বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:১০
Home / অনুসন্ধান / দ্বীনী মাদরাসায় শিক্ষাপদ্ধতির সংস্কার : একটি প্রস্তাবনা (আরবী শ্রেণীসমূহে পাঠদানের সাপ্তাহিক নির্দেশনা)

দ্বীনী মাদরাসায় শিক্ষাপদ্ধতির সংস্কার : একটি প্রস্তাবনা (আরবী শ্রেণীসমূহে পাঠদানের সাপ্তাহিক নির্দেশনা)

হযরত মাওলানা খায়ের মুহাম্মদ রাহ. [সাবেক সদর, বেফাকুল মাদারিস, পাকিস্তান]

dewbond

আমি আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় মনে করি যে, দ্বীনী মাদরাসার প্রচলিত “নেসাবে তালীম” রদবদল না করে শিক্ষাদান পদ্ধতি সংস্কার করলে বেশি ফায়দা হবে। আসাতিজায়ে কেরাম যারা শিক্ষাদান করবেন, তাদেরকে আমল-আখলাকের নমুনা হতে হবে এবং ছাত্রদের আমল-আখলাকের সংশোধনে মনোযোগী হতে হবে। আমি এই প্রবন্ধে আসাতিযায়ে কেরামের খেদমতে ‘শিক্ষাদান পদ্ধতি’ সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। আশা করি এগুলোর উপর সকলেই যদি যত্নবান হন তাহলে ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়িই ছাত্রদের ইলমী ও আমলী তারাক্কী হবে, কিতাবের সাথে তাদের মুনাসাবাত সৃষ্টি হবে এবং তাদের আমল-আখলাক ও স্বভাব চরিত্র সংশোধন হবে।
দ্বীনী তালীম (যেমন- হাদীস, ফেকাহ, তাফসীর ইত্যাদি) এবং তার প্রাথমিক বিষয়াবলী (যেমন নাহু, সারফ, বালাগত ইত্যাদি) নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর উপযুক্ত বিনিময় আখেরাতে পাওয়া যাবে। আসাতিযায়ে কেরাম ইবাদত ও সওয়াবের নিয়তে দ্বীনী তালীমের দায়িত্ব আঞ্জাম দেবেন। পার্থিব প্রয়োজন পূরণের জন্য বেতন-ভাতাকে শুধু দ্বীনী তা’লীমের ওসিলা মনে করবেন, বিনিময় মনে করবেন না।
আসাতিযায়ে কেরাম তা’লীম ও তাদরীসের পাশাপাশি ছাত্রদের দীনদারী ও তাদের আমল-আখলাকেরও নেগরানী করবেন এবং প্রয়োজন অনুপাতে আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার (সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ) এর দায়িত্বও আঞ্জাম দেবেন। জরুরত মনে করলে তারা ছাত্রদের প্রতি কিছু কঠোরতাও করবেন। সালেহীনদের লেবাস ও তাদের চাল-চলন, জামাতে নামায আদায়, সালাম প্রদান ও তার জবাব দান ইত্যাদি বিষয়ে নিজেরাও যতœবান হবেন এবং ছাত্রদেরকেও এগুলোর প্রতি যত্ন নিতে বাধ্য করবেন। দাড়ি মুণ্ডানো, সিগারেট পান, বিজাতীয় লেবাস পরিধান ও তাদের বেশ-ভূষা অবলম্বন এবং এ ধরণের কাজ থেকে ছাত্রদের কঠোরভাবে বিরত রাখবেন। যে সকল ছাত্র এসব বিষয় মেনে চলবে না তাদেরকে অবিলম্বে মাদরাসা থেকে বিদায় করে দেবেন।
আসাতিযায়ে কেরাম মুতালা’আ করার সময় নিজের স্মৃতিতে প্রতিটি সবকের এমন একটি তারতীব কায়েম করবেন যাতে ছাত্ররা সহজে বুঝে নিতে ও আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়। কিতাব পড়ানোর সময় প্রতিটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে পেশ করবেন।

1454042035পড়ানোর সময় ছাত্র যদি যুক্তিসঙ্গত কোন কথা বলে তাহলে উস্তাদ তার তাহকীকের বিপরীত হলেও ছাত্রের কথা মেনে নিবেন। অযথা কথার মারপ্যাচে নিজের মতকে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করবেন না।
যেসকল ছাত্র পড়াশুনায় মেহনত কম করে কিংবা একদম করে না তাদের ক্ষেত্রে উস্তাদ এমন পন্থা অবলম্বন করবেন যাতে তারা মেহনতে অভ্যস্ত হয় এবং ইলম শিক্ষায় মনোযোগী হয়। প্রত্যেক কিতাব শুরু করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের সংজ্ঞা, আলোচ্য বিষয়, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং কিতাব রচয়িতার জীবনী আলোচনা করবেন।
আরবী শ্রেণীসমূহের শিক্ষাদান পদ্ধতি
আরবী শ্রেণীসমূহকে তিনভাবে বিভক্ত করা যায়। এক-প্রাথমিক, দুই-মাধ্যমিক, তিন-উচ্চ।
প্রাথমিক- মীযান থেকে কাফিয়া পর্যন্ত। মাধ্যমিক-শরহেজামী থেকে হেদায়া আওয়ালাইন পর্যন্ত। উচ্চ তাফসীরে জালালাইন থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত। প্রতিটি স্তরে কীভাবে শিক্ষা দান করতে হবে-নিম্নে তার আলোচনা পেশ করছি।

প্রাথমিক স্তর
১. এই স্তরে কিতাব পড়ানোর ক্ষেত্রে যথাসম্ভব শাব্দিক তরজমা করবেন এবং সহজ-সরল ভাষায় বাক্যের মতলব বলে দেবেন। লম্বা-চওড়া তাকরীর না করে মূল বিষয়টিকে সংক্ষেপে ছাত্রদের মন ও মস্তিষ্কে বদ্ধমূল করে নেবেন। এরপর ছাত্রদের কাছ থেকেও শুনবেন। দারস শেষে উস্তাদ নিজের তত্ত্বাবধানে ছাত্রদেরকে সবক মুখস্ত করাবেন। পরের দিন পেছনের সবক আদায় করে সামনে অগ্রসর হবেন। দৈনন্দিন সময়ানুপাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করে ছাত্রদের কাছ থেকে লিখিত বা মৌখিক উত্তর আদায় করবেন। এভাবে চর্চা করলে ছাত্রদের ভেতর ‘ইলমী গভীরতা’ আসবে।
২. ‘মীযানুস সারফ’ অল্প অল্প করে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে পড়াবেন। এ সাথে মাওলানা মুশতাক আহমদ চরথাওলী রাহ. রচিত ‘ইলমুস সারফ’ প্রথম খণ্ড কিছু কিছু করে পড়াবেন। ‘মীযানুস সারফ’ এ তারতীব অনুসারে সীগা এবং গরদানের নাম বেশি বেশি চর্চা করাবেন।
ইসমে যরফ ও ইসমে তাফযীল’ এর সীগাগুলোর সাথে ‘তাসগীর’ এর সীগাও অনুশীলন করাবেন। তাইসীরুল আবওয়াব এর ১২টি সীগা ‘আবওয়াবুস সারফ’ এর তারতীব অনুসারে পড়াবেন। মীযান শ্রেণীর ছাত্রদেরকে মৌখিক এবং লিখিতভাবে যথাসম্ভব বেশি বেশি সীগা ‘মশক’ করাবেন।
৩. ‘মুনশাইব’-এ শুধু ২৪টি বাব (সুলাসী মুর্জারদ-এর ৬টি), সুলাসী মযীদ-এর ১৪টি রুবাঈ মুজাররদ ও মযীদফীহি-এর ৪টি) তাইসীরুল আবওয়াব কিতাবের সাহায্যে নাম আলামতসহ খুব ভালোভাবে মুখস্ত করাবেন। অথবা শুধু তাইসীরুল আবওয়াব কিতাবটি মশক করালেও যথেষ্ট হবে। এরপর আরবী সাফওয়াতুল মাসাদির এর সাহায্যে সহীহ সরফে সাগীর ও কাবীর ভালোভাবে মশক করাবেন। প্রথম সাময়িক পরীক্ষা পর্যন্ত মীযান ও মুনশাইব কিতাবটিকেই শুধু নেসাবে রাখা হয়েছে।
৪. ইলমুস সারফ তৃতীয় খণ্ড পড়ানোর সময় হাফতে আকসাম এর সারফে ছাগীর ও কাবীর তরজমা সহ সাফওয়াতুল মাসাদির এবং সব ধরণের তা’লীল খুব ভালো করে মশক করাবেন। সারফে মীর এবং ইলমুস সীগাহ-এর ক্ষেত্রেও এই নিয়ম মেনে চলবেন।
(বি.দ্র. ‘সারফ’র সকল কিতাব একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পুরাতন উস্তাদের যিম্মায় থাকা চাই। নতুন উস্তাদের যিম্মায় এই দায়িত্ব দেয়া ঠিক হবে না।)
৫. ‘নাহবেমীর’ কিতাবের মৌখিকভাবে মাসআলাগুলো শিখানোর সাথে সাথে প্রতিটি বাক্যের তারকীবও শেখাবেন। কিতাবে যে সকল উদাহরণ আছে এগুলো ছাড়াও কুরআন, হাদীস এবং আরবী আদবের কিতাবাদি থেকে বেশি বেশি উদাহরণ মশক করাবেন। ‘নাহু’ চর্চার ক্ষেত্রে উদাহরণ যত বেশি দেয়া হবে, ছাত্রদের ফায়দাও তত বেশি হবে। এরাব- এর প্রকারগুলো অত্যন্ত জোরদার মশক করাবেন। নাহুর আমেল সম্পর্কে লিখিত ফার্সী ছন্দগুলো ছাত্রদের মুখস্ত করিয়ে দেবেন।
৬. ‘শরহে মিয়াতে আমেল’-এর ক্ষেত্রে একদিনে শুধু আরবী ইবারত, তরজমা এবং মতলব পড়াবেন এবং দ্বিতীয় দিন তারকীব করাবেন। প্রথম পরিচ্ছেদ পর্যন্ত তারকীব ছোট ছোট হবে এরপর বড় তরকীব করা হবে প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্যন্ত সকল তারকীব বড় বড় হবে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু ছোট ছোট তারকীব হবে এবং মাঝে মাঝে পরীক্ষামূলক বড় তারকীবও করাতে হবে।
৭. ‘রওজাতুল আদব’ বা আরবী সাহিত্যের অন্য কোন কিতাব পড়ানোর সময় তরজমা ও সীগাহ চর্চার পাশাপাশি নাহবী তারকীবও করাবেন। আরবী লেখা ও মোকালামা ছাত্রদের চর্চা করাবেন।
৮. ‘হিদায়াতুন্নাহু’ এবং ‘মিরকাত’ কিতাবে পারিভাষিক শব্দগুলোর সংজ্ঞা আরবীতে মুখস্ত করাবেন। আর মাসআলাগুলো মাতৃভাষায় পড়িয়ে দেবেন। দৈনন্দিন কথাবার্তায় মানতেক-এর মাসআলাগুলো এমনভাবে অনুশীলন করাবেন, যাতে ছাত্ররা মনে করে যে, আমরা সবাই মানতেকী।
৯. ‘নূরুল ইযাহ’ ও ‘মুখতাসারুল কুদুরী’ পড়ানোর সময় শাখাগত মাসআলাগুলো সহজ ভাষায় ছাত্রদের বুঝিয়ে দেবেন এবং প্রশ্নোত্তর আকারে এ সকল মাসআলা চর্চা করাবেন।
১০. ‘তাহযীব’ কিতাবটি সহজ-সরল ভাষায় ছাত্রদের এমনভাবে পড়াবেন যাতে শরহে তাহযীব-এর সকল মাসায়েল জানা হয়ে যায়। পুনরায় যেন শরহে তাহযীব পড়ার দরকার না হয়।

ািািািািডপমাধ্যমিক স্তর
এই স্তরে কিতাবগুলোর ইবারত এক এক মাসআলা পরিমাণ পড়াবেন এবং শব্দ ও এরাব-এর ভুলগুলো শুধরাবেন। শব্দ কিংবা এরাব ভুল হলে ইবারতে কেমন জটিলতার সৃষ্টি হবে তাও বুঝিয়ে দেবেন। এর ফলে ছাত্ররা ইবারত ভুল হওয়ার মন্দ দিকগুলোও অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। যথাসম্ভব ছাত্রদের শব্দ বা এরাব বিশুদ্ধ করানোর চেষ্টা করবেন। ছাত্র যদি বুঝে উঠতে না পারে তাহলে উস্তাদ ভুল চিহ্নিত করে দেবেন। এক ছাত্র ইবারত পড়লে উস্তাদ অন্য ছাত্রদের বলে রাখবেন যে, তোমরা ভালোভাবে শুন এবং সে কোথাও ভুল পড়লে সাথে সাথে তা চিহ্নিত করবে এবং শুদ্ধ কি হবে- তা তুমি বলে দেবে। প্রতিদিনই এক ছাত্রের দ্বারাই ইবারত পড়াবেন না এবং কোন পালাও নির্ধারণ করবেন না। বরং উস্তাদ যে ছাত্রকে মুনাসিব মনে করবেন তার দ্বারা পড়াবেন। বিশেষভাবে যে ছাত্র ইবারত পড়তে চায় না তার দ্বারা অবশ্যই পড়াবেন। এছাড়া আরো যে সকল পদ্ধতি অবলম্বন করলে ছাত্রদের ইবারত শুদ্ধ হতে পারে তা অবলম্বন করবেন। ইবারত পড়াকালীন ‘সারফ ও নাহু’ সংক্রান্ত কোন জটিলতা দেখা দিলে উস্তাদ তা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেবেন। ইবারতের কোথাও উহ্য প্রশ্ন থাকলে, তা ছাত্রদের সামনে তুলে ধরবেন এবং কিতাবের ইবারত দ্বারা সে প্রশ্নের উত্তর ছাত্রদের কাছ থেকে আদায় করবেন।
ছাত্ররা কীভাবে মুতালাআ করলে ইবারতের জটিল বিষয়গুলো চিহ্নিত করে তার সমাধান জানা যাবে- এ ব্যাপারে উস্তাদ তাদেরকে দিক-নির্দেশনা দেবেন।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে দারস দান করলে সবকের পরিমাণ কিছুটা কম হবে। তবে কিছুদিন এভাবে চর্চা করালে যখন ছাত্রদের ‘যোগ্যতা’ হয়ে যাবে, তখন সেই কমতিটুকু পুরো হয়ে যাবে। বছরের শুরুতে কিছুদিন অবশ্যই এই পদ্ধতিতে দারস দান করতে হবে।
মাঝে মধ্যে পেছনের সবক সম্পর্কেও ছাত্রদের জিজ্ঞেস করবেন। এতে তারা সতর্ক হবে এবং পেছনের সবক স্মরণ রাখার চেষ্টা করবে।
মাধ্যমিক স্তরের সকল ছাত্রকে মুতালা’আর সাথে ‘তাকরার’ করতে অভ্যস্ত বানাতে হবে। এর পন্থা এই হবে যে, উস্তাদ ছাত্রদেরকে বলবেন- আমাদের পূর্ব পুরুষগণ ‘তাকরার’ এর পদ্ধতি এই জন্য চালু করেছেন যাতে ছাত্ররা ‘ইলমী ইসতেদাদ’ হাসিল করার সাথে সাথে দারস দানের যোগ্যতাও ধীরে ধীরে লাভ করতে পারে।
তাকরার করাকে ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ’- এর প্রাথমিক স্তর বলা চলে। বাস্তবেও দেখা গেছে যে, যে সকল ছাত্র তাদের শিক্ষা জীবনে তাকরারে অভ্যস্ত ছিল তারা পরবর্তীতে শুধু নামের শিক্ষক নয় বরং একজন সফল ও সার্থক শিক্ষক বনে গেছে। এই উপকারিতার কথা ছাত্ররা শুনলে অবশ্যই তাদের ভেতর তাকরার করা ও করানোর জযবা সৃষ্টি হবে। উস্তাদ প্রত্যেক জামাতের ছাত্রদের দুই বা তিনভাবে বিভক্ত করে দেবেন এবং পালাক্রমে প্রত্যেককে ‘তাকরার’ করতে বাধ্য করবেন। তাকরারের সময়ে মাঝে মাঝে উস্তাদ গিয়ে নেগরানীও করবেন। যাতে ছাত্ররা তাকরার করার পরিবর্তে গল্পে লিপ্ত না হয়ে যায়।
২. ‘উসূলুশ শাশী’, ‘কানযুদ দাকায়েক’ এবং এ ধরণের অন্যান্য শাস্ত্রীয় কিতাব পড়ানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের পারিভাষিক শব্দসমূহের সংজ্ঞা আরবী ভাষায় মুখস্ত করাতে হবে। কিতাবের মাসআলাগুলো সহজ-সরল ভাষায় ছাত্রদের সামনে তুলে ধরতে হবে এবং এমনভাবে চর্চা করাতে হবে যাতে তাদের সে বিষয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে।
৩. তরজমায়ে কুরআন পড়ানোর সময় সারফ ও নাহু শাস্ত্র চর্চা করাতে হবে। প্রথমে শব্দের আভিধানিক অর্থ এরপর তার মর্ম বুঝাতে হবে এবং সরল ভাষায় তরজমা করাতে হবে। প্রয়োজনীয় শানে নুযুল ও ঘটনাবলী সংক্ষেপে বলে দিতে হবে। দু’টি আয়াতের পারষ্পরিক সম্পর্ক কি- এ ব্যাপারেও বিশেষ নজর রাখতে হবে।
৪. ‘হিদায়া আওয়ালাইন’ পরিপূর্ণ তাহকীক সহকারে পড়াবেন। যে সকল মাসআলার পেছনে যুক্তিগত দলিল রয়েছে তা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেবেন এবং এর উসূলে ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মাসায়েলও বর্ণনা করবেন। এতে ছাত্ররা ‘উসূল’ এর উপর ভিত্তি করে আরো অন্যান্য মাসআলা উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবে।
৫. বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান সম্পর্কিত কিতাবাদি পড়ানোর সময় সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের পারিভাষিক শব্দগুলোর সংজ্ঞা আরবী ইবারতসহ মুখস্ত করাবেন। এই শাস্ত্রের ‘মুলনীতিসমূহ’ও তা থেকে মাসআলা কিভাবে বের করতে হবে তাও ছাত্রদেরকে শেখাবেন।

imagesউচ্চ স্তর
১. যে সকল বিষয় ও শাস্ত্রের কিতাবাদি ছাত্ররা পূর্বে পড়েছে এই স্তরে এসে তারা সে সকল বিষয় ও শাস্ত্রের সর্বশেষ কিতাব অধ্যয়ন করে। অনেক সময় এরপর আর কোন কিতাব পড়ার সুযোগ হয়ে উঠে না। এই জন্য আসাতিযায়ে কেরামকে পূর্ণ মেহনতের সাথে শুধু কিতাব নয়; বরং নির্ভরযোগ্য টীকা-টিপ্পনী এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আরো অন্যান্য কিতাব মুতালাআ করতে হবে। পড়ানোর সময় মুতালাআ থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী বিষয়গুলো উদ্ধৃতিসহ সংক্ষেপে সাজিয়ে গুছিয়ে আলোকপাত করতে হবে। এতে ছাত্রদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গভীরতা অর্জন হওয়ার পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য তথ্যসমৃদ্ধ কিতাবের নামও জানা হয়ে যাবে। ফারেগ হওয়ার পর এ বিষয়ে সে দারস দান করলে কিংবা কোন প্রবন্ধ তৈরি করতে চাইলে সে সকল কিতাবের সহযোগিতা নিতে পারবে। আসাতিজাগণ ছাত্রদেরকে কিতাবী বিষয়ে আলাপ করার সাথে সাথে যুগ সমস্যা ও শরীয়তের দৃষ্টিতে তার সমাধান’ এ বিষয়ে অবশ্যই আলোচনা করবেন। এতে ছাত্ররা যুগের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে।
২. তাফসীরে জালালাইন পড়ানোর সময় হাশিয়ায়ে সাবী বা জামাল মুতালাআ করবেন। আয়াতের পারষ্পরিক সম্পর্ক এবং কুরআন মজীদের অন্যান্য জ্ঞান লাভের জন্য তাফসীরে বয়ানুল কুরআন মুতালাআ করবেন। ‘উসূলে তাফসির’ বিষয়ে আল ফাউজুল কাবীর ও এতকান মুতালাআ করেন। কুরআন মজীদের ‘তাফসীর’ বিষয়ে হাদীস ও ফেকাহ সংক্রান্ত মাসায়েল তাহকীক করতে হলে তাফসীরে মাযহারী মুতালাআ করবেন।
৩. ‘উসূলে হাদীস’ শাস্ত্র ইলমে হাদীসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। নেসাবে তা’লীমে এ বিষয়ে শুধু মুকাদ্দামায়ে ইবনুল সালাহ শরহে নুখবা বা খায়রুল উসূলকে রাখা হয়েছে। উস্তাদের করণীয় হবে এ সকল কিতাবে লিখিত হাদীসের সকল পরিভাষা খুব ভালোভাবে ছাত্রদের মুখস্ত করানো। প্রয়োজন অনুপাতে এ বিষয়ের অন্যান্য কিতাবাদির সহযোগিতা নিয়ে সারগর্ভ আলোচনা ও উস্তাদকে করা উচিত।
৪. মিশকাত শরীফ পড়ানোর সময় সহজ-সরল ভাষায় হাদীসের অর্থ ও মতলব বর্ণনা করার পর তদসংশ্লিষ্ট ফিকহী মাসআলা এবং প্রমাণাদি সহ আইম্মায়ে কেরামের মতামত সংক্ষেপে তুলে ধরবেন। তবে হানাফী মাযহাব ও তার প্রমাণাদি বিশ্লেষণ সহকারে কিছুটা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরবেন। হাদীস যদি হানাফী মযহাবের পরিপন্থী হয় তাহলে উপযুক্ত তাহকীকসহ তার জবাব অবশ্যই প্রদান করবেন। এ ক্ষেত্রে আল্লামা ইবনে রূশদ রচিত বিদায়াতুল মুজতাহিদ এবং মেশকাতের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লুমআত বা আততালীকুছ ছাবীহ মুতালাআ করবেন।
৫. দাওরায়ে হাদীসে নেসাবভুক্ত দশটি কিতাব বিশেষ করে বোখারী শরীফ পড়ানোর সময় ফাতহুল বারী, আইনী কিংবা হাশিয়ায়ে আল্লামা আহমাদ আলী সাহরানপূরী এবং ফয়জুল বারী মুতালাআ করবেন। তারাজিমে বোখারীর এর জন্য হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. রচিত আল-আবওয়াব ওয়াত-তারাজিম অবশ্যই মুতালাআয় রাখবেন।
তিরমিযী শরীফ পড়ানোর সময় মাআরেফুস সুনান বা আল-কওকাবুদ্দুররী মুতালাআ করবেন। সুনানে আবু দাউদের জন্য বজলুল মজহুদ মুতালাআ করবেন। এভাবে হাদীসের অন্যান্য কিতাবাদি পড়ানোর সময় কিতাবের হাশিয়া ও শুরুহাত অবশ্যই মুতালাআ করবেন। তবে যে সকল শুরুহাত (ব্যাখ্যাগ্রন্থ) ব্যাপক ও বিস্তৃত এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাসমূহ খুব সংক্ষেপে বর্ণনা করবেন। যাতে বছর শেষ হওয়ার সাথে সাথে কিতাবও খতম হতে পারে।
হাদীসের কিতাব শুরু করার পূর্বে মুকাদ্দামা স্বরূপ হাদীস সংকলনের ইতিহাস, হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা, সিহাহ সিত্তাহ ও সুনান রচয়িতাগণের জীবনী, হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তাদের শর্তাবলী, নেসাবভুক্ত দশটি কিতাবের বৈশিষ্টাবলী সংক্ষেপে আলোচনা করবেন। তবে সংশ্লিষ্ট কিতাব ও তার রচয়িতার উপর বিশ্লেষণ সহকারে বিস্তারিত আলোচনা করবেন। এরপর কিতাব শুরু করবেন। হাদীসের কিতাব পড়ানোর সময় আদব, ইহতেরাম ও গাম্ভীর্যতা বজায় রাখবেন। প্রতিটি হাদীসের প্রয়োজনীয় শাব্দিক তরজমা ও মতলব বলার পর এর সাথে সংশ্লিষ্ট মাসআলার উপর সারগর্ভ আলোচনা পেশ করবেন। যে সকল মাসআলায় ইখতেলাফ রয়েছে সেক্ষেত্রে আইম্মায়ে কেরামের মতামত ও তাদের প্রমাণাদি আদব ও ইহতেরাম বজায় রেখে আলোচনা করবেন। এর পাশাপাশি হানাফী মাযহাব ও তার প্রমাণাদি গভীর বিশ্লেষণ সহকারে ইনসাফের আন্দাজে ব্যক্ত করবেন এবং তার শ্রেষ্ঠত্বের দিকগুলোও তুলে ধরবেন। যথাসম্ভব ইখতেলাফ খতম করার বা কমিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। মাযহাবকে হাদীসের অনুকুলে আনার চেষ্টা করবেন, হাদীসকে মাযহাবের অনুকুলে নয়। কারণ আসল তো হাদীস। আর মাযহাব তার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাদীস তা’বীল করা এবং জাহেরী অর্থ ছেড়ে দূরবর্তী কোন অর্থ গ্রহণ করা- এর চেয়ে হাদীসের সূত্র ও সনদ নিয়ে আলোচনা করলে বেশি ফায়দাজনক হবে। ইমাম তাহাবী রাহ. তার কিতাবে এ ধারাই অবলম্বন করেছেন। এ কারণেই হানাফী মাযহাবের জন্য তার শরহু মাআনিল আছার একটি বড় মূল্যবান নেয়ামত। ইখতেলাফী মাসআলা আলোচনা করার সময় উক্ত কিতাবটি এবং মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ রাহ. সামনে রাখা অত্যন্ত জরুরী।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে দারস দানের পাশাপাশি প্রাচীন কালের এবং বর্তমানকালের ভ্রান্ত মতবাদগুলো নিয়েও আলোচনা করবেন। উপযুক্ত দলিল-প্রমাণের সাহায্যে এগুলো প্রত্যাখ্যান করে সত্য বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করে তুলবেন। ছাত্রদের ঈমান-আক্বীদা বিশুদ্ধকরণ ও আমল-আখলাক সংশোধনের জন্য তদসংশ্লিষ্ট বিষয়েও আলোচনা করবেন। এ ক্ষেত্রে তা’লীমের সাথে সাথে তরবিয়তের যিম্মাদারীও আদায় হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম উস্তাদকে আমলী নমুনা হতে হবে। খোদাভীতি, তাকওয়া ও পরহেজগারীর আদর্শ তাকে কায়েম করতে হবে। বস্তুত: যিনি হাদীস পড়াবেন তার ভেতরে এমন গুণাবলী অবশ্যই থাকা চাই। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন।
হাদীস পড়ানোর সময় উস্তাদ শুধু ইখতেলাফী মাসায়েল বর্ণনার প্রচলিত পদ্ধতি অবলম্বন করবেন না বরং হাদীসের অন্তর্নিহিত শিক্ষা ও তদসংশ্লিষ্ট জ্ঞান-প্রজ্ঞা নিয়ে সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করবেন। এতে ছাত্ররা হাদীসের যথোপযুক্ত মর্যাদা এবং দ্বীন ও শরীয়তের দৃষ্টিতে তার তাহকীকী মাকাম অনুধাবন করতে পারবে এবং যুগের ফেতনা মোকাবেলায় সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
যারা হাদীস পড়ান তারা সাধারণত বছরের অধিকাংশ সময় শুধু আইম্মায়ে কেরামের ইখতেলাফী মাসায়েল বর্ণনায় ব্যয় করে থাকেন। আর বছরের শেষদিকে এসে কিতাব শুধু তেলাওয়াত করে খতম করে দেন। এরপরও অনেক কিতাব খতম করা সম্ভব হয়ে উঠে না। এই পদ্ধতি নিঃসন্দেহে অনেক ক্ষতিকর এবং রাসূলুল্লাহ সা.’র হাদীস অবমূল্যায়ন করার নামান্তর। আমরা এই অন্যায় কাজ থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। অতএব, উস্তাদকে বছরের শুরু থেকেই কিতাব খতম করার ফিকির রাখতে হবে। মূলত: উস্তাদ অনেক কিছু মুতালাআ করে এসে এ জরুরী সারনির্যাসটুকু ছাত্রদের সামনে ব্যক্ত করবেন।
৬. হাদীসের কিতাবাদির মত অন্যান্য বিষয়ে কিতাবাদির ক্ষেত্রেও আসাতিযাগণ উক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করবেন। হেদায়া আখেরাইন পড়ানোর সময় ফাতহুল কাদীর এবং হাশিয়ায়ে আহমাদ হাসান সাম্ভলী কিংবা অন্তত এনায়াহ মুতালা’আ করবেন। শরহে আকায়েদ পড়ানোর সময় ইশারাতুল মারাম লিল বায়াযী এবং আল মারাম ফী আকায়িদিল ইসলাম কিতাবদ্বয় মুতালাআ করবেন। হামাসা পড়ানোর ক্ষেত্রে তার শরাহ ফয়জী বা তীবরীজী কিংবা অন্তত হাশিয়ায়ে এজাজ আলী রাহ. মুতালাআ করবেন।

কমাশিসা-লগো-310x165৭. সীরাত এবং ইতিহাস দু’টি নতুন বিষয়। এ বছর এ দু’টি বিষয় বেফাকের নেসাবভুক্ত হয়েছে। এগুলো যারা পড়াবেন তাদের কিতাব শুরু করার পূর্বে সে বিষয়ে গভীর মুতালাআ করে নিতে হবে। যাতে পড়ানোর সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উস্তাদ চিহ্নিত করে দিতে পারেন। তাহলে ছাত্ররা এগুলো স্মরণ রাখার চেষ্টা করাবে।
সীরাত ও ইতিহাস বিষয়ে উর্দু নির্ভরযোগ্য তথ্য সমৃদ্ধ কিতাবাদি মওজুদ রয়েছে। সীরাতে মুগলতাঈয়ের সাথে সীরাতে ইবনে হিশাম এবং নূরুল ইয়াকীন মুতালাআ করবেন আবুল ফিদা এর সাথে মুহাজারাতে খিজরী মুতালাআ করবেন। এছাড়া আওজাযুসসিয়ার এবং উর্দু ভাষায় রচিত আরো অন্যান্য কিতাব মুতালাআয় রাখতে পারেন।
ইতিহাস ও সীরাত যে উস্তাদের যিম্মায় থাকবে তিনি রাসূলুল্লাহ সা.’র যুগ, খোলাফায়ে রাশেদ্বীনের যুগ, বনু উমাইয়ার যুগ, আব্বাসীয় যুগ, বর্তমান যুগ তথা সকল যুগে মুসলিম বিশ্বের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান অর্জন করবেন। বেফাকের নেসাবে ইতিহাসের সাথে ভূগোলকেও শামিল রাখা হয়েছে। মাদরাসার যিনি যিম্মাদার তাঁর উচিত এ ব্যাপারে উস্তাদকে সার্বিক সহযোগিতা করা। তা না হলে এ বিষয়গুলো পরিপূর্ণভাবে দারস দান সম্ভব হবে না।
৮. ইলমে আখলাক এবং ইলমে কালাম জাদীদ দু’টি নতুন বিষয়। এগুলো দারসদানের পূর্বে উস্তাদ ইলমে আখলাক বিষয়ে ইমাম গাযালী রাহ. রচিত এহয়াউল উলূম কিংবা অন্তত কীমিয়ায়ে সাআদাত মুতালা’আ করে নেবেন। আর ইলমে কালাম বিষয়ে কাসেম নানুতবী রাহ. রচিত হুজ্জাতুল ইসলাম, ইনতিসারুল ইসলাম, কেবলানামা এবং হযরত থানভী রাহ. রচিত কিতাবাদি মুতালাআ করে নিতে হবে।
বি.দ্র. : উচ্চস্তরের উস্তাদের যিম্মায় সর্বোচ্চ চারটি কিতাব দিতে হবে। এর চেয়ে বেশি নয়। তা না হলে কিতাবের হক আদায় করা সম্ভব হবে না। ছাত্ররাও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথোপযুক্ত জ্ঞান অর্জন করতে পারবে না। এর জন্য উস্তাদের কোন ত্র“টি হবে না। বর্তমানে যে সকল সমসাময়িক বিষয় নেসাবে নতুন করে শামিল করা হয়েছে এ বিষয়গুলো স্বয়ং উস্তাদের কাছেই অপরিচিত। তাই তাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গভীর মুতালাআ করে পড়াতে হবে। এ ছাড়া এ সকল বিষয়ে যে কিতাবাদি রচিত হয়েছে এর সাথে কোন টীকা-টিপ্পনীও নেই। মাদরাসার যিম্মাদারগণকে এ ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

ভাষান্তর: মাওলানা হাবীবুর রহমান কিশোরগঞ্জী

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...