লামিয়া ফেরদৌস তিনা :: গল্পটা ইউরোপের বা প্রাচীন মিশরের। এক কুমিরের ক্ষিধে পেলে কান্না করতো। কান্নার শব্দ শুনে কেউ যদি পানিতে নামতো অমনি খপ করে তাকে কুমিরটি খেয়ে ফেলতো। আমাদের ভার্সিটিতেও এরকম কুমির দেখলাম। এ নিয়ে চারবার আমাদের পরীক্ষা পেছালো। বারবার ভাবি প্রতিবাদ করবো কিন্তু হয়ে উঠে না। তবে এবার আর না লিখে পারলাম না। হয়তো ধৃষ্টতা তবু লিখছি কারণ মা আমাকে প্রায়ই বলে, মেয়ে হয়ে জন্মেছিস তাই বলে অন্যায় দেখলে চুপ করে থাকবি না।
পরিবার থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি, যে পরিবেশে বড় হয়েছি এখানে তার একদম উল্টো। অনেক আশা নিয়ে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। হতাশার সাগরে হাবুডুবু খেলাম যখন দেখি এখানকার কিছু শিক্ষক অত্যন্ত নিচু মানসীকতা নিয়ে ক্যাম্পাসে বুক ফুলিয়ে হাটে। বাংলাদেশের সবাই জেনে গেছে যে এক শিক্ষক ও কর্মকর্তা মারামারি করে পুরো ক্যাম্পাস অচল করে দিয়েছে। শিক্ষকের নাম বাছেত স্যার। উনাকে নাকি জুতা দিয়ে পিটিয়েছে ওই কর্মকর্তা। বাছেত স্যার আবার কেঁদে কেটে সব শিক্ষকদের জড়ো করে ফেলেছেন। ছোটবেলায় আমার এক বান্ধবী আমাকে চড় মেরেছিলো। এই লেখাটার আগে লজ্জায় আজ পর্যন্ত সেটা আমি কাউকে বলিনি। অথচ ভাবুন এই শিক্ষকের কতটুকু মান সম্মান কম থাকলে নিজের জুতা খাওয়ার বিষয়কে ইস্যু করে পুরা টিচারদের এক করতে উঠে পরে লেগেছেন।
পত্রিকায় খবরটি দেখার পর বাবা ফোন করে বলেন, আগে শুনতাম ছাত্ররা পড়ালেখা বাদ দিয়ে মারামারি করে। এখন শুনি তোর ভার্সিটির টিচাররাও মারামারি করে। লজ্জায় মাথা আমার হেট হয়ে যায়। গত এক দুই বছরে যা দেখেছি, এ ভার্সিটি নিয়ে আমি আর কোনদিন গর্ব করতে পারবো না। বাবাকে সেদিন বলতে পারিনি, বাবা তোমার মেয়ে যখন ভাইবা দিতে যায় তার টিচাররা চেম্বারে বসিয়ে ড্যাব ড্যাব করে তার শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একদিন খুব জ্বর, পাঁচ মিনিট ক্লাসে দেরী করে আসার কারণে আমাকে যে গালাগাল করা হয়েছিলো সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। কিন্তু ঘিন্নায় মনে মনে ওই টিচারের মুখে থু থু মেরেছি যখন সকাল নয়টায় আমি তার চেম্বারে প্র্যাকটিকাল খাতা সাইন করাতে গিয়েও পাইনি। শুনে হয়তো অবাক হবেন এখানকার টিচাররা কেউ সকাল নয়টায় আসেন না। কোনমতে গুগুল থেকে ডাউনলোড দিয়ে প্রিন্ট দিয়ে বস্তা বস্তা শিট ধরিয়ে ক্লাস শেষ। বিকালে তাদের চেম্বারে পাওয়া যায় না। ২৪ ঘন্টায় মাত্র এক ঘন্টা তাও আবার সপ্তাহে ১/২ টা ক্লাস নিয়ে একজন টিচার মাসে ৬০-৭০ হাজার টাকা বেতন পান। তাও কম হয়ে গেলো বলে আবার আন্দোলন হয় এখানে।
বাছেত স্যারকে মারা হলে বলে প্রচার হচ্ছে তার দায়িত্ব আমার মতো ছাত্র-ছাত্রীরা কেন নিবে? হুট করে বলা হলো ক্লাস পরীক্ষা সব বন্ধ। সেই শিক্ষককে যদি কেউ মেরে থাকে তাহলে তার বিচার ভিসি স্যার করবে। আমাদের কেন জিম্মি বানানো হচ্ছে। হল প্রভোস্ট বলে গেলেন, তোমরা বাড়ি চলে যাও ভার্সিটি বন্ধ। মাসের শেষ দিকে হাতে টাকা একদম নাই। বাবার কাছে সেদিন মাত্র টাকা আনলাম। এ অবস্থায় আমি পরলাম অথৈ সাগরে। বান্ধবীদের কাছে টাকা চাইবো সে মুখও নাই। কারণ মাস শেষের দিকে সবার পার্সের টাকাই তলানীতে থাকে। বাসায় যেতে আসতে মিনিমাম ২০০০ টাকা লাগবে।
ক্যাম্পাসে স্টুডেন্ট আছে প্রায় ২০০০, আমার মতো ৫০০ স্টুডেন্টকেও যদি এখন বাসায় যেতে হয় তাহলে প্রায় ১০ লাখ টাকা এ পারপাসে খরচ হবে। এ টাকা কে দিবে? বাছেত স্যার? এক সপ্তাহ বন্ধ থাকলে ক্যাম্পাস ২০০০ জন মানুষের কাছ থেকে কত মিনিট কত সেকেন্ড কেড়ে নেয়া হলো হিসেব করেন। যাই হোক বাবাকে সাহস করে পুরো ঘটনাটা বললাম। সত্য বলতে দ্বিধা নেই আমার বাবা অতো পয়সাওয়ালা মানুষ না। যে চাইলেই সেকেন্ডের ভেতর টাকা পাওয়া যাবে। এখানকার টিচাররা শিক্ষা প্রদানের নামে রমরমা ব্যবসা চালান সেরকম না আমার বাবা। টিচাররাই তাইতো ছোট্ট একটা পদ নিয়ে কারকারি করে। ছাত্রদের কাছে টাকা বিলি করে। সবাই অবশ্য পায় না। এনিয়ে আবার ছাত্রদের মধ্যে গন্ডগোল।
এইযে মারামারির ঘটনা ঘটলো, শুনলাম এটাও টাকা নিয়েই নাকি গন্ডগোল। বাছেত স্যারের বাড়ি ময়মনসিং, সে তার এলাকার নাজমুল নামে এক ছেলেকে এখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবেন। অই ছেলের কাছ থেকে নাকি পাঁচ লাখ টাকাও খেয়ে ফেলেছেন। নাজমুলের রেজাল্ট খুব কম তবু টাকার বিনিময়ে শিক্ষক হয়ে যাবে। আবার অই কর্মকর্তার বাড়ি সিলেট, সে সিলেটি এক ছেলেকে টিচার বানানোর জন্য ঠিক করছে। এ নিয়ে দু বন্ধুর মধ্যে মারামারি। বন্ধু এ কারণে বললাম কারণ, যে অফিসার তাকে মেরেছে বলে শোনা যাচ্ছে তার চেম্বারে নাকি বাছেত স্যার সিগারেট খেতে যেতো নিয়মিত। মদ্যপানের অভ্যাসও নাকি আছে উনার। শুধু তাই নয় সিগারেট খাওয়ার জন্য, তাস খেলার জন্য প্রশাসনিক ভবনের সামনে একটি বিল্ডিং নাকি দখল করেছে তারা। এগুলো বানানো কথা হতে পারে। তবে জুতা মেরেছে সবাই জানে কিন্তু কেন জুতা মেরেছে সে বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলছে না।
জানতে মন চাইছে শুধুমাত্র পলিটিক্স করলেই কি শিক্ষক হওয়া যায়? ফাস্ট ইয়ারে আমার রেজাল্ট যখন ভালো হলো তখন আমার রুমে এসে এক বড় আপু বললেন, তুমি বাসেত স্যারের বিনোদন সংগঠনে যোগ দাও তোমাকে টিচার বানিয়ে দেয়া হবে। আরেক আপু এসে বললো, তোমার বাড়ি তো ময়মনসিংহ না সুতরাং তুমি টিচার হতে পারবা না। আরেক বন্ধু বললো, আরে টাকা থাকলেই চলে, তারপর ভিসি যখন যে এলাকার সে এলাকার মানুষ হতে হয়। এখনকার ভিসি, ছাত্র পরিচালক, অর্থ পরিচালক, ডিন সবার বাড়ি খুলনা, তোর বাড়ি খুলনা না?। সুতরাং ট্রাই মেরে লাভ নাই। শিক্ষকতার যোগ্যতা যদি এই হয়, নিকুচি করি আমি এই পেশার।
একটা বিষয় লক্ষ্য করেন। এক শিক্ষককে মারা হইছে অথচ একটা ছাত্রও এর প্রতিবাদ করলো না। শিক্ষার্থীদের কতটুকু ঘৃণা থাকলে এরকমটা হতে পারে। একটা ফাঁকা বুলি মাঠে ছাড়া হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবচে মেধাবী স্টুডেন্ট। এই যে টিচারকে সামনে নিয়ে সিকৃবিতে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ করে দিছে, সে শিক্ষকের এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স সলল বিষয়ে নাকি সেকেন্ড ক্লাস। ওয়ার্ল্ড ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স না পিএইচডি করে নামের পাশে ডক্টর লাগায় সে ভার্সিটির সকল সার্টিফিকেট ভুয়া বলে সরকার ঘোষণা করেছে।
যার নিজের যোগ্যতা নাই সে আমাকে কিভাবে যোগ্য বানাবে? তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন কিন্তু টাকা খেয়ে বিএনপি ও ছাত্রশিবিরের ক্যাম্পাসের বড়ভাই মুজাহিদ ভাই ও শারমিন আপুর এখানে টিচার বানিয়েছে বলে শোনা যায়। মুজাহিদ ভাইয়ের বিএনপির মিছিলের ছবি সবার কাছে আছে। শারমিন আপুর নিয়োগ পাওয়ার কদিন পর উনাকে আপু বলে ডেকেছিলো আমার এক বান্ধবী। সে নাকি পারলে মারতে আসে আর বলে, আর আপু ডাকবা না, এখন থেকে ম্যাডাম। যারা শেখাবেন অহংকার করো না, মিথ্যা বলো না, ভালো কাজ করো, তারা নিজেরাই যদি খারাপ কাজ করে আমরা শিখবো কি? মজার কথা হলো, পরে শুনলাম শারমিন আপু বাসেত স্যারের সংগঠনে যোগ দিয়েছেন।
খুব চাইছিলাম গায়ে মানে না আপনি মোড়লদের নিয়ে কিছু লিখবো না। আমি বলছিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক খারাপ। তবে এটা সত্য শিক্ষক হওয়ার পর তাদের আচার আচরণ জঘন্য রকমের খারাপ হয়ে যায়। একটা কথা জানানো দরকার, এ ঘটনা ঘটার আগে এখানকার ড্রাইভাররা একহয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রক্টর বাসেত স্যার আর ছাত্র পরিচালক মতিউর স্যারকে তারা গাড়িতে উঠাবে না। চাকরী চলে গেলেও না। এদের আচরণ কতটুকু খারাপ হলে কর্মচারীরা পর্যন্ত এরকম ঘৃণা তৈরী হতে পারে বলে একবার চিন্তা করুন। আইসিসির তিন পরাশক্তি দেশের কথা সবাই জানে। ক্রিকেট নিয়ে যা ইচ্ছা তা তারা করছে। এই সিলেটে যে নিরবে আইসিসির মতো আরেকটি বাজে মানুষের দল শক্তি অর্জন করছে সে বিষয়ে সচেতন থাকা দরকার। এরা স্টুডেন্টদের কথা চিন্তা করে না। মাস শেষে মোটা অংকের টাকা দিয়ে নিজেদের পকেট ভরলেই চলে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি আমার লেখাটি পড়ে থাকেন তাহলে অনুরোধ করছি, বাসেত স্যারকে যত ইচ্ছা পোস্ট দেন, ভিসি বানাই দেন। কোটি কোটি টাকা পয়সা দিয়ে দেন। তবু বলেন ক্যাম্পাসটাকে খুলে যাতে দেয়। যত দ্রুত সম্ভব ডিগ্রী নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে চাই। campuslive24.com
লামিয়া ফেরদৌস তিনা, শিক্ষার্থী, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।