পুলিশসহ কমপক্ষে ১৯ জন আহত হন। কয়লাভিত্তিক বেসরকারি ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি নেওয়াকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসী ক্ষুব্ধ ছিল। তবে একটি অংশ ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে অবস্থান নিলে দুই পক্ষে উত্তেজনা দেখা দেয়। পুলিশের দাবি, ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী তাদের ওপর হামলা চালালে তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়।
এই ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলা করেছেন নিহত দুই ব্যক্তির স্বজনরা। পৃথক আরেকটি মামলা করেছে পুলিশ। পুলিশের সহ-পরিদর্শক বাহার মিয়া বাদী হয়ে ৫৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং তিন হাজার ২০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলাটি করেছেন।
সংঘর্ষে নিহত আনোয়ার আলীর বড় ভাই বশির আহমেদ ৬ আসামির নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত দেড় হাজার জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন। আরেকটি মামলা করেছেন সংঘর্ষে নিহত জাকের হোসেনের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। তিনি বাদী হয়ে অজ্ঞাত দেড় হাজার জনকে আসামি করে মামলাটি করেছেন।
উল্লেখ্য, এস আলম গ্রুপের সঙ্গে চীনের একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনে সম্প্রতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ বিষয়ে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও কাউকে পাওয়া যায়নি। বাংলা ট্রিবিউন।