খতিব তাজুল ইসলাম ::
দ্বীনের অর্থ ধর্ম বলা হয়। আরবি দ্বীন শব্দের অর্থের হক্ব বাংলা ধর্মে কতটুকু আদায় হয় তা প্রশ্নসাপেক্ষ। দ্বীনের অর্থ পরামর্শ, নসীহত, খাসলত, আদর্শ, কিয়ামতসহ আরো অনেক কিছু আছে। দ্বীনের একটি ব্যাপক অর্থ হলো জীবনব্যবস্থা। ‘ইন্নাদ্দী-না ইনদাল্লাহিল ইসলাম’ বলতে আল্লাহর মনোনীত জীবনবিধান বা জীবনব্যবস্থাকে ইসলাম বলা হয়। ধর্মের অর্থে তো জীবনবিধান বা জীবনব্যবস্থা হয়না। তাই আমি বলবো- ইসলামকে ধর্মের আবরণে প্রকাশ করা, বলা বা পরিচিতি দান খুবই দুঃখজনক এবং অবিবেচনাসুলভ কাজ।ধর্ম হিসেবে বহুল ব্যবহৃত শব্দটি ইসলামকে খাটো করে তার সীমানাকে সীমিত করে ফেলে। তাই হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খৃস্টান ধর্মের মতো ইসলামকে সেরকম আরেকটি ধর্ম বলা শুধু অন্যায় এবং অশুভনীয় নয়; অবিচারও বলতে হবে।
সাধারণ মুসলমানদের মন মগজে এ কথাটি খুব কৌশলে এবং সন্তর্পণে ঢুকানো হয়েছে। তাইতো আজ আওয়াজ উঠে যে, ধর্ম-কর্ম একটি ব্যক্তিগত বিষয়। রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোন সংযোগ থাকতে পারেনা। আসলে বিশ্বের দরবারে আমরা মুসলমানরা আজ ব্যর্থ। এর কারণ, ইসলামকে আমরা তার প্রকৃত আবেগ অনুভুতি, শিক্ষা-দীক্ষা বা বাস্তবকেন্দ্রিক ভাবে তুলে ধরতে পারিনি। প্রতিনিয়ত চলমান বদলে যাওয়া সমাজের সাথে ইসলাম যে খুব সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং আপডেট ভার্সন ছাড়াই তা অটো আপডেট হতে থাকে, তা কি আমরা উপলব্ধি করি?
সমাজতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র সহ যত মতবাদ আছে- এসবের পিছনে যত সময় ব্যয় হয়েছে মানব জাতির, যত শ্রম আর রক্ত ঝরেছে, ঝরানো হয়েছে, তার সিকিভাগও যদি ইসলামের উপর গবেষণা করে ব্যয় হতো তাহলে পুরো বিশ্বের চিত্র আজ ভিন্ন ধরনের হত।
বর্তমান বিশ্বে সমৃদ্ধি আছে, উন্নতি আছে, অগ্রগতি সবই আছে কিন্তু শান্তি নেই। নেই স্থিতিশীলতা। মানুষের প্রতি অন্য মানুষের ঘৃণা, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি-মারামারি, বোমা আর গুলীর এই সংস্কৃতি আমাদের এখন ভাবিয়ে তুলেছে। জেদ, অহংকার, অহমিকা, আত্মম্ভরিতা মানুষকে পোড়ে মারছে। চোখের সামনে কিছু উদাহরণ আছে, শোনলে হয়তো আৎকে উঠবেন। আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি। ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলি। আচ্ছা, সত্যিই কি মানুষ ধর্মীয়ভাবে স্বাধীন? মানুষ মুক্তি চায় কিন্তু সে বাঁধা অহমিকার নাগপাশে। ভারতের দলিত শ্রেণীর হিন্দুরা মুক্তি চায়। মানুষ হিসেবে বাঁচার মতো বাঁচতে চায় কিন্তু তাদের সে সুযোগ দেয়া হয় কি? মুসলমান হলেই শুরু হয় চিৎকার! ডলার আর পেট্রোরিয়ালের রটনা। না, শুধু এখানে থামেনা। হুমিক ধমকি প্রাণে মারাতো আছেই। তেমনি আমরা দেখি বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের অনুন্নত এলাকায় এনজিওরা সেবার নামে সরলমনা মানুষদের ধর্মান্তরীত করে। তারা ঈসায়ী মুসলমান, মক্কা মদীনার ছবি দিয়ে সুরা ফাতিহার তরজমা লিখে ধোকার পথ অনুসরণ করে মানুষকে ধর্মান্তরীত করছে। অথচ ইউরোপে; তাদের নিজ দেশে মাত্র ৫% শ্বেতাঙ্গ খৃস্টধর্মে বিশ্বাস করে। বাকিরা করেনা বা নাস্তিক। কারণ খৃস্টবাদের মাঝে মানুষকে পাগল বানানো ছাড়া ধরে রাখার মতো কিছু নেই। তাই কুরআন আর ইসলামের বক্তব্যের বিকৃতি ঘটিয়ে মানুষকে বেঈমান বানানোই তাদের কাজ। অথচ ইউরোপে ঝাকে ঝাকে শ্বেতাঙ্গরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। যারা নিচ্ছে, তারা উচ্চ শিক্ষীত, ইসলামের প্রকৃত মর্ম বুঝেই তারা আশ্রিত হচ্ছে ইসলামে। তাদের কেউ রুখতে পারেনা। কোনো প্রলোভন তাদের ঈমানের কমজোরী আসেনা। এজন্য ইউরোপে চলে সন্ত্রাসবাদের জিগির। খৃস্টবাদের কথা না বলে নিজেদের কৃষ্টিকালচার শেষ হয়ে যাচ্ছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে ধোয়া তুলে মুসলমানদের জীবনকে তারা বিষিয়ে তুলার চেষ্টা করছে। নানান রকম প্রোপাগান্ডা তো আছেই।
চীন, রাশিয়া, আফ্রিকায় এভাবেই মুসলমানদের উপর চলছে অত্যাচার। কোন আদর্শ আখলাক্ব সৌন্দ্যর্যের ভিত্তিতে নয়, অস্ত্র আর গায়ের জোরেই তারা ইসলাম এবং মুসলমানদেরকে ঘায়েল করার কসরত করছে। কিন্তু এর বিপরীতে মুসলমানরা ইসলাম এবং দ্বীন হেফাজতের জন্য কি কর্মসুচী নিয়েছে?
বর্তমান সমাজ ও যুগচাহিদার প্রতি লক্ষ রেখে ইসলামের ভবিষ্যৎ প্রোগ্রাম কিভাবে সাজানো দরকার, দাওয়াতী কাজের ধরণ এখন কেমন হওয়া চাই, সামাজিক রীতিনীতিকে কিভাবে ডিল করতে হবে- এসবের কোন ব্যাখ্যা নেই। কি আছে? চলো জেহাদ করো, কাফির খতম করো, ইসলামী খেলাফত কায়েম করো, চোরের হাত কাটো, জিনায় পাথর মারো, নারীদের বোরকার ভিতরে ঢুকাও, আর পুরুষদের বলো মসজিদে গিয়ে যেনো জামাতের সাথে নামায পড়ে নতুবা দুররা খাবে!
এখানে আমার কিছু প্রশ্ন আছে- বর্তমান বিশ্বে পুর্ণাঙ্গ ইসলামি কোন দেশ আছে বলে আমার জানা নেই। এই বাংলাদেশের কথাই আমরা বলি। কয়েক দশক আমরা কাটিয়ে দিয়েছি ইসলামী হুকুমত ছাড়াই। আরো অর্ধ শতের উপর দেশ আছে সমান অবস্থা। এখন আমাদের করণীয় কি? সুইসাইড করবো নাকি এভাবে সময়ের সাথে নিজেদেরক খাপ খাইয়ে নেবো, নাকি লড়াই করে মারা অথবা মরা?
ইসলাম থেকে গোটা পৃথিবী কতশত মাইল দূরে অবস্থান করছে। তাই মানুষকে তার নেচারের সাথে মন মেজাজের সাথে মিলিয়ে ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিৎ।
আমাদেরকে এখন মানুষের জীবনমুখী প্রোগ্রাম তৈরি করতে হবে। ৪০ বছর ভিডিওকে সাফ হারাম বলে ফতোয়া দিতে দিতে মুখে ফেণা তুললাম আর ময়দান খালি পেয়ে শয়তান তার পুরো ডালপালা মেলে জড় পাকিয়ে নিলো। এখন এসে বলছি- ‘হ্যাঁ, ইহা খুব জরুরী এবং দরকারি।’ ঈমানী ফরিজা ফরজে আইন বলেও কেউ কেউ ঘোষণা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। কারণ, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সয়লাব দেখে এখন টনক নড়ছে। এতো পিছনে কেন আমরা বলুন?
আমাদের মাঝে কুফর এমন একটি দেয়াল তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে, যার নাম ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষা। আমরা মাদরাসাকে বানিয়েছি ধর্মীয় শিক্ষাগার আর স্কুল কলেজ ভার্সিটিকে বানিয়েছি জাগতিক শিক্ষাগার।
মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- ‘তোমরা নামায আদায় করো আর যাকাত পরিশোধ করো।’
আরো এরশাদ করেন- ‘যা কিছু অতিরিক্ত আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো।’
আরো ফরমান- ‘আমি ব্যবসাকে হালাল করেছি আর সুদকে করেছি হারাম।’
আরো বলেন- ‘তোমরা যখন ব্যবসা বাণিজ্যের লেনদেন করবে তখন সাক্ষী রেখে চুক্তিনামা তৈরী করে লিখে নিবে।’
রাসুল সা. এরশাদ করেন- ‘ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী, তার হাশর হবে নবী সিদ্দীক্বীন সালেহিনদের সাথে।’
এরশাদ করেন- ‘শ্রমিকের পাওনা সমজিয়ে দাও তার শরিরের ঘাম শুকানোর আগে।’
কুরআন হাদীসের দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে লেনদেন মুয়ামেলাত আর মোয়াশেরাতের কথা। এমনকি ইসলামের একটি স্তম্ব হলো যাকাত।
যুদ্ধে গেলে গণিমতের মালের কথারও উল্লেখ আছে। বিয়ে-শাদি মোহরানার কথা কে না জানে। আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার কথা কতবার জানি কুরআনে এসেছে?
মাল, ধন-দৌলত, সঠিক পথে খরচ না করলে কিভাবে আগুনে পোড়তে হবে, তারও বিস্তর বর্ণনা কুরআনে আছে। এমনকি কেউ মারা গেলেও মৌরসি সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা কুরআন করে দিয়েছে।
এমতাবস্থায় আমরা যারা জাগতিক শিক্ষা বলে আলাদা কিছু দেখে শুধু মাদরাসা শিক্ষাকে দ্বীনী শিক্ষাগার বলে মনে করে তাকে ইসলামি শিক্ষা বলে চালিয়ে দেই, তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
হাদীসের তরজমাকেও আমরা আমাদের মতো করে নিয়েছি। ‘তালাবুল ইলমে ফারিজাতুন আ’লা কুল্লি মুসলিমিন…।’ (দ্বীনী) জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ।
প্রথমে জুড়ে দেয়া হয়েছে দ্বীনী শব্দটি। তারপর দ্বীনের ব্যাখ্যায় বলা হয়- দ্বীনী শিক্ষা মানেই নামায, রোযা, অজু-গোসল আর কুরআন তেলাওয়াতের শিক্ষা। এভাবে হলো দ্বীনের ব্যাখ্যার খতনা। তারপর জাগতিক শিক্ষা বলে তাকে দ্বীনী শিক্ষা থেকে আলাদা করে বলা হলো- ইহা এক প্রকার দুনিয়াদারী, যা অপছন্দনীয়। আমাদের চোখের সামনে খুব কৌশলে ইসলাম থেকে জাগতিক জীবনের প্রয়োজনীয়তার শিক্ষাটা বের করে নিয়ে আজ ফতুর জাতিতে রূপান্তরীত করা হয়েছে। এই অভিশাপ এখন আমাদের ক্ষুরে ক্ষুরে খাচ্ছে। আজ রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য কোন আলেম আইনবিদ নেই। আজ ডাক্তার প্রফেসর প্রকৌশলি ইঞ্জিনিয়ার কেউই আলেম মাঝ হতে তৈরি হয়না। কারণ, কৌশলে কুফর শক্তি মুসলমানদের ভাগ করে একটা নিদৃষ্ট সীমারেখার ভিতর আটকে দিয়েছে।
এই সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে খান খান করে দিতে হবে। দ্বীন এবং ইসলামের মৌলিক চেতনাকে আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরকে সাজাতে হবে হেরার দ্যুতিতে। ওহীর আলোয় উদ্ভাসিত হতে হবে অলি-গলি। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি, অফিস-আদালত, সচিবালয়, ক্যান্টনমেন্ট, সংসদ, ভঙ্গভবন থেকে গণভবন সবখানে সব জাগায়। ধর্মের নামে ইসলামকে খণ্ড-বিখণ্ড করার ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। আরো জোরালো ভুমিকা পালন করতে হবে। তবেই আমাদের মুক্তি আসবে।
লেখক : গবেষক, কলামিষ্ট।