বাংলাদেশে ইসলামী সাহিত্য-সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক মহাপরিচালক বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ শাইখুল আরব ওয়াল-আজম আলহাজ মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইউনুস (প্রকাশঃ হাজী সাহেব হুজুর) রহ. (১৯০৬-১৯৯২) এর অবদান এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা। এই মহান ব্যক্তিত্ব নিজে সাহিত্যিক কিংবা সাংবাদিক না হলেও সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে ইসলামের শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রচার-প্রসার ঘটানোর গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। এক ইশতেহারে তিনি বলেন, ‘…দরসে নেজামীতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা শিক্ষা দেওয়ার গুরুত্ব নেই। এ কারণেই আমাদের আমাদের ক্বওমী মাদরাসাসমূহের ফারিগ (গ্র্যাজুয়েট) ছাত্ররা বিশুদ্ধ বাংলা না বলতে পারে আর না লিখতে পারে। অথচ আমাদের শ্রোতা বা পাঠকগণের অধিকাংশই বাংলাই বুঝে। এর ফলে ধর্মীয় শিক্ষার উদ্দেশ্য তাবলীগ ও দাওয়াতের পরিধি অধিক থেকে অধিক সংকুচিত হয়ে পড়ছে’ [আমার জীবনকথা- মাওলানা সুলতান যওক নদভী, পৃ. ১৮৪]। তাই বাতিলপন্থী সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মোকাবেলায় হকপন্থী সাহিত্য ও সাংবাদিকতা সৃষ্টিতে তিনি এমন কিছু বলিষ্ঠ ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, যা ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে এ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
ইসলামী সাহিত্য-সাংবাদিকতায় হাজী মাওলানা ইউনুস রহঃ এর কালজয়ী কর্মযজ্ঞ
সাঈদ হোসাইন::
সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় ছাত্রদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে তিনি জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় যে বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, সে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল।
আরবি সাহিত্য ও ইসলামী গবেষণা বিভাগঃ সকল ইসলামী জ্ঞানের মূল হচ্ছে আরবি ভাষা। আরবি ভাষায় দক্ষ না হলে তাকে ইসলামী জ্ঞানের পথে তাকে অন্ধের মতো পথ চলতে হয়। আরবি ভাষায় দক্ষ আলেমে দ্বীন সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘আরবি সাহিত্য ও ইসলামী গবেষণা বিভাগ’ নামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ। উক্ত বিভাগে আরবি ভাষা ও আধুনিক সাহিত্যে দক্ষতা ও পারদর্শিতা অর্জনের নিমিত্ত ব্যাপক সুবিধা প্রদান করা হয়। আরবি সাহিত্যের প্রাচীন ইতিহাস থেকে শুরু করে আরবি সাহিত্যের আধুনিক গতিধারা সম্পর্কে পাঠদান হয়। আরবি ভাষার সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা পাঠ এবং প্রতিটি সাহিত্য ও সংস্কৃতিমূলক সেমিনারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ছাত্ররা আরবি ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষ হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। জামিয়ার শ্রেষ্ঠ আরবি অধ্যাপক ছাড়াও মিশর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রিধারী তিনজন মিশরী অধ্যাপকও উক্ত বিভাগে পাঠদান করেছিলেন এক সময়।
বাংলা সাহিত্য ও ইসলামী গবেষণা বিভাগঃ স্নাতকোত্তর বিভাগসমূহের মধ্যে বাংলা বিভাগ একটি অনন্য বিভাগ। এ বিভাগটি চালু করেন ১৩৮৪ হিজরি মোতাবেক ১৯৬৫ ঈসায়ীতে। এ বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত সুযোগ্য ও প্রতিভাবান অধ্যাপক ও বিশিষ্ট আলেমদের মাধ্যমে ছাত্রদের শিক্ষা প্রদান করা হয়। উক্ত বিভাগ সমাপনকারী অনেক ছাত্র আজকের দেশ ও জাতির বৃহত্তম খেদমতে নিয়োজিত আছেন। মাতৃভাষা বাংলায় বুৎপত্তি অর্জন করে অনেকে খ্যাতিমান সাহিত্যতিকের পদ অলঙ্কৃত করেছেন।
উক্ত বিভাগের ছাত্রদেরকে এক বিশেষ পদ্ধতিতে পাঠদান করা হয়। বাংলা, গণিত, ইংরেজি, ইসলামের, ইতিহাস, ইসলামী রাজনীতি, ভুগোল শাস্ত্র, আরবি ও উর্দু অনুবাদ প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা প্রদানের সাথে সাথে বক্তৃতা অনুশীলন, প্রবন্ধ ও পুস্তিকা রচনায় ছাত্রদেরকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। বর্তমান যুগের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী অন্যান্য ভাষা আরবি-উর্দু হতে ধর্মীয় গ্রন্থাবলী অনুবাদ এবং বাংলা, উর্দু ইত্যাদি ভাষা থেকে আরবিতে ভাষান্তর করার যোগ্যতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয় [কুতবে জমান, শাইখুল আরব ওয়াল-আজম আল্লামা শাহ হাজী মুহাম্মদ ইউনুস রহ. জীবন, কর্ম , অবদান- মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, ফেব্রুয়ারী ২০১৫, পৃ. ১৮২-১৮৩]।
কাব্যচর্চা বিভাগঃ সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার মূলে রয়েছে কবিতা চর্চা। মানুষের মন, মানসিকতা ও পরিবেশিক বিপ্লব-সৃষ্টির পেছনে কবিতার ভূমিকা অগ্রগণ্য। জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কুতবে জমান মাওলানা মুফতী আজিজুল হক রহ. একজন প্রতিভাধর স্বভাবকবি (অবশ্যি আরবি-ফার্সি-উর্দু ভাষায়; বাংলায় নয়)। সে সূত্র ধরে জামিয়ার ফাজেলীনদের (শিক্ষাসমাপনকারী) ওপর এটার খুব ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের অন্যান্য প্রাচীন মাদরাসার তুলনায় পটিয়ার ফাজেলীনরা সাহিত্যমনা ও লেখকপ্রকৃতির হয়ে থাকেন।
হাজী সাহেব হুজুর নিজে ওই সাহিত্যিক-প্রকৃতির না হলেও পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন খুব সজাগ ও দরদী। তাঁর আমলেই কাব্যচর্চামূলক বিভাগটি একটি স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদা লাভ করে। তাঁর যুগে কাব্যদক্ষ শিক্ষকগণই এ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ বিভাগের অধীনে দক্ষ শিক্ষকমণ্ডলির তত্ত্বাবধানে ছাত্ররা বিশুদ্ধ কাব্যচর্চায় ব্রতী হয়। আরবি-উর্দু-ফার্সি-বাংলা ভাষায় চর্চা হয় কবিতা,সাহিত্যের আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় কবিতা-অনুষ্ঠান। বিভাগটি এখনো প্রাণবান রয়েছে [প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৬]।
লেখালেখি ও কবিতাচর্চায় পটিয়ার ছাত্রদের অর্জনঃ এ সম্পর্কে হাজী সাহেব হুজুরের ঘনিষ্ঠ ছাত্র, তাঁর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত তৎকালীন জামিয়ার শিক্ষক, দেশ-বিদেশখ্যাত আরবি-উর্দু-ফার্সি ভাষার সাহিত্যিক মাওলানা সুলতান যওক নদভী (দা.বা.) তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জীবনকথা’তে লিখেন, (মূল গ্রন্থের বানান-পদ্ধতি ও ভাষা-রীতি অক্ষত রাখা হয়েছ।) লেখালেখি এবং কবিতাচর্চায় পটিয়া মাদরাসার ছাত্রদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা শিক্ষিত জনের কাছে সুবিদিত ও স্বীকৃত ছিল। মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুফতী আযীযুল হক সাহেব এর কাব্য প্রতিভা এবং লেখক প্রতিভাই ছিলো এখানে মূল প্রেরণাদানকারী বিষয়। উস্তাদ্গনের ভিতরে হযরত ইমাম সাহেব (রহ.), হযরত আলী আহমদ খিলী সাহেব (রহ.), হযরত মুফতি ইবরাহীম সাহেব (রহ.), হযরত মাওলানা দানেশ সাহেব (রহ.) এর মতো কবি-সাহিত্যিকদের উপস্থিতিই যেন ছিলো তখন এমন এক মেশিন যা ছাত্রদের লেখক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলতো এবং বর্ণিল করে দিতো। পরবর্তীতে এই অধমকে দিয়েও আল্লাহ পাক এই মহান খিদমতকে বেগবান করেছেন। এমন কি মাদরাসার সীমানার বাইরেও ছাত্রদের সাহিত্য চর্চা ও কাব্য প্রীতির ডংকা বেজে উঠেছিলো [পৃ. ১০৯]।
ইসলামী সম্প্রচার ও সংবাদ-সংস্থাঃ ইসলামী সম্প্রচার ও সংবাদ সংস্থাটি হাজী সাহেব হুজুরের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সনিষ্ঠ উদ্যোগে এক কঠোর প্রতিবাদী সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ইসলামের চরম শত্রু কাফির-মুশরিক বিশেষ করে ইহুদী চক্রের জঘন্য মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে এটি একটি শক্তিশালী প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। এ সংস্থা ইসলামী দুনিয়ার উপর আক্রমণ, ইহুদী-খ্রিস্টানসহ কাফির জগতের ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা, ইসলামের ইতিহাসের বিকৃতিসাধন এবং নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার বিরুদ্ধে বস্তুনিষ্ঠ ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ইসলামবিদ্বেষী সাংবাদিকতা ও সম্প্রচারের মোকাবিলায় জামিয়ার মহাপরিচালক গ্রহণ করেন সুদূরপ্রসারী এক মহা পরিকল্পনা।
মাসিক আত্-তাওহীদ প্রকাশঃতিনি লক্ষ করেন আধুনিক সভ্যতার কুসংস্কৃতি প্রতিরোধ করতে হলে এবং ইসলামী আদর্শ-ঐতিহ্য এবং বাঙালি মুসলমানদের অতীত-ঐতিহ্য, ধর্ম ও চরিত্রকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হলে বাংলা ভাষা শেখার বিকল্প নেই। একথা উপলব্ধি করেই তিনি ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে ইসলামের শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রচার-প্রসার ঘটানো আলেমদের পবিত্র দায়িত্ব। আর এ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী মুখপত্রের। এমহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি মাসিক আত-তাওহীদ প্রকাশে ব্রতী হন ১৯৭০ সালের শুরুতে।
মাতৃভাষা বাংলায় দীনের খেদমত গতিশীল ও শক্তিশালী হোক- এই ব্রত নিয়েই তিনি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। বাংলা ভাষার চর্চা, গবেষণা, অনুবাদ, রচনা ও সাহিত্যের মাধ্যমে ইসলামের উত্তম ও বৃহত্তম খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার জন্যে তিনি জামিয়ার মসজিদের ‘মিনার’ কক্ষে অনুবাদ ও রচনা বিভাগ চালু করেন। বাংলাদেশের ইসলামী পত্র-পত্রিকার মধ্যে মাসিক মদিনার পরেই এর স্থান। বর্তমানে আত-তাওহীদ দেশ-বিদেশে বহুল পরিচিত ও পঠিত। জ্ঞান- বিজ্ঞান, ধর্ম ও সাহিত্য, প্রবন্ধ এবং কুরআন ও হাদীসের শাশ্বত বাণী দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার ব্যাপারে এর গুরুত্ব অপরিসীম ও অনস্বীকার্য। পাশ্চাত্য ও হিন্দুয়ানী কুসংস্কৃতির আগ্রাসনের তীব্র প্রতিবাদে আত-তাওহীদ বলিষ্ঠ ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর [কুতবে জমান, শাইখুল আরব ওয়াল-আজম আল্লামা শাহ হাজী মুহাম্মদ ইউনুস রহ. জীবন, কর্ম , অবদান- মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, ফেব্রুয়ারী ২০১৫, পৃ. ১৯৩]।
দেশের বরেণ্য ইসলামী সাহিত্যিক মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ, ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনসহ অনেক ইসলামী লেখকের জীবনের প্রথম ছাপার অক্ষরে লেখা এই পত্রিকায়ই প্রকাশিত হয়েছিল। তাই বলা যায়, এই পত্রিকাটি বর্তমান সময়ের খ্যাতিমান অনেক ইসলামী লেখকের প্রেরণার বাতিঘর ছিল এবং ইসলামী লেখক সৃষ্টিতে এই পত্রিকা স্বর্ণোজ্জ্বল ভূমিকা রেখে চলছে।
আস্-সুবহুল জাদীদ, আত্-তাবলীগ ও আদ্-দাওয়াহ্ ওয়াল ইরশাদ প্রকাশঃ ভাষা ও সাহিত্যের মূল ও মহৎ উদ্দেশ্যাবলি বাস্তবায়ন করা এবং সাহিত্যমুখী একটি পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ‘আস্-সুবহুল জাদীদ’ নামে একটি আরবি পত্রিকা বের করা হয় তৎকালীন পটিয়ার স্বনামধন্য শিক্ষক মাওলানা সুলতান যওক নদভীর সম্পাদনায়। পত্রিকাটি সাহিত্যিক শ্রেণীর কাছে বেশ প্রীতিও অর্জন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কিছুদিন পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর জামিয়াকর্তৃপক্ষ ‘আত্-তাবলীগ’ নামে একটি আরবি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেটিও কয়েকটি সংখ্যা বের হওয়ার পর একই পরিস্থিতির শিকার হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর জামিয়ার উচ্চ পরিষদ (মজলিসে আমেলা) সম্মত হয় ‘আদ্-দাওয়াহ্ ওয়াল ইরশাদ’ নামে একটি আরবি পত্রিকা প্রকাশ করতে। এবং সিদ্ধান্ত মোতাবেক আলোর মুখও দেখে সেটি। কিন্তু কেন-কখন-কীভাবে সেটি বন্ধ হয়ে যায়, সে কথা জানা যায় নি [প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৪-১৯৫]।বর্তমানে ‘বালাগ আশ-শারক’ নামে একটি আরবি সাময়িকী নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। পত্রিকাটির সম্পাদক ও যুগ্মসম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন মাওলানা ওবাইদুল্লাহ হামযা ও ড. আ ফম খালিদ হোসেন।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতাঃ হুজুরেরই পৃষ্ঠপোষকতায় জামিয়ার বাংলা সাহিত্য বিভাগ থেকে একটি বাংলা পত্রিকা বের হত ‘দর্পণ’ নামে। এতে বিভিন্ন উপলক্ষে লিখিত ছাত্রদের প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো ছাপা হত। এছাড়াও প্রকাশ করা হত ধর্ম, সাহিত্য, ইতিহাস ও সমাজবিষয়ক লেখা। অন্যান্য পত্রিকা ও সাময়িকীর মতো এটির প্রকাশও ধারাবাহিকতা লাভ করে নি। … হাজী সাহেব হুজুরের পৃষ্ঠপোষকতায় আরবি ভাষা বিভাগের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্ররা (আল-আযীয নামে) একটি দেয়ালিকা বের করত। এতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ছাত্রসহ অন্যান্য কচি-কাঁচারা নিজের অনুভূতি লিখত আরবি ভাষায়। এভাবে তারা ভবিষ্যতে একজন আদর্শ বিপ্লবী লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখত। ১৪০০ হিজরির শুরুর দিকেই দেয়ালিকাটির যাত্রা শুরু। দেওয়ালিকাটির সার্বিক তত্ত্বাবধান ও দিকনির্দেশনায় ছিলেন জামিয়ার শিক্ষক আবু তাহের নদভী [প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৪-১৯৫]
দৈনিক জিন্দেগী নামক নেজামে ইসলাম পার্টির মুখপত্র প্রকাশে তাঁর উদ্যোগী ভূমিকা এবং অর্থসংগ্রহে তাঁর অবদান পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট কারো অজানা নয় [প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৫]।
প্রখ্যাত আলমে দীন, সুলেখক ও রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী লিখেন, জমিয়তে ওলামার মুখপাত্র সাপ্তাহিক জমিয়ত প্রকাশিত হওয়ায় তিনি খুবই খুশি হন এবং এর স্থায়িত্ব ও কবুলীয়তের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। তিনি নিজেও ছিলেন সংবাদপত্রের একজন পৃষ্ঠপোষক [আত্-তাওহীদ হাজী ইউনুস রহ. বিশেষ সংখ্যা, আগস্ট ১৯৯২]।
ইসলামী মিশনারী কেন্দ্র স্থাপনঃ এ সম্পর্কে হাজী সাহেব হুজুরের জীবদ্দশায় মাসিক আত্-তাওহীদের ১৯৯০-এর জুন সংখ্যায় অধ্যাপক সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম ‘ইসলামী মিশনারী পর্যায়ে জামিয়ার ভূমিকা’ শীর্ষক লেখায় ‘চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লায় ইসলামী কেন্দ্র স্থাপন’ উপশিরোনামে লিখেন, ‘প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিদায়ী ছাত্র, আলেম ও মুবাল্লিগদের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে যাতে ইসলামের ব্যাপক প্রচারকার্য পরিচালনা করা যায়, সে জন্য ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এখানে দ্বিতল এক বৃহৎ অট্টালিকা (অট্টালিকা তো নয়, ভবন) নির্মাণ করা হয়েছে। যুগোপযোগী গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা ও মাসিক আত্-তাওহীদ প্রভৃতি প্রকাশনা ও প্রচারের দায়িত্ব এ কেন্দ্রের মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে। ‘ইসলামী মিশনারী কেন্দ্র’ প্রকাশনার ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার লক্ষ্যে অফসেট প্রেস স্থাপনের কার্যকরী ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন [মাসিক আত্-তাওহীদ, জুন ১৯৯০, পৃ. ২২]।
‘বাংলাদেশ ইসলামী গবেষণা পরিষদ’ গঠনের উদ্যোগঃ যুগসচেতন অলিয়ে কামেল মৃত্যুর মাত্র দু’মাস আগে এক যুগোপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করার জন্য সব ব্যবস্থা করে যান। সেটি ছিল, বাংলাদেশ ইসলামী গবেষণা পরিষদ গঠনের উদ্যোগ।
১৪১২ হিজরির ৬ জুমাদাস-সানি মোতাবেক ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯১ ঈসায়ীর কথা, সেদিন ”আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ”র কেন্দ্রীয় বৈঠক ছিল। হজরত হাজী সাহেব হুজুর আঞ্জুমানের সভাপতি হিসেবে উপস্থিত সদস্যদের লক্ষ করে একটি প্রস্তাব পেশ করে বলেন, আমার মনের বড় আকাঙ্ক্ষা, আধুনিক সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান বের করার জন্য আঞ্জুমানের অধীনে দেশের যোগ্য-দক্ষ আলেম মুফতীদের দিয়ে একটি পরিষদ গঠন করা হোক, যাঁরা সকলেই এ পরিষদের সদস্য গণ্য হবেন। তারপর কোন সমস্যা সামনে আসলে সকলে পরস্পর আলোচনা-পর্যালোচনা ও মতবিনিময় করে সেটি সমাধান করবেন। সমাধানটি সপ্রমাণ লিপিবদ্ধ করে দেশ-বিদেশের দক্ষ ও অভিজ্ঞ মুফতীগণের কাছে পাঠানো হবে। তাঁদের সত্যায়নের পর তা পুস্তকাকারে প্রকাশ করে জাতির কাছে পেশ করা হবে।
এমন সুন্দর ও যুগোপযোগী প্রস্তাবটি সকলে বিনাবাক্যে সমর্থন করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, উক্ত বৈঠকের দু’মাস পর (১৪/২/১৯৯২)-এ তিনি এন্তেকাল করেন। তাঁর আন্তেকালের এক বছর পর ২৫ রবিউস-সানি ১৪১৩ হিজরির এক বৈঠকে হুজুরের উদ্যোগ-নেওয়া পরিষদটির নাম রাখা হয় ‘বাংলাদেশ ইসলামী গবেষণা পরিষদ’। পরিষদ থেকে এ পর্যন্ত দু’টি গবেষণা-পুস্তিকা বের হয়েছে। প্রথমটি তৈরি করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার তৃতীয় পরিচালক মাওলানা হারুন ইসলামবাদী (রহ)। পুস্তিকাটির নাম ‘ইসলামী অর্থনীতির কতিপয় মূলনীতি’। দ্বিতীয় গবেষণা-পুস্তিকাটির নাম ‘আধুনিক দশটি সমস্যার যুতসই সমাধান’। পুস্তিকাটি সম্পাদনা করেন পরিষদ-সম্পাদক মাওলানা মুফতী আহমদুল্লাহ সাহেব [কুতবে জমান, শাইখুল আরব ওয়াল-আজম আল্লামা শাহ হাজী মুহাম্মদ ইউনুস রহ. জীবন, কর্ম , অবদান থেকে সংক্ষেপিত, লেখক- মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, ফেব্রুয়ারী ২০১৫, পৃ. ২৩৩-২৩৫]
আরবি ভাষা একাডেমি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাঃ এ কমপ্লেক্সের প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে আরবি ভাষার আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে ও নব আঙ্গিকে বেগবান করা। মূলীভূত মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আরবি সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী ও দক্ষ ব্যক্তিবর্গ নিয়ে গঠন করা হয় একটি ভাষা-পরিষদ। প্রতিষ্ঠার পর এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত পেশ করা হয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু অভিধান রচনার। যেমন, আরবি-বাংলা, বাংলা-আরবি, উর্দু-বাংলা, বাংলা-উর্দু ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ কমপ্লেক্স কতদিন টিকে ছিল, কোন কাজ জাতিকে উপহার দিতে পেরেছিল কিনা? সে সম্পর্কে কিছুই জানা যাচ্ছে না [প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৪]
‘ইদারাতুল মাআরিফ’র গতিসঞ্চারে তাঁর ভূমিকাঃ ইসলামী জ্ঞান ও প্রজ্ঞার গভীর গবেষণা, কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক বিষয়াদির সর্বাত্মক প্রসার এবং বাতিল ধর্ম ও মতবাদসমূহের অসারতা তুলে ধরার উদ্দেশ্যে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার তীব্র প্রয়োজন হয়ে ওঠলে ১৯৬৭ সালে ‘ইদারাতুল মাআরিফ’ নামে একটি যুগবিরল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন সাধনাজগতের প্রবাদপুরুষ ও ইসলামী জ্ঞান-গবেষণা-জগতের অনন্য দিশারী হজরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.। ১৯৬৯ সালে হজরত ফরিদপুরী রহ.-এর এন্তেকাল হলে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হন শাইখুল আরব ওয়াল-আজম আলহাজ মুহাম্মদ ইউনুস রহ.। সেই থেকে প্রতিষ্ঠানটির অবলুপ্তি (১৯৭৬) পর্যন্ত তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন প্রতিষ্ঠানটির গতিসঞ্চারের জন্য [প্রাগুক্ত, পৃ. ২২৮]।
এ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন গবেষণা-অধ্যাপক অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাক সাহেবের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে এই ইদারা তথা গবেষণা একাডেমীর উদ্দ্যশ্য ছিল ইসলামের শাশ্বত শিক্ষা কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক গবেষণা এবং মানব জাতির নিকট ইসলামকে একমাত্র মুক্তির সনদ হিসেবে উপস্থাপিত করার উদ্দ্যশ্যে লেখক ও সাংবাদিক সৃষ্টি করা। এ উদ্দেশ্যের প্রেক্ষাপটে একটি দু’বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্সও বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা হয়। এর পয়লা বছর যেহেতু এ দেশের মাদরাসা শিক্ষিত লোকেরা জাগতিক বহু বিষয়ে অজ্ঞ থেকে যান সেহেতু রাজনীতি, অর্থনীতি, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি মৌলিক জ্ঞানের সাথে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ এবং সাংবাদিকতার মৌলিক বিষয় শিক্ষা দেওয়া হতো এবং পরবর্তী বছরে উপযুক্ত গবেষণা-নির্দেশকের অধীনে নির্দিষ্ট বিষয়ে গবেষণা-পুস্তিকা রচনার ব্যবস্থা অবলম্বন করা হতো।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম সভাপতি ছিলেন হজরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.। তাঁর ইন্তেকালের পর দ্বিতীয় সভাপতি ছিলেন বাংলার অন্যতম দেশবরেণ্য আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ হজরত মাওলানা ইউনুছ সাহেব রহ.। পটিয়া জামিয়া ইসলামিয়ার ন্যায় একটি বিরাট ও বহুমুখী ইসলামী প্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিচালনার মহান দায়িত্ব পালন করার সাথে সাথে ‘ইদারাতুল মাআরিফের’ পরিচালনায় অনেক সময় সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাল ধরে ঢাকায় অবস্থান করতে বিন্দুমাত্রও কার্পণ্য করেননি।
… এ প্রতিষ্ঠানে শত শত গ্রন্থ অধ্যয়ন করে এবং লেখা ও গবেষণা প্রশিক্ষনের পর যারা উত্তীর্ণ হয়েছেন তাঁদের লিখিত পুস্তক-পুস্তিকার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল, ১. ইসলাম ও কমিউনিজম ২. ইসলাম ও পুঁজিবাদ ৩. খ্রীষ্টান ধর্মের ঐতিহাসিক সমীক্ষা ৪. কাদিয়ানী মাযহাবের পটভূমি ৫. ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
অনূদিত পুস্তকের মধ্যে উল্লখযোগ্য হলঃ ১. খুলাফায়ে রাশেদীন, ২. মুহাজিরীন (নাদওয়া) আর যেসব পুস্তক বা পুস্তিকা এই প্রতিষ্ঠানের অর্থে বা সহযোগিতায় প্রকাশিত হয়েছিল তার মধ্যে উল্লখযোগ্য হল, ১. ইসলামের অর্থনৈতিক সংস্কার ২. ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি ৩. রাশিয়ার করাল গ্রাসে তুর্কিস্তান ৪. ইসলামী নিযামে মাঈশাত কে চাঁন্দ উসূল (উর্দু) [হজরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহঃ) স্মারকগ্রন্থ থেকে সংক্ষেপিত, আল-কাউসার প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯,পৃ. ২২৩-২২৫]।
ইসলামী সাহিত্য-সাংবাদিকতার জন্য মাওলানা মুহাম্মদ ইউনুসের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আর আমাদের জন্য ইসলামী সাহিত্য-সাংবাদিকতার উন্নতি সাধনে তাঁর এই স্বর্ণোজ্জ্বল কর্মগুলো আজীবন পথনির্দেশক হয়ে থাকবে। আল্লাহ তাঁকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন এবং জান্নাতুল ফেরদাউসে আলা মকাম দান করুন। আমিন।