শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ দুপুর ২:২৮
Home / প্রতিদিন / জামিয়া মাদানিয়া বিশ্বনাথ সিলেট : বাসিয়ার তীরে মদীনার নূর

জামিয়া মাদানিয়া বিশ্বনাথ সিলেট : বাসিয়ার তীরে মদীনার নূর

প্রতিষ্ঠান পরিচিতি- ১০
komashisha-Madania-Biswanat

মুসা আল হাফিজ ::

বাসিয়ার তীরে মদীনার নূর : শায়খে বিশ্বনাথী রাহ. তখন বালাগঞ্জের পারকুল মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। এলাকার মুরুব্বীয়ান ও উলামায়ে কেরাম তার মধ্যে দেখলেন সম্ভবনার আলো। তারা বিশ্বনাথীকে অনুরোধ করলেন বন্ধ হয়ে যাওয়া এম.ই মাদরাসার হাল ধরার জন্য। এলাকাবাসীর এ আহ্বানকে তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না। প্রতিকূল তুফানের বিপরীতে তিনি শুরু করলেন দরিয়া সাঁতার। প্রতিষ্ঠানটির কান্ডারী হিসেবে তিনি গ্রহণ করলেন দায়িত্বভার।
১৯৫৯ সাল। কওমী মাদরাসা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি পূর্নজন্ম হলো। শুরু হলো নতুন জিহাদ। ক্রমাগত মেহনত আর মুজাহাদা। এর জন্য ছাত্র সংগ্রহ, অর্থসংকট দূরীকরণ, উপযুক্ত শিক্ষকের বন্দোবস্ত, এলাকার সাধারণ মানুষকে মাদরাসামুখী করা ইত্যাদি কাজ আর কাজ। শায়খে বিশ্বনাথীর রাহ. যেনো কোনো বিরাম নেই। তার মেহনতের সুফলও ফলতে লাগলো দ্রুত। প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে ধীরেধীরে বাড়তে লাগলো তার স্বপ্নের ডালপালা। ফুটতে লাগলো প্রত্যাশার নতুন কুঁড়ি।
১৯৬১ সাল। মাদরাসাকে তিনি বাসিয়া নদীর উত্তর পাড়ে স্থানান্তরের উদ্যোগ নিলেন। বিভিন্ন জটিলতা মোকাবেলা করে এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলো। মাদরাসাটি পেয়ে গেলো তার নিজস্ব ঠিকানা। উত্তর পাড়ের জন্য খুলে গেলো সমৃদ্ধির দরোজা। মৃতপ্রায় এলাকায় সৃষ্টি হলো জীবনের সাড়া। এখানে ছিলোনা কোনো বসতি। মাদরাসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলো মানুষের নিবাস। দোকান-পাট। ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো সমৃদ্ধ শহর। বিশ্বনাথবাসীর ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক জীবনে মাদরাসাকে কেন্দ্র করে তৈরী হওয়া বিশ্বনাথ উত্তর বাজার এখন বিশাল এক আশীর্বাদ।
নতুন ঠিকানায় মাদরাসার কার্যক্রম চলতে লাগলো সম্পূর্ণ শূন্য থেকে। পূঁজি কেবল তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ ও তায়াল্লুক মায়াল্লাহ। বস্তুগত কোনো উপাদানই তখন হাতের নাগালে ছিল না। নতুন করে মাদরাসার নাম হলো বিশ্বনাথ দারুল উলূম আলিয়া মাদরাসা। পরে তাতে জুড়ানো হলো কওমী শব্দটি। ১৯৭৪ সালে ফেদায়ে মিল্লাত আওলাদে রাসূল সা. আল্লামা আসআদ মাদানী এ মাদরাসায় এলে মাদরাসার নামের সাথে মাদানিয়া শব্দটি যুক্ত করা হয়। এবং পরবর্তিতে উলামায়ে কেরামের পরামর্শে আলিয়া শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ফলে তার নাম দাঁড়ালো দারুল উলূম মাদানিয়া কাওমিয়া মাদরাসা, বিশ্বনাথ।

komashisha-Madania-Biswanat1গোলাপের পাঁপড়িদল
দারুল উলূমকে কেন্দ্র করে দ্বীনের আশিক সূধীম-লীর ঝাঁক তৈরী হয়। তারা একনিষ্ঠভাবে এগিয়ে আসেন মাদরাসার সহায়তায়। দ্বীনদরদী জনগণের সহযোগিতার হাত প্রসারিত হয় ক্রমাগত। এই ধারাবাহিকতায় যুক্ত হয় একের পর এক নাম। যেসব মুরুব্বিয়ান এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন, তারা হলেন শাহজিরগাঁও এর জনাব মাওলানা খুরশিদ আলী, (প্রাক্তন হেড মুদাররিস ও পরিচালক বিশ্বনাথ এম.ই মাদরাসা।) চান্দশিরকাপন-এর মরহুম হাজী মুহাম্মাদ আছমত আলী, রাজনগর এর মরহুম হাজী মুহাম্মাদ তবারক আলী (মেম্বার) কারিকোনার মরহুম হাজী আকরাম উল্লাহ, জানাইয়া এর মরহুম হাজী তুতা মিয়া, পারকুলের মরহুম মাওলানা আবদুল মুছাব্বির, কাশিমপুরের মরহুম মাস্টার আলতাফুর রহমান, দুর্যাকাপন নিবাসী মরহুম কারী আহমদ আলী, রামধানা নিবাসী মিরেরচর নিবাসী মরহুম হাজী মুছলিম আলী ও আলহাজ্ব হাফিয মুকাররম আলী প্রমূখ।

লক্ষ্যের পথে এগিয়ে চলা
দারুল উলূম এগিয়ে চললো সুমহান উদ্দেশ্য সাধনে। কী ছিলো সেই উদ্দেশ্য? আল্লামা ক্বারী তায়্যিব সাহেব রাহ. এর ভাষায় প্রতিটি কওমী মাদরাসার মূল উদ্দেশ্য হলো (ক) তাওহীদে খালিসের প্রতিষ্ঠা। (খ) ইত্তেবায়ে সুন্নাত তথা রাসূলের আদর্শ অনুসরণ-অনুকরণ। (গ) তা’আল্লুক মাআল্লাহ ও ইনায়ত ইলাল্লাহ তথা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও তার প্রতি নিমগ্ন হওয়া। (ঘ) ই’লায়ে কালিমাতুল্লাহ তথা আল্লাহর বাণী প্রচার- প্রসার ও দ্বীনে হককে উচ্চকিতকরণ। এ সব লক্ষ্যের ভেতরে দ্বীনী খেদমতের সমস্ত শাখা-প্রশাখা ঢুকে পড়ে। দারুল উলূম মাদানিয়া এ লক্ষ্যকে কথার কথা হিসেবে নয়, বরং বাস্তব ও অপরিহার্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে। এ জন্য তা’লিম-তারবিয়্যাত, দ্বীনের প্রচার-প্রসার, সংগ্রাম ও মুজাহাদার সিলসিলা এগিয়ে চলে। এ অগ্রগতিকে আরো বেগবান করার জন্য ১৯৭৪ সালে আরো একধাপ এগিয়ে গেলো দারুল উলূম। চালু হলো মিশকাত শরীফের জামাত। এলাকাবাসী ও ছাত্রদের মধ্যে উদ্দীপনার মাত্রা বেড়ে গেলো। চতূর্দিক থেকে মৌমাছির মতো ইলমে ওহীর আগ্রহীরা জড়ো হতে লাগলো মাদরাসায়। বিশ্বনাথের পরিবেশ হতে লাগলো উজ্জল ও পবিত্র। মুগ্ধতা ও তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়ছিলো দ্বীনদার জনতার হৃদয়ে। কিন্তু তৃপ্ত হতে পারছিলেন না শায়খে বিশ্বনাথী রাহ.। কেননা এখনো একটা শূণ্যতা রয়ে গেছে মাদরাসায়। সেই শূণ্যতা হলো এখনো এতে সিহাহ সিত্তার দারস চালু হয়নি। এখনো আসাহহুল কুতুব বা’দা কিতাবিল্লাহর পষ্ঠা উন্মুক্ত হয়নি দারুল উলূমের শ্রেণীকক্ষে। সেই অপূর্ণতা দূর হতেও বেশি দিন গেলোনা।

চালু হলো বুখারীর দারস
শায়খে বিশ্বনাথী রাহ.’র সুদৃঢ় বিশ্বাস ছিল এখানে একদিন সিহাস সিত্তার দারস চালু হবে। তার হৃদয়ের বাগিচায় স্বপ্নের কুড়ি অনেক আগ থেকেই জীবন্ত হয়ে ওঠে। মাদরাসাটি যখন হেদায়াতুন্নাহু জামাত পর্যন্ত ছিল, তখন মাদরাসায় অবস্থায় একরাতে তিনি অবাক এক স্বপ্ন দেখেন। দেখেন আধ্যাত্মিক জগতের সূর্য, শায়খুল আরব ওয়াল আজম সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. মাদরাসায় এসে হাজির। তিনি হযরত মাদানী রাহ.’কে ইস্তেকবাল জানানোর পর দফতরে নিয়ে এলেন। টেবিলের উপর হেদায়েতুন্নাহু কিতাব দেখে মাদানী তা হাতে নিলেন এবং বললেন- ময় য়েহ্ বিহি পড়হাতা হোঁ আওর ওহ বিহী পড়হাতা হো।’ অর্থাৎ আমি এ কিতাব ও পড়াই, সেই কিতাবও পড়াই। সেই কিতাব দ্বারা বোখারী শরীফ উদ্দেশ্য। তা তিনি স্বপ্নের মধ্যেই উপলব্ধি করেন। স্বপ্ন থেকে জেগে তিনি দৃঢ়চিত্ত হয়ে গেলেন যে, এ প্রতিষ্ঠানে একদিন দাওরায়ে হাদীস জামাত চালু হবে। ১৯৮৩ সালে শায়খে বিশ্বনাথী রাহ. পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলেন এখন থেকে মাদরাসা নয়, দারুল উলূম মাদানিয়ার নামে জামিয়া শব্দটি ব্যবহৃত হবে। সে বছরই ১০ই আগস্ট  বুধবার জামিয়া মাদানিয়ায় দাওরায়ে হাদীসের প্রথম সবক দেওয়া হয়। সেদিন বাদ জুহর জামিয়ার জামে মসজিদে আলিম-ওলামা, ছাত্র-জনতা ও সূধী মহলের উপস্থিতিতে হযরত শায়খে কৌড়িয়া রাহ. নসিহত বানী প্রদান করেন। এবং আল্লামা রিয়াসত আলী শায়খে চখরিয়া রাহ. বুখারী শরীফের প্রথম সবক দান করেন।

দ্বীনের মজবুত কেল্লা
এলাকাবাসী ও ছাত্রদের মধ্যে উদ্দীপনার আলো ছড়াতে লাগলো। ইলমে নববীর মধু আহরণকারীরা আসতে লাগলো ঝাঁকেঝাঁকে। প্রতিদিন বেলা উঠলেই চারদিক থেকে কিতাব হাতে, কুরআন গলায় ঝুলিয়ে, গ্রাম-গঞ্জের মেঠোপথ মাড়িয়ে ছাত্ররা ছুটে আসছে মাদরাসায়। নববী সুন্নাতের আভা তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে পথে প্রান্তরে। সুদূর দশপাইকা, অলংকারী, পৌদনাপুর, রশিদপুর, কিংবা রামপাশা থেকে কিতাব কাঁধে নিয়ে পায়ে হেটে, কাদা মাড়িয়ে ছাত্ররা মাদরাসায় আসছে, এটি হয়ে উঠলো বিশ্বনাথের স্বাভাবিক দৃশ্য। আর জানাইয়া, মিরেরচর, রামধানা, শাহজিরগাঁও কিংবা রাজনগর শিমুলতলার এমন কোনো পাড়া বা হাটি বাকি থাকলোনা, যেখানে কোনো না কোনো তালেবে ইলমের অবস্থান ও কুরআন-হাদীস চর্চার মাধ্যমে পবিত্র পরিবেশ তৈরী হচ্ছিলনা। শেখেরগাঁও, কামালপুর, শ্রীধরপুর, গড়গাঁও, মিয়াজানের গাঁও, দূর্যাকাপন, রজকপুর, গবিন্দপুর, সরুয়ালা, তাতিকুনা, নোয়াগাঁও, ইত্যাদি অঞ্চলও মুখরিত হতে লাগলো ইলমে ওহীর মৌমাছির গুঞ্জনে। সর্বত্রই নতুন আলোর বৃষ্টি বইতে লাগলো। শিরিক-বেদআতের বিরুদ্ধে জামিয়া এক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠলো। গ্রামে-গঞ্জে এর প্রতিরোধে জামিয়ার উস্তাদ-ছাত্ররা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে লাগলেন। কোথাও হলো সহজ বিজয়। মানুষ তাওবা করে শুদ্ধ ও পরিশীলিত হতে লাগলো ধীরে ধীরে। কোথাও করতে হলো বাহাস ও প্রতিরোধ। কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির যে সব ভেজাল শত শত বছর ধরে সমাজ জীবনে জেঁকে বসেছে, সেগুলোর উচ্ছেদে জামিয়ার সংস্কার কার্যক্রম চলতে লাগলো। পাশাপাশি জাতীয় জীবনে ইসলাম বিরোধী প্রতিটি আগ্রাসী তৎপরতার প্রতিরোধে জামিয়া থেকে আওয়াজ ধ্বণিত হতে লাগলো বলিষ্ঠভাবে। নাস্তিক্যবাদ, কাদিয়ানিয়্যাত, মওদূদীবাদ ও ধর্মদ্রোহী তৎপরতার মোকাবেলায় জামিয়া তার ভূমিকা পালন করতে লাগলো।
বাইরের এসব কার্যক্রম ছিল ভেতরের সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। ভেতরে চলছে জামিয়ার সন্তানদের মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী এর পূর্ণাঙ্গ ধারক ও ভাষ্যকার রূপে গড়ে তোলার সাধনা। মুহাদ্দিসীনে কেরামের সুবিস্তৃত ইলমী তরঙ্গে দোলায়িত হতে লাগলো জামিয়ার আঙ্গিনা। শায়খে বিশ্বনাথী রাহ. এ ধারাকে আরো বলিষ্ঠ করার জন্যে দেশবরেণ্য শায়খুল হাদীসবৃন্দকে জামিয়ার জন্য বাছাই করে নিয়ে আসতেন।

Asraf-Ali-Biswanati1আল্লামা আশরাফ আলী শায়খে বিশ্বনাথীর ইন্তেকাল ও এহতেমাম
হযরত শায়খে বিশ্বনাথী রাহ. ২০০৫ সালের ২০ মে শুক্রবার সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। শায়খের পর কিছুদিন মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন হযরত মাওলানা জহির উদ্দীন সাহেব মিরেরচরী, নায়েবে মুহতামিম হযরত মাওলানা শিব্বীর আহমদ সাহেবজাদায়ে বিশ্বনাথী। তার পরে মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব নিলেন মৌলভী আবদুল হক। বর্তমানে হযরত মাওলানা শিব্বীর আহমদ ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।

চতূর্দিকে আলোর ডানা
যিন্দেগীর শত্রুদল যেহেতু অগণিত, গোমরাহীর উৎস যেহেতু অবারিত, আধুনিক জাহেলিয়াতের চ্যালেঞ্জ যেহেতু ক্রমবিস্তৃত, অতএব জনগণের হেদায়াত ও ইসলাহের দায়িত্বকেন্দ্র দ্বীনী জামিয়া তার কোনো কৃতিত্ব নিয়েই আত্মতুষ্ট হয়ে বসে থাকতে পারে না। তাকে এক ফ্রন্টে জিতে খুলে বসতে হয় সাধনার নতুন আরো ফ্রন্ট। জামিয়া মাদানিয়াও তাই পরিণত হতে লাগলো দ্বীনী তৎপরতার বিস্তৃত মারকাজে। হয়ে উঠলো দ্বীনে হকের বলিষ্ঠ দূর্গ। এখানে একদিকে কুরআন-হাদীসে বিশেষজ্ঞ তৈরীর মেহনত চলতে লাগলো। অপরদিকে জাহেলিয়াতের মোকাবেলায় সাহিত্যের ময়দানে দক্ষ লড়াকু তৈরীর প্রচেষ্টাও জারী থাকলো। একদিকে তাহযীবুল আখলাক ও তাযকিয়ায়ে বাতিনের সাধনা চলতে থাকলো। অপরদিকে দ্বীনী শিক্ষার পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাষার চর্চা ও শুরু হলো। একদিকে তালাবাদেরকে সুন্নাতের অনুসরণ ও আকাবীর ও আসলাফের রঙ্গে উজ্জীবিত করার সিলসিলা জারী থাকলো। অপরদিকে তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ করার মেহনতও চলতে লাগলো। এদারা বোর্ডের সিলেবাসের পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষাবোর্ডের সিলেবাসভূক্ত মাধ্যমিক স্তরের বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান ইত্যাদির পাঠদান করা হয় সানাবিয়্যাহ স্তর পর্যন্ত। জামিয়ায় রয়েছে সমৃদ্ধ সেবার ঐতিহ্য। মাদানিয়া ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সহযোগিতায় একদিকে সিডরসহ প্রাকৃতিক দূর্যোগে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে জামিয়া, অপরদিকে গরীব দুস্থ জনসাধারণকে সরবরাহ করেছে শীতবস্ত্র, কুরবানীর বিপুল পরিমাণ গোস্ত ইত্যাদি। দরিদ্র ছাত্রদের বিলাচ্ছে নিত্যনৈমিত্তিক সেবা, ফ্রি চিকিৎসা, শিক্ষাসামগ্রী,  পোশাকাশাক ইত্যাদি।

ছড়ানো শাখা প্রশাখা
জামিয়ার শিক্ষাবিভাগ পরিচালিত হচ্ছে আকর্ষণীয় নুরানী বিভাগ থেকে নিয়ে সাধারণ বিভাগে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত। তাহফীজুল কোরআন বিভাগে সর্বাধুনিক প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ যতœসহকারে ছাত্রদের হিফজুল কুরআনের সুব্যবস্থা রয়েছে। নারী শিক্ষার জন্য জামিয়ার ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে স্বতন্ত্র মহিলা মাদরাসা। কারিগরি শিক্ষার জন্য রয়েছে কমপিউটার প্রশিক্ষণ কোর্স, সেলাই মেশিন ও বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রশিক্ষণ কোর্স। জামিয়ার ছাত্ররা ফাইন্যাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন আযাদ দ্বীনী এদারা ও তানযীমুল মাদারিস বোর্ডের অধীনে তাহফীজুল কুরআন, নূরানী বিভাগ, মুতাওয়াসসিতা, সানাবিয়্যাহ, ফযীলত ও দাওরায়ে হাদীসের জামাতে বোর্ডভিত্তিক কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় বরাবরই জামিয়ার ছাত্ররা বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করে আসছে। স্বতন্ত্র মহিলা শাখার ছাত্রীরা মহিলা মাদরাসা ভিত্তিক বোর্ডের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অর্জন করছে ঈর্ষণীয় কৃতিত্ব। যা মাদরাসার সুনাম-সুখ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
মাদরাসার গরীব ছাত্রদের ফ্রি কিতাবদান ও আসাতিযায়ে কেরামের ইলমী তাকাযা পূরণে প্রয়োজন ছিল এক সমৃদ্ধ কুতুবখানার। জনগণের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ফতোয়া ও বিভিন্ন পরিস্থিতি প্রেক্ষাপটে গবেষণামূলক প্রয়োজন পূরণে গুরুত্বপূর্ণ মশহুর কিতাবের পাশাপাশি বিরল ও দুস্প্রাপ্য কিতাব সমূহ দ্বারা যথাসম্ভব সমৃদ্ধ করা হয় কুতুবখানাকে। দ্বীনী বিষয়াবলীর প্রকৃত সমাধান জনগণের কাছে উপস্থাপন করতে জামিয়ায় গঠন করা হয় ফতওয়া পরিষদ। যার মাধ্যমে জটিল ও সুক্ষ্ম ফতোয়া ও নিত্য নৈমিত্তিক সমস্যার ফারাইজের সমাধান পেশ করা হয়।
মেধাবী-গরীব ছাত্রদের ফ্রি থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত হয় বোর্ডিং বিভাগে। দারুল একামায় উস্তাদদের নেগরানীতে সার্বক্ষণিক ছাত্রদের তা’লিম ও তারবিয়াতের তত্ত্বাবধান রাখা হয়। শত শত ছাত্র মাদরাসার পরিবেশকে সারাক্ষণ মুখর করে রাখছে কোরআন-হাদীসের চর্চার মাধ্যমে। ছাত্রদের মেধা ও মননশীলতা বিকাশের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত আছে আল আশরাফ ছাত্র সংসদ। ছাত্ররা যাতে বাগ্মীতা ও উপস্থাপন কৌশলে পারদর্শী হতে পারে, এ জন্য সাপ্তাহিক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এতে কেরাত, হামদ-নাত ও বক্তৃতার অনুশীলন চলতে থাকে।
জামিয়ার প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ বিভাগ থেকে মাদরাসার পরিচিতি, লিফলেট, বুকলেট, প্রসপেক্টাস, পোস্টার, হ্যান্ডবিল ইত্যাদি প্রচারিত হয়। দ্বীনের প্রচার প্রসার ও বাতিলের প্রতিরোধে জামিয়া থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক মুখপত্র-আল ফারুক। যা অধিকার করেছে স্বতন্ত্র মর্যাদার নান্দনিক মানচিত্র।

মাসিক আল ফারুক : হকের লড়াকু
ইসলাম আজ আক্রান্ত হচ্ছে মিডিয়ার মাধ্যমে। ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে ইহুদী-খৃস্টীয় শক্তি মিডিয়ার অস্ত্র দিয়ে। এর মোকাবেলা করা খুবই অপরিহার্য।
অপসংস্কৃতির উদগাতারা পাশ্চাত্য সভ্যতার বিকাশে ব্যবহার করছে মিডিয়াকে। যার তোড়জোড় প্রচারণায় জাতি আজ দ্বীন- ঈমান, স্বকীয় তাহযীব-তামাদ্দুন থেকে দূরে। ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে ইলহাদ ও ইরতেদাদ। মিডিয়ার অভাবে মুসলমানরা স্বজাতির ইতিহাস ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারছে না সময়ের খাতায়। নীতি ও নৈতিকতার অবয়ব হচ্ছে ক্ষত বিক্ষত। বিষিয়ে উঠছে সমাজের প্রতিটা স্তর। আলোকে বলা হচ্ছে কালো, কালোকে দেয়া হচ্ছে আলোর মর্যাদা। এ পরিস্থিতিতে ঈমানের আহ্বানে শায়খে বিশ্বনাথী হয়ে উঠেন তৎপর। গড়ে তোলেন ইসলামিক শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মাসিক মুখপত্র আল ফারুক।

komashisha-Madania-Biswanat-02মহিলা মাদরাসা : সম্ভাবনার রাজপথ
ওহীভিত্তিক ইলমের স্রোতধারায় নারীদের বিধৌত করতে আল্লামা শায়খ আশরাফ আলী বিশ্বনাথী রাহ. ১৯৮১ সালে জামিয়া মাদানিয়ার ১টি ভবনে চালু করেন মাদরাসাতুল বানাত নামে মেয়েদের দ্বীনি শিক্ষার স্বতন্ত্র কার্যক্রম। স্বপ্ন দেখতে থাকেন পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ মহিলা মাদরাসার। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে চলতে থাকে প্রয়াস ও পরিকল্পনা। শুরু হয় একখ- জমির তালাশ। জুমআর নসিহতে তিনি প্রায়ই মহিলা মাদরাসার প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্বের উপর বয়ান রাখতেন।
অবশেষে ২০০২ সালে বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী হাজী আবদুল খালিক সাহেব (জানাইয়া) দান করেন ৩১ শতক মূল্যবান জমি। এবার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের পালা। শায়খে বিশ্বনাথী নিজ হস্তে কাজটি সম্পন্ন করলেন এ সনেই। আস্তে আস্তে এগুতে থাকে নির্মাণকাজ। প্রথম তলার কাজ অর্ধেক এগুনোর পর অর্থ সংকটে আটকা পড়ে নির্মাণ কাজ। শায়খে বিশ্বনাথী রাহ. এ নিয়ে ছিলেন খুবই পেরেশান। অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করার জন্যে আর্থিক প্রয়োজন পুরণার্থে ২০০৫ সনের ২৯ শে মে লন্ডন সফরের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এর আগেই ২০ শে মে রফিকে আ’লার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি পরপারে পাড়ি জমান।
শায়খের ইন্তেকালে চারদিকে নেমে আসে শোকের ছায়া। তার জীবদ্ধশায় প্রবাসী অনেকেই টেলিফোনে মাদরাসার বিভিন্ন কক্ষ নির্মাণের খরচ দেয়ার ওয়াদা করেন। এবার প্রত্যেকেই যার যার ওয়াদা পূরণ করেন। এবং অধিক মাত্রায় সাহায্যের হাত প্রসারিত করেন। পরবর্তীতে মাদরাসার পক্ষ থেকে মাওলানা কামরুল ইসলাম ছমির সাহেবকে লন্ডন পাঠানো হয়। সেখানে অবস্থানরত শায়খে বিশ্বনাথী রাহ. অনুসারীরা প্রচ- শ্রম ও বিপুল সহযোগিতার দ্বারা প্রচুর আর্থিক অনুদান নিশ্চিত করেন।
পুনরায় শুরু হয় নির্মাণ কাজ। অল্পদিনেই নিচতলার শিক্ষাভবনের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে মহিলা বিভাগকে সম্পূর্ণ পৃথক করে তথায় স্থানান্তর করা হয়। অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে শুরু হয় মহিলাদের দ্বীনি তা’লিম। ক্লাশ চলতে থাকে নূরানী ১ম থেকে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত। এর পাশাপাশি হিফজ বিভাগে চলতে থাকে তাহফিজুল কুরআনের চর্চা।
বর্তমানে মহিলা মাদরাসায় পর্যাপ্ত সংখ্যক মহিলা ও পুরুষ শিক্ষকের মাধ্যমে ইবতেদায়ী ১ম শ্রেণী থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক ছাত্রীকে নিয়মিত ক্লাশ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি দূরবর্তী এলাকা থেকে আগত ছাত্রীরা বোর্ডিংয়ে অবস্থান করে যোগ্য শিক্ষিকার তত্বাবধানে তা’লীমের পাশাপাশি আমলী তরবিয়ত পাচ্ছে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আলোর পতঙ্গরা ছুটে আসছে জামিয়া মাদানিয়ায়।
শহরের কোলাহল ডিঙ্গিয়ে এখানে তৈরী হয়েছে আরেক ইলমের শহর। যেখানে সকালে ধ্বণিত হয় কালল্লাহু তা’য়ালার মনকাড়া ধ্বনি, সারা দিন জারি থাকে কুরআন-হাদীসের সুবাস বিতরণ। হাদীসে রাসূলের সূরভিত উদ্যান এখন এ জামিয়া। আহলে ইলিমের সিলসিলা এখান থেকে সোনার মদীনার সাথে প্রতিষ্ঠিত। রাসূলে পাকের সিনায়ে আতহার থেকে জারি হওয়া স্রোতধারায় বিধৌত হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মা। সেখানে যে পবিত্রতার ঝলক ফোটে ওঠে, তার আকর্ষণে বিমূহিত হচ্ছেন এলাকার ধর্মপ্রাণ জনসাধারণ। তারা উদার চিত্তে এগিয়ে আসছেন সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। দেশে বিদেশে তৈরী হয়েছে ভালোবাসার সেতুবন্ধন। এই ভালোবাসা কেবলই দ্বীনের জন্য। এই সহযোগিতা কেবলমাত্র ঈমানের দাবীতে। এখানে কেবলই আল্লাহর সন্তুষ্টি আর রাসূলে কারীমের সা. পদাঙ্ক অনুস্মরণের আকাঙ্খা জাগ্রত। এই আকাঙ্খা আর সাধনা নিয়েই জামিয়া মাদানিয়া মাদরাসা মঞ্জিলে মাকসুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঈষৎ সংক্ষেপিত।

লেখক : বিজয়ের সন্তানখ্যাত কবি ও কলামিস্ট।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...