মাওলানা ইবনুল হাসান আব্বাসী ::
এটি স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, কওমী মাদরাসাসমূহের পাঠ্যসূচি ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এমন অসংখ্য ভালো ও সুন্দর দিক রয়েছে যা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কল্পনাও করা যায় না। তবে এত সব ভালো দিক থাকা সত্ত্বেও কিছু দূর্বলতা ও অপূর্ণতা রয়ে গেছে। সেগুলো সংশোধনের মানসিকতায় আমাদেরকে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। সমালোচনাকারীরা আমাদের চেয়ে অধিক ত্র“টি-বিচ্যুতির শিকার শুধুমাত্র এ যুক্তিতে নিজেদের দূর্বলতার অবসান না করা সংশোধনকামীদের নীতি বহির্ভূত। প্রথমে আমি নেসাবে তা’লীম তথা পাঠ্যক্রম ও পরবর্তীতে নেযামে মাদারিস তথা সার্বিক ব্যবস্থাপনার উপর আলোকপাত করব।
দারসে নেজামীর পটভূমি
কওমী মাদরাসার পাঠ্য নেসাবই ‘দারসে নেজামী’ নামে প্রসিদ্ধ। এটি হিজরী দ্বাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত আলিমে দ্বীন মোল্লা নেজামুদ্দীন সাহালুভী কর্তৃক রচিত বিধায় তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়েছে।
অনন্য বৈশিষ্টের অধিকারী হওয়ার দরুণ এ নেসাবটি আঠারশত পয়ত্রিশ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত হিন্দুস্তানের প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই প্রচলিত ছিল। আঠারশত পয়ত্রিশের পর ইংরেজরা একটি নতুন পাঠ্যক্রম তৈরি করতঃ ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তা বাস্তবায়নের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যা মূলত স্যার মেকলের আবিস্কার ছিল। দূর্ভাগ্যবশত ইংরেজদের এই নতুন সিলেবাস অত্যন্ত দ্রুতগতিতে হিন্দুস্তানের প্রভাবশালী শিক্ষালয়গুলোতে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এবং ভারত উপমহাদেশের স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটিসমূহ ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে তা বরণ করে নিয়েছে। সিলেবাসটির গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের একটি কারণ এও ছিল যে এতে যুগোপযোগী বিষয়াদি, আধুনিক দর্শন ও প্রযুক্তিকে বুনিয়াদী স্তরে রাখা হয়েছে। মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ আধুনিক বিষয়াদী, শিল্পবিপ্লব বৈজ্ঞানিক আবিস্কারসমূহ দ্বারা উপকৃত হওয়ার লক্ষ্যে উক্ত পাঠ্যক্রমকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। অপরদিকে ইংরেজ প্রশাসনের লক্ষ্যে ছিল-অভিসন্ধিমূলকভাবে দারসে নেজামীর গ্রহণযোগ্যতার উপর আঘাত হানা এবং সেটাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে বিদায় করা। সে লক্ষ্যে তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য নব আবিস্কৃত সিলেবাসের উপর দক্ষতা লাভ করার শর্ত জুড়ে দিল। ফলে দারসে নেজামী নিস্ক্রিয় ও প্রাচীন ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় পরিণত হয়ে পড়েছে। সেখান থেকে ফারেগ ছাত্রদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।
বর্তমানে অতি স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম সর্বসাধারণের সিংহভাগ উক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। যা মূলত: পূর্ব হতে সাজানো সুপরিকল্পিত ও সুক্ষ্ম চক্রান্তের যথার্থ ও সুনিশ্চিত ফলাফল।
এখানে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, উপরোল্লিখিত অনাকাঙ্খিত পরিণতি মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থার আড়ষ্ট নীতিরই ফলাফল। অষ্টাদশ শতকের পয়ত্রিশের পূর্বে অনেক আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের আবিস্কৃত নানা ধরণের নতুন নতুন বিষয়াদির আবির্ভাব ঘটেছিল। মুসলিম নেতৃবৃন্দ যদি নিজেরাই সে সকল বিষয়াদিকে দারসে নেজামীতে সংযোজন করতেন, তবে শিক্ষা সিলেবাস সংস্কারের নামে মুসলিম জনগণকে ইউরোপিয়ানদের অনুগামী করার চক্রান্তে কুচক্রীরা কখনোই সফল হতো না। অথচ দুঃখজনকভাবে এতে তারা সফল হয়ে গেছে। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ তাদের কৌশলের ধ্বংশাত্মক বিষয়কে আধুনিক শিক্ষার লেবেন এটে আকর্ষণীয়রূপে পেশ করার সুযোগ পেত না। শত্র“দেরকে এ ধরণের সুযোগ করে দিয়েছে মূলত আমাদের প্রাচীনতা প্রীতি, স্থবিরতা-নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতা। আর সে উদাসীনতার দরুণ মুসলিম শিক্ষানীতিতে দুটি ভিন্নমেরুর সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম মিল্লাত দ্বীনী ও দুনিয়াবী, প্রাচীন ও আধুনিক, মিস্টার ও মোল্লার দু’টি প্রান্তিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে।
মাদারিসে কাওমিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা
সমকালীন শিক্ষাব্যবস্থা যখন ইসলামী শিক্ষার পূর্ণ কার্যকরি নেসাবকে অচল তথা পৌরাণিক বলে আখ্যায়িত করে শিক্ষাঙ্গণসমূহ থেকে বিতাড়িত করেছে তখন ওলামায়ে কেরামের চিন্তাজগৎ আলোড়িত ও আন্দোলিত হয় এবং তারা ‘মাদারিসে কাওমিয়া’ নামে নতুন ধাঁচের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েম করেন। মাদারিসে কাওমিয়ায় দারসের নেযামীর শিক্ষা সিলেবাসই অনুসৃত হত। হিতাকাঙ্খী ও দানশীল ব্যক্তিবর্গের অনুদানে পরিচালিত এ সকল প্রতিষ্ঠান না সরকারি-আধা সরকারি ছিল, আর না কোন একক ব্যক্তিমালিকানাধীন ছিল। বরং সাধারণত: অস্বচ্ছল মুসলিম পরিবারের সন্তানরা তাতে শিক্ষাগ্রহণ করত। আর দীন রক্ষার খাতিরে নিজেদের ব্যক্তিসত্তা ও আত্মসম্মানকে উৎসর্গ ও বিলীনকারী ওলামায়ে কেরাম চাঁদা সংগ্রহ করতেন। এ সকল প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচালনার লাগাম ওলামায়ে কেরামের হাতেই ছিল। শুধুমাত্র আর্থিক সাহায্য করত মুসলিম সর্বসাধারণ।
১৮৬৬ তে সাহারানপুর জেলার ছোট একটি শহরে প্রতিষ্ঠা লাভকারী ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’ ছিল এ ধারার দ্বীপ্তমান নক্ষত্রতুল্য। যা মুসলিম জাতির মাঝে এহইয়ায়ে দ্বীন তথা দীনকে পুনরুজ্জীবিত করার চেতনা যুগিয়েছে। সুন্নাতের পূর্ণ অনুকরণ, সালফে সালেহীনের মুহাব্বাত ও তাঁদের প্রতি আস্থার বীজ বপন করেছে মুসলিম উম্মাহর হৃদয়পটে। সৃষ্টি করেছে তাহযীব-তামাদ্দুনের উত্তরাধিকার সংরক্ষণের জাগরণ।
দারুল উলূম দেওবন্দ ও তার চেতনায় বিশ্বাসী মাদরাসা সমূহে ছিল ইলমের সাথে আমলের অপূর্ব সমন্বয়। সেখানকার ফারেগীনের এক হাতে ছিল ইলমের প্রদীপ ও অপর হাতে আমলের মশাল। এ ধারার মাদরাসাসমূহ কেবলমাত্র মুসলিম সমাজে লর্ড মেকলের ছড়িয়ে দেয়া বিষের প্রতিশোধনই করেনি বরং মুসলিম বক্ষে ঈমানী উদ্দীপনার তরঙ্গও সৃষ্টি করেছে। হিন্দুস্তান থেকে নিয়ে বোখারা-সমরকন্দ পর্যন্ত সর্বত্র দারুল উলূমের শাখা প্রতিষ্ঠান সমূহ হতেই উচ্চারিত হয়েছে ইসলামের আওয়াজ। ছড়িয়েছে ইলমী নূরের দ্যুতিময় আলোকচ্ছটা। ইসলামী শিক্ষার প্রশাখা বিস্তার ও উপমহাদেশ সহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের যুগশ্রেষ্ট ব্যক্তিত্বের বিস্ফোরণ ঘটেছে এ সকল প্রতিষ্ঠান হতেই। আল্লামা ইকবালের কবিতা সম্পূর্ণ প্রযোজ্য হয় এ ধারার প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে-
“সে দরিয়া হতে আগুনের তরঙ্গও সৃষ্টি হয়।”
যার উত্তাপে নির্লজ্জদের স্বপ্নের প্রাসাদ চুরমার হয়ে যায়।
বর্তমান দারসে নেজামী
দ্বীনী মাদরাসাসমূহের নেসাবে তা’লীমের মেরুদণ্ড হল দারসে নেজামী। তাতে বিষয়ভিত্তিক বুনিয়াদী কিতাব হুবহু সেগুলোই আছে যা পূর্বের দারসে নেজামীতে ছিল। অবশ্য বিভিন্ন পরিস্থিতি ও যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে সংযোজন-বিয়োজনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। পুরাতন নেসাবের অনেক বিষয় ও মা’কুলাতের বহু কিতাব বাদ দেয়া হয়েছে। পুরাতন নেসাবে সাধারণত বিশটি বিষয়ের শতাধিক কিতাব পড়ানো হত। আট বছর মেয়াদী কোর্স সিলেবাস নাহু, সারফ, মা’আনী, বালাগাত, আদব, ইনশা, মানতিক, ফালসাফা, হাইআত, কালাম, মুনাযারা, ফেকাহ, উসূলে ফেকাহ, তাফসীর, উসূলে হাদীস ও হাদীস- এ পনেরটি বিষয়ে সর্বমোট প্রায় ষাটটি কিতাব অধিকাংশ মাদরাসার পাঠ্য তালিকাভুক্ত। এই আট বছরের নেসাবে পা রাখার পূর্বে শিক্ষার্থীকে আরো একটি প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করতে হয়। যাকে দরজায়ে ‘এ’দাদিয়া বা মক্তব বিভাগ’ বলা হয়। এ স্তরটি কোন কোন মাদরাসায় দুই বছর আবার কোন মাদরাসায় তিন বছর মেয়াদী। এতে স্কুলের ষষ্ঠ থেমে অষ্টম শ্রেণীর সকল বিষয় যেমন-উর্দূ, ঈসায়ীরেজি, অংক, বিজ্ঞান ইত্যাদি ছাড়াও আরবী ও ফার্সির প্রাথমিক কিতাবাদি পড়ানো হয়। এ বিভাগটি মূলত দারসে নেজামীর আবশ্যকীয় লেখনী ও যবানী যোগ্যতা সৃষ্টির বুনিয়াদ হিসেবে কাজ করে। অবশ্য মেট্রিকোত্তীর্ণদেরকে এ বিভাগটি অতিক্রম করতে হয় না।
দারসে নেজামীর বৈশিষ্ট
দারসে নেযামীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হচ্ছে এটা কোন বিষয়ে মামূলী তথা সাধারণ জ্ঞানের স্থলে গভীর ও সুদৃঢ় ইলমী যোগ্যতা সৃষ্টি করে। ফলে যে কোন শিক্ষার্থী শ্রম ও সাধনার মাধ্যমে মজবুত ইলমী যোগ্যতার অধিকারী হতে পারে। এখানে স্মর্তব্য যে, অন্যান্য সকল শিক্ষা ব্যবস্থার ন্যায় দারসে নেজামীর উদ্দেশ্যও এই নয় যে, এর দ্বারা পাঠ্যকিতাব সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্ণ বু্যুৎপত্তি ও সর্বোচ্চ জ্ঞান অর্জিত হয়ে যাবে। যাতে উক্ত বিষয়ে আর অধ্যয়নের প্রয়োজন না থাকে। বরং উক্ত পাঠ্যক্রমে যে কোন বিষয়ের কেবলমাত্র বুনিয়াদী কিতাব নির্বাচন করা হয়েছে। যাতে তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে পরিচিতি লাভ ও নিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এ মাপকাঠির ভিত্তিতেই কিতাব চয়নের ক্ষেত্রে সাধারণত এমন সংক্ষিপ্ত ও দুর্বোধ্য কিতাবকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে যে, পাঠক পূর্ণ মনোযোগ ও গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ না করলে তা থেকে উপকৃত হওয়া অসম্ভব। এভাবেই একজন ছাত্রের মধ্যে কঠিন ও দুর্বোধ্য পাঠ রপ্ত, সুক্ষ্ম মাসায়েল উপলব্ধি ও অস্পষ্ট বিষয়াদির নিগুঢ়তত্ত্ব উদঘাটনের যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে সে পঠিত কিতাব হতে সৃষ্ট শক্তি ও সামর্থ দ্বারা উক্ত বিষয়ের বড় বড় কিতাব বুঝতে সক্ষম হয় নিছক ব্যক্তিগত অধ্যয়ন দ্বারা। তখন আর ওস্তাদের সহযোগিতার প্রয়োজন হয় না।
কয়েটি দূর্বলতা ও লক্ষ্যণীয় বিষয়
এ নেসাবে উল্লেখিত গুণ-বৈশিষ্ট থাকা সত্ত্বেও কিছু ত্র“টি ও অপূর্ণতা রয়েছে। বিভিন্ন ইলমী পরিসরে খুব জোরেশোরে এ দাবী উত্থাপিত হয়েছে যে, প্রচলিত নেসাবকে যুগ চাহিদা ও নিত্য-নতুন সমস্যার প্রেক্ষিতে পুনরায় সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে আরো গতিশীল করা অপরিহার্য। আমি মনে করি যে, নেসাব সংস্কারের দাবী অযৌক্তিক নয়। বরং অনেক প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা সংস্থা হতে এ আওয়াজ উঠেছে। সুতরাং পরিবর্তন-পরিবর্ধন সংক্রান্ত নতুন প্রস্তাব সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ফিকির করা উচিত।
বর্তমান নেসাবের একটি বড় ধরণের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যে, এতে প্রাথমিক কিছু কিতাব ব্যতীত বাকী সকল কিতাবই আরবী ভাষায়। তন্মধ্যে নাহু, সারফ, আদব, ইনশা, মা’আনী ও বালাগাতের একমাত্র তথা মূল উদ্দেশ্য হল- শুধুমাত্র আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা।
কেননা, কুরআন-হাদীস আরবী ভাষায়। ইসলামী জ্ঞানের উৎপত্তি ও উৎস আরবী ভাষা হতেই। আরবীতে গভীর জ্ঞানার্জন করা ব্যতীত ইসলামী শিক্ষায় পারদর্শী হওয়া কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়। অথচ বাস্তব অবস্থা হল দারসে নেজামীর ফারেগীন ফুজালাদের অধিকাংশকে দেখা যায় যে, আরবী ভাষায় তাদের পূর্ণ দখল ও ব্যুৎপত্তি নেই। প্রায় সকলেই বিশুদ্ধ আরবী পঠন ও লিখনে দুর্বল। আর বর্তমান যুগের নিত্য নতুন পরিভাষা এবং আধুনিক আরবী সম্পর্কে অবগতি লাভ করা তো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। মূলত আরবীতে কথোপকথন ও আধুনিক আরবীর নিয়ম কানুন আয়ত্ত করা ও লেখনী শক্তি সৃষ্টি করা দারসে নেজামীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্হিভূত। দারসে নেজামীর আরবী সংশ্লিষ্ট সকল আয়োজন কেবল কুরআন-হাদীস বুঝার জন্য।
কিন্তু সময়ের চাহিদা অনুযায়ী একজন আলিমে দ্বীনের বুনিয়াদী কর্তব্য হল- আরবী বক্তব্য ও রচনাশৈলীতে দক্ষতা অর্জন করা। আর এটি ইলমী ব্যক্তিত্বের জন্য মূল স্তম্ভের পর্যায়ভুক্ত। বর্তমান যুগে মুসলিম জাহানের সঙ্গে আরব বিশ্বের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করার গুরুত্ব অস্বীকার করার জোঁ নেই। নিজেদের কথা তাদের নিকট পৌঁছানো ও তাদের কথাকে নিজেরা বুঝার জন্য এবং উপমহাদেশের ওলামায়ে কেরাম উর্দূ ভাষায় যে গুরুত্বপূর্ণ ইলমী চর্চা ও অবদান রেখে থাকেন তা প্রদর্শন করার তাগিদে আধুনিক আরবী পরিভাষা ও নিয়ম-কানুনে দক্ষতা অর্জন করা জরুরী। প্রচলিত নেসাবে কিছু কিছু পরিবর্তন হলেও এখনো পর্যন্ত তেমন উল্লেখযোগ্য ও পূর্ণাঙ্গ সংস্কার হয়নি।
দারসে নেজামীর উক্ত দূর্বলতা ইতোমধ্যেই দ্বীন দরদী ও শুভাকাঙ্খী ওলামায়ে কেরাম আঁচ করেছেন। শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র আরবী ভাষার উপর যে পরিমাণ সাধনা ও সময় ব্যয় করে থাকে, তার সিকি পরিমাণ যোগ্যতাও তাদের মাঝে সৃষ্টি হয় না, এটাই বাস্তব সত্য। আমার মতে এর মৌলিক কারণ দু’টি। প্রথমতঃ বর্তমান নেসাবের অন্তর্ভ্ক্তু কিছু কিতাব। দ্বিতীয়ত সে সকল কিতাব পাঠদানের নিয়ম-পদ্ধতি।
নাহু-সারফ
যে কোন ভাষায় গভীরতা অর্জন করতে হলে সে ভাষায় নাহু সারফ তথা গ্রামারের জ্ঞান লাভ করতে হয়। বর্তমান নেসাবে নাহু তথা আরবী গ্রামার চার বছর এবং সারফ দু’বছর ধরে শিক্ষা দেয়া হয়। সারফের প্রথম বর্ষে পড়ানো হয় ইলমুস সারফ (উর্দূ), মীযান ও মুনশাইব (ফার্সী) আর দ্বিতীয় বর্ষে ইলমুস সীগাহ (ফার্সী)। উক্ত কিতাবগুলো যথেষ্ট মুনাসিব ও উপকারী। তবে সমস্যা হল ফার্সী ভাষায়।
নাহু পড়ানো হয় চার বছরে। প্রথম বর্ষে নাহুমীর, শরহে মিআতে আমিল, দ্বিতীয় বর্ষে হিদায়াতুন্নাহু, তৃতীয় বর্ষে কাফিয়া ও চতুর্থ বর্ষে শরহে মোল্লা জামী।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ সনে লখনৌতে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রাহ.’র সভাপতিত্বে মাদরাসার নেসাব সংক্রান্ত একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতির ভাষণে তিনি একটি হৃদয়গ্রাহী আলোড়ন সৃষ্টিকারী বক্তব্য পেশ করেছেন। ভুলে গেলে চলবে না যে, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রাহ. নিজেও দারসে নেজামী পড়–য়া ছিলেন। নাহু সারফের এবতেদায়ী তা’লীম সম্পর্কে তিনি বলেন, “নাহু সারফ তথা গ্রামার একটি বুনিয়াদী বিষয়। নাহু, সারফ ছাড়া আমরা আরবী ভাষা আয়ত্ত করতে পারব না। তবে আরবী গ্রামার শিক্ষা করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান সিন্দুকে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে চাবি তালাশ করতে হবে। আর চাবি হল আরবী গ্রামার। তবে আমাদের মাদরাসাসমূহে নাহু, সারফের শিক্ষাদান পদ্ধতি সঠিক নয়। যে কাজটি স্বল্প সময়ে আঞ্জাম দেয়া যেত তার পেছনে আমরা ব্যয় করছি অনেক দীর্ঘ সময়। যার দরুণ আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। সর্ব প্রথম যে বিষয়টির প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব তা হল-ফার্সী, আরবী কোনটিই আমাদের মাতৃভাষা নয়। আমাদের পূর্বের নিয়ম ছিল আরবী গ্রামারের অভিযান শুরু হত মীযান ও মুনশাইব দ্বারা। পরবর্তীতে পড়ানো হত সারফে মীর ও নাহবেমীর প্রভৃতি। উক্ত কিতাবগুলো সে যুগে প্রযোজ্য ছিল যখন ফার্সীর চর্চা ব্যাপকভাবে সর্বত্র বিদ্যমান ছিল। কিন্তু হিন্দুস্তানে আজ ফার্সী একটি অচেনা ভাষা। মীযান মুনশাইব দ্বারা আরবীর সূচনা করা হলে একই সাথে শিক্ষার্থীর মাথায় তিনটি বোঝা চাপানো হবে। প্রথমতঃ পূর্ব সম্পর্ক ব্যতীত ফার্সীর মত একটি কঠিন ভাষা আয়ত্ত করা। দ্বিতীয়ত এমন দুর্বোধ্য কিতাবের পাঠ রপ্ত করা যেগুলোতে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সহজ-সরলভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। তৃতীয় বোঝা হল- আরবী গ্রামার তথা নাহু, সারফ আয়ত্ত করা। এভাবে একজন শিক্ষার্থীর মেধা তিনটি খাতে ক্ষয় ও বিভক্ত হয়ে যায়। ফার্সী ভাষা শিক্ষা করা, পাঠ রপ্ত করা ও আরবী পাঠের বিষয়বস্তু মাসায়েল বুঝা।
উপরোক্ত পদ্ধতির বিপরীতে যদি তার মেধা ও স্মৃতিকে কেবলমাত্র একটি খাতে অর্থাৎ নাহু, সারফ আয়ত্ত করার পেছনে ব্যয় করা হত, তবে শিক্ষার্থী অবশ্যই আরবী ভাষায় গ্রামারে আরো বেশি পারদর্শিতা ও গভীরতা অর্জন করতে সক্ষম হত। অতএব আরবী নাহু, সারফ ও অন্যান্য উপকরণিক বিষয়াদির প্রাথমিক কিতাব মাতৃভাষায় হওয়া বাঞ্ছনীয়। যাতে একই সময়ে শিক্ষার্থীকে ভাষা আয়ত্ত, পাঠ রপ্ত ও বিষয়বস্তুতে দক্ষতা অর্জন করার ত্রিমুখী চাপের শিকার না হতে হয়। (খুতুবাতে আযাদ)
সম্ভবত একারণেই অনেক মাদরাসায় নাহবেমীরের পরিবর্তে ইলমুন নাহু (উর্দূ) পড়ানো হয়। ইতোমধ্যে নাহবেমীরের আরবী অনুবাদও হয়েছে। তৎসঙ্গে আরো কিছু অনুশীলনী যোগ করে নেসাবভুক্ত করা হলে তুলনামূলক ভালো ফল আশা করা যায়।
দ্বিতীয় বর্ষে নাহুর প্রসিদ্ধ কিতাব হেদায়াতুন নাহু পড়ানো হয়। কিতাবটি সংক্ষিপ্ত ও অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘ আলোচনামুক্ত এতে সুন্দর পদ্ধতিতে নাহুর নিয়ম-কানুনগুলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে উক্ত কিতাব দ্বারা তখনই পূর্ণ মাত্রায় ফায়দা হাসিল হতে পারে যখন ওস্তাদ দারসের মাঝে অপ্রাসংগিক তথা মূল বিষয় বহির্ভূত আলোচনা ও নাহুর নিয়ম-কানুন সম্পর্কে উদ্ভট তথা কৃত্রিম যুক্তির জঞ্জালে ছাত্রকে না ফেলবেন। বরং ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের দৃষ্টি কেবলমাত্র কায়দা জানা ও প্রয়োগ করার প্রতি থাকবে।
তৃতীয় বর্ষে নাহু বিষয়ের ‘কাফিয়া’ সিলেবাসভুক্ত। এটা সপ্তম শতাব্দীর প্রসিদ্ধ আলিম আল্লামা ইবনে হাজেব রাহ.’র রচনা। এ কিতাবটিকে দারসে নেজামীতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মানদণ্ড বলে ধারণা করা হয়। দারসে নেজামীতে অন্তর্ভূক্ত অন্যান্য সাধারণ মূল কিতাবগুলোর ন্যায় কাফিয়াতে এত পরিমাণ সংক্ষিপ্ততা অবলম্বন করা হয়েছে যে, মূল পাঠ সীমাতিরিক্ত জটিল ও কঠিন হয়ে গেছে। আর লেখক রাহ.’র প্রচেষ্টা ছিল কিতাবকে অতি মাত্রায় সংক্ষিপ্ত করা, চাই তাতে যত জটিলতা, হেঁয়ালী ও নিগুঢ়তাই থেকে যাক না কেন। দারসে নেযামীতে প্রবিষ্ট এ কিতাবটির গ্রহণযোগ্যতা এখনো পর্যন্ত এ পরিমাণ রয়েছে যে, তার শরাহ লেখা হয়েছে প্রায় পঞ্চাশটি। আর শত শত মূল্যবান মেধা ও উচ্চ পর্যায়ের ইলমী ব্যক্তিদের বিচরণক্ষেত্র হয়ে আছে এখনো এ কিতাবটি।
বরং বাস্তব সত্য হল কাফিয়া কিতাবটি ও তার পাঠদান পদ্ধতি (যা কাফিয়ার চেয়েও এক ধাপ বেশি জটিল) শিক্ষার্থীকে ইলমে নাহুর পথ প্রদর্শন তথা তার সাথে মুনাসাবাত, সৃষ্টির পরিবর্তে তার থেকে আরো দূরে সরিয়ে দেয়। যে ছাত্র দু’বছর যাবৎ ইলমে নাহুর শিক্ষা গ্রহণ করেছে তা বাস্তব অবস্থা এমন হওয়া উচিৎ যে এখন তার নাহুর নিয়ম-কানুনের সঠিক ব্যবহারে পূর্ণ পরিপক্ষতা অর্জিত হয়ে যাবে এবং নাহু অনুযায়ী সঠিক আরবী পঠন, লিখন ও কথনের যোগ্যতা সৃষ্টি হবে এবং যে সকল নিয়ম সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত পূর্ণ অবগতি লাভ করেনি সেগুলোকে অনুশীলন ও বাস্তবে প্রয়োগ করবে। যাতে দ্বিতীয় বর্ষে নাহুর কিতাব সমাপনকারী ছাত্র তৃতীয় বর্ষে এসে আরবী এবারত পড়া এবং আরবী বক্তব্য ও রচনাতে নাহু সংক্রান্ত ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে পারে। কেননা ইলমে নাহুর মূল উদ্দেশ্য এটিই। অথচ কাফিয়ার ছাত্র নাহুমুখী হওয়ার পরিবর্তে আল্লামা ইবনে হাজের রাহ.’র সুক্ষ্ম ও সংক্ষিপ্ত এবারত রপ্ত করা এবং তাতে সৃষ্ট অথবা কৃত্রিমভাবে আরোপিত নানা প্রশ্নের উত্তর ও শাব্দিক সুক্ষ্মতা উদঘাটনে ব্যস্ত থাকে। যার অনিবার্য ফলাফল এই দাঁড়ায় যে, কাফিয়া পড়–য়া বহু ছাত্র কাফিয়ার মতন ও তার উপর উত্থাপিত সকল প্রশ্নের উত্তর ও স্বরচিত নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যথেষ্ট পটু হয়ে থাকে (কারণ সকল শ্রম ও মেধা ব্যয় হয়েছে উক্ত কাজেই)। অথচ একটি আরবী এবারত পড়া ও লেখাতে অসংখ্য ভুল করে বসে। ভাতর উপমহাদেশের সর্বজনবিদিত ও স্বীকৃত আরবী সাহিত্যিক আল্লামা আবদুল আযীয মাইমানী রাহ. কাফিয়া ও তদনুরূপ অন্যান্য নাহুর কিতাব প্রসঙ্গে লিখেন-
“সর্বপ্রথম আমি যখন ঠিয়াওয়াড় থেকে দিল্লি এলাম, তখন তিন বছর শুধুমাত্র নাহু, সারফের প্রাথমিক শিক্ষার পেছনে ব্যয় হয়েছে। এই দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে শরহেজামীতে এসে পৌঁছলাম। পরবর্তীতে সহসা খোদায়ী তাওফীক আমাকে পথ প্রদর্শন করল। আমি অনুভব করলাম যে, আমি ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছি। অতএব, সবকিছু বাদ দিয়ে নিম্নোক্ত কিতাবগুলো ব্যাখ্যা গ্রন্থ সহকারে গভীরভাবে মুতালাআ করলাম। সারফের জন্য ‘শাফিয়া’ এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ সমূহ এবং নাহুর জন্য ‘আলফিয়াহ’ এর শরাহ সমূহ ও ‘মুফাসসালুল আশবাহি ওয়ান নাযাইরি’ ও ‘তাসহীলুল জাওয়ায়েদ’ ইত্যাদি অধ্যয়ন করলাম। মোটকথা ফুকাহা ও মানতেকীনের নাহু থেকে নিস্কৃতি পেলাম। কাফিয়ার কোন কোন ভুল মাসআলা আমাকে নাহু সম্পর্কে উদাসীন করে দিয়েছে। যেমন- মাওসুফ তার সিফাতের মুযাফ হয় না। অনুরূপভাবে সিফাত ও মাওসুফের মুযাফ হয় না। অথচ আরবী ভাষায় এ ধরণের ব্যবহার অহরহ। এ জাতীয় আরো বহু অপব্যাখ্যার দ্বার উন্মোচন করা হয়েছে। এবং অযথা একজন নাহুর ছাত্রকে অনর্থক গর্ত খনন (অর্থাৎ কৃত্রিম ও ধারণামূলকভাবে সূক্ষতা সাব্যস্ত করা) ও কোন লেখকের পক্ষ হতে আক্রমণ বা আত্মরক্ষার বেহুদা ঝামেলায় ফেলা হয়। সে সকল কিতাব সম্পর্কে কু-ধারণার অবতারনা করা হয়েছে। অথচ তা’লিবে ইলমের উদ্দেশ্য হল নিজের আরবী চর্চাকে বিশুদ্ধ করা। কারো জিম্মাদারী পালন করা তথা তার পক্ষ থেকে প্রশ্ন-উত্তর প্রদান করা নয়। মাশাহীরে আহলে ইলম কি মুহসিন কিতাবী। পৃষ্ঠা -১৬৯)
চতুর্থ বর্ষে নবম শতাব্দীর প্রসিদ্ধ বুযুর্গ মোল্লা আব্দুর রহমান জামীর লিখিত কিতাব শরহে জামী পড়ানো হয়। এটা মূলত: কাফিয়ার সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য শরাহ। তবে মূল দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্ম পদ্ধতিতে মতন ও শরাহ এক ও অভিন্ন। আল্লামা জামী রাহ.’র উক্ত ব্যাখ্যা গ্রন্থে নাহুর নিয়ম-কানুনের তুলনায় ফালাসাফা ও দর্শনের সূত্র অনেক বেশি। যেমন একটি মূলনীতি হল- “সকল ফায়েল পেশযুক্ত হবে” এখানে আরেকটি রয়েছে দর্শন। তাহল- ফায়েল কেন পেশ যুক্ত হবে? যে কোন ভাষার হেকমত তথা নিগুঢ় তত্ত্ব তালাশ করা ও তা বর্ণনা করাকে সে ভাষার দ্বিতীয় স্তরের খেদমত অবশ্যই বলা যায়। আল্লামা জামী রাহ.’র উক্ত ব্যাখ্যা গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে এ দিক থেকে অপূর্ব শৈলী ও ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু মৌলিক ও প্রাথমিক কাজ হল- মূল বিষয়ে ব্যাপক প্রজ্ঞা ও মুনাছাবাত অর্জন করা। যেমন উপরোক্ত মূলনীতি জানার পর প্রয়োজন হল তার প্রয়োগ ও অনুশীলন করা। যাতে যে কোন ফায়েল পেশ পড়ার যোগ্যতা পাকাপোক্ত হয়ে যায়। থাকল এ কথা যে, আরবীতে এটাকে কেন পেশ দেয়া হয়? এ সম্পর্কে অবগত হওয়া দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। এমন একজন ছাত্র যে আরবী নিয়ম কানুন ও কলা-কৌশল সম্পর্কে অনভিজ্ঞ; যে অনর্গল বিশুদ্ধ আরবী পড়ার যোগ্যতা এখনো অর্জন করতে সক্ষম হয়নি; যে গ্রামারের নিয়মাবলীর যথাযথ প্রয়োগের নিবিড় দক্ষতা হাসিল করতে পারেনি; যার সব থেকে বড় প্রয়োজন হল- আরবীতে পূর্ণ ব্যুৎপত্তি লাভ করা, তাকে নাহুর অন্তর্নিহিত গোপন রহস্য ও অজানা ভেদ সম্পর্কে অবগত করা মূলত: ধ্বংশপ্রায় নড়বড়ে ও টলমলে পুরাতন বিল্ডিংকে কারুকার্য ও চাকচিক্য করারই নামান্তর। যেমন- শরহে জামীর শুরুতে গিয়ে ‘হাসেল মাহসুল’র শিরোনামে ফালসাফার ধাঁচে একটি সূদীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। দারসের মাঝে উক্ত শিরোনামের অধীনে যে লম্বা-চওড়া আলোচনা করা হয় এবং ব্যাখ্যাতাগণ যে পরিমাণ উদ্দীপনা সহকারে এ আলোচনার ফালসাফা সূলভ ব্যাখ্যার নামে সুদীর্ঘ বিবৃতি পেশ করে থাকেন, তাতে মধ্যম স্তরের দূরের কথা উচ্চ স্তরের মেধাবী ছাত্রদের দেমাগ তথা মস্তিষ্ক পর্যন্ত উল্টে-পাল্টে যায়। হায় আল্লাহ! এর কিই বা উদ্দেশ্য? কিউ বা লাভ? অথচ এ সকল বিষয়কেই সহজভাবে উপস্থাপন করা যেত, আর অনেকে তা করেছেনও বটে। এসব দেখে অনিচ্ছাকৃতভাবে মুখে এসে যায়-
“কথা সামান্যই ছিল, কিন্তু অনারবদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও যোগ্যতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের বিলাসিতাই তাকে দীর্ঘায়িত করেছে।”
সমকালীন জনৈক বিজ্ঞ আলিম হাছেল মাহফুলের ব্যাখ্যায় পূর্ণ চারশত পৃষ্ঠা বিশিষ্ট একটি কিতাব রচনা করেছেন। এ থেকে খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে, তা কি পরিমাণ তুমুল মতবিরোধপূর্ণ আলোচনা। এটি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, এ জাতীয় সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিষয় ও অন্তর্নিহিত গোপন রহস্যাবলী তথা অজানা ভেদ কেবল মাত্র এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তথাপি তাদের ক্ষেত্রেও শুধু অধ্যয়নের জন্য থাকতে পারে। দ্বিতীয় পর্যায়ের এ সুক্ষ্মদর্শী বিষয়টিকে সাধারণ নেসাবভুক্ত করার ফায়দা অপ্রতুল।
শরহে জামীতে এসে তালিবে ইলম তার পূর্ণ শক্তি-সামর্থ ও মেহনত-মুজাহাদাকে নিয়ম-কানুনের ফালাসাফাসূলভ আলোচনার পেছনে উজাড় করে দেয়।
“আর তারা ধারণা করে যে তারা সৎকর্মে লিপ্ত।” শায়খুল আদীব মাওলানা এযায আলী রাহ. এ কথাটি অত্যন্ত দরদ ও ব্যথার সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন-
“হিন্দুস্তানের মাদরাসা শিক্ষার্থীদেরকে মূল্যবান জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ব্যয় করতে হয় ইলমে নাহু ও সারফের পেছনে। এ জন্য তাদেরকে সীমাহীন কষ্ট ক্লেশ ও পরিশ্রম করতে হয়। কুরআন হেফজের ন্যয় কণ্ঠস্থ করতে হয় নাহু, সারফের বহু কিতাব। এতদসত্ত্বেও তারা মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। কেননা নাহু, গারফের উদ্দেশ্য হল শব্দের উৎপত্তি জানার পর আরবী ভাষায় গ্রামার ও ব্যাকরণগত ভুলভ্রান্তি হতে নিরাপদ থেকে নিজের ভাব প্রকাশ করতে পারা। অথচ সত্য কথা হল- এই লক্ষ্যে তারা পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি। অতএব, ইলমের উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার দরুণ সে উক্ত বিষয়ে মূর্খই থেকে গেল। কারণ কোন কিছুর অর্জন সাব্যস্ত হয় কেবল তখনই যখন তার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়।” (আল ফারাসা মুকাদ্দামায়ে দেওয়ানে হামাসা-৮)
আরব বিশ্বে সর্বজন বিদিত ও স্বীকৃত আলিম এবং মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.’র ভাষায় বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আরবী সাহিত্যিক, শায়খ আলী তানতাবী স্বরচিত ‘ফিকর ও মাবাহেছ’ গ্রন্থে ‘নাহু আরবী ভাষার সব থেকে বড় সমস্যা’ শিরোনামে, ইলমে নাহুর সুক্ষ ও জটিল বিষয়াদি সম্পর্কে লিখেন-
“অপ্রয়োজনীয় আলোচনা এবং অযথা ব্যাখ্যাদির ফলে ইলমে নাহু ফলহীন বৃক্ষে পরিণত হয়ে আছে। যুগ যুগ ধরে ইলমে নাহুর দারস-তাদরীস তথা অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় লিপ্ত, দিন-রাত নাহুর যাবতীয় মাসাঈলের জটিলতা নিরসন ও কঠিন তথা দুর্বোধ্য এবারত রপ্তকরণে অভ্যস্ত থাকা সত্ত্বেও ভাষাগত বিশুদ্ধতা এবং নির্বিঘ্নে নিজের মনোভাবকে আরবীতে প্রকাশ করার মত মূল্যবান সম্পদ হস্তগত হয় না। আমি নাহুতে অভিজ্ঞ এমন কয়েকজন ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অবগত আছি যে, তাঁরা নিজ জীবনের মূল্যবান একটি অংশ ব্যয় করেছেন নাহুর পেছনে। তাতে নাহুবিদদের মাযহাব ও মতামত সম্পর্কেও যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছেন। সংশিষ্ট সকল জটিলতা ও সুক্ষ্মবিষয়াদীতে দক্ষতা অর্জন করেছেন। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যাচাই-বাছাই ও বিতর্ক-বাহাসেও যথেষ্ট দূরদর্শিতা অর্জন করেছেন। এতসব গুনাগুনের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কোন আরবী বাক্য বুঝা বা এক পৃষ্ঠা আরবী এবারত পড়ার মত সামর্থ তাঁদের ছিল না। আরবীতে কোন বয়ান-বক্তৃতা বা ওয়াজ-নসীহত করাও ছিল তাদের পক্ষে দুষ্কর।
ইলমে নাহুর উত্থানের যুগে একটি প্রচলন ছিল, তা হল সাধ্যমত রচনায় সংক্ষিপ্ততা, মূল পাঠে অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা, মাসায়েলে সুক্ষ্মদর্শিতা ও গোপনীয়তা ইত্যাদিকে কিতাব মূল্যায়নের মাপকাঠি এবং রচয়িতার পাণ্ডিত্য ও যোগ্যতার মানদণ্ড বলে বিবেচনা করা হত। যে সকল কারণে ইলমে নাহু বিপন্ন হতে চলছে। তন্মধ্যে একটি কারণ হল- আরবী ভাষায় ব্যবহৃত সকল শব্দের কারণ দর্শানো ও হেতু উদঘাটন করার পেছনে পড়া এবং অনুরূপভাবে সকল মানসুব-মাজরুরের (তথা যবর ও যের বিশিষ্ট বাক্যের) মধ্যে কোন না কোন তত্ত্ব বা গুপ্ত ভেদ প্রমাণ করা। চাই তাতে যতই দূরবর্তী ও অযৌক্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের আশ্রয় নেয়া হোক না কেন। (ফিকর ও মাবাহেছ পৃ.-৪)
কাফিয়া, শরহে জামীর স্থলে শরহে ইবনে আকীল, আওযাহুল মাছালেক, আল কাতরুন্নাদা, আননাহবুল ওয়াফীও এ জাতীয় অন্যান্য কিতাবকে নেসাবভুক্ত করা হলে বরং তাতে তুলনামূলকভাবে আরো ভালো ফলাফলের আশা করা যায়। আর যদি কাফিয়া, শরহেজামীকে আবশ্যক মনে করা হয়, তবে অন্ততপক্ষে পাঠদানের প্রচলিত ধারা পাল্টানো অপরিহার্য। কারণ, তাতে অযথা প্রশ্নোত্তর ও জঞ্জালের মাধ্যমে মেধা ও মূল্যবান সময় নষ্ট হয়।
আরবী সাহিত্য ও রচনা
আরবী সাহিত্য ও রচনার যে সকল কিতাব প্রচলিত নেসাবে পড়ানো হয়, আমার মতে তা যথেষ্ট উপযোগী ও ছন্দোবদ্ধ। কাসাসুন নাবিয়্যিন, আল কেরাতুর রাশেদা, নফহাতুল আরব, মাকামাতে হারীরী, দেওয়ানে মুতানাব্বী, দেওয়ানে হামাসা, সাবআ মুআল্লাকা, মোআল্লিমুল ইনশা ও আল উসলুবুস সহীহ লিল ইনশা ইত্যাদি পাঁচ-ছয় বছর যাবৎ স্বতন্ত্র ঘণ্টায় পড়ানো হয়। কিন্তু এর পরেও আরবী আদবের প্রতি ছাত্রদের মনোযোগ ও স্পৃহা পরিলক্ষিত হয় না।
আর আরবী রচনা চর্চা অধিকাংশ মাদরাসায় নামেমাত্র রয়েছে। ছাত্র তো দূরের কথা; শিক্ষকরা অবধি এতে দুর্বল। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষভাবে যতœবান হলে ছাত্রদের দুর্বলতা ও অনীহা কিছুটা দূরীভূত হবে ইনশাআল্লাহ।
১. আরবী বক্তব্য ও লেখনীসহ বহুমূখী সাহিত্য চর্চার জন্য জামাত ওয়ারী সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আসাতিযায়ে কিরাম সে সকল সংগঠনে কেবলমাত্র উপদেষ্টার ভূমিকাই পালন করবেন না; বরং নিজেরাও তাতে অংশগ্রহণ করে আন্তরিকতার পরিচয় দেবেন। মাঝে মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বক্তব্য ও লেখনীতে যোগ্যতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনকারী ছাত্রদের মাঝে পুরষ্কার বিতরণের মাধ্যমে তাদেরকে আরো উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত করে তুলতে হবে। মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষকগণ পালাক্রমে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে এর গুরুত্ব ও মহত্ব তুলে ধরবেন। এভাবে মেহনত করা হলে ছাত্রদের মাঝে আরবী বক্তৃতা ও লেখনীর এক অদ্ভুত জযবা সৃষ্টি হবে। কোন কোন মাদরাসাতে আরবী চর্চার জন্য এ জাতীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এবং আসাতিযায়ে কেরামের পক্ষ হতে উৎসাহ-উদ্দীপনা যোগানোর অভাবে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। বরং প্রভাতের প্রদীপের ন্যায় এ ঔজ্জ্বল্য ও জাকজমকতা কিছুদিন পর নিজে নিজেই নি®প্রভ হয়ে যায়। অধিকাংশ আসাতিযায়ে কেরাম বিষয়টির প্রতি ততটা ভ্রুক্ষেপ না করার প্রধান কারণ হল- তাঁরা নিজেরাই আরবী সাহিত্য চর্চার সাথে খুব একটা সম্পৃক্ত নন। তথাপি তাঁদের উক্ত অনীহার প্রতিকার করা হলে এবং শিক্ষা কার্যক্রম বিষয়টির প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করলে এ জাতীয় সংগঠন যথেষ্ট ফায়দা বয়ে আনবে।
২. কওমী মাদরাসাসমূহে আরবী পত্র-পত্রিকা পড়ার প্রবণতা একেবারেই নেই। আধুনিক আরবীতে নিয়ম-নীতি ও যুগজিজ্ঞাসার সঙ্গে পরিচিতি লাভের স্বার্থে ইসলামী মানসিকতাসম্পন্ন, মানসম্মত পত্রিকা ও সাময়িকী অধ্যয়ন করা কেবল উপযোগীই নয়, জরুরীও বটে। কেননা যে কোন ভাষা চর্চা ও তার বহিঃপ্রকাশ পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে যতটুকু হয় অন্য কোন পন্থায় তা সম্ভব নয়। প্রখ্যাত আরবী সাহিত্যিক মোফাক্কেরে ইসলাম হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. নিজ শিক্ষা জীবনের স্মৃতিচারণের এক পর্যায়ে পত্র-পত্রিকার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে লেখেন; আরবী ভাষার সুবিশাল ভান্ডার সর্বকালেই উন্মুক্ত ছিল। যুগ-যুগান্তরে সাহিত্যিকগণ পত্রিকার মুক্তাঙ্গনে তা বিতরণ করে আসছেন। আমীর শাকীব আরছালানের ভাষ্য হল- “আব্বাসীয় শাসনামলে একজন আরবী সাহিত্যিক যুগ যুগ ধরে যে পরিমাণ লিখতেন, বর্তমান কালের সাহিত্যিক ও সাংবাদিকগণ তা কয়েকদিনেই লিখে থাকেন।” বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় আমি পত্রিকা পড়তে আরম্ভ করলাম এবং তা দ্বারা এমন যে উপকার হয়েছে এবং অভিব্যক্তি ও ভাব প্রকাশের সামর্থ অর্জিত হয়েছে তা আরবী সাহিত্যের কোন কিতাব এমনকি সকল কিতাব হতেও অর্জিত হয়নি।” (মেরী ইলমী ও মুতালাআতী যিন্দিগী; পৃ-৬০)
মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এমনিতেই ছাত্রদেরকে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকেন। লাইব্রেরীতে শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন কিতাবাদির এন্তেজাম করে থাকেন। সে সাথে কিছু পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিন-সাময়িকীর ব্যবস্থা থাকলে এর জন্য পৃথক কোন ঝামেলা পোহাতে হবে না। তবে পত্রিকা নির্বাচনে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন এমন গবেষণাধর্মী পত্রিকা চয়ন করা হয় যা ছাত্রদেরকে চিন্তাশীল করে গড়ে তোলে। বলিষ্ঠ ও গভীর আরবী সাহিত্যের সঙ্গে যুগের পট পরিবর্তন তথা পারিপার্শ্বিক বিষয়াদির সমন্বিত পত্রিকা নির্বাচন করতে হবে। যাতে মানসিকতা ও চিন্তা-চেতনার উৎকর্ষতা সাধিত হয়। এ জাতীয় পত্রিকার মধ্য হতে ‘আল আ’সুল ইসলামী, আর রা-ইদ, আদ-দাঈ, আর-রাবেতা, আদ-দাওয়াহ, আল মোজতামা, আল-বালাগ, আল-মুসলিমূন’ প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।
মা’আনী ও বালাগাত
মা’আনী বালাগাত শাস্ত্রে আল্লামা তাফতাযানী রাহ.’র লিখিত ‘তালখীসুল মিফতাহ’র ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মুখতাসারুল মা’আনী ও মুতাওয়্যাল’ সিলেবাসের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু বাস্তব কথা হল এ বিষয়টি আয়ত্বের জন্য উক্ত দুই কিতাব যথেষ্ট নয়। যে কোন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ফায়দা হাসিল করতে হলে নিতান্তপক্ষে সে বিষয়ের প্রাথমিক কিছু কিতাব পড়াতে হবে। যাতে শুধুমাত্র নিয়ম-কানুনের বাস্তব ব্যবহার ও দৃষ্টান্তের সমাবেশ থাকে। এর জন্য দুরুসুল বালাগাত ও আল বালাগাতুল ওয়াজেহা অত্যন্ত ফায়দাজনক। ‘মুখতাসারুল মা’আনী ও মুতাওয়্যাল’ মুসলিম বিশ্বের ইলমী অধঃপতনের যুগে লেখা হয়েছে। উক্ত কিতাব দু’টি ঐ সকল রচনার অন্তর্ভূক্ত যাতে শব্দগত সুক্ষ্মতা ও এবারতের জটিলতা তথা মারপ্যাঁচকে সৌন্দর্য-পরাকাষ্ঠা ও নৈপূণ্যের মানদণ্ড বলে ধারণা করা হত। নিঃসন্দেহে তা গভীরতা এবং সুক্ষ্মদর্শীতায় নৈপূণ্য অর্জনের জন্য যথোপযুক্ত কিতাব, তবে তা দ্বারা অলংকার শাস্ত্রের ব্যবহার ও বিষয় সম্পর্কিত আলোচনায় প্রজ্ঞা অর্জিত হতে পারে না। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রাহ.’র ভাষায় “আল্লামা তাফতাযানী একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর লিখিত কিতাব ও ব্যাখ্যা গ্রন্থ সে যুগে জনপ্রিয় ছিল। এ যুগেও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করেছে। তার কারণ হচ্ছে ইসলামী শিক্ষার উন্নতি-অগ্রগতির যুগ শেষ; মানসিক বিপর্যয় আরম্ভ হয়েছে। এ কিতাবগুলো দ্বারা ছাত্রদের এক ধাপ উন্নতি হওয়ার পরিবর্তে এক ধাপ অবনতি ঘটবে। আমার বিশ্বাস- আরবী আদব ও বালাগাতের লম্বা, চওড়া ও দীর্ঘ কিতাবাদি যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করেছে।”
হযরত বিন্নুরী রাহ.’র একটি প্রাণবন্ত পর্যালোচনা
কওমী মাদরাসা সমূহে অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তা হল- যে কোন বিষয়ের সহজ-সরল কিতাবগুলোর স্থলে সংক্ষিপ্ত, দূর্বোধ্য অথবা মানতেকী ধাঁচে লেখা কিতাবাদিকে গুরুত্বের নজরে দেখা হয়। আসাতিযায়ে কেরাম ও তালাবা সবাই সে কিতাবগুলো পড়া, সেগুলোর পেছনে মেহনত মুজাহাদা করা এবং মনোসংযোগ স্থাপনে পূর্ণ শক্তি ব্যয় করে থাকে। আর সহজ সরলভাবে লিখিত ফায়দাজনক কিতাবাদির খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না।
এখন আর আগের মত মেধা সম্পন্ন ছাত্র পাওয়া যায় না। তথাপি আরেকটি সমস্যা যোগ হয়েছে। তা হল ফালসাফার কঠিন কিতাবগুলো অধিকাংশ ছাত্রের বোধগম্য হয় না। পাশাপাশি সহজ কিতাবগুলোর প্রতি তেমন কোন গুরুত্বারোপ ও ভ্রুক্ষেপ না করার ফলে ছাত্ররা পাঠ্য বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না।
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা ইউসূফ বিন্নুরী রাহ. দারসে নেজামীতে সিলেবাসভুক্ত সংক্ষিপ্ত, দূর্বোধ্য ও কঠিন ধাঁচে লেখা কিতাবগুলোর উপর একটি মূল্যবান আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন-
“কওমী মাদরাসাসমূহের নেসাবে তা’লীমকে সংস্কার, নবায়ন ও সংশোধন করা অতিজরুরী। বর্তমান নেসাব যে যুগে প্রণয়ন করা হয়েছিল সে যুগের জন্যই সঙ্গত ও যথার্থ ছিল। তখন তা থেকে কাঙ্খিত ফলাফল হাসিল হয়েছে। তবে যুগের চাহিদা পরিবর্তন হয়ে গেছে। রুচি ও মানসিকতা পাল্টে গেছে, চিন্তা-চেতনায় নতুনত্বের সৃষ্টি হয়েছে। সুক্ষ্ম ও কঠিন এবারত রপ্ত করার মত যোগ্যতা বিলুপ্ত হতে চলেছে। এখন আধুনিক ও সাধারণ বিষয়াদির সংযোজন অপরিহার্য।”
বর্তমান মাদরাসা নেসাবে যে সকল কিতাব পড়ানো হয় তন্মধ্যে হাদীস ও ফেকাহর কিছু কিতাব ব্যতীত অধিকাংশ কিতাবই হিজরী সপ্তম শতাব্দী ও তার পরবর্তী যুগের স্মৃতিস্মারক। সে সকল যুগ হতেই মূলত বাস্তবিক পতন শুরু হয়েছে। পূর্বসূরী আকাবিরের লিখিত কিতাবাদিতে ইলমের রূহ ও প্রাণ ছিল। সেগুলোর এবারত ছিল সহজ সরল প্রস্ফুটিত ও উন্মুক্ত। বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও নিয়ম-কানুন ছিল সুস্প।” তাতে এবারতের মারপ্যাচ ও জটিলতা ছিলনা। ছিল না অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্ছিত কোন আলোচনা। বরং সে সকল কিতাব অধ্যয়ন করলে প্রকৃত অর্থে অকৃত্রিমভাবে মন ও মস্তিষ্ক প্রভাবিত হত। তাতে হত না সময়ের অপচয় বা মস্তিষ্কে অবাঞ্ছিত বোঝা আরোপিত হওয়ার আশংকা।
প্রাথমিক যুগের সে সকল সোনালি রচনাবলীর স্থলে এমনসব কিতাবাদি লেখা হয়েছে যেগুলোতে সীমাবদ্ধতা ও সংক্ষিপ্তকরণকেই পাণ্ডিত্বের মাপকাঠি বলে ধারণা করা হয়েছে। শব্দগত আলোচনার উপর জোর দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় যোগ্যতার মানদণ্ড মনে করা হয়েছে এমন রচনা প্রণয়নকে যার দুর্বোধ্যতা ও জটিলতার দরুণ ব্যাখ্যাগ্রন্থ এবং হাশিয়ার প্রয়োজন হয় এবং কয়েকটি বিশেষণ ব্যতীত সেগুলো বোধগম্য হয় না। পরিশেষে এটাকে ইলম নিয়ে বিলাসিতা ও কৌতুক ছাড়া আর কী-ই-বা বলা যেতে পারে? আমার সাধারণ মত হল- এটাই ছিল ইলমের জন্য সব থেকে বড় ফেৎনা। এ মানসিকতার দরুণ ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবচে বড় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ধরুণ, কোন বিষয়কে বিস্তারিতভাবে ব্যক্ত করতে প্রয়োজন ছিল কয়েক পৃষ্ঠা। সেখানে কাগজ বাঁচিয়ে মাত্র এক পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হল। এতে সময় ও কাগজের যথেষ্ট সাশ্রয় হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে শিক্ষকের প্রয়োজন হল এক ঘণ্টা। এজন্য পেশ করতে হয়েছে ভূমিকা স্বরূপ অনেক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। অথচ কিছুক্ষণ পর সকল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মাথা থেকে উড়ে গিয়ে জটিল ও শূণ্য দিগন্তে পরিণত হয়েছে। উক্ত পদ্ধতির বিপরীতে যদি একই বিষয়কে দু’পৃষ্ঠায় প্রকাশ করা হয়; আর তাতে সাধারণভাবে নজর বুলাতেই বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম হয়ে যায়, তবে কোন পদ্ধতিটি ভালো? ব্যাপারটি এমন হয়েছে যে, আমরা সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে কাগজের প্রতি দয়াপরবশ হলাম তথা কাগজ বাঁচালাম কিন্তু মস্তিষ্কের ন্যায় সুক্ষ্ম ও কমনীয় পদার্থ এবং মেধার ন্যায় অমূল্য সম্পদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করলাম। ইবনে দাকীকুল ঈদ, ইযযুদ্দীন ইবনে আবদুস সালাম, ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কায়্যিমের ন্যায় যুগশ্রেষ্ঠ ও ইতিহাসের দুর্লভ মুহাক্কিক তথা গবেষক ও বিশ্লেষকগণ এ সকল জটিল কিতাব অধ্যয়ন করে এক বড় বিচক্ষণ ও মূল্যবান রত্মে পরিণত হয়েছেন? এ সকল বুযুর্গদের লিখিত কিতাবাদিতে কি পরবর্তী বা পূর্ববর্তীদের জটিলতা ও অস্পষ্টতার লেশমাত্র ছিল? অনেক সূদীর্ঘ আলোচনা! অত্যন্ত দুঃখজনক অধ্যায়!”
আধুনিক দর্শন শাস্ত্র
মাদারিসে কাওমিয়ার প্রচলিত পাঠ্যসূচিতে আধুনিক দর্শন শাস্ত্রের কোন কিতাব অন্তর্ভূক্ত নেই। মাদরাসাগুলোতে সাধারণত শরহে আক্বাইদ, খেয়ালী ও শরহে মাওয়াকেফ পড়ানো হয়। এ কিতাবগুলো মুসলিম বিশ্বের উপর বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণের ফলে সৃষ্ট আক্বীদা বিশ্বাসের নিত্য নতুন ইলমী ও গবেষণামূলক আলোচনায় পরিপূর্ণ। নিঃসন্দেহে এটি সে যুগের মুসলিম দার্শনিকদের বড় সাফল্য যে, তাঁরা গ্রীকদর্শন কর্তৃক নির্মিত মূলনীতির হাতিয়ার দ্বারা তাদেরই প্রাসাদে কঠোর আঘাত হেনেছেন, এতে গ্রীকদর্শনের মহল শুধুমাত্র প্রকম্পিতই হয়নি। বরং এমন জীর্ণ ও বিধবস্ত হয়েছে যে, তা আজ কেবল প্রাচীন কালের স্মৃতি ও পুরাকীর্তি হয়ে আছে। এ জন্যই সেকালের মুসলিম দার্শনিকদের রচনাবলীতে ফালসাফার জটিলতা, জঞ্জাল ও গ্রন্থির আধিক্যতার দরুণ অনেক সময় নির্ণয় করা দুষ্কর হয়ে পড়ে যে, এটি ফালসাফার কিতাব নাকি ইলমে আকায়েদের। এখন ইসলাম গ্রীক দর্শনের বুদ্ধিবৃত্তিক হামলার আশংকামুক্ত। অনুরূপভাবে আক্বাইদের পুরাতন কিতাবসমূহে মুসলিম দার্শনিকগণ যে সকল বাতিল ফেরকাকে তাড়া করেছেন তার অধিকাংশ সম্প্রদায়ের উত্থান-পতনের যুগ আজ কালের কুয়াশাচ্ছন্ন ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। এখন বেদীন-বদদ্বীনের আস্তাকুড় হতে নিত্যনতুন সম্প্রদায় জন্ম নিয়েছে। আধুনিক জীবনদর্শন সৃষ্টি হয়ে বিকশিত হতে চলেছে। জীবনযাত্রার মহাসংগ্রামে সকল আলোচিত দর্শন সম্পূর্ণ আবেগ, অনুরাগ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজ অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। তন্মধ্যে পশ্চিমা জীবনদর্শন নিজের পূর্ণশক্তি সামর্থ উজাড় করে এবং যোগানদাতাদের সাহায্যে মুসলিম বিশ্বে আক্রমণ চালাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের উপর গ্রীকদর্শনের বিধ্বংশী হামলার মোকাবেলায় সে যুগের মুসলিম দার্শনিকগণের ভূমিকায় আজ কে অবতীর্ণ হবে? সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে কে? এ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে কে? প্রচলিত নেসাবে এমন কোন বিষয় নেই যা অন্তত সে দায়িত্ব পালনে সহায়ক হবে। পশ্চিমা জীবনদর্শনের সে তুফান কি আজ ওলামায়ে কেরামের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না?
মাদরাসা কর্তৃপক্ষের নৈতিক ও গুরুদায়িত্ব হল- ছাত্রদেরকে সমকালীন জীবন দর্শনের সঙ্গে পরিচিত করা। তাদের মাঝে ইসলামী জীবনদর্শনের গুরুত্ব-মর্যাদা ও সর্বকালে তার উপযোগিতাকে বাস্তবদর্শনের আলোকে অভিজ্ঞতা ও যুক্তির নিরিখে প্রমাণ করার যোগ্যতা ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করা। তালিবে ইলমদেরকে এভাবে গড়ে তোলা যাতে তারা উভয়মূখী অধ্যয়নের মাধ্যমে প্রচলিত সকল জীবনদর্শনের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে পারে। লেখনী ও বক্তব্য বিশ্লেষনের দ্বারা জনগণকে সজাগ করতে পারে। এ কার্যক্রমে আমরা যতদূর পিছিয়ে থাকব বাতিলদর্শনের জাল ততবেশি বিস্তার লাভ করবে। এর জন্য প্রথমতঃ আধুনিক দর্শন শাস্ত্রের কিতাবাদিকে নেসাবভুক্ত করতে হবে। হুসাইন ইবনে জিসর ত্বারাবলিসী কর্তৃক রচিত ‘আর রেসালাতুল হামীদা’ এবং হাকীমুল উম্মত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানবী রাহ.’র ‘আল এন্তেখাবাতুল মুফীদাহ’ ও এ জাতীয় কিতাবাদি ও ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট সহায়ক হবে।
লিখনী শক্তি সৃষ্টি করার প্রয়োজনীয়তা
দ্বিতীয়তঃ রচনা সম্পাদনা তথা লিখনী যোগ্যতা অর্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে ছাত্রদের মাঝে চেতনা ও জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। কওমী মাদরাসার ছাত্ররা বক্তব্যে মোটামুটি পারদর্শী থাকলেও ক্ষুরধার ও মর্মস্পর্শী লেখনীতে অধিকাংশই দূর্বল। এর কারণ হচ্ছে মাদরাসাসমূহে লেখালেখির প্রতি আগ্রহের অভাব। ফলে ইসলাম বিরোধী প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের দীক্ষায় দীক্ষিত কারো পক্ষ হতে ইসলামের অপরিবর্তনশীল কোন বিধানকে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার দাবী সম্বলিত কোন লেখা প্রকাশিত হলে তার জবাব দেয়ার মত কোন আলিম-ওলামাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সকল বাতিলপন্থী লেখকের মোকাবেলায় এমন লোকদেরকে কলম ধরতে দেখা যায় যারা নিজেরাই ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে অনেকাংশে দূর্বল বা অজ্ঞ। তারা রীতিমত ইসলামী জ্ঞানার্জন করতে না পারলেও কেবলমাত্র নিজের ব্যক্তিগত অধ্যয়ন ও লেখনী শক্তি এ দুই হাতিয়ার নিয়ে ইসলামের পক্ষে প্রতিরক্ষার সাইডে মজবুত অবস্থান নিয়েছে। আর যেহেতু তারা রীতিমত কোন ওস্তাদের মাধ্যমে ইসলামের দীক্ষা অর্জন করেনি, ফলে ইসলামী শিক্ষার বুনিয়াদী বিষয়াদির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা নিজেরাই পদঙ্খলনের শিকার হয়। আর সাধারণ মুসলমান তাদের ইসলামের রক্ষক তথা ধারক-বাহক ধারনা করে তাদের গোমরাহী ও ভ্রান্তি সম্বলিত সকল লেখনীকে গ্রহণ করে নেয়। অতএব, দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত মাদরাসা ছাত্রদেরকে লেখালেখির জগতে প্রত্যয়ের সাথে অগ্রসর হতে হবে। প্রায় সকল মাদরাসা হতেই মাসিক ও বার্ষিক সাময়িকী প্রকাশিত হয়। এ সকল পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে ছাত্রদেরকে লেখালেখির প্রতি উদ্যোগী করে গড়ে তোলা যেতে পারে। এ সকল প্রকাশনার পক্ষ হতে তাদের লিখিত বিষয় ভিত্তিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করে উৎসাহ উদ্দীপনা যোগান দিয়ে রীতিমত লেখার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হলে কিছু কলমসৈনিক তৈরি হবে বলে আশা করা যায়।
বড়ই পরিতাপের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, এ সকল পত্র-পত্রিকাগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ছিল। অথচ তা কাজে লাগিয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ বা ফলপ্রসূ কার্য সাধন করা হচ্ছে না। উদ্বুদ্ধ করার পরিবর্তে উৎসাহ নষ্ট করার পরিবেশে কোন যোগ্য ব্যক্তিত্বের যোগ্যতার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে না। এটা চিরন্তর সত্য ও বাস্তব যে, যোগ্য ব্যক্তিত্বকে যদি কেউ পেছন হতে উৎসাহ প্রদান করে সম্মুখে অগ্রসর না করেন, তবে তার সকল যোগ্যতা ও কার্যকারিতার গতি মন্থর ও আড়ষ্ট হয়ে যায়। উৎসাহের প্রাতঃবায়ু চলমান হলে যোগ্যতার কলি প্রাণবন্ত ও সজীব হয়। কলম সৈনিক ওলামায়ে কেরামের প্রতি লক্ষ্য করুন! তাঁরা লেখালেখির ময়দানে অগ্রগামী হয়েছেন তখনই, যখন তাদের মেহনত মুজাহাদার সঙ্গে উৎসাহ-উদ্দীপনা যোগ হয়েছে। মাওলানা সায়্যিদ সুলায়মান নদভী, মাওলানা মানাযের আহসান গীলানী, মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী, মাওলানা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. প্রমুখ কলমযোদ্ধাগণ প্রাথমিক যুগে কোন না কোন মুরুব্বির উৎসাহ পেয়েছেন। আর তখনই অবিরামগতিতে সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে শুরু করেছেন, দীর্ঘায়িত হওয়ার ভয় না থাকলে এ সকল মনীষীর জীবনের উক্ত দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতাম। মাদরাসার উচ্চপদস্থ আসাতিযা, ধর্মীয় পত্র-পত্রিকার সম্পাদক ও ব্যবস্থাপকগণ নিজেদের নেগরানিতে যোগ্য ছাত্রদেরকে উৎসাহ প্রদান এবং বিষয় ভিত্তিক লেখালেখির অনুশীলনের মাধ্যমে তাদেরকে অগ্রসর করার প্রতি যতœবান হলে খুব অল্প সময়ে যুবক শ্রেণীর একঝাঁক কলম সৈনিক তৈরি হতে পারে। কিন্তু তা কেবল তখনই সম্ভব, যখন শিক্ষকগণ লেখালেখির গুরুত্ব অনুধাবন করবেন। এবং ছাত্রদের প্রতি সহানুভুতিশীল হবেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের উন্নত অগ্রগতি আগ্রহ ও জযবা বিদ্যমান থাকবে।
আধুনিক অর্থনীতি ও রাজনীতি
আমার নেসাব সংক্রান্ত শেষ নিবেদন হল- আধুনিক অর্থনীতি ও চলমান বিশ্বে প্রচলিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবগতি লাভ করা প্রসঙ্গে। প্রচলিত মাদরাসা নেসাব আধুনিক অর্থ ও বাণিজ্যনীতি সংক্রান্ত আলোচনামুক্ত। ব্যবসা-বাণিজ্যের যে সকল মাসায়েল ছাত্ররা কুদুরীতে পড়ে থাকে, হুবহু সেগুলোই সমাপনীবর্ষে হাদীসের কিতাবে পড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা মোটেই জানে না যে, অর্থনীতির বর্তমান বাজারে এ সকল সাদাসিধে পদ্ধতির বেচাকেনা অপ্রতুল। নতুন অর্থ ও বাণিজ্য নীতি নিত্য-নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করেছে। সেগুলো সম্পর্কে অবগতি লাভ করা ও শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সেগুলোর বিশ্লেষনোত্তর বিধান নির্নয় করা একজন আলিমেদ্বীনের দ্বীনী দায়িত্ব। আরবীতে এ খেদমত যথেষ্ট পরিমাণ হয়েছে। উর্দূতে মাওলানা মুহাম্মদ তকী ওসমানী সাহেব রচিত ‘ইসলাম আওর জাদীদ তিজারাত ও মায়ীশাত’ নামক কিতাবটি নেসাবভুক্ত হওয়ার মত। পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাসমূহ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়াও জরুরী। এমন কোন কিতাব সিলেবাসভুক্ত হওয়া উচিত, যাতে ইসলামী রাজনীতির মৌলিক নীতিমালার পাশাপাশি নানাধরণের চলমান রাজনৈতিকধারা ও ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গেও মোটামুটি আলোচনা স্থান পেয়েছে।
উৎস : লেখাটি জামিয়া মাদানিয়া বিশ্বনাথের দস্তারবন্দী স্মারক।