শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সন্ধ্যা ৭:০২
Home / আকাবির-আসলাফ / যে সূর্যে প্রতীপ্ত বিশ্ব- সে তুমি আলেম

যে সূর্যে প্রতীপ্ত বিশ্ব- সে তুমি আলেম

ািইাযে আলেম আল্লাহওয়ালা, তিনি জগতের সূর্য, কল্যাণ ও সফলতার তিনি এক তূর্য।
দুনিয়া তো তার পিছু পিছু ছুটে, কিন্তু তার হৃদয়ে সীমাহীন জগতের কামনা ফুটে।
উলামায়ে রব্বানী বাহারী জীবনের লিপ্সা করেন না, খানা-দানা, পোশাক-আশাক চাকচিক্যের ইপ্সা করেন না। এই সব ব্যাপার তাদের কাছে মূখ্য নয়, জমকালো জীবনযাত্রার প্রতি তাদের উৎসুক্য নয়। তাদের তরিকা হলো মধ্যবর্তিতা, তাদের রীতি হলো বুজুর্গদের অনুবর্তিতা। জীবন যাপনে নিম্নমানই বরং তাদের পছন্দ, খাহেশাতের বিরোধিতার মাধ্যমেই তাদের জীবনে আসে ছন্দ। আল্লাহর নৈকট্যই তো তাদের চাওয়া, ফলে এই চাহিদার জলধারায় তাদের নিয়ত: নাওয়া। এরই সীমানায় তাদের বাঁচা-মরা। এখানে শুধুই শুদ্ধি-সুস্থতা; নেই কোনো জরা। এখানে যে যত বেশি গোসল সারবেন, তিনিই সাফল্যের মঞ্জিল মাড়াতে পারবেন। তার মর্যাদা বেড়ে যাবে আল্লাহওয়ালাদের কাছে, তার গতিশীলতা বাড়তে থাকবে খোদার সকাশে।
শায়খ আব্দুল্লাহ খাওওয়াস রহ. এক বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটি তার শায়খ আবু হাতেমের রহ.। শায়খ আব্দুল্লাহ খাওওয়াস রহ. বলেন- মুলকে রায় থেকে আমরা রওয়ানা দিলাম, কাফেলায় ৩২০ জন ছিলাম। একজন গুরু-বাদবাকি শিষ্য, হজ্বই ছিলো আমাদের উদ্দেশ্য। দলটি ছিলো তাওয়াক্কুলকারীদের; যাদের কোনো ছামানই নেই, খানা-দানা, আত্মরক্ষা ইত্যাদি ব্যাপারে বাহ্যত তাদের কোনো আমানই নেই। শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ভরষা করে কাফেলা এগুচ্ছে, পথ-প্রান্তর, বন-বাদাড় একে একে পেরুচ্ছে। পৌঁছলাম এক শহরের দ্বারপ্রান্তে, অনেকেই এলেন আমাদের অবস্থা জানতে। এক ব্যবসায়ী রাতের মেহমান হিসেবে আমাদের দাওয়াত করলেন, গোটা কাফেলাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বাড়ীর পথ ধরলেন। লোকটির বাড়ীতে গিয়ে বোঝা গেলো তিনি যথেষ্ট বিত্তের অধিকারী, রাতের মেহমানদারীতে বোঝা গেলো তিনি প্রশস্ত চিত্তের অধিকারী। সকালে সূর্য উঠলো, আলো ফুটলো। ব্যবসায়ী হযরত হাতেমকে বললেন-হুজুর! এখানে একজন আলেম রয়েছেন, দীর্ঘদিন তিনি অসুস্থতার যন্ত্রণা সয়েছেন। মন বলছে আমি যেনো তাকে দেখতে যাই, এক্ষেত্রে আপনাকেও আমরা সঙ্গে চাই। আপনি তাশরীফ নিলে খুশি হই, না গেলেও অখুশী নই।
ব্যবসায়ী বক্তব্য থামালেন, হাতেম রহ. মাথা ঘামালেন। তিনি ভাবলেন-রুগী দেখতে যাওয়ায় তো সওয়াব আছে, আবার রুগীর বাড়িটিও মোটামোটি কাছে। এছাড়া তিনি যেহেতু বুজুর্গ-হযরত, তাই তার সান্নিধ্যে যাওয়াটাও ইবাদত। সুতরাং তারা রওয়ানা হলেন, হাতেম আসাম! বিনীত জ্ঞানবৃক্ষ, ধীর গতিতে চলেন। তারা এগিয়ে যাচ্ছেন আর চারপাশে লোকদের মধ্যে কৌতুহলের সাড়া পাচ্ছেন। লোকেরা বলছে- এই তো হাতেম! মহান বুজুর্গ, তিনি আলেমদের সর্দার, ন্যায়ের দূর্গ। হাতেম হাঁটছেন ক্রমাগত প্রশংসাবাক্যের ঢেউ ঠেলে, এই স্তুতিবৃষ্টি বড় অনাকাঙ্খিত, চলে যেতে হবে একে পিছনে ফেলে। ধীরে ধীরে আলেমের বাড়ীতে পৌঁছে গেলেন, তারপর হাতেম সারা বাড়ী দেখার জন্য দৃষ্টি মেলেন। এই হচেছ শায়খ মুহাম্মদ বিন মাকাতিলের রহ. ঘর। খুবই সুসজ্জি, সুবিশাল; যেনো স্বতন্ত্র এক শহর। চাকচিক্য ছড়াচ্ছে আসবাবপত্রের সৌন্দর্য, ঘরভরতি যেনো সৌখিনতার সৌকর্য।
কাজী মুহাম্মদ বিন মাকাতিল মসৃন বিছানায় শুয়ে, তার পাশে এক গোলাম খাড়া ভূয়ে। সওদাগর সাহেব বসলেন কাজী সাহেবের একেবারে কাছেই, হাতেম রহ. তখন দাড়িয়ে আছেন পাশেই। কাজী সাহেব ইশারায় হাতেমকে রহ. বসতে আরজ করলেন, হাতেম রহ. বসলেন না, কাজী সাহেবের দিকে শুধু একটু নড়লেন। গম্ভীরভাবে বললেন- সহযোগিতা নিয়ে মাথা উঠালেন, দুচোখে একান্তিক আগ্রহের আলো ফোটালেন, যেনো তার মনোযোগ বাতাসও লম্বা নি:শ্বাস নিলো। আগ থেকেই হাতেমের রহ. প্রতি তার সম্ভ্রমবোধ ছিলো, এবার সম্মুখে দাড়ানো হাতেমের সুউচ্চ ব্যক্তিত্ব তা আরো বাড়িয়ে দিলো।
হাতেম রহ. বললেন- হুজুর সা. এর নিকট ইলিম এলো কিভাবে?
কাজী সাহেব বললেন- জিব্রাইল আ. এর মাধ্যমে।
হাতেম রহ. কাজী সাহেবকে প্রশ্ন করলেন।
আপনি কিভাবে ইলিম শিখেছেন? কার কাছে পড়েছেন, লিখেছেন?
বিশ্বস্ত উলামাদের কাছে গিয়ে গিয়ে, তাদের ইলমের সুরাহী থেকে পিয়ে পিয়ে।
তারা কোথা থেকে ইলিম পেলেন? এজন্য কোন ঠিকানায় ছুটে গেলেন?
সাহাবায়ে কেরামের কাছ থেকে, তাদের সিনার নূরে খাস থেকে।
তারা ইলিম পেলেন কার থেকে? কোন সে নূরের সার থেকে?
বিশ্বনবীর সা. আলোকধারায়, ইলমে ওহীর পাড়ায় পাড়ায়।
কিভাবে ইলিম এলো নবীজির সা. কাছে, যেই ইলিমে মহামানবতা হাসে?
জিব্রিল আমীন আ. আল্লাহর কাছ থেকে ইলিম নিয়ে নিয়ে আসেন, তারই মহান ফলস্রুধারায় নবীয়ে পাক সা. ভাসেন।
এবার হাতেম আসামের রহ. কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ম হয়ে উঠলো, তার আওয়াজ থেকে তীব্রতার হুলকা যেনো ছুটলো। শব্দাবলী হয়ে উঠলো উদাত্ত-গম্ভীর, কাজী সাহেব তার দিকে তাকিয়ে আছেন সুস্থির। হাতেম বললে লাগলেন যে ইলিম রুহুল আমীন আ. আল্লাহর নিকট থেকে হাসিল করলেন, এবং বিশ্বস্ততার সাথে রাহমাতুল্লিল আলামীনের নিকট পড়লেন, আর কাসিমুল উলূম সা. থেকে শিখলেন সাহাবা আজমাইন, আর সাহাবাদের থেকে যা শিখলেন উলামাসালেহীন, তাদের থেকে যে ইলিম অর্জন করে, আপনি আজ রঙ্গিন।
-সেই ইলিমের কোথাও কি পেয়েছেন দুনিয়াপূজার মহত্বের কথা কিংবা জাকজমকের বড়ত্বের কথা? কোথাও কি লিখা আছে- দুনিয়ায় যে উচ্চবালাখানায় অধিষ্ঠিত, আল্লাহর দরবারে তার উচ্চমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত? কোথাও কি এমন ইঙ্গিত আছে যে, দুনিয়াপূজার সঙ্গীত গাইতে হবে? নষ্ট জলে নাইতে হবে? আল্লাহকে পেতে হলে এগুলো কি কোনো শর্ত? নাকি এর মধ্যে খোঁড়া থাকে ধ্বংশের গর্ত?
হাতিম আসামের রহ. কথার তেজ কেবল বাড়ছে এবং তার সম্মুখে কাজী সাহেবের জৌলুস কেবল হারছে।
হাতিম রহ. বললেন-
কাজী সাহেব! কোথাও কি দুনিয়ার আজমতের কথা দেখছেন? যে আজমতের রঙ আপনি নিজের জীবনে মেখেছেন!
না, এমনটি দেখিনি কোথাও, এর গুরুত্বের উল্লেখ নেই এক সূতাও।
এর গুরুত্বের কথা না থাকলে কিভাবে এ সম্পর্কে কি আলোচনা পেয়েছেন? আল্লাহ এর সাথে আমাদের কেমন আচরণ চেয়েছেন?
কিতাব বলছে একে দূরে রাখার কথা, কারণ পরিণতির দিক থেকে এর নৈকট্য একেবারে অযথা, কিংবা ক্ষতিকর, কারণ দুনিয়া এমন সাপ, যা বিষধর।
কিতাব তাহলে কাকে গুরুত্ব দিতে বলে? মুমীনহৃদয়ে কোন জগতের বাতি জ্বলে?
কিতাব বলছে পরকাল কামনা করতে, সে জগতে সাফল্য অর্জনের পথ ধরতে। সেই জীবনের জন্য বলছে সামান জমাতে, আর ক্ষনস্থায়ী জীবনের ব্যস্থতা কমাতে। গরীবদের যেনো ভালোবাসি- একথাও কিতাবে আছে, দুনিয়াত্যাগীরাই যেনো আপন হয়, মুজাহিদরাই যেনো থাকে কাছে। এই সব গুনাবলী অর্জন করে যেনো আল্লাহর প্রিয় হই, এর বিপরীত জিনিসগুলো বর্জনে যেনো সঙ্গিয় রই।
এই যদি হয় আপনার বোঝ, তাহলে খোঁজ করে দেখুন জীবনে তা মানছেন কি? নিজের দিকে আল্লাহর রহমতকে টানছেন কি? আপনিই তো জানেন, এপথের নন আদর্শ নবী-সাহাবী-তাবেয়ী, যেই তাদে আদর্শের বাইরে যাবে, তিক্তফল সে পাবেই। এ পথে চলতে পারেননা রববানী উলামা, এ পথে সামান্য বিচ্যুতির ফল হতে পারে বিপর্যয় আর হোতামা। আপনি আমলের দ্বারা লোকদেরকে দাওয়াত দিচ্ছেন কোনদিকে? নব্বী বনাম ফেরাউনী তরিকা থেকে আপনার অনুসারীরা গ্রহণ করবে কোনটিকে? দুনিয়াদাররা তো তাদের ভ্রষ্টতার পক্ষে আপনাকে দলীল বানাবে, আপনাদের কথা উল্লেখ করে দুনিয়াপূজার পক্ষে যুক্তি শুনাবে। আপনারা জাহিলদের জন্যও গোমরাহীর খাল কাটছেন, পরিণতি চিন্তা না করেই তাৎক্ষণিক স্বাদের জন্য দুনিয়ার বিষ চাটছেন।
হযরত হাতিম আসাম রহ. বক্তব্য শেষ করলেন, কঠোর সত্যকে দলীল ও কৌশলের সাথে পেশ করলেন। কাজী সাহেব বক্তব্য শুনলেন কান পেতে, আর উৎকণ্ঠার কম্পিত হয়ে উঠলেন জান থেকে। আগেই তার অসুখ ছিলো, এই ঘটনা রোগের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিলো। তিনি নিজেই পরখ করে দেখলেন নিজেকে, দিন-রাত চাষ করতে লাগলেন নয়া জিন্দেগীর বীজকে। যুহদ ওতাকওয়ার চাষাবাদই তো আলেমের কাজ। এই কাজে জীবন হয়ে উঠে আলোর জাহাজ। মানবতা সে জাহাজে পৌঁছাতে থাকে আল্লাহর ঠিকানার বন্দরে, রহমতের বসন্ত নামে যিন্দেগীর সদরে-অন্দরে।

মূল: শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ.

অনুবাদ : মুসা আল হাফিজ

যে সূর্যে প্রদীপ্ত বিশ্ব; সে তুমি আলেম’ শীর্ষক অনুবাদ গ্রন্থের অংশ বিশেষ

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...