শনিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ ভোর ৫:২৯
Home / অনুসন্ধান / আরবি ভাষা-সাহিত্য ও তরবিয়তী কর্মশালায় প্রদত্ত প্রশিক্ষকবৃন্দের আলোচনার সারসংক্ষেপ

আরবি ভাষা-সাহিত্য ও তরবিয়তী কর্মশালায় প্রদত্ত প্রশিক্ষকবৃন্দের আলোচনার সারসংক্ষেপ

মা’হাদুশ শাইখ ইলিয়াস রহ. যাত্রাবাড়ী ঢাকা ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইসলামী মাদরাসা হাটহাজরী চট্টগ্রাম’র যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আরবি ভাষা-সাহিত্য ও তরবিয়তী কর্মশালা’য় প্রদত্ত প্রশিক্ষকবৃন্দের আলোচনার সারসংক্ষেপ-

সংকলন- সাঈদ হোসাইন::

১. মাওলানা আনোয়ার শাহ আজহারী। আদীব হাটহাজরী মাদরাসা। তাঁর বিষয় ছিল ইনশা। এ সম্পর্কে তাঁর আলোচনার সারসংক্ষেপ- প্রাথমিক পর্যায়ে আরবি ভাষা শেখার জন্য প্রয়োজন হল আরবি শব্দ মুখস্ত করা। তারপর শব্দগুলোকে ছোট ছোট বাক্যে প্রয়োগ করা। বেশি বেশি আরবি ভাষাজ্ঞান অর্জনের জন্য আরবি কিতাব অধ্যয়ন করা। একটি লেখা পড়ে তা নিজ সৃষ্ট আরবিতে প্রকাশ করা। আরবিতে চিন্তা করা। রোজনামচা লেখা। নাহু-সরফ-ইমলা’র কাওয়ায়েদগুলো জানা। মুতারদিফ শব্দ সম্পর্কে অবহিত হওয়া। সহিহ আলফাজ ব্যবহার করা। আবুল হাসান আলী নদভী রহ বলেছেন- ‘যে এক পৃষ্ঠা লিখতে চাই তার একশ পৃষ্ঠা পড়া প্রয়োজন। আর যে একশ পৃষ্ঠা লিখতে চাই তার এক হাজার পৃষ্ঠা পড়া প্রয়োজন।
২. মাওলানা হাবীবুল্লাহ। ত্রৈমাসিক আরবি পত্রিকা ‘আন নূর’ এর সম্পাদক ও মুজাহিরুল উলুম মাদরাসার শিক্ষক। তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল আরবি কাব্যশাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা। আলোচনার সারসংক্ষেপ- পবিত্র কুরআনে শা’য়েরদের সমালোচনা করা হয়েছে। তবে এখানে ইস্তেসনা করা হয়েছে- ‘ইল্লাল্লাজিনা আ’মানু…’ বলে। অর্থাৎ যারা কবিতাকে কল্যাণের বার্তাবাহক বানিয়েছেন তারা ব্যতীত। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও বিভিন্ন সময় কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং সাহাবাদেরকেও উৎসাহিত করতেন। সাহাবাদের কারো কারো কবিতায় তিনি শব্দের পরিবর্তনও করে দিতেন। কবিতাকে তিনি মূল্যায়ন করেছেন। অতীত ও নিকট অতীতের প্রসিদ্ধ তাফসিরগুলোতে কুরআনের বালাগাত-ফাসাহাত বোঝার জন্য জাহেলি যুগের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছ। তাহলে বুঝা যায় কুরআন বোঝার জন্য কাব্যশাস্ত্র সম্পর্কে জানা আবশ্যক। প্রতিটি ক্ষেত্রে কাব্যশাস্ত্র অপরিহার্য। তাই আরবি কাব্যশাস্ত্রের গতি-প্রকৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা রাখা খুবই জরুরী।
৩. মুফতি আব্দুল্লাহ নাজীব। মারকাযুদ দাওয়াহর সাবেক কৃতি ছাত্র। হাটহাজরী মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক। তাঁর বিষয় ছিল জাদিদ ও কদিম আরবি। আলোচনার সারসংক্ষেপ- কুরআন মাজিদ নাজিলের আগে যে আরবি ব্যবহার হত তা কদিম আরবি। আর কুরআন মাজিদ নাজিলের পরে যে আরবি ব্যবহার হয় তা হল জাদিদ আরবি। জাদিদ আরবি বিকশের কারণ হল- ১ প্রযুক্তির কারণে নতুন শব্দ গঠিত হয়। ২. ইউরোপের প্রভাবে আরবি শব্দ ও বাক্যে নতুনত্ব এসেছে। ৩. আরবি সাহিত্যিক মহলে ইউরোপের রচনার প্রভাবেও ভাষা ও সাহিত্যে নতুনত্ব এসেছে। আজকাল আমরা আরবি পত্রিকা পড়ে বুঝতে না পারার কারণ হল নতুন নতুন পরিভাষাগুলো সম্পর্কে ধারণা না থাকা। এখন প্রয়োজন জাদিদ ও কদিম আরবির সমন্বয়ে আরবি সাহিত্য চর্চা করা। এর জন্য প্রয়োজন একজন মাহের উস্তাদের সুহবত।
৪. মাওলানা ফুরাকানুল্লাহ খলিল। আদীব ও মুহাদ্দিস, জামিয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া। তাঁর বিষয় ছিল ‘কিতাবি দুর্বলতা দূর করার উপায়’। আলোচনার সারসংক্ষেপ- নাহু-সরফের কওয়ায়েদ সূরা ফাতেহার মতো মুখস্ত রাখা। নাহু-সরফের অনুশীলনমূলক চর্চা করা। বালাগাতের কায়েদাগুলো ভালোভাবে রপ্ত করা। দরসী কিতাবের পাশাপাশি গাইরে দরসী কিতাবও মুতালাআ করা। আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশমিরি রহ. ও শাইখুল আদব ওয়াল ফিকহ আল্লামা ইজাজ আলী রহ. প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম হাজার হাজার কিতাব মুতালাআ করেছেন। এ জন্যই তাঁরা বড় হতে পেরেছেন। শুধু দরসী কিতাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। গাইরে দরসী কিতাবও প্রচুর পরিমাণ মুতালাআ করতে হবে।
৫. মাওলানা আহমদ দিদার। সিনিয়র শিক্ষক, হাটহাজরী মাদরাসা। তাঁর বিষয় ছিল বালাগাত। আলোচনার সারসংক্ষেপ- ‘আস-সরফু উম্মুল উলুম উয়ান-নাহও আবুহা ওয়াল বালাগাতু শাইখুল উলুম’। নাহু-সরফ-বালাগাতের যে কোন একটা মানসম্মত কিতাব ও একটা শরাহ ভালো করে মুতালাআ করা। এগুলোর উপর মেহনত করা। মেহনত ছাড়া কিছু হয় না।
৬. মুফতি কিফায়াতুল্লাহ। মুফতি ও মুহাদ্দিস, হাটহাজরী মাদরাসা। আলোচনার সারসংক্ষেপ- মানুষের মন জয় করার জন্য সাহিত্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এটাকে দীনী কাজে ব্যবহার করা উচিৎ। দীনী দাওয়াতের জন্য সাহিত্য শেখার বিকল্প নেই। আরবি সাহিত্য অর্জন করা ছাড়া কুরআন-হাদিস পরিপূর্ণ বুঝা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন চারটি জিনিস। ১. সাহিত্যের রুচি অনুধাবনের শক্তি। ২. মাহের উস্তাদের সুহবত। ৩. সাহিত্যের কিছু কিতাব ৪. নিরলস প্রচেষ্টা।
৭. মাওলানা আবু সাবের আবদুল্লাহ। মুহাদ্দিস, জামিয়া শরইয়্যাহ মালিবাগ। তাঁর আলোচনার বিষয় ছিল ‘অমনোযোগী ছাত্রদের মনযোগী হওয়ার উপায়’। আলোচনার সারসংক্ষেপ-
ইলমের মহব্বত বৃদ্ধির জন্য কয়েকটি আমলঃ
১. সলফের ইলমি জিন্দেগী পাঠ করা। এর জন্য এই বইগুলো বুঝে বুঝে বারবার পাঠ করা-
১. আপবিতী-শাইখুল হাদিস জাকারিয়া রহ. ২. উলামায়ে সলফ-হাবীবুর রহমান খান শেরওয়ানি ৩. সাফহাত মিন সবরিল উলামা ৪. আল ওলামাউল উজ্জাব ৫. কিমাতুজ জামান। শেষোক্ত তিনটি বইয়ের লেখক শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.।
২. ফানা ফিল ইলম আকাবিরের সুহবত অর্জন করা।
৩. ইলমের আজমত উপলব্ধির জন্য কুরআন-হাদিসে এ সম্পর্কিত আয়াত ও হাদিসগুলো পড়া।
৪. ইলমের হাকিকত বুঝা।
৫. ইলমের জন্য দৈনিক একটা সময় কান্নাকাটি করা। হাদিসে বর্ণিত দুয়াগুলো পড়া। যেমন- ‘আল্লহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিআ ওয়া রিজকন তইয়িবা ওয়া আমালাম মুতাকব্বালা’ ইত্যাদি।
থানবী রহ. এর ‘নাসীহুত তলাবা’ কিতাবটি প্রত্যেক তালিবে ইলমের পড়া উচিৎ। এ কিতাবে তিনি লিখেন ছাত্রদের জন্য তিনটি কাজ ওয়াজিব।
১. সামনের সবক মুতালাআ করে আসা।
২. নিয়মিত দরসে উপস্থিত থাকা।
৩. নিয়মিত তাকরার করা।
আরেকটি নফল কাজ হল- নিয়মিত কিছু কিছু পিছনের সবক দেখা।
৮. মাওলানা আহমদ মায়মূন। আদীব ও মুহাদ্দিস জামিয়া শরইয়্যাহ মালিবাগ। তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘আরবি সাহিত্যের ক্রমবিকাশঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’। আলোচনার সারসংক্ষেপ- আরবি সাহিত্যের চর্চায় দেশের পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরাম অবদান না রাখায় অনেকের মধ্যে সেসব আকাবিরকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা যায়। আসলে এটা ঠিক না। কারণ, তাঁরা তাঁদের সময়ে যে কাজ করেছেন তা-ই ছিল তাঁদের জন্য সবচে’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবুও আমাদের দেশের কিছু আলেম আরবি ভাষার খেদমত করেছেন। মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ. এর বেশ কিছু রেসালা আরবিতে লেখা। এরপর পটিয়া মাদরাসা কেন্দ্রিক মাওলানা সুলতান যওক নদভী আরবি সাহিত্যের কিছু খেদমত করেন। ছাত্রদের উপযোগী আরবিতে তিনি কয়েকটি কিতাবও লিখেছেন। গত ত্রিশ বছর ধরে আরবি ভাষার খেদমত করে চলেছেন মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ। তাঁর হাতে গড়া কিছু ছাত্র এ ময়দানে কাজ করছে। বর্তমান সময়ে মাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী সাহেবও আরবি ভাষার খেদমতে অগ্রসর হয়েছেন। আকাবিরদের দোষারোপ না করে আমাদের এখন এ ময়দানে কাজ করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
৯. মাওলানা নাসীম আরাফাত। আরবি ও বাংলা ভাষার সুসাহিত্যিক, জামিয়া শরইয়্যাহ মালিবাগের সিনিয়র শিক্ষক। তাঁর আলোচনার সারসংক্ষেপ- আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পৃথিবীতে খলিফা হিসেবে পাঠিয়েছেন। তাই খলিফা হওয়ার জন্য যে যোগ্যতা দরকার তা দিয়েই পাঠিয়েছেন। এ যোগ্যতাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের ব্রেন দশ হাজার সুপার কম্পিউটারের সমান। আসলে আমাদের আত্মবিশ্বাস থাকা দরকার। আমরা এখন নিজেদের সার্কাসের হাতি মনে করছি। সার্কাসের হাতিকে শিকল দিয়ে বেধে রাখায় সে মনে করে আমি নিজে কিছুই করতে পারব না। আমার মালিক যে হুকুম করে সেটাই মানতে হবে। আমাদেরও একই অবস্থা। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে আমার মাধ্যমেই বাংলাদেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম হবে। ভবিষ্যৎ আমাদেরই হাতে। রাষ্ট্রপতির আসনটা আমারই জন্য। প্রধানমন্ত্রীর আসনটা আমারই জন্য। এই বিশ্বাস আমদের মাঝে জাগ্রত করতে পারলে আমরা সফল। বাংলাদেশে মুফতি আমিনির মতো ২৫ জন বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব থাকলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। আজকের এই জলসা থেকে অন্তত ২৫ জন বিপ্লবী আলেম যদি তৈরি হয় তাহলে ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব আমাদেরই হাতে। আজ আমি আপনাদের সেই বিশ্বাস অর্জনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
১০. মাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী। আরবি সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র, বহু ভাষাবিদ। তাঁর আলোচনার সারসংক্ষেপ- কুরআন-হাদিস আরবি সাহিত্যের মানদণ্ড। আরবি ভাষাকে টিকিয়ে রেখেছে এই কুরআন-হাদিসই। আরবি ভাষাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১. আদি বিশুদ্ধ আরবি ভাষা। ২. আধুনিক বিশুদ্ধ আরবি ভাষা। ৩. বিদেশী বিশুদ্ধ আরবি ভাষা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি আরবী ভাষা, ব্যাকরণ ও সাহিত্যের পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করার পরও ছাত্ররা কেন নতুন করে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের কোর্সে ভর্তি হয় এবং কমপক্ষে এক-দুই বছর ব্যয় করে? এর সহজ উত্তর হল, আমাদের কওমী মাদরাসাগুলোর আরবী পাঠ্যক্রমের চূড়ান্ত লক্ষ্য আরবী ভাষা ও সাহিত্যে পান্ডিত্য অর্জন নয় বরং এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে:
১. বিশুদ্ধভাবে আরবী ইবারত পাঠ করার দক্ষতা অর্জন।
২.আরবী ভাষায় লিখিত গ্রন্থাদি পাঠ করে এর মর্ম উপলব্ধি করার দক্ষতা অর্জন।
৩.পবিত্র কুরআন ও হাদীসের অসাধারণ ভাষাগত নৈপুণ্যের সাথে পরিচিতি লাভ।
তবে এটা অনস্বীকার্য যে, কওমী মাদরাসার আরবী পাঠ্যক্রমেও এমন মৌলিক উপাদান রয়েছে যার মাধ্যমে একজন প্রতিভাধর শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত সাধনা ও অনুশীলনের মাধ্যমে আরবী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনে সক্ষম হতে পারে। বাস্তবেও এর প্রমাণ লক্ষ্য করা যায়।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে আদবের সংজ্ঞা-
كل شعر أو نثر يؤثر في النفس، ويهذب الخلق، ويدعو إلى الفضيلة، ويبعد عن الرذيلة بأسلوب جميل (د. عبد العزيز بن محمد الفيصل / الأدب العربي وتاريخه)
অর্থ: সাহিত্য হচ্ছে এমন প্রতিটি কাব্য বা গদ্য যা নান্দনিক প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে হৃদয়ে প্রভাব সৃষ্টি করে, চরিত্রকে পরিশীলিত করে, শালীনতার প্রতি আহবান করে এবং অশালীনতা হতে দূরে রাখে।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

পুলিশি নির্যাতনে হত্যার বিচার চাইবেন কার কাছে?

ডক্টর তুহিন মালিক: (১) মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে যুবককে রাতভর নির্যাতন ...